ডানা মেলা অতিথি

জায়গাটা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন চত্বরে। চায়ের দোকানগুলোর পেছনের লেকের পাড়ে। এই লেকেই পরিযায়ী পাখির আনাগোনা (যা এ ‘অতিথি পাখি’ হিসেবেই বেশি পরিচিত)। এখানে বসেই রোজকার মতো পরিযায়ী পাখি আর এদের দেখতে আসা মানুষের হাবভাব দেখছিলাম। এই যে এত এত পরিযায়ী পাখি লেকে, এগুলো কি আসলেই সেই সাইবেরিয়া থেকে আসে? আমার তো কেমন সন্দেহ হয়! ওখান থেকে আসে, নাকি এখানেই ডাউনলোড হয়, সেটা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। তার চেয়ে পাখি দেখতে এসেছি, পাখিই দেখি। কী সুন্দর অলস সময় কাটাচ্ছে পাখিগুলো!

লেকভর্তি শত শত পরিযায়ী পাখি গিজগিজ করছে। এই পাখিদের কেউ ডুব দিচ্ছে, কেউ কেউ ঝাঁক বেঁধে উড়াল দিচ্ছে, কেউ ছানাপোনাদের যত্ন–আত্তিতে ব্যস্ত তো কেউ প্যাঁচার মতো পালকের ভেতর মুখ গুঁজে রোদ পোহাচ্ছে গম্ভীরভাবে। যে পাখিগুলোকে আদর করে সবাই ‘অতিথি পাখি’ বলে!

আবার মনে হলো, পাখিগুলো আসলেই কী সেই দূরের সাইবেরিয়া থেকে আসে? বরফঢাকা উত্তর মেরুর কোনো দেশ থেকে? এমন প্রশ্ন কি তোমাদের মনে আগে খেলেছে? সে তথ্য জানা নেই। তবে একটু পেছনে ফিরলে তথ্য মেলে যে প্রতিবছর সেপ্টেম্বরের দিকে উত্তর হিমালয়ের শীত নামতে শুরু করায় বরফে ঢেকে যায় সেখানকার অধিকাংশ অঞ্চল। ফলে অনেক প্রাণীর ভেতরেই অভাব দেখা দেয় পর্যাপ্ত খাবারের। এর ফলে সেখানকার কিছু পাখি পাড়ি জমায় একটু গরমের খোঁজে, বাঁচার তাগিদে। সাইবেরিয়া, চীন, জিংজিয়াং মঙ্গোলিয়া, ভারত ও নেপালের বিভিন্ন জায়গা থেকে এই পাখিরা নিজেদের ডানায় ভর করে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আসে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে।

সারা পৃথিবীতে পাখির প্রজাতির সংখ্যা লাখ পাঁচেকের কাছাকাছি। এই পাখিদের মধ্যে অনেক প্রজাতিই বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় অন্য দেশে চলে যায়। এদের বলা হয় ‘পরিযায়ী পাখি’। এর মধ্যে কিছু পাখি তো প্রতিবছর ২২ হাজার মাইল পথ অনায়াসে পাড়ি দিয়ে চলে যায় এক দেশ থেকে আরেক দেশে, এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে।

এই পরিযায়ী পাখিরা প্রকৃতিগতভাবেই শারীরিক গঠনে খুব পোক্ত হয়। ৬০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ মিটার উঁচু দিয়ে উড়তে পারে এই পাখিরা। আকারে ছোট পরিযায়ী পাখিরা ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারে, আর বড় পাখিদের গতিবেগ ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার। দিনে–রাতে এরা অনায়াসে ২৫০ কিলোমিটার উড়তে পারে।

একটু উষ্ণতা আর পর্যাপ্ত খাবারের খোঁজে ঠিক ঠিক দিক চিনে প্রতিবার নাতিশীতোষ্ণ খাবারের আস্তানা খুঁজে বের করতে পারে এসব পরিযায়ী পাখি। বাংলাদেশ তাদের সেই বাঁচার সুযোগ করে দেওয়া এক উষ্ণ আস্তানার নাম। শীতজুড়ে বাংলাদেশের অনেক যায়গায় এসব ‘মেহমান’ পাখিদের আনাগোনা ঘটে, এর মধ্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম। সারা দেশে আসা বিভিন্ন প্রজাতির মেহমানদের ভেতর প্রায় ৫০ শতাংশ প্রজাতি আসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকগুলোতে। ডাঙার পাখি এবং জলের পাখি এই দুই ধরনের পাখিরই দেখা মেলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেক এবং এর আশপাশের জায়গাগুলোতে। ডানায় ভর করে উড়ে আসা এসব মেহমানের নামগুলোও ভারি বাহারি। পাতিসরালি, বড় সরালি, পাতারি,  ফ্লাইফেচার, গার্গেনি, পান্তামুখী, পচার্ড, ছোট জিরিয়া, মুরগ্যাধি, কোম্বডাক, খয়রা, পাতারি হাঁস, জলকুক্কুট, মানিকজোড়, কাস্তে চাড়া, চিতাটুপি, কলাই, জলপিপি, ছোট নগ, নর্দানপিনটেল, নাকতা, লাল গুড়গুটি, বামুনিয়া হাঁস, লাল গুড়গুটিসহ আরও কত রংচং এদের নামের ভেতর!

শুরু করলেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরে একে একে ভিড় করা শুরু করে এই পাখিরা। আবার মার্চ শেষ হতে হতে তারা মার্চ করতে করতে ফিরে যায় তাদের আগের ঠিকানায়। এই অল্প কয়েক মাস সময়ের ভেতরেই ব্যস্ত ডানায় দিনে দিনে ঘরবসতি, সংসার, ছানাপোনা নিয়ে লেকে, গাছে সংগ্রামী এক জীবন গড়ে তোলে তারা। ডানার মেহমানদের সে এক মেহনতি কাজকারবার।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকে কবে থেকে আসে এই পরিযায়ী পাখিরা, এই প্রশ্নের জবাব মেলে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. কামরুল হাসানের কাছে, তিনি জানান, কথিতমতে, ১৯৮৬ সালে পরিযায়ী পাখিরা আসার তথ্য পাওয়া গেলেও মূলত ১৯৮৮ থেকেই নিয়মিত এই পাখিরা হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে ক্যাম্পাসের লেকগুলোতে সংসার গড়ে। তাঁর কাছে আরও জানা যায় যে স্থানীয় ও পরিযায়ী পাখি মিলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ১৯৮ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে, যার মাঝে প্রায় ৬৯টি প্রজাতি হলো পরিযায়ী পাখি। এই পাখিদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন লেকগুলোকে পাখিদের অভয়ারণ্যও ঘোষণা করেছে বেশ কয়েক বছর আগেই।

মোট তিনটি পর্যায় সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, নভেম্বর-জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল মাসগুলোতে পরিযায়ী পাখিরা বাংলাদেশে আসে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা এসব মেহমানকে দেখতেও হুড়োহুড়ি পড়ে যায় মানুষের ভেতরে। ঢাকা এবং এর আশপাশের এলাকা থেকে শীতকালজুড়েই মানুষ আসে পাখি দেখতে। লেকে বসে রোদ পোহানো গম্ভীর চেহারার কোনো বুদ্ধিজীবী পরিযায়ী পাখি হয়তো যে মানুষগুলোকে দেখে পাশের চঞ্চল পাখিটিকে বলে, ‘দেখ দেখ, পরিযায়ী মানুষ এসেছে আমাদের দেখতে!’

ক্যাম্পাসের লেকে ভোরের দিকে ধীরে ধীরে চোখ মেলতে শুরু করে ঝাঁকে ঝাঁকে লাল শাপলারা, তাদের সেই চোখ মেলার শব্দেই হয়তো ঘুম ভেঙে যায় পাখিদের। তারা জেগে ওঠে, কলকাকলিতে স্বাগত জানায় দিনের প্রথম সূর্যকে। তাদের সেই কলকাকলিতে অন্য রকম এক ছন্দ আছে, একটানা বাজতে থাকে, বাজতেই থাকে, সন্ধ্যা শেষ হলে তবেই ছেদ পড়ে সেই ছন্দের। সে কলকাকলি অন্য রকম সুখ জাগায় কানে। এই সুখের খোঁজেই ভিড় ঠেলে মানুষ আসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। লেকে আসা মেহমানদের দেখে একটু সবুজ নিশ্বাস নিতে।

পাখি দেখতে আসা দর্শনার্থীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক পাখিদের বিরক্ত না করা–বিষয়ক নানা নিয়মকানুন আছে। তবুও অতিরিক্ত দর্শনার্থীর চাপে বর্তমানে লেকে আসা পরিযায়ী পাখিদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটছে বলে দাবি করেন প্রাণিবিদসহ অনেকেই। ফলে দিনে দিনে কমে যাচ্ছে এই পরিযায়ী পাখির সংখ্যা। জরিপমতে, ১৯৯২, ২০০৮ ও ২০০৯ সালে প্রায় ২৫ হাজার পাখি এসেছিল, সেখানে বর্তমানে পাখির সংখ্যা কমে গেছে একেবারেই। গত বছর আসা পাখির সংখ্যা মাত্র ৪ হাজার ৫০০–এর মতো। কিন্তু এ বছর পাখির সংখ্যা বেশ আশাব্যঞ্জক। গতবারের তুলনায় এবার কয়েক গুণ বেশি পাখির আনাগোনা দেখা যায় ক্যাম্পাসের লেকগুলোতে।

এই অতিথি পাখিরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অলংকারবিশেষ। ভোরে সূর্য ওঠার বহু আগেই পাখিরা জেগে ওঠে। অদ্ভুত ছন্দের এক কিচিরমিচির তান তুলে চক্কর মারে ক্যাম্পাসের লেকের ওপরের আকাশে। খুব ভোরে উঠলে পরিযায়ী পাখিদের এই ছন্দময় ওড়াউড়ি দেখা যায় খুব আয়েশ করে, যা মন ভরিয়ে দেবে যেকোনো গোমড়ামুখো মানুষকেও।

পরিযায়ী পাখিরা আমাদের পরিবেশের জন্য উপকারী, আমাদের মেহমান তারা, তাই আমাদের উচিত মেহমানদের যথেষ্ট যত্ন–আত্তির ভেতর রাখা।