তাঁকে বলে দিয়ো...

মাথা চুলকেও যখন কিছু পেলেন না, হাল ছেড়ে দিলেন মার্ক। মার্ক মানে মার্ক জাকারবার্গ, ফেসবুকের সিইও। ২০১৯ সালের ঘটনা। হঠাৎ শৈত্যপ্রবাহ শুরু হওয়ায় পাড়ার ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট নিয়ে আমাদের যেমন খুব চিন্তা হচ্ছিল, মার্কও চিন্তিত ছিলেন। তবে তাঁকে করা প্রশ্ন নিয়ে।

মার্কিন কংগ্রেসে তাঁকে ডাকা হয়েছিল জেরা করার জন্য। মন্ত্রী-সামন্ত নিয়ে রাজারা যেভাবে দরবারে বসতেন, নির্বাহী উপদেষ্টাদের নিয়ে মার্ক সেভাবে বসেই অভ্যস্ত বলে শুনেছি। বেশ ক্ষমতাধর মানুষ। অথচ কংগ্রেসে তিনি অপরাধীর মতো মুখ কাঁচুমাচু করে একা বসে আছেন। আর প্রশ্নবাণে তাঁকে বিদ্ধ করছেন কংগ্রেস সদস্যরা।

এবার প্রসঙ্গ ভিন্ন হওয়ার কথা ছিল। তবে কংগ্রেস সদস্যরা তাঁকে ঘুরেফিরে একটা প্রশ্নই বারবার করেছেন, ‘এই যে এত এত মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে, তোমাকে বিশ্বাস করে তথ্য দেয়, তুমি তাঁদের তথ্যের নিরাপত্তা দিতে কী করেছ? ওই যে বললাম, মাথা চুলকে মরলেও মার্ক তার সদুত্তর দিতে পারেননি।’

মার্ক জাকারবার্গ ও তাঁর প্রতিষ্ঠান ফেসবুকের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ আছে। ব্যবহারকারীদের তথ্যের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়া সেগুলোর অন্যতম। আরেকটি অভিযোগ হলো ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহারকারীর তথ্য ব্যবহার করা।

এই ব্যবহারকারী কিন্তু আমরা। আমরা যে তথ্য দিই, সেগুলোই পুঁজি করে আয় করে ফেসবুক। কিংবা ইনস্টাগ্রাম। কিংবা গুগল। কিংবা রাজ্যের যত বড় বড় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সার্চ ইঞ্জিন, ভিডিও ভাগাভাগি বা স্ট্রিমিংসহ যে প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের ভার্চ্যুয়াল সেবা দেয়, সেগুলো আয় করে দুইভাবে। একটা হলো সেবা দেওয়ার জন্য দিনে, মাসে বা বছরে একটা নির্দিষ্ট টাকা নিয়ে। যেমন নেটফ্লিক্স। আরেকটা হলো আমাদের কাছ থেকে সরাসরি টাকা নেবে না। বরং টাকা নেবে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। এর বিনিময়ে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিজ্ঞাপন দেখাবে আমাদের কাছে। যেমন ফেসবুক।

সেখানে আবার রাজ্যের তথ্য চেয়ে বসে। ফোনে তির ছোড়ার গেম ইনস্টল করতে গেলে কন্টাক্ট লিস্ট চেয়ে বসে। আর আমরাও সুবোধ বালকের মতো দিয়ে বসি।

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরে নিলাম আমি ১৫ বছরের এক কিশোর। স্কুলে যাই নিয়মিত। ছুটিতে ঘুরতে বেরোই। ক্রিকেট আমার সবচেয়ে প্রিয়। পছন্দের খাবার পাস্তা। এখন কেউ যদি বিজ্ঞাপন দেখায়, ঘরের মেঝেতে ব্যবহার করুন আমাদের টাইলস, কী করব? এড়িয়ে যাওয়ার কথা।

এখন এভাবে চললে তো টাইলসের ব্যবসায়ীরা বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করে দেবে। আয় কমে যাবে। আর তাতেই চিন্তায় পড়ে গেল ফেসবুক। ভেবেচিন্তে বের করল, যার যেটা পছন্দ, তাঁকে তেমন বিজ্ঞাপনই দেখাতে হবে। আর পছন্দ জানতে হলে সে মানুষটা সম্পর্কে জানতে হবে। কিসে তাঁর আগ্রহ, কী ভালো লাগে, কী লাগে না, সেসব জানতে হবে।

আমাদের পোস্ট করা লেখা, ছবি, ইনবক্সে কথোপকথন, কোথায় লাইক দিয়েছি, কোন ভিডিও বেশিক্ষণ দেখছি, কোন ওয়েবসাইটে বেশিক্ষণ থেকেছি, এসব তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করল ফেসবুক। প্রত্যেক ব্যবহারকারীর আলাদা প্রোফাইল তৈরি করল। ফেসবুক সেটা নিজের কাছে না রেখে বিজ্ঞাপনদাতাদের দিয়ে বলল, এই ব্যবহারকারী এটা পছন্দ করে, ওই ব্যবহারকারী ওটা পছন্দ করে। বিজ্ঞাপনদাতারা তা দেখে দেখে বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করল।

এসব পুরোনো ঘটনা। প্রযুক্তি আধুনিক হয়েছে। মোবাইল কাছে রেখে ‘কফি খেতে ইচ্ছে করছে’ বললেও নাকি কফিশপের বিজ্ঞাপন দেখায়। আগে দেয়ালের কান নিয়ে সচেতন থাকতে হতো, এখন থাকতে হয় ডিভাইসের কান নিয়ে।

সচেতনতার কথা যখন এলই, আরেকটা কথা বলি। পথেঘাটে কেউ কিছু খেতে দিলেই যে খেতে হয় না, মা–বাবা আমাদের বহুবার সতর্ক করে দিয়েছেন। তবে ওয়েবে কেউ কিছু চাইলেই যে দিতে হয় না, এখন বরং তা নিয়ে সতর্ক করার সময়।

ওয়েবে অপরিচিত বা স্বল্প পরিচিত কাউকে ব্যক্তিগত তথ্য বা ছবি দিতে বারণ করা হয়। এর একটা কারণ, ওই মানুষটি তা নিয়ে কী করবেন, আমরা জানি না। আরেকটা কারণ, যে মাধ্যমে পাঠালাম (মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, শেয়ারইট) তা থেকেই যে একদিন ফাঁস হবে না, তা–ও আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি না। সুতরাং সাধু সাবধান (নাম সাধু না হলেও সাবধানতার মার নেই)।

এ তো গেল একটা দিক। ভুঁইফোড় কী সব ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করতে বলে, সেখানে আবার রাজ্যের তথ্য চেয়ে বসে। ফোনে তির ছোড়ার গেম ইনস্টল করতে গেলে কন্টাক্ট লিস্ট চেয়ে বসে। আর আমরাও সুবোধ বালকের মতো দিয়ে বসি। বরং নিজেকেই প্রশ্ন করো। কেন দেব? যৌক্তিকতা কী? এই কাজে এই তথ্য কেন দরকার? চাহিবামাত্র তথ্য দেওয়ার বিড়ম্বনা যে কী...আচ্ছা, চলো আরেক ঘটনা দিয়ে আজকের মতো বকবক শেষ করি।

ছয় সদস্যের এক পরিবার। মা-বাবা আর চার সন্তান। চারজনের বয়সই দশের নিচে। ওদের ইংল্যান্ডের হ্যাম্পশায়ারের বাসায় নিনটেনডো সুইচ গেম কনসোল ছিল। ফিফা খেলত তারা। গেমের নিয়ম হলো, বিশেষ খেলোয়াড়ের জন্য টাকা খরচ করে প্যাক কিনতে হয়। তবে সে প্যাকে কোন খেলোয়াড় পাওয়া যাবে, তা কেনার আগে জানার সুযোগ থাকে না।

বাবার নাম থমাস কার্টার। সন্তানদের আবদারে একদিন ৮ পাউন্ড খরচ করে একটি প্যাক কিনে দিলেন। কেনার সময় ব্যাংক কার্ড ব্যবহার করেন। তবে কেনা হয়ে গেলে যে কার্ডের তথ্য মুছে ফেলা উচিত ছিল, সেটা তাঁর মনে ছিল না। এরপর যা হওয়ার তা–ই হলো।

সন্তানদের যখন ইচ্ছা মনের আনন্দে ফিফার প্লেয়ার প্যাক কিনতে থাকে আর তাঁদের পারিবারিক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা কাটা হয়। এমন করতে করতে একসময় ব্যাংকের সব টাকা ফুরিয়ে তাঁদের পথে বসার মতো অবস্থা হলো।

বিবিসি এই খবর প্রকাশ করে। এরপর যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনেক মা-বাবা তাঁদের কথা লিখে পাঠিয়েছিলেন। বিবিসি সেগুলোও প্রকাশ করেছিল। যাহোক, খবর প্রকাশের পর টাকা ফেরত পেয়েছিল কার্টার পরিবার। বাবা আফসোস করে জানিয়েছিলেন, এই যে এত টাকা খরচ করল, তবু আমার সন্তানেরা তাদের পছন্দের খেলোয়াড় মেসিকে পেল না।

উপদেশ দেওয়ার জন্য লেখা শুরু করেছিলাম। ভেবে দেখলাম, কিশোর আলোর পাঠকেরা যথেষ্ট স্মার্ট। তোমরাই বরং সবাইকে জানিয়ে দিয়ো। বলে দিয়ো, ওয়েবসাইটে কোনো তথ্য চেয়েছে বলেই যেন তারা না দেয়। বলে দিয়ো, ব্যক্তিগত তথ্য যেন ব্যক্তিগত বলেই মানে, যাকে-তাকে যেন না দিয়ে বসে। বলে দিয়ো, তারা যেন অনলাইনে নিরাপদ থাকে।