তিন নম্বর গলির চার নম্বর রাস্তা

অলংকরণ: সারা তৌফিকা

এদিকে যে এ রকম একটা ঘিয়ে রঙের বাড়ি আছে, তা এর আগে খেয়ালই করেনি রিয়াদ। এখন এই ঝড়-বৃষ্টির সন্ধ্যায়, সোডিয়াম আলো, ঝড়ের শোঁ-শোঁ আওয়াজ আর রিকশাওয়ালার সিগারেটের ভেজা গন্ধের মধ্যে বাড়িটাকে দেখে রিয়াদের ভ্রু কুঁচকে এল। বলল, এটা কি তিন নম্বর গলি?

রিকশাওয়ালা মাথায় পলিব্যাগ ঢুকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। মুখে বৃষ্টির ছাট এসে পড়ছিল। রিয়াদের প্রশ্নে তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন এল না। বরং নিজের ঘোরেই মাথাটা নাড়িয়ে মুখে একটা আফসোসের ঢং এনে বলল, ‘আইজ খবর আছে! ঢাকা ডুইবা শ্যাষ হয়া যাইব!’

রিয়াদের খুব মেজাজ খারাপ হলো। রিকশাওয়ালাটা এমনিতেই একটু বেশি বোঝে। তাকে সে বলেছিল বড় রাস্তাটা দিয়েই আসতে। আসেনি সে। বড় রাস্তায় জ্যাম, সাত ঘণ্টা লাগবে আসতে ইত্যাদি বিতর্ক করে লোকটা ধরেছিল ভেতরের অলিগলি-উপগলি রাস্তা। এখন তার ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে। তারা দাঁড়িয়ে আছে অচেনা এক গলির ভেতরে প্রায় চেনা এক বাড়ির পাশে। মাথার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছে ভাঙা একটা বিল্ডিংয়ের আধভাঙা ছাদ। মরচে ধরা রড কটোমটো চোখে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। সবকিছু মিলিয়ে রিয়াদের কাছে মনে হচ্ছে এটা একটা দুর্বোধ্য রাত। কিন্তু রাতের চেয়েও দুর্বোধ্য যেন রিকশাওয়ালা। কী বলে, কী বলে না, কী বোঝাতে চায়, কিছুই বোঝা যায় না।

ঘিয়ে রঙের ওই বাড়িটা রিয়াদের পরিচিত। পরিচিত এ কারণে যে রিয়াদের মনে হচ্ছে বাড়িটা তাদের। অথচ গলিটা পরিচিত নয়। মানে এটা তিন নম্বর গলিই না আসলে।

চার মাস আগে বনানীর এই এলাকার তিন নম্বর গলিতে উঠেছে রিয়াদরা। এদিকে আসায় রিয়াদের ভার্সিটিটা একটু দূরে যেমন হয়েছে, তেমনি বিকেলের ক্রিকেটটাও প্রায় ফুরাতেই বসেছে; তবু রিয়াদ খুশি যে ফ্ল্যাটটা আগের ফ্ল্যাটের চেয়ে বড়, তার রুমটাও বেশ ঢাউস হয়েছে অ্যাটাচ বাথসহ। আর সবচেয়ে বড় কথা, আম্মুর অফিসটা হয়েছে খুব কাছে। কষ্ট যা বাড়ার তা আসলে বেড়েছে আব্বুর। তার অফিসটা একবারে বিপরীত মাথায় পড়েছে। কিন্তু রিয়াদ জানে, আব্বুও আসলে তাদের খুশিতে খুশি। প্রথম দিনেই রিয়াদকে নিয়ে আব্বু বেরিয়েছিল এলাকাটা দেখতে। প্রায় সব গলি এখানকার একই রকম। গলির দুই মাথায় দুটি রাস্তা। আর মাঝে একটা শোল্ডার পথ। রিয়াদ আব্বুকে বলেছিল, ধাঁধা লেগে যাচ্ছে তো! সব তো একই রকম!

আব্বু হেসে একটা আমগাছ দেখিয়ে বলেছিল, ওই গাছটাকে মার্ক করে রাখলেই পারিস! ও রকম গাছ আশপাশের কোনো গলিতে নেই।

রিয়াদ আমগাছটাকে দেখে দেখে প্রথম প্রথম গলিতে ঢুকত। এবার জাঁকিয়ে আম ধরেছে গাছটাতে। অবশ্য যে ঝড় হচ্ছে, কতটুকু আম থাকবে গাছটাতে কে জানে!

রিয়াদ ভালো করে খেয়াল করে দেখে, এই গলিতে কোনো আমগাছ নেই। থাকার কথাও নয়। রিকশাওয়ালা যতই বলুক, এটা তিন নম্বর গলি নয়। কিন্তু বাড়িটা খুব কাছাকাছি দেখতে। প্রায় একই রং। ছয়তলা বাড়ি দুটোই। শুধু তাদের যে পাঁচতলার ফ্ল্যাট তার ওপরের তলার জানালার কাচ ভাঙা। এই ঝড়েই ভাঙল কি না, কে জানে! হয়তো একই ডেভেলপার কোম্পানি বাড়ি দুটো বানিয়েছে। শুধু রিয়াদের মনে খটকা একটাই, এ রকম বাড়ি যে তাদের ফ্ল্যাটের আশপাশে আছে, তা সে এই চার মাসে খেয়াল করেনি।

বৃষ্টি থামার নাম নেই। রিকশায় বসে বসেও ভিজে যাচ্ছে রিয়াদ। অসন্তুষ্ট হয়েই বলল, এখানে আর কতক্ষণ দাঁড়াবেন? তিন নম্বর গলিতে ঢোকেন।

কথাটা বলতে গিয়ে কোনো কারণ ছাড়াই রিয়াদের গলা একটু যেন কেঁপে উঠল। বৃষ্টিভেজা বাতাসের ঠান্ডায় কি না, কে জানে। কিন্তু রিকশাওয়ালা যখন বলল, মামা, এইটাই তো তিন নম্বর...তখন রিয়াদ বুঝতে পারল কেন তার গলাটা কাঁপছিল। তার মনে হচ্ছিল, রিকশাওয়ালা ঠিক এ কথাটাই বলবেন। বলবেন যে এটাই তিন নম্বর গলি। আর রিয়াদেরও কোথাও যেন একটা সন্দেহ হয়ে যাচ্ছে যে তিন নম্বর গলি না হয়েও এটা যেন একটা তিন নম্বর গলির রেপ্লিকা।

ঝরঝর করে বৃষ্টি ঝরেই যাচ্ছে। সঙ্গে বাতাস আর ড্রেন উপচানো পানি। রিয়াদ সেসবের তোয়াক্কা না করেই রিকশা থেকে প্রায় লাফ দিয়ে নামল। মনে যে ভয়টা দানা বেঁধে উঠেছে, সেটাকে দূর করতে হবে। এটা যে তিন নম্বর গলি নয়, সেটা নিজের কাছেই প্রমাণ করা লাগবে। রাস্তায় পানি জমে উঠেছে। তার মধ্যেই ছাপছুপ করে পা ফেলে রিয়াদ গলির এ-মাথা আর ও-মাথা দেখে নিল। একটু যেন স্বস্তি এল তার ভেতরে। না, এটা তিন নম্বর গলি হতেই পারে না। রিকশাওয়ালাকে এবার জোর গলায় বলল, ‘ওই মিয়া, মাথা খারাপ হইছে আপনার? এইটা তিন নম্বর গলি নাকি?’

: এইটা তিন নম্বর না হইলে কোনটা তিন নম্বর?

: তিন নম্বর আরও ওই দিকে!

কিন্তু কোন দিকে রিয়াদ ঠিক বুঝতে পারে না। ফলে বোঝাতেও পারে না। বৃষ্টির ছাটে মুখ ভিজে যাচ্ছিল রিয়াদের। তাতে মুখের ভেতর থুতু আর মনের ভেতর বিরক্তি জমে উঠছিল তার। পাশ দিয়ে ভুস করে একটা প্রাইভেট কার চলে গেল। পানিও ছিটাল। রিকশাওয়ালা বললেন, ‘ওই যে দেহেন, গেইটে লেহা থ্রি...এইটাই তিন নম্বর!’

অলংকরণ: সারা তৌফিকা
গায়েব হয়ে গেল নাকি? এগোতেই দেখল গার্ড বসে আছে তার ঘরে। গার্ডটাকে দেখে শান্তি। মন্তাজ ভাই-ই আছে।

বাজারের দিকে গিয়ে ফুরিয়ে যাওয়া একটা রাস্তার মুখে গেট দেখল রিয়াদ। এবং তাতে সত্যি সত্যি লেখা—থ্রি। তাদের বাড়ির পেছন দিক কি এ পাশটা? হতে পারে। তাহলে অবশ্য লেকটা থাকবে আশপাশে। রিকশাওয়ালাকে প্রশ্ন করল, লেকটা কই?

রিকশাওয়ালা সে কথার উত্তর না দিয়ে পিচিক করে থুতু ফেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার বলল, ‘আইজ খবর আছে!’

আকাশের দিকে রিয়াদও তাকাল। এ বৃষ্টি কবে থামবে তার ঠিক নেই। বলল, ‘একটু এগিয়ে দেন তাহলে আমাকে। ওই ঘিয়ে রঙের বাড়িটার কাছে নামিয়ে দেন!’

: ওখানে যাইবেন আগে কইলেই পারতেন! হুদাই এই বৃষ্টির মধ্যে বসায়া এইটা কয় নম্বর তা নিয়া ফাল পাড়ছেন! ওঠেন!

রিকশাওয়ালার ধমক খেতে খেতে রিয়াদ পলিথিন জড়িয়ে নিল শরীরে। যদিও পুরোটাই ভিজে গেছে। ভাঙা ছাদ থেকে গলির রাস্তায় নামতেই প্রচণ্ড শব্দে কাছে কোথাও বজ্রপাত হলো। সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার সোডিয়াম আলোগুলো নিভে গেল। গলিটা অন্ধকারে ডুবে গেল। রিকশাওয়ালা বলল, ‘আর রক্ষা নাই!’

পকেট থেকে আধভেজা মোবাইলটা বের করে ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে রাখল রিয়াদ। সেই আলোয় রিকশা এগিয়ে চলল। বাতাস কমেছে কিছুটা। কিন্তু বজ্রপাতের সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির গতি আরও বেড়েছে। আরেকটা প্রাইভেট কার চলে গেল রাস্তার পানি কাটিয়ে। রিকশায় তার ঢেউ আছড়ে পড়ল। আর ওই অন্ধকারের ভেতরেই রিয়াদ ঘিয়ে রঙের বাড়িটার সামনে এসে পড়ল। ভাড়া মিটিয়ে বাড়িটার সামনে দাঁড়াতেই রিয়াদের মনের সব আশঙ্কা যখন দূর হয়ে যাচ্ছিল, এই তো পরিচিত বাড়ি, ওই যে গার্ডের ঘর। তখনই রিয়াদের মনে পড়ল, তাদের গলিতে কি বনানীর এ পাশের কোনো গলিতেই কোনো দিনও কোনো গেট ছিল না, তাতে থ্রি লেখা তো দূরের কথা। আরেকটা বজ্রপাত হলো কাছেই। রিয়াদ চমকেই উঠল শব্দে। পেছনে ফিরে দেখল রিকশাটা নেই। এত দ্রুত চলে গেল? গায়েব হয়ে গেল নাকি? এগোতেই দেখল গার্ড বসে আছে তার ঘরে। গার্ডটাকে দেখে শান্তি। মন্তাজ ভাই-ই আছে।

মন্তাজ বলল, ‘ভিইজেন না। উপ্রে যান। বাতাস মেলা। ঠান্ডা লাগব!’

: এই দিকে গেট আছে নাকি গলির শেষে?

: হ। এই গলিটার আছে।

: এই গলিটার আছে মানে? আগে তো কখনো দেখিনি।

: যান, উপ্রে যান। ঠান্ডা লাগব। রাস্তা খুঁইজা পাইছেন এইটাই বহুত। সহজে কেউ এই গলিটার রাস্তা খুঁইজা পায় না।

: মোটে তো তিনটা রাস্তা। খুঁজে না পাওয়ার কী আছে! অন্ধকারে চিনতে পারি নাই, তাই।

: তিনটা না, রাস্তা আছে চাইরটা, আপনে আসছেন চাইর নম্বর দিয়া! ধরেন, দুনিয়ার তিনটা রাস্তার বাইরের রাস্তা এইটা!

: দুনিয়ার বাইরের চার নম্বর রাস্তা? হিহি! কিছু খাইছেন নাকি মন্তাজ ভাই?

: যান উপ্রে যান। ঠান্ডা লাগব।

বাড়ির ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে রিয়াদ বোঝার চেষ্টা করল মন্তাজ ভাইয়ের গন্ডগোলটা কী! গোঁফ কেটে ফেলেছে...এতটুকুই? নাকি চোখও লাল ছিল? ঝড়-বৃষ্টির সন্ধ্যা পেয়ে কিছু খেয়েও নিয়েছে বোধ হয়।

ভেতরে জেনারেটর চলছে। পুরো ফ্ল্যাটটাই যেন মৃদু কাঁপছে। মনে হচ্ছে ফ্ল্যাটের হার্টবিট শুনছে রিয়াদ। লিফটে পাঁচতলায় উঠে শান্তি পেল সে। ওই তো তাদের দরজা। বাইরে তার কালো স্পঞ্জটাও রাখা আছে। আলো একটু ঘোলা। জেনারেটরের তেল বোধ হয় ফুরিয়ে আসছে।

বাসায় ঢুকে স্বস্তি অনুভব করল সে। আম্মু রান্নাঘর থেকে বের হচ্ছিল, রিয়াদকে দেখে থমকে বলল, ‘যাক, আসতে পেরেছিস তাহলে! মাথা তো একদম ভিজিয়ে ফেলেছিস!’

উত্তরে রিয়াদ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তখনই আব্বুকে দেখল সে। সোফার ওপর বসে ল্যাপটপে কী যেন একটা করছে। অদ্ভুত! আব্বুর মাথার চুল একেবারে কমে গেছে। টাকটা যেন চকচক করছে। সকালেও তো দেখল চুল আঁচড়ে আব্বু অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছে! আম্মু বলল, ‘মাথাটা মুছে নে তাড়াতাড়ি!’ তারপরই জোরে একটা ডাক দিল—রিয়া! রিয়া!

রিয়াটা আবার কে? কেউ বেড়াতে এসেছে?

আম্মু আবারও গলা উঁচিয়ে বলল, ‘একটা টাওয়েল এনে দে তোর ভাইয়াকে!’

তারপর রিয়াদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মাথা মুছে খেয়ে নে আগে। পরে রিয়াকে নিয়ে একটু বসিস তো। তোদের এই সৃজনশীল পড়াশোনার কিছুই বুঝি না আমি!’

রিয়াদ থমকে দাঁড়িয়ে আছে। কার কথা, কিসের কথা আম্মু বলছে—সব বোঝার আগেই রিয়া এসে একটা টাওয়েল বাড়িয়ে দিল রিয়াদের দিকে। ছয়-সাত বছরের একটা বালিকা। টানা টানা সুন্দর চোখ। লম্বা চুল। আব্বুর মুখটা যেন কেটে বসানো। বলল, ‘ইশ্ ভাইয়া, অনেক ভিজে গিয়েছ!’

একটা বজ্রপাত হলো। কয়েকটা কুকুর ডেকে উঠল কোথাও। রিয়াদ স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে আরেকটা রিয়াদ। মানে সে-ই, যেন একটা আয়না। আরেকটা বজ্রপাত হলো এবার। রিয়াদ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না

রিয়াদ আর এক মুহূর্তও দেরি করল না।

বাসা থেকে সোজা দৌড় দিল বাইরে। লিফট নিল না। বলা যায়, অপেক্ষাই করল না লিফটের জন্য। সিঁড়ি দিয়ে ছুটতে ছুটতে নিচে নেমে এল। হাঁপাতে লাগল। এটা তাদের ফ্ল্যাট, কিন্তু তার না। এটা তার ফ্ল্যাট না। কাঁপছে রিয়াদ। ভয়ংকরভাবে কেঁপে কেঁপে উঠছে।

মেইন গেটের কাছে আসতেই দেখল বৃষ্টি ধরে এসেছে। কিন্তু গলির রাস্তা উপচে পড়ছে পানিতে। রিয়াদ তার মধ্যেই নেমে পড়ল। পেছন থেকে ছুটে এল মন্তাজ, ‘ভাইজান, কই যান?’

রিয়াদ তাকাল আতঙ্কিত চোখে। মন্তাজের মুখে উদ্বেগ। বলল, ‘যাইয়েন না, ভাইজান। একবার গেলে আর ফিরা আসতে পারবেন না। রাস্তা পাইবেন না ভাইজান!’

পানির ঢলের ভেতরে নিজেকে একরকম ছেড়েই দিল রিয়াদ। গলি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে সে। পেছনে রেখে আসা ঘিয়ে রঙের বাড়িটাকে দেখল সে। তারপর গলিটাকে। এইটা তিন নম্বর গলি না। কখনোই না।

হুটোপুটি করে বড় রাস্তায় এল রিয়াদ। অনেকটা সময় ধরে রাস্তাটাকে দেখল। এখনো জ্যাম। ঠিক যে রাস্তা ধরে ও প্রতিদিন যাতায়াত করে, সেই রাস্তা ধরে এগোল। এক নম্বর গলি...দুই নম্বর গলি—ওই তো তিন নম্বর। ওই তো আমগাছ। ঝড়ে গাছটার একটা ডাল ভেঙে গেছে। আহ্‌, শান্তি!

পাঁচতলায় যেতেই নিজের বাসার দরজা দেখল। কালো স্পঞ্জটা বাইরেই রাখা। আনন্দে কান্না চলে এল রিয়াদের। দরজা খোলাই আছে। বাইরের লাইট নেভানো। সবাই ঘুমিয়ে গেল নাকি? দেয়ালঘড়ির রেডিয়াম কাঁটা দুইটার ঘরে। এত রাত হয়ে গেছে?

নিজের ঘরে ঢুকল রিয়াদ। অন্ধকার। লাইটটা জ্বালাতেই দেখল তার বিছানায় তারই থ্রি-কোয়ার্টার আর টি-শার্ট পরে কে যেন শুয়ে আছে। আম্মু বলে ডাকতে গেল একবার। কিন্তু কী মনে হতে অ্যাই বলে ছেলেটাকেই ডেকে বসল সে। পাশ ফিরে ঘুরে তাকাল ছেলেটা। সঙ্গে সঙ্গে বাইরে একটা বজ্রপাত হলো। কয়েকটা কুকুর ডেকে উঠল কোথাও। রিয়াদ স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে আরেকটা রিয়াদ। মানে সে-ই, যেন একটা আয়না। আরেকটা বজ্রপাত হলো এবার। রিয়াদ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। ঠিক আগের মতো ছুটে বেরিয়ে এল বাইরে।

একেবারে বড় রাস্তায়। তিন নম্বর গলির ফ্ল্যাটে যদি একটা রিয়াদ থাকেই, তাহলে সে কোথায় যাবে?

**** ****

সারা রাত তিন নম্বর গলির চার নম্বর রাস্তাটা খুঁজতে থাকল রিয়াদ। প্রতিবার সে বড় রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াল। আর তারপর খুঁজতে থাকল সেই গলিটা, যেখানে তাদের ঘিয়ে রঙের বাড়িটা আছে। বাড়ির ভেতরে আব্বু, আম্মু আর বোন রিয়া আছে। কিন্তু কিছুতেই রিয়াদ রাস্তাটা খুঁজে পেল না। তার শুধু মন্তাজের কথাই মনে আসতে থাকল, ‘যাইয়েন না, ভাইজান। একবার গেলে আর ফিরা আসতে পারবেন না। রাস্তা পাইবেন না ভাইজান!’

রাস্তা পেল না রিয়াদ।

রিয়াদ সকালের অপেক্ষা করল। তারপর রাতের। তারপর সকালের। এভাবে বছর পেরিয়ে গেলেও রিয়াদ আর কোনো দিন তিন নম্বর গলির চার নম্বর রাস্তাটা পেল না। বনানীর বড় রাস্তার ফুটপাতে বসে থাকতে থাকতে এখন রিয়াদ ভাবে, চার নম্বর রাস্তাটা হয়তো সময়ের রাস্তা ছিল। আবার সময় ফিরলে সে ওই রাস্তাটা খুঁজে পাবে। বোনটা এবার আদর করে জড়িয়ে ধরতে পারবে। প্রতি সন্ধ্যায় সে চেনা রাস্তাটা ধরে হেঁটে যায় এই ভরসায় যে রাস্তাটা একদিন হয়তো অচেনা হয়ে যাবে।