দরজা

অলংকরণ: সব্যসাচী চাকমা

ফাঁকা মাঠটাতে একা বসে আছে রাশেদ। সবুজ ঘাসভর্তি মাঠ। অথচ রাশেদ ছাড়া আর কোনো জনমানবই নেই মাঠে। প্রতিদিন বিকেলে রাশেদ তার বন্ধুদের সঙ্গে খেলে এই মাঠে। আজ একেকজন গেছে একেক জায়গায়। শফিক গেছে তার গ্রামের বাড়ি, রনি কোচিংয়ে, সোহেল তার খালার বাড়ি, মামুন তার ক্লাসের এক বন্ধুর বাসায়। আর রাফি অসুস্থ। কোনো কারণে মাঠে বড়রাও আজ খেলতে আসেনি। এই মাঠে বড়রাই খেলে অর্ধেক জায়গা নিয়ে। আজ তারাও নেই। যেন সবাই আজ খেলার বিরুদ্ধে ‘বিদ্রোহ’ ঘোষণা করেছে!

মাঠ থেকে এক হাতে একটু ঘাস তুলে নিল রাশেদ। তার কিছুই করার নেই। স্কুল থেকে খুব একটা হোমওয়ার্কও দেয়নি, অল্প কিছুক্ষণে শেষ করা যাবে। বাসার সব গল্পের বই পড়া শেষ, সেগুলো আবার পড়তে ইচ্ছা করছে না। মন খারাপ হয়ে গেল রাশেদের। মনে হচ্ছে, আজকের দিনটা খুবই বিরক্তিকর।

উঠে দাঁড়াল সে। শরতের হিমেল হাওয়া তার পাশ দিয়ে চলে গেল। বাসার দিকে যাচ্ছে সে। এখানে মাঠে বসে থাকার কোনো মানে নেই।

ফিরতি পথে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থামল রাশেদ। তাদের মফস্বল শহরের জমিদারবাড়ির কাছে চলে এসেছে সে। এই জমিদারবাড়ির ভেতরে ঢোকার খুব শখ তার। স্থানীয় লোকজনের ধারণা, এই বাড়ির মালিক এক নিষ্ঠুর জমিদার। তাঁর আত্মা এই বাড়ির ভেতর এখনো আছে। তাই লোকজন এই বাড়ির ধারেকাছে আসে না। রাশেদ অবশ্য এসব বিশ্বাস করে না। সে বাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল।

ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলল প্রধান দরজা। এরপর বাড়ির দরজাটা। সাধারণত এসব পুরোনো বাড়িতে বাদুড় থাকে বলে শুনেছে সে। তাই দরজাটা খুলে একটু সরে দাঁড়াল। কোনো বাদুড় বের হলো না। রাশেদ বাড়িটার ভেতর উঁকি দিল। না, বাদুড় বা এ রকম কিছু নেই। ভেতর ঢুকল সে।

সেই ব্রিটিশ আমল থেকে এই বাড়ি জনমানবহীন। বাড়ির ভেতরে ঢুকে রাশেদ একধরনের বোঁটকা গন্ধ পেল। দোতলা বাড়ি। একতলায় অল্প কিছু ঘর। সব কটিরই দরজা খোলা। সে ঘরগুলোতে উঁকি দিয়ে সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। এভাবে নিচতলার সব ঘর দেখল। তারপর গেল দ্বিতীয় তলায়।

দ্বিতীয় তলারও সব কটি ঘর খোলা, একটি বাদে। রাশেদ প্রথমে সেই ঘরের দরজার সামনে দাঁড়াল। দরজার একটা হ্যান্ডেল আছে। রাশেদ দরজার হ্যান্ডেল ধরে দরজায় হালকা ধাক্কা দিল। দরজা খুলল না। রাশেদ এবার আরও জোরে ধাক্কা দিল। খুলে গেল দরজা। ভেতরে ঢুকল রাশেদ। তীব্র বোঁটকা গন্ধ এই ঘরে। পুরো ঘর অন্ধকার। কোনো জানালা নেই। হঠাৎ একটা শব্দ হলো। পেছনে তাকিয়ে রাশেদ দেখল, ঘরের দরজা আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেছে। মেরুদণ্ডে শীতল স্রোত বয়ে গেল তার। সামনে তাকাল সে। হঠাৎ করে নীল আলোয় ভর্তি হয়ে গেল ঘর। আলো বেড়েই চলছে। একপর্যায়ে রাশেদের চোখ ধাঁধিয়ে গেল। আলো আবার কমে যাচ্ছে। ঘরটা আবার অন্ধকার হয়ে গেল। ভয় পাচ্ছে রাশেদ। হ্যান্ডেলে হেঁচকা টান দিয়ে দরজা খুলে বের হয়ে এল সে। দৌড়াতে দৌড়াতে বের হয়ে গেল বাড়িটা থেকে। সে ছুটছে। এই বাড়ি থেকে তার দূরে থাকতে হবে।

ছুটতে ছুটতে মাঠের কাছে চলে এল রাশেদ। এরপর যা দেখল, তাতে আতঙ্কিত হয়ে গেল সে। মাঠে সবাই খেলছে। শফিক, রনি, সোহেল, মামুন, রাফি, এমনকি সে নিজেও! মাঠে ঠিক তার মতোই দেখতে আরেকটি ছেলে! একজন আসল রাশেদ, আরেকজন তার ডুপ্লিকেট রাশেদ! সবাই আসল রাশেদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ডুপ্লিকেট রাশেদও। আসল রাশেদ আবার দৌড়াতে শুরু করল। সেই জমিদারবাড়ির দিকে।

রাশেদ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দরজাটা আটকানো। সে দরজাটা আটকিয়ে রেখেছিল কি না, তা মনে করতে পারল না। দরজার হ্যান্ডেলটা ধরে জোরে ধাক্কা দিল সে। দরজাটা খুলে গেল। ঘরটা আগের মতোই অন্ধকার। ভয়ে ভয়ে ঘরের ভেতর ঢুকল সে। এ ঘর থেকে বের হওয়ার পরই সে মাঠে তার বন্ধুদের সঙ্গে দেখতে পেয়েছিল নিজেকে।

ঘরের ভেতরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল রাশেদ। দরজা নিজে নিজে আটকে গেল না। আলোর ঝলকানি দেখা গেল না। নিজেকে খুব অসহায় মনে হতে লাগল রাশেদের। তার মনে হলো, সে কোনো দিনই তার পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারবে না।

ঠিক সেই মুহূর্তেই আপনাআপনি আটকে গেল দরজাটা। একটু পরে দেখা গেল আলোর ঝলকানি। চোখ ধাঁধিয়ে গেল রাশেদের। একটু পর সব আগের মতো। দরজায় আবার হেঁচকা টান দিয়ে বের হয়ে গেল রাশেদ। দৌড়ে সে মাঠে চলে গেল। থামল মাঠের সামনে। জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে সে। মাঠে কেউ ছিল না। রাশেদ তার পৃথিবীতে চলে এসেছে। তার চেনা পৃথিবীতে। সে বাড়িটির দিকে আবার ছুটতে থাকল।

বাড়িটির সামনে এসে থামল সে। এই বাড়িতেই আছে সেই রহস্যময় ঘর। সেই রহস্যময় দরজা পার করলেই সে যেতে পারবে আরেক জগতে। প্যারালাল ইউনিভার্সে। সে একটা বইয়ে পড়েছে। রাশেদ ধীরে ধীরে বাসার দিকে যেতে শুরু করল। আজকের দিনটা যতটুকু বিরক্তিকর হবে বলে সে ভেবেছিল, তা হলো না। কারণ, সে পেয়ে গেছে প্যারালাল ইউনিভার্সে যাওয়ার রাস্তা!

লেখক: নবম শ্রেণি, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল, ঢাকা