দ্বন্দ্ব

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

লংহর্ন সিটিতে সন্ধ্যা নেমেছে। দীর্ঘকায়, রুক্ষ চেহারার লোকটা যখন রাস্তায় নামল, আর জন কলিনসের দোকানের পাশে বাঁধা একটা পনির বাঁধন খুলল, তখন বেগুনি মখমলের মতো দক্ষিণ আকাশে একটা চঞ্চল তারা মিটমিট করছিল। শহরটা দিনের বেলায় খুবই কর্মব্যস্ত, খোলা জায়গায় ধুলা আর প্রখর রোদে চোখ ঝলসে যাওয়ার উপক্রম হয়। আর এখন, শহরজুড়েই আঁধার; কৃত্রিম আলোয় শুধু ঝলমল করছে একটা স্টোর, স্যালন আর গির্জা। কাজেই গলার স্বরটা অন্ধকার থেকেই ভেসে এল।

‘ট্রেভারস!’

রুক্ষ চেহারার লোকটা এরপর যা করল, সেটা চর্মচক্ষে মৃদু একটা নড়াচড়া মনে হলেও লোকটার জীবনে এর গুরুত্ব অনেক। বিজলির চমকের মতো তার হাত দুটো চলে গেল নিচু করে বাঁধা হোলস্টারের দিকে, নিমেষেই হাতে উঠে এল একজোড়া সোনালি পিস্তল। ছায়ার মধ্যে একটা অবয়ব দেখা গেল।

‘দাঁড়াও!’ কণ্ঠটা বলে উঠল।

মুহূর্তকাল পরই জন কলিনসের জানালা দিয়ে আলোকিত জায়গাটুকুতে একটা অল্প বয়স্ক ছেলে দুই হাত তুলে বেরিয়ে এল, এক হাতের কনুইয়ের ভাঁজে নিজের ঘোড়ার লাগামটা আটকানো।

‘গুলি কোরো না,’ সে বলল, ভয়াবহ দুটি আগ্নেয়াস্ত্রের মুখে নার্ভাসনেস নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। ‘আমি মিত্র।’

কমপক্ষে ১৫ সেকেন্ড নীরবে দৃষ্টিবিনিময় হলো নবাগত আর কঠিন চেহারার লোকটার মধ্যে। একে অন্যকে জরিপ করল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। তরুণটি লক্ষ করল, তার সামনে দাঁড়ানো লোকটা বিশালদেহী, মুখে রুক্ষতা। চেহারা বলে দেয়, পশ্চিমের বহু ঝড়ঝঞ্ঝা সে মোকাবিলা করেছে। এমন একটা পরিস্থিতিতেও স্বীকার না করে উপায় নেই, লোকটা সুদর্শন।

‘কী চাও?’ সে প্রশ্ন করল।

‘হাত দুটো নামাতে পারি?’ ছেলেটা বিনীত কণ্ঠে বলল।

‘আগে বলো, আমাকে ট্রেভারস বলে ডাকলে কেন? কে চিনিয়েছে? শহরের কেউ?’

‘নাহ্,’ ছেলেটা বলল। ‘আজ বিকেলে মাত্র আমি এই শহরে এসেছি। তবে বোকা নই। যখন দেখলাম, রাস্তায় তোমাকে দেখে লোকজন সরে যাচ্ছে, তখন বেশ অবাক হয়েছিলাম। হঠাৎই তোমার সোনালি পিস্তলজোড়া চোখে পড়ল। আমার জানা আছে, অমন পিস্তল এ তল্লাটে আর কারও কাছে নেই। শোনো, তোমার ক্ষতি করতে চাইলে আমি তো ডাক না দিয়ে গুলিই করতে পারতাম।’

লোকটা গোঁফে তা দিল। ‘ঠিক আছে, হাত দুটো নামাতে পারো।’

‘ধন্যবাদ।’ হাত নামাল ছেলেটা।

‘এবার বলো বাছা, কী চাও তুমি?’

‘তোমার সঙ্গে যোগ দিতে চাই।’

‘কী!’ চমকে গেল লোকটা।

‘হ্যাঁ,’ ছেলেটা বলল। ‘কথাটা হয়তো বোকার মতো শোনাচ্ছে। কিন্তু মিস্টার টেড ট্রেভারস, তোমার সহকারী এখন উমার কারাগারে পচছে। আমার ধারণা, ওর শূন্য পদটা আমি অনায়াসেই পূরণ করতে পারি। আমার কোনো বাজে রেকর্ড নেই, কিন্তু আমি বেশ ভালো ঘোড়ায় চড়তে পারি, বন্দুকবাজিতেও মন্দ নই, আর...আর আমার যাত্রা শুরু করার জন্য একটা কাজেরও খোঁজ এনেছি।’

‘তা-ই?’ লোকটাকে আগ্রহী মনে হলো।

‘তোমার অন্যান্য কুকীর্তির মতো বড় কিছু নয় অবশ্য,’ বলল ছেলেটা। ‘তবে আসল ব্যাপার হলো টাকা। তা ছাড়া আমার এ কাজই প্রমাণ করবে, আউট ল হতে আমি কতটা বদ্ধপরিকর।’

কঠিন চেহারার লোকটার চোখের পলক পড়ছে না।

‘হুঁ,’ সে বলল। ‘কেন এ পথে পা বাড়াতে চাও?’

‘হাড়ভাঙা খাটুনি আর প্রাণে সইছে না।’

‘তোমার কী ধারণা, ডাকাতি করাটা টাকা রোজগারের সবচেয়ে সহজ উপায়?’

‘না!’ ছেলেটা মাথা নাড়ল। ‘আমি আসলে রোমাঞ্চ চাই। কাউপাঞ্চিংয়ে সেটা নেই।’

‘কোনো মেয়েকে ভালোবাসো?’

ছেলেটা মাথা ঝাঁকাল।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লোকটা বলল, ‘বেশ, কাজটা কী?’

জন কলিনসের দোকানের জানালার অস্পষ্ট আলোয় দেখা গেল, ছেলেটা বেপরোয়া ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েছে। বলল, ‘তুমি যদি আমাকে নিয়ে রওনা হও, তাহলে বলতে পারি, গন্তব্যটা কোথায় হবে। আর তা যদি না করো...বেশ তো, ব্যাপারটা এখানেই চুকেবুকে যাক।’

বিশালদেহী লোকটা তার সোনালি পিস্তল দুটো হোলস্টারে ফেরত পাঠাল। চকিতে একবার জানালার দিকে তাকাল সে, তারপর ছেলেটার পানে। ‘তোমার নামটা যেন কী?’

‘নিক। নিকোলাস কার্টার।’

‘বেশ, এসো তাহলে।’

মিনিট পাঁচেক পরই দুজনকে ঘোড়ায় চড়ে শহর থেকে বেরিয়ে যেতে দেখা গেল। পর্বতমালা দক্ষিণ দিকে শহরটাকে অবরোধ করে রেখেছে। সেদিকেই এগোচ্ছে ওরা। কী করতে যাচ্ছে, সেটা খুলে বলল নিক। এক বৃদ্ধের কাছ থেকে টাকা ছিনিয়ে নেবে।

‘বুড়োটার কাছে যে টাকা আছে,’ একসময় প্রশ্ন করল ট্রেভারস। ‘কী করে জানলে?’

‘বিকেলে ওকে ব্যাংক থেকে বেরোতে দেখেছি,’ নিক জানাল। ‘টাকার বান্ডিলটা মুখে বুলিয়ে পকেটে ভরছিল। চলে যাওয়ার পর খোঁজখবর নিলাম। ব্যাটার নাম অ্যালারসন, মাইলখানেক দূরে একটা কেবিনে থাকে। নিরীহ লোক, গোলমাল বাধাবে না। টাকাটা ওর কাছে যক্ষের ধনের মতো; কিন্তু তুমি যদি নিজের বলে দাবি করো, তাহলে দিয়ে দিতে কোনো আপত্তি করবে না...’ নিজের রসিকতায় নিজেই সে হেসে উঠল হা হা করে।

কিন্তু তার সঙ্গীটি আবেগহীন। নীরস গলায় বলল, ‘আমি কিছুই করব না। কাজের খোঁজ এনেছ...এখন ওটা করবেও তুমি। আমি শুধু দেখব।’

‘হয়তো!’ এক লাফে ঘোড়া থেকে নামল নিক। ‘কিন্তু টাকাগুলো থাকতে পারে। পকেটে অত টাকা নিয়ে নিশ্চয়ই ঘুরে বেড়াবে না? নিশ্চয়ই ভেতরে লুকিয়ে রেখে গেছে। আমি দেখে আসছি।’

ছেলেটা খানিকটা অনিশ্চয়তায় ভুগল। ‘বেশ,’ বলল সে। ‘তুমি যা বলবে, তা-ই হবে। কিন্তু...তুমি আমাকে সঙ্গে রাখছ তো?’

‘হ্যাঁ,’ জবাবটা সংক্ষিপ্ত।

দুই অশ্বারোহী একটা পাহাড়ের গোড়ায় পৌঁছে থামল। চাঁদের আলোয় আবছাভাবে কেবিনটার কাঠামো দেখা যাচ্ছে। জানালায় আলো নেই। ট্রেভারস বলল, ‘বুড়ো ঘরে নেই।’

‘হয়তো!’ এক লাফে ঘোড়া থেকে নামল নিক। ‘কিন্তু টাকাগুলো থাকতে পারে। পকেটে অত টাকা নিয়ে নিশ্চয়ই ঘুরে বেড়াবে না? নিশ্চয়ই ভেতরে লুকিয়ে রেখে গেছে। আমি দেখে আসছি।’

হামাগুড়ি দিয়ে ঘরটার দিকে এগোল সে। আকাশের চাঁদ হঠাৎ মেঘে ঢাকা পড়ল। গাঢ় অন্ধকারে ছেয়ে গেল চারদিক। রুক্ষ লোকটা নিজের ঘোড়ায় অনড়ভাবে বসে শুনতে পেল কেবিনের দরজা ঠোকার শব্দ। কিছুটা বিরতির পর কাঁধ দিয়ে দরজার ওপর আক্রমণ করা হলো। মুহূর্তকাল পরই মড়মড় করে পুরোনো দরজাটা ভেঙে পড়ল। শব্দটা শুনে নিজের অজান্তেই দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরল লোকটা। কেবিনের ভেতর জিনিসপত্র পড়ার ধুপধাপ শব্দ শোনা গেল এবার। একটু পর দেশলাইয়ের আলোয় জানালা আলোকিত হয়ে উঠল। রাতের অন্ধকারে কেবিনের ২০ গজ দূরে ঘোড়ার পিঠে বসে রুক্ষ লোকটা একে একে শুনল কেবিনের শক্ত মেঝেতে তার সঙ্গীর বুটের খটখটানি আর ধুপধাপ—টাকার খোঁজে নিক কার্টার কেবিনটা তছনছ করে ফেলছে। আরেকটা দেশলাই জ্বালানোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শোনা গেল ছেলেটার বিজয়োল্লাস। কেবিন থেকে একটু পরই বেরিয়ে এল সে।

‘পেয়েছি,’ বলল সে, হাঁপাচ্ছে। ‘বুড়ো হাবড়াটা আস্ত গর্দভ। চা-পাতার টিনে ভরে ম্যান্টেলশেলফে রেখে দিয়েছিল। টাকাটা কম নয়। নাও দেখো।’

রুক্ষ চেহারার লোকটা বরাবরের মতোই প্রতিক্রিয়াহীন, হাত বাড়িয়ে নিকের হাত থেকে টাকার বান্ডিলটা নিল।

‘দেশলাই হবে আরেকটা?’ সে বলল।

একটা জ্বালল নিক, দেখতে পেল, জিব দিয়ে আঙুলের মাথা ভিজিয়ে টাকা গুনতে শুরু করেছে লোকটা।

‘১০ ডলারের ৫০টা,’ বলল বিশালদেহী। ‘মানে ৫০০ ডলার। আমার সঙ্গে থাক এটা।’

তার শীতল নীল চোখ দুটো ঊর্ধ্বপানে তাকিয়ে থাকা তরুণটির মুখের ওপর দিয়ে ঘুরে এল। সোনালি পিস্তল দুটোর ওপর দিকে, বেল্টের নিচে একটা পকেটে টাকাগুলো ভরল সে।

‘চলো, এখান থেকে ভাগি,’ প্রস্তাব দিল নিক।

‘না...মানে, এক্ষুনি না,’ বলল লোকটা। ‘ঘোড়ায় চড়ো আর চুপটি করে একটু অপেক্ষা করো।’

‘তোমার মতলবটা কী?’ ছেলেটা ভুরু কোঁচকাল।

হাসল লোকটা। ‘বহুদিনের শখ...আমি চলে যাওয়ার পর কী ঘটে, তা দেখি। কি জানো, ট্রেন ডাকাতির পর মজা দেখার অমন সুযোগ তো নেই; কিন্তু এখানকার অবস্থা ভিন্ন। বুড়োটা নিশ্চয়ই শিগগির ফিরে আসবে। আমি দেখতে চাই ফিরে এসে টাকাটা না পেয়ে সে কী করে।’

‘কিন্তু...’

‘কোনো কিন্তু নয়। ও আমাদের দেখতে পাবে না। তা ছাড়া ও ভাববে চোরেরা এতক্ষণে পগার পার। অথচ আমরা এখানেই চুপচাপ অপেক্ষা করব। ব্যাপারটা মজার, তাই না?’ লোকটার কণ্ঠে কেমন যেন খুশির সুর।

‘কিসের শব্দ...’ হঠাৎ লোকটার বাহু আঁকড়ে ফিসফিসাল নিক।

লোকটা কান পাতল।

‘নিশ্চয়ই বুড়োটা,’ বলল সে। ‘চুপ করে বসো।’

দুজন ঘোড়সওয়ার, গলার স্বরে বোঝা গেল—একজন পুরুষ, অন্যজন নারী। কেবিনটার কাছেই কাঠের তৈরি একটা পুরোনো কোরাল, সেখানে ঘোড়া ছাড়ল ওরা। ওদের হাসি আর কথাবার্তা পরিষ্কার যখন শোনা গেল, তখন ওরা কেবিনের সামনের দরজার দিকে এগোচ্ছে।

‘আমি কিন্তু সেটা বলিনি,’ হাসতে হাসতে মেয়েটি বলছে। ‘যা-ই বলো ড্যাডি, তুমি নিশ্চয়ই এখানে থাকতে চাইছ না...’

‘বাহ্! বাহ্! বাহ্!’ বৃদ্ধ মানুষটি বলল। ‘ওই ৫০০ ডলারের কথা ভুলে গেছিস? ওই টাকা আজেবাজে খরচের জন্য নয়। তা ছাড়া তোর নেলি খালাও টাকাটা এমনি এমনি দেয়নি। “ও যদি কলেজে যেতে চায়,” তোর খালা বলেছে, “কাজ করে তাহলে প্রমাণ করুক। আমি অর্ধেক খরচ দেব, কিন্তু বাকিটা তো ওকে জোগাড় করতে হবে।” যাহোক, কাজ তুই করেছিস আর...আরে, ঘরের চাবিটা কোথায় রাখলাম!’

নীরবতা। বুড়ো লোকটি চাবি খুঁজছে পকেট হাতড়ে। তক্ষুনি মেয়েটি কথা বলে উঠল, তার কণ্ঠে স্পষ্ট ভীতি।

‘ড্যাডি, তু-তু-তুমি কি টাকাটা ঘরে রেখে গেছ?’

‘হ্যাঁ। কেন, কী হয়েছে?’

‘ড্যাডি, দরজাটা ভাঙা...আর...’

একটা চিত্কার শোনা গেল, পরমুহূর্তে ছুটন্ত পায়ের শব্দ। কেবিনের ভেতর খানিকক্ষণ পরই একটা আলো জ্বলে উঠল, সেই অস্পষ্ট আলোয় দরজায় একটা মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল—দুই হাতে মুখ চেপে ধরেছে। আর রুপালিচুলো বুড়ো এক হাতে দেশলাই, অন্য হাতে ম্যান্টেলশেলফ থেকে একটা টিনের পাত্র তুলে নিয়েছে।

‘তা নয়,’ ছেলেটা স্বীকার করল। ‘কিন্তু টাকাটা আমি ফেরত দেব। ওটা পেতে তোমাকে কোনো ঝামেলা পোহাতে হয়নি, কাজেই তুমি কিছু হারাচ্ছ না।’

‘নেই!’ ভাঙা গলায় সে হাহাকার করে উঠল, ‘নেই!’

দাঁতের ফাঁক দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিক, অস্বস্তি ভরে স্যাডলে নড়ে বসল। সঙ্গে সঙ্গে লৌহমুষ্টিতে তার একটা হাত চেপে ধরল ট্রেভারস। বলল, ‘শোনো!’

‘ড্যাডি...ড্যাডি...প্লিজ, অমন কোরো না,’ মেয়েটির কণ্ঠ শোনা গেল। বেচারির কণ্ঠ কান্নাভেজা, অনেক কষ্টে চোখের পানি ঠেকিয়ে রেখেছে। ফায়ারপ্লেসের পাশে একটা পুরোনো চেয়ারে বুড়ো মানুষটিকে জোর করে বসাল সে। মানুষটা কাঁদছে দুই হাতে মুখ ঢেকে। মেয়েটি টেবিলের ওপর রাখা একটা বাতি জ্বালল। তারপর বাবার সামনে হাঁটু গেড়ে বসল।

‘শান্ত হও!’ বাবার কাঁধে হাত রেখে বলল মেয়েটি। ‘শান্ত হও, ড্যাডি! সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি অমন ভেঙে পোড়ো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।’

কিন্তু এই সান্ত্বনায় কাজ হলো না।

‘কিছুই ঠিক হবে না!’ মুখ থেকে হাত নামিয়ে আর্তনাদ করে উঠল বৃদ্ধ অ্যালারসন। ‘সব হারিয়েছি আমি—শেষ সম্বল, সন্তানের ভবিষ্যৎ! লেখাপড়া আর করতে পারবি না তুই, এই গরিবি জীবনই কাটাতে হবে! হায়...দুটো বছর আমার কাছ থেকে দূরে ছিলি তুই...দুটো বছর ওই জঘন্য স্টোরটাতে ক্রীতদাসীর মতো খেটেছিস! কিসের জন্য? কী প্রতিদান পেলি এর...’

‘প্লিজ ড্যাডি, থামো। কোনো অসুবিধা নেই, আমি না হয় আবার কাজে যাব...’ মেয়েটি কথা শেষ করতে পারে না।

ঝট করে বুড়ো উঠে দাঁড়ায়। ‘তার মানে আরও দুই বছর দাসত্ব? অথচ কতগুলো বদমাশ তোমার টাকা দিয়ে মদ খাবে, জুয়া খেলবে!’ বুড়ো চিত্কার করে ওঠে। ‘সে যে-ই হোক, তাকে অভিশাপ দিচ্ছি। ঈশ্বরের পৃথিবীতে কি বিচার নেই? ও কীভাবে বুঝবে, তোর খালাকে কতটা কষ্ট করতে হয়েছে এই টাকার জন্য, তোকে কতটা অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়েছে দুটো বছর? একটা চুরি যে আমাদের সব সুখ মুহূর্তেই তছনছ করে দিল, তা সে কীভাবে জানবে?’

মেয়েটি হাত দিয়ে তার বাবার মুখ চাপা দিল।

‘না ড্যাডি,’ সে বলল। ‘এসব বোলো না। এসো, বিছানায় শোও। আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেব। প্লিজ ড্যাডি, কেঁদো না।’

মা যেমন তার সন্তানকে আদর করে ঘুম পাড়ায়, মেয়েটি তেমনি তার বাবাকে বাইরের দুই দর্শকের দৃষ্টিসীমার বাইরে নিয়ে গেল। তাদের আর দেখা গেল না, শুধু শোনা গেল ভগ্নহৃদয় বৃদ্ধটির ফোঁপানোর আওয়াজ।

‘নাটক হলো বটে একখানা!’ আকর্ণ হেসে বলল রুক্ষ চেহারার লোকটা। ‘চলো বাছা, এবার কেটে পড়ি।’

তার ঘোড়াটা কয়েক কদম এগোল, কিন্তু নিক কার্টারেরটা নয়। স্যাডল থেকে রুক্ষ লোকটা ঘুরে তাকাল।

‘কী ব্যাপার, তুমি আসছ না?’

কয়েক সেকেন্ড কোনো জবাব দিল না নিক। তারপর পনিটাকে তার সঙ্গীর পাশাপাশি এনে থামাল।

‘না!’ স্পষ্ট গলায় সে বলল। ‘আর...আর ওই টাকাও আমি নিচ্ছি না।’

‘তাই?’ কণ্ঠটা নিচু, তবে ব্যঙ্গাত্মক।

‘আমি ভেবেছিলাম ব্যাপারটা একটা খেলা,’ ছেলেটা বলল। ‘মনে হয়েছিল, রোমাঞ্চটাই আসল—ফটাফট গুলি ছোড়া, যুদ্ধ, আক্রমণ, পুরোটাই মজামাত্র। কিন্তু এই দিকটা নিয়ে ভাবিনি কখনো...বুড়ো মানুষটা কাঁদছে!’

‘সেটা আমার দোষ নয়,’ লোকটা বলল।

‘তা নয়,’ ছেলেটা স্বীকার করল। ‘কিন্তু টাকাটা আমি ফেরত দেব। ওটা পেতে তোমাকে কোনো ঝামেলা পোহাতে হয়নি, কাজেই তুমি কিছু হারাচ্ছ না।’

‘আমি যদি তাতে রাজি না হই?’ লোকটার ঠোঁটের কোণে একটুকরা হাসি।

‘সে ক্ষেত্রে,’ হিসিয়ে উঠল কার্টারের গলা, ‘তোমার মাথার খুলি উড়িয়ে দিয়ে টাকাটা আমি কেড়ে নেব। খবরদার, নড়ার চেষ্টা কোরো না! আমি তোমাকে কাভার দিচ্ছি। টাকাটা আমি নিজেই নিয়ে নিচ্ছি।’

সঙ্গীর নাকের ডগায় রিভলবারের মাজল ঠেকিয়ে ডলারের বান্ডিল বের করে নিল ছেলেটা। তারপর ঘোড়ার পাছায় থাপ্পড় দিয়ে সরে গেল, এগোল কেবিনের দিকে। রুক্ষ চেহারার লোকটা এখনো আগের মতোই প্রতিক্রিয়াহীন, চুপচাপ ঘোড়ার পিঠে বসে রইল, একটুও নড়ল না। কেবিনের ভেতর আবার শব্দ শোনা যাচ্ছে—তবে এবারেরটায় অদ্ভুত একটা আনন্দের ছোঁয়া।

পুরো ১০ মিনিট পর নিক কার্টার ফিরল। ঘোড়ায় চড়তে গিয়ে লক্ষ করল, বিশালদেহী লোকটা এখনো মূর্তির মতো বসে আছে, একচুল নড়েনি।

‘আমি দুঃখিত,’ বিব্রত কণ্ঠে ছেলেটি বলল। ‘কিন্তু...’

‘আমি দুঃখিত নই,’ শান্ত স্বরে বলল লোকটা। ‘তোমার কী ধারণা, বোকা গর্দভ, কেন তোমাকে আমি দেরি করিয়েছি?’

ছেলেটি প্রথমে কোনো জবাব দিতে পারল না। সহসা তার ঘাড়ের চুল সড়সড় করে খাড়া হয়ে গেল।

‘সত্যি করে বলো,’ সে শুধাল। ‘তুমি টেড ট্রেভারস নও?’

জবাবে লোকটা শুধু মুচকি হাসি হাসল।

‘কিন্তু...কিন্তু...ওই পিস্তল দুটো...তা ছাড়া লংহর্নের লোকেরাও তোমাকে ভয় পাচ্ছিল। যদি টেড ট্রেভারস না হয়ে থাকো, তুমি তাহলে কে?’

চাঁদটা হঠাৎ মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। নিক কার্টার সেই আলোয় দেখল তার সঙ্গীর রুক্ষ মুখমণ্ডলে কৌতুকের ঝিলিক।

‘কেন,’ তরল গলায় লোকটা বলল। ‘আমিই সেই শেরিফ, যে গতকাল ট্রেভারসকে খতম করেছে।’