নজর যাঁদের পায়ে

গতবছর মার্চের মাঝামাঝি যখন সবকিছু তড়িঘড়ি করে বন্ধ করে দেওয়া হলো, তখন থেকেই কুডাক ডাকছিল—এই ফুটবল মৌসুম আদৌ শেষ হবে তো? ফুটবল–ফ্যানদের কাছে ফুটবল না থাকা জীবনের একটা অংশ না থাকার মতোই। এরপরই ফুটবল বিশ্ব উপভোগ করল তাদের দেখা সবচেয়ে বড় ফুটবল মৌসুমের। এমনই এক মৌসুম, যার শুরুতে রবার্ট লেভানডফস্কির বয়স ছিল ৩০, আর চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফি হাতে নিয়ে সিজন শেষ করলেন ৩২ বছর বয়সে। প্রায় ১৩ মাসের ফুটবল মৌসুম শেষে বসে থাকার ফুরসত ছিল না। বরং তড়িঘড়ি করেই নামাতে হয়েছে নতুন মৌসুম। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে লাখো মানুষের রুটিরুজি। তাই কোভিডের ভয়কে পাশে রেখেই নতুন মানিয়ে নেওয়ার ফুটবল মৌসুম এটা। আর এই মৌসুমে যেসব তরুণ তুর্কির দিকে নজর থাকবে, তাঁদের নিয়েই আজকের লেখা।

জাডোন সাঞ্চো

জাডোন সাঞ্চো

মৌসুম শুরুর আগে থেকেই সাঞ্চোকে নিয়ে জল্পনাকল্পনা ইংলিশ মিডিয়ার। ইংলিশ ফুটবলারদের বাইরের দেশে খেলার খুব একটা উদাহরণ নেই, তাই তাঁকে পারলে এই মৌসুমেই ইউনাইটেডে ভেড়াতে চেয়েছিল মিডিয়া। কিন্তু যা রটে, তাই কি আর ঘটে? ডর্টমুন্ডের গোঁ ধরে থাকার কারণে এই মৌসুমেও ডর্টমুন্ডেই থাকতে হচ্ছে তাঁকে। গত মৌসুমে গোলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে করেছেন অ্যাসিস্ট, ২০ গোল আর ২০ অ্যাসিস্ট। বয়সটাও যে তাঁর ২০। এই বছর তাই তাঁর ডানা মেলে ওড়ার বয়স। বরুসিয়া ডর্টমুন্ডে তরুণদের যত্নআত্তি কেমন হয়, তা আর বলতে হবে না নিশ্চয়ই? যদিও শুরুটা তেমন ফাটাফাটি হয়নি, তবু ৪ ম্যাচে ১ গোল ২ অ্যাসিস্ট কম কিসে। অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারদের গোলের চেয়ে শান্তি তো প্লেমেকিং দেখে!

মার্টিন ওডেগার্ড

মার্টিন ওডেগার্ড

পাঁচ–ছয় বছর ধরে যদি কোনো ইয়াংস্টারের নাম শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়, তবে সেই নামটা নিঃসন্দেহে মার্টিন ওডেগার্ড। সেই ২০১৪ সালে ১৪ বছরের এক নরওয়েজিয়ান ফুটবলারকে কিনে এনেছিল রিয়াল মাদ্রিদ। এত দিন ধরে পেলে–পুষে বড় করেছে রিয়াল মাদ্রিদ। এখন যেন সময় ফল দেওয়ার। গত মৌসুমের অসাধারণ পারফরম্যান্স রিয়ালকে বাধ্য করেছে ওডেগার্ডকে ফিরিয়ে এনে তাঁর ওপর ভরসা রাখতে। গত মৌসুমে মোটামুটি একাই সোসিয়েদাদকে টেনে নিয়ে এসেছেন ইউরোপা লিগে। যে কারণে তড়িঘড়ি করে রিয়াল নিজেদের ছেলেকে ফিরিয়ে এনেছে নিজেদের ঘরে। এখন থেকেই তাঁকে যে হাল ধরতে হবে রিয়ালের। মদরিচের বয়স বেড়েছে, ক্রুসও পার করেছেন ৩০। ওডেগার্ড এখন রিয়াল সমর্থকদের ভরসা। যদিও মৌসুমের শুরুতেই সামান্য চোটে ছিটকে গেছেন, কিন্তু তাতে হতাশার কিছু নেই। ওডেগার্ড যখন ফিরবেন, তখন তাঁর সবটা দিয়েই ফিরবেন।

রেইনার জেসুস

রেইনার জেসুস

রিয়ালের তরুণ তুর্কিদের কথাই যখন হচ্ছে, তখন রিয়াল ছেড়ে যাওয়া তারকাদের কথাই বলা যাক। নরওয়েজিয়ান তারকার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে ধারে খেলতে চলে গেছেন ব্রাজিলিয়ান ১৮ বছর বয়সী তারকা রেইনার জেসুস। বয়স ১৮ হলে কী হবে, গোলবারের সামনে এমন ক্ষুধার্ত তারকা বড্ড কম। গিয়েছেনও এমন জায়গায়, যেখানে তাঁদের মতো তারকাদেরই বসবাস। এক মৌসুমের জন্য ধারে বরুসিয়া গেছেন রেইনার, আর এটাই সুযোগ তাঁর প্রতিভা মেলে ধরার আর আমাদের চোখধাঁধানোর। যদিও জাডোন সাঞ্চোর ট্রান্সফারের ওপর নির্ভর করবে তাঁকে কতটা মাঠে দেখা যাবে। তবে যতক্ষণই মাঠে থাকুন, তোমাদের নজর কেড়ে নেবেন ঠিকই।

আনসু ফাতি

আনসু ফাতি

বার্সেলোনা থেকে কুবোকে যখন জাপান ফেরত নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তখনই বার্সেলোনা দলে ঢুকেছিলেন ফাতি। দুজনের বয়সের কিছুটা পার্থক্য হলেও খেলতেন একসঙ্গে। পাল্লা দিয়ে রাজত্ব করছেন বার্সার ইয়ুথ মিডফিল্ডে। সে প্রায় বছর পাঁচেক আগের কথা। এখন দুজন দুজনের রাইভাল, চিরশত্রু। কুবোকে এই মৌসুম খেলতে হবে ভিয়ারিয়ালে, কিন্তু ফাতির করে দেখানোর সুযোগ বার্সাতেই। সেটাই করে দেখাচ্ছেন ফাতি। মৌসুম শুরু হতে না–হতেই কোমানের ভরসার পাত্র হয়ে উঠেছেন। এল ক্লাসিকোতে সবচেয়ে কম বয়সে গোল করে নাম লিখিয়েছেন রেকর্ডবুকে। ইতিমধ্যে লা লিগাতে গোলবন্যা শুরু করে দিয়েছেন। বার্সার এই তথৈবচ অবস্থা দূর করতে ইয়াংস্টারদের থেকে বড় ভরসা কে–ইবা হতে পারে?

তাকেফুসা কুবো

তাকেফুসা কুবো

এই মৌসুম শুরুর আগেই ট্রান্সফার মার্কেটের হটকেকে ছিলেন এই জাপানিজ বালক। মাত্র ১২ বছর বয়সে বার্সেলোনায় এসেছিলেন স্বপ্ন পূরণ করতে। নিজের খেলা দিয়েই নিকনেম পেয়েছিলেন ‘জাপানিজ মেসি’। এ রকম হাজারো মেসি এসেছেন দেশে দেশে, কিন্তু এই কুবোর খেলার ধরন ছিল অন্য সবার থেকে বড্ড আলাদা। কিন্তু বেআইনিভাবে কম বয়সে কেনার কারণে ১৫ বছর বয়সেই তাঁকে ফেরত পাঠানো হয় জাপানে। আশা নিয়ে বসে ছিল বার্সা, ১৮ হওয়ামাত্রই কিনে নেবে। কিন্তু তার আগেই তাঁকে ছিনিয়ে নিয়ে আসে রিয়াল। মৌসুমের শুরু থেকেই নিজের নামের সুবিচার করছেন কুবো। রিলেগেশন ব্যাটলে একাই ধরে রেখেছিলেন মায়োর্কাকে। যদিও লাভের লাভ হয়নি। তাই রিয়াল তাঁকে ধারে পাঠিয়েছে ভিয়ারিয়ালে। মৌসুমের শুরুতে যদিও কোচ উনাই এমেরির গুডবুকে নাম লেখাতে পারেননি, তবে এক ম্যাচে সুযোগ পেয়েই দেখিয়ে দিয়েছেন, কী করতে পারেন। ইউরোপা লিগে প্রথম ম্যাচেই ১ গোল, ২ অ্যাসিস্ট। এভাবে চলতে থাকলে মৌসুম শেষে চোখে পড়ার মতো তারকা হবেন কুবো।

গাব্রিয়েল মার্তিনেল্লি

গাব্রিয়েল মার্তিনেল্লি

এক বছর আগেও ব্রাজিলিয়ান লিগের ফোর্থ ডিভিশনে খেলতেন গাব্রিয়েল। সেখান থেকেই প্রি–সিজনে আর্সেনাল কোচের চোখে পড়ে যান ১৯ বছর বয়সী গাব্রিয়েল। ব্রাজিলে প্রি–সিজন খেলতে গিয়ে দেখা তারকাই তড়িঘড়ি করে দলে ভেড়ায় আর্সেনাল। যদিও আশা তেমন বড় কিছু ছিল না, কিন্তু তার থেকে অনেক বেশিই দিয়ে ফেলেছেন তিনি। দলের বিপদে এসে ২০ ম্যাচে ১০ গোল করে আর্সেনালের এফএ কাপ জয়েও রেখেছেন ভূমিকা। আর্সেনালের নতুন কোচ আর্তেতার ভরসা তাই এই তরুণ তুর্কিতে। ইংলিশ লিগের মতো লিগে জয়জয়কার করা মার্তিনেল্লি হারিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছেন না টিকে থাকার জন্য, সে পরীক্ষা এখনই। ইংলিশ লিগের ইয়াংস্টারদের মধ্যে নজর তাঁর দিকেই বেশি। নতুন করে আর্সেনালের পুনর্জাগরণের জন্য তরুণদের ওপরই যে ভরসা রাখতে হবে কোচকে।

কথায় আছে ‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’। দিনের শুরু দেখেই পুরো দিনটা আন্দাজ করা যায়। তেমনই আজকের এই তরুণদের থেকেই হয়তো ভবিষ্যতের তারকারা বের হবেন। ফুটবল দেখলে নজর রেখো, বড় হলে গল্প ফাঁদতে পারবে, ও যখন ছোট্টবেলায় খেলত, তখন থেকে আমি ওর ফ্যান। সেরা খেলোয়াড়ের সেরা ফ্যান হওয়ার চেয়ে আনন্দ আর কিসে বেশি?