নাইজেরিয়ায় পরমার ঈদ উদ্‌যাপন

ওল্ড সিটির তোরণ

রোজ গেস্টহাউসের বাগানে দোলনায় বসে ছিল পরমা। চারটি পাখি চৌবাচ্চায় পাখা ঝাপটিয়ে গোসল করছে। তখনই সে ঢোলকের তাক দুমাদুম আওয়াজ শোনে। বিষয়টি দেখার জন্য সে লোহার বেড়ার পাশে এসে দাঁড়ায়। এক সপ্তাহ আগে পরমা তার মা সামিনা চৌধুরীর সঙ্গে নাইজেরিয়ায় এসেছে। সে এখন থাকছে কানো সিটির রোজ গেস্টহাউসে। সামিনা এখানে বিশ্বব্যাংকে চাকরি করতে এসেছেন। নতুন চাকরি, তাই বাসা এখনো পাননি। পরমা মায়ের সঙ্গে কানো সিটিতে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড থেকে। ওখানে তার বাবা ডক্টরেট করছেন। তাই তিনি আসতে পারেননি। তেরো বছর বয়সের পরমা সেভেনথ গ্রেডে পড়ে। কানো সিটিতে নতুন একটি স্কুলে তার ভর্তির প্রক্রিয়া চলছে। এখনো তার কোনো বন্ধুবান্ধব জোটেনি। দিনের বেলা মা অফিসে গেলে সে কম্পিউটারে ডিভিডি দেখে, গেমস খেলে, কিন্তু তার সময় কাটতে চায় না। অজানা একটি দেশে আনার জন্য মায়ের ওপর তার রাগও হয়।

আলখাল্লা পরা তিনজন নাইজেরিয়ান মানুষ ঢোলকে চাটি মারতে মারতে গেস্টহাউসের সামনে এসে হাঁক পাড়ে, ‘ইয়াল্লা ঈদ মোবারক।’ পরমা ছুটে গেটের কাছে গিয়ে তাদের দিকে হাত নেড়ে ‘ঈদ মোবারক’ বললে তারা থেমে অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়। একজন জানতে চায়, ‘হোয়াট কান্ট্রি আর ইউ ফ্রম লিটিল গার্ল?’ সে ‘বাংলাদেশ’ জবাব দিলে তারা হেসে ঢোলকে চাটি মেরে যেতে যেতে বলে, ‘ঈদ মোবারক বাংলাদেশ।’ সন্ধ্যার পরে পরমা তার মাকে ঢোলক বাজানো মানুষদের কথা বলছিল। তার মন একটু খারাপ হয়েছিল, কারণ নাইজেরিয়ার কানো সিটিতে তাদের জানাশোনা কোনো বন্ধুবান্ধব নেই। এ দেশে মানুষজন কীভাবে ঈদ পালন করে, তা-ও তারা জানে না। আগামীকাল অবশ্য মায়ের ছুটি। কিন্তু ঈদের দিনে কোথাও বেড়াতে যাওয়া যাবে না, কোনো আনন্দ করা যাবে না—ভেবে পরমার মন খারাপ হয়। তখনই গেস্টহাউসের ম্যানেজার এসে তাদের দরজায় নক করেন। তিনি কানো সিটির আমিরের কাছ থেকে একটি দাওয়াতনামা নিয়ে এসেছেন। আমির হচ্ছেন রাজার মতো। ঈদের দিনে তাঁর প্রাসাদের চত্বরে তিনি বিদেশিদের দাওয়াত করেন। ঢোলক বাজানো মানুষেরা তাঁর দপ্তরে পরমার কথা রিপোর্ট করলে ওখান থেকে দাওয়াতনামা পাঠানো হয়েছে। ম্যানেজার তার মাকে বুঝিয়ে বলেন, কীভাবে পরদিন গেস্টহাউসের গাড়ি নিয়ে প্রাসাদ চত্বরের মসজিদে ঈদের অনুষ্ঠানে যেতে হবে।

পরদিন সকালে মা স্যুটকেস থেকে পরমার জন্য বের করেন সালোয়ার, কামিজ ও ওড়না। তিনিও সুন্দর একটি শাড়ি পরেন। গেস্টহাউসের গাড়ি চড়ে কানোর ওল্ড সিটিতে আসতে তাঁদের কোনো অসুবিধা হয়নি। কানো সিটির এদিকটা খুবই ঐতিহাসিক। দেয়ালঘেরা এ শহরের প্রাসাদ, মসজিদ ও কেল্লা তৈরি হয় চৌদ্দ শ শতকে। ওল্ড সিটিতে ঢোকার মুখে পড়ে বিশাল একটি তোরণ। তাতে টাইলস বসিয়ে করা রঙিন নকশা। ট্রাফিক জ্যাম যাতে না হয় তার জন্য তোরণ দিয়ে কোনো গাড়ি যেতে দিচ্ছে না। মা প্রহরীকে দওয়াতনামা দেখালে তাদের গাড়িতে পার্কিংয়ের স্টিকার লাগিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।

ছুটে যাচ্ছে নকিব

মসজিদের দিকে গাড়িতে যেতে যেতে সে দেখে দূরে আমিরের প্রাসাদ। তার ছাদে উড়ছে ঝলমলে পতাকা। ওখানে বর্শা হাতে দাঁড়িয়ে আছে সৈনিকেরা। মসজিদের গেটের কাছে গাড়ি থামে। নামতে গিয়ে পরমা অবাক হয়ে দেখে, ঈদের নামাজ পড়তে বেশ কিছু মানুষ এসেছে ঘোড়ায় চড়ে। তাদের ঘোড়ার পিঠে কার্পেটের রংচঙে জিনগদি লাগানো। সবকিছু কেমন যেন রূপকথার গল্পের মতো মনে হয়।

ঈদের নামাজের পর একজন মহিলা এসে তাদের নিয়ে যান একটি দালানে। ওখানে ঝাড়বাতি ঝোলানো হলকামরায় তাদের হাতে গোলাপজল মাখিয়ে দেওয়া হয়। আমিরের দাওয়াতে এ হলঘরে জড়ো হয়েছেন বেশ কয়েকজন বিদেশি মহিলা। কাঠের স্ক্রিনের ওপাশে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলছেন তাঁদের স্বামী বা বাবারা। এঁদের অনেকেই আরব দেশের। ইউরোপ ও চীন দেশের কয়েকজন নারী-পুরুষও এসেছেন। তাঁদের সবার বেশভূষা আলাদা আলাদা। পরমা অবাক হয়ে সবকিছু দেখছিল। তখন তার মতো দেখতে একটি মেয়ে এসে তাকে ‘হ্যালো’ বলে। মেয়েটির নাম জেরিন কোরেশি। সে-ও কানো সিটির একটি স্কুলে সেভেনথ গ্রেডে পড়ে। জেরিনের মা এসে পরমার মায়ের সঙ্গে কথা বলেন। এঁরাও বাঙালি, তবে কয়েক পুরুষ ধরে আফ্রিকাতে বাস করছেন। তাই তাঁরা বাংলায় কথা বলতে পারেন না। জেরিনের পূর্বপুরুষ পশ্চিম বাংলার চব্বিশ পরগনা থেকে আফ্রিকার উগান্ডাতে চাকরি করতে যান আজ থেকে এক শ তেত্রিশ বছর আগে। তিনি আর বাংলাদেশে ফিরে আসেননি। উগান্ডাতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। তিরিশ বছর আগে জেরিনদের পরিবার উগান্ডা ছেড়ে নাইজেরিয়াতে অভিবাসী হয়ে আসে। জেরিনের জন্ম হয়েছে এ কানো সিটিতে।

দুজন মহিলা জোরে শঙ্খ বাজালে জেরিন ও পরমা কথা বন্ধ করে তাকায়। বাটিকের বেজায় রংচঙে পোশাক পরা মেয়েরা মাথায় করে নিয়ে আসে খাবারের গোল ট্রে। কোনো কোনো মেয়ের মাথায় রাখা শরবতের কলসি। তাদের গলা, কান ও চুলে পুঁতির ঝলমলে অলংকার। এক নারী আমিরের নাম নিয়ে আবার শঙ্খ বাজালে পরিবেশিত হয় খাবার। আমের টুকরা ও পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে ভাজা ভাতের সঙ্গে তাঁদের কাবাব খেতে দেওয়া হয়। ভাতটাত খাওয়ার পর পরিবেশিত হয় চিনচিন নামে গরম গরম পিঠা ও আদার রস মেশানো শরবত।

খাওয়া শেষে মেয়েরা কোমরে ছোট ছোট ঢোলক বেঁধে নাচতে শুরু করে। তারা গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে ঢোলক বাজিয়ে নাচছে। জেরিন পরমার হাত ধরে তাকে নিয়ে যায় হলকামরার এক কোণে। ওখানে বুড়ো এক মহিলা মেহেদি পরিয়ে দিচ্ছেন। তিনি গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে পরমা ও জেরিনের হাতে মেহেদির নকশা এঁকে দেন। এরপর তারা জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলে। জেরিন যে স্কুলে পড়ে সেখানেই পরমা ভর্তি হতে যাচ্ছে। জেরিন কখনো বাংলাদেশে যায়নি। পরমা তাকে দেশে কীভাবে ঈদ পালিত হয় তা বলছিল। তখনই পিলে চমকিয়ে দিয়ে প্রাসাদ থেকে কামান দাগা হয়।

মসজিদে ঘোড়ায় চড়ে নামাজিরা

সারা হলকামরায় তোড়জোড় পড়ে যায়। সবার সঙ্গে পরমা ও জেরিন বেরিয়ে আসে দালানের ঝুলবারান্দায়। খানিকটা দূরে দেখা যাচ্ছে ময়দান। তাতে রঙিন শামিয়ানা খাটিয়ে আমিরের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তার সামনে বিশাল বিশাল ড্রামে মুগুর দিয়ে চাটি মারছে ছয়জন মানুষ। জেরিন তাকে বুঝিয়ে বলে, ঈদের সময় এ ময়দানে বসে আমিরের দরবার। সে দুরবিন নিয়ে এসেছে। তা দিয়ে তারা পালা করে দেখে শামিয়ানার চারপাশে উটের পিঠে বসা তির-ধনুক হাতে সৈনিকদের।

আবার জোরে জোরে শঙ্খ বাজে। তাদের সামনে দিয়ে এবার ঘোড়ায় চড়ে ছুটে যায় নকিব। নকিবের কাজ হচ্ছে দরবারের ঘোষণা দেওয়া। তার ঘোড়া থেকে ঝুলছে লাল রঙের ট্যাসেল। নকিবের সঙ্গে সঙ্গে ছুটছে আরও কয়েকজন। তাদের গায়ে সাদা ও নীল রঙের ঢিলেঢালা আলখাল্লা। এদের কারও মাথায় লাল টুপি, আবার কেউ পরেছে হলুদ রঙের পাগড়ি।

জেরিন তাকে বলে, একটু পর এ পথ দিয়ে যাবে যোদ্ধারা। তারপর দেখানো হবে উটের নাচ ও তরবারির খেলা। পরমা অস্থির হয়ে তাকিয়ে থাকে ময়দানের দিকে। মায়ের ওপর তার আর কোনো রাগ থাকে না। বরং তাঁকে নাইজেরিয়ার কানো সিটিতে নিয়ে আসার জন্য সে খুশি হয়। মনে মনে ভাবে, মা তাকে এ দেশে নিয়ে না এলে জেরিনের সঙ্গে তার কখনো দেখা হতো না। আর ঈদে আমিরের দরবারও সে দেখতে পেত না।