নিঃসঙ্গ গাছ

লোন ট্রির সামনে লেখকছবি: আরাফাত রহমান

আরাফাত বলল, ‘চলেন, আপনাকে একটা গাছ দেখাতে নিয়ে যাই।’

গাছ! ১২ কি ১৪ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে, বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুর হয়ে ১৭ ঘণ্টার বিমানযাত্রা শেষে নিউজিল্যান্ডে এসে আমি কিনা দেখতে যাব গাছ? মানছি, নিউজিল্যান্ড সবুজে ভরা একটা দেশ। তাই বলে আমিও তো সৌদি আরবের লোক নই।

এত কিছু থাকতে গাছ দেখতে যাব কেন? এটা কি বিশ্বের সবচেয়ে বড় বৃক্ষ? এই গাছে টাকা ধরে? নাকি এটাই সেই শব্দকল্পদ্রুম!

আমার কথা শুনে আরাফাত মিটিমিটি হাসে। ওর অবশ্য হাসি রোগ আছে, সেটা এতক্ষণে বেশ বুঝতে পেরেছি। বেচারার তখন চরম সংকট চলছে। চাকরিবাকরি নেই বেশ কমাস হলো। কুইন্সটাউনের মতো ব্যয়বহুল একটা শহরে তবু দাঁত কামড়ে পড়ে আছে। এই শহরের কোলের ওপরে খেলা করে পেঁজা পেঁজা মেঘ। তাই বলে মেঘ খেয়ে তো আর জীবন চলে না। আর এক মাসের মধ্যে চাকরি জোটাতে না পারলে নিউজিল্যান্ড ছেড়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে দেশে ফিরতে হবে। কিন্তু আরাফাতকে দেখে এসবের কিছুই বোঝার উপায় নেই। আমি যা বলি, তাতেই ও হাসে।

সাপ দেখাতে নিয়ে যাবে বললেও চমকাতাম। এখানে আসার আগে জেনেছি, নিউজিল্যান্ডের কোথাও নাকি সাপ নেই। কিন্তু না, ও আমাকে দেখাতে নিয়ে যাবে গাছ!

কুইন্সটাউন থেকে আরাফাতের গাঢ় নীল রঙের দুই আসনের ছাদখোলা গাড়িতে করে ক্রাউন রেঞ্জের ১ ঘণ্টার পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে যখন ওয়ানাকা লেকে পৌঁছালাম, বিশেষ দ্রষ্টব্য সেই গাছ দেখে মনে হলো, নাহ্‌, ঠিকই আছে। এই গাছ না দেখে দেশে ফিরলে একটা আফসোস থেকেই যেত।

এতটুকু পড়ে অনেকের কল্পনায় গাছটার যে ছবি ভেসে আসছে, সত্যিকারের গাছটা দেখতে একেবারেই তার উল্টো। এই লেখার সঙ্গে যে ছবিটা ছাপা হয়েছে, সেটা দেখলেই তো তোমরা বুঝবে, গাছটার উচ্চতা আহামরি তেমন কিছু নয়। গাছটার আকৃতি দেখলে ঘাড়কুঁজো এক বুড়োর কথাই মনে হবে, যে বুড়োর মাথায় চুল একেবারেই কমতির দিকে। একটু কষ্ট করলে গাছটার পাতা গুনে শেষ করা হয়তো সম্ভব।

কিন্তু তবু নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে বিখ্যাত গাছ এটিই। কেবল ইনস্টাগ্রামের খুঁজলে এই গাছের ৫০ হাজার ছবির খোঁজ মেলে। কেউ এর নাম দিয়েছে ওয়ানাকা ট্রি, স্যোশাল মিডিয়ার হ্যাশট্যাগ নামকরণ দ্যাটওয়ানাকাট্রি। তবে আমার অন্য নামটাই পছন্দ হলো—দ্য লোন ট্রি। নিঃসঙ্গ গাছ।

ওয়ানাকা লেকের দক্ষিণ প্রান্তে পাড় থেকে মোটামুটি দূরত্বে হ্রদের পানিতে একা একটি উইলোগাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। ১৯২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বিশাল এই লেকের দুই দিকে সবুজের সুউচ্চ দেয়াল হয়ে আছে অসংখ্য বড় বড় গাছ। সেই গাছগুলো থেকে দলছুট হয়ে আছে লোন ট্রি, কোনো কারণে যেন অভিমান হয়েছে বাকিদের সঙ্গে!

আরাফাত যখন আমাকে বলল, এই গাছের বয়স এক শ বছরের বেশি, চমকে উঠলাম। এতগুলো বছরেও গাছের আকার এতটুকু! পরে ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করে জেনেছি, গাছটি আসলে প্রথমে ‘গাছ’ই ছিল না। গত শতাব্দীর শুরুর দিকে বড় একটা উইলোগাছের ডাল কেটে সেটি মাটিতে পোঁতা হয়েছিল বেড়ার খুঁটি হিসেবে। কিন্তু খুঁটিজীবন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে চায়নি বলেই পরে শিকড় ছড়িয়ে অল্প অল্প কচি পাতা গজিয়ে ডালপালা মেলেছে এই গাছ। বেড়ে উঠেছে একটু একটু করে। ১০০ বছর পর এখন সে বলতে পারে, সার্থক জনম আমার!

করাতের আঘাতে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন একটি ডালের হার না মেনে আবার নতুন জীবন তৈরির একটা গল্পই গাছটিকে অনন্য করে তুলেছে। নিউজিল্যান্ডে এই গাছকে তাই দেখা হয় আশার প্রতীক হিসেবে।

২০১৪ সালে আলোকচিত্রী ডেনিস র৵াডারম্যাচার এই গাছের ছবি তুলে পুরস্কার পাওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সৌজন্যেই তা ভাইরাল হয়ে যায়। এখন এটি পরিণত হয়েছে অন্যতম পর্যটন আকর্ষণে। ভিনদেশ থেকে অনেকেই এই গাছ দেখতে আসেন। কেউ কেউ এই গাছ পেছনে রেখে বিয়েও করেন বলে শুনলাম।

আরাফাত আমারও ছবি তুলে দিল বেশ কটা। চড়া রোদেও হালকা শীত করছিল বলে আমার পরনে জ্যাকেট। চোখে সানগ্লাস। আমাকে প্রোফাইলে রেখে ক্লিক ক্লিক শব্দ তুলে চলল আরাফাতের ক্যামেরা। একটা ছবি বেশ পছন্দও হলো, যে ছবির নাম দেওয়া যায় নিঃসঙ্গ বৃক্ষ ও নিঃসঙ্গ মানব!

আমার ছবি তোলা শেষ হলে গাছটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আরাফাত চোখ বন্ধ করে থাকল বেশ কিছুক্ষণ। আশার প্রতীকের কাছ থেকে তার চরম দুর্দিনে হয়তো কিছুটা আশা খুঁজে নিতে চাইল। আমি বিরক্ত করলাম না। নিঃসঙ্গ বৃক্ষের আশাবরী সুর জানা আছে কি না জানি না, আরাফাতের কঠিন সময় আর বেশি দিন থাকেনি।

এখন সে নিউজিল্যান্ডে বেশ ভালো অবস্থাতেই আছে। সেবার টাকা বাঁচাতে আমরা দুই বঙ্গসন্তান ভাত রান্না করে গাড়িতে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাম, যেন পথে খিদে পেলে কিছু কিনে খেতে না হয়। আরাফাত অবশ্য বলেছে, এখন বেতন-টেতন বেশ ভালো পেলেও এরপর আমি নিউজিল্যান্ডে গেলে আবারও সেই একই কাজ সে করবে। নিউজিল্যান্ডের সৌন্দর্য আর বঙ্গদেশের আলুভর্তা, ডালভাত—দুটোই আস্বাদনের তৃপ্তি নাকি সমান!

পুনশ্চ ১: কিআর পাঠকদের জানিয়ে রাখি, নিউজিল্যান্ডে সেবার বেড়াতে গিয়ে পাহাড়ি পথের ধারের সাইনবোর্ডে মাঝেমধ্যেই ‘কিআ’ লেখা খুঁজে পাচ্ছিলাম। আমি তো বেশ চমকিত। বাপ রে, কিআর সুনাম এত দূরে পৌঁছে গেছে! পরে জানলাম, কিআ আসলে একধরনের বিরল তোতাপাখি, যেটা শুধু নিউজিল্যান্ডে পাওয়া যায়।

পুনশ্চ ২: এই লেখা লিখব বলে ইন্টারনেটে আরেকটু ঘাঁটাঘাঁটি করতেই একটা দুঃসংবাদ পেলাম। লোন ট্রির যে শাখাটি লেকের জল ছুঁইছুঁই দূরত্বে হেলে ছিল বলে গাছটিকে দেখতে বেশ সুন্দর লাগত, গত মার্চে কোনো এক দুর্বৃত্ত সেই শাখাটি কেটে ফেলেছে। গাছটিই কেটে ফেলার দুরভিসন্ধি ছিল কি না, কে জানে! মন খারাপের খবরটি পড়ছিলাম আর মনে মনে বলছিলাম, হে লোন ট্রি, তুমি আবার ক্ষত সারিয়ে নাও। কর্তিত শাখায় নতুন করে ডাল ছড়াক, পাতা গজিয়ে উঠুক। এর জন্য আরও ১০০ বছর লাগলেও ক্ষতি নেই!