নিশীথপুরের পথে... এক রাতে

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

ট্রেন থেকে নামতেই সন্ধ্যা পেরিয়ে গেল। অথচ দিশাপুর স্টেশনে আসার কথা ছিল দুপুরের পর। ট্রেন থেকে নেমে খানিকটা হোঁচট খেল তিনু। স্টেশনটা অন্য রকম লাগছে।

স্টেশনঘরটা বাঁশ, কাঠ আর টিন দিয়ে বানানো। একটা বাঁশের খুঁটিতে একটা হারিকেন ঝুলছে। টিমটিমে আলো। এই আলো অন্ধকার তো দূর করতে পারেই না, বরং অন্ধকারটাকে আরও ভুতুড়ে করে তোলে।

বাঁ পাশে একটা বকুলগাছ। বিশাল। গাছের চারপাশ সিমেন্ট দিয়ে উঁচু করে বাঁধানো। কেউ একজন বসে আছে ওখানে। কোনো যাত্রী? দিনে একটামাত্র ট্রেন এখান দিয়ে আসা-যাওয়া করে। রাতে আর ট্রেন নেই। তাহলে? তবে কি কেউ ওকে এগিয়ে নিতে এসেছে?

আজ ও একা এসেছে। সঙ্গে মোবাইল আছে। এখানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক নেই।

কিন্তু ওখানে কে বসে আছে? মাশুক ভাই নয় তো? অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না। সামনে এগিয়ে গেল তিনু। যে বসে আছে, তার দিকে তাকাল চোখ কুঁচকে। ভুতুড়ে অন্ধকারে অবয়বটা চেনা চেনাই তো মনে হচ্ছে। কিন্তু পাশ থেকে দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। আনমনে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। রেললাইন পেরিয়ে ওপাশের গাছপালার অন্ধকারের দিকে। মাশুক ভাই নয় তো!

আলতো করে ডাক দিল তিনু, মাশুক ভাই!

অমনি চট করে ওর দিকে ঘুরল চেহারাটা। চেহারা দেখেই চমকে উঠল তিনু। বুকের ভেতর হাতুড়িপেটা শুরু হলো। তিনু! আরেকটা তিনু বসে আছে ওর সামনে!

তিনুর এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে তিন দিন আগে। পরীক্ষার পর একাই নানাবাড়ি বেড়াতে এসেছে। দুই বছর আগে শেষবার এসেছিল। সঙ্গে তখন মা ছিলেন। পথঘাট কঠিন কিছু নয়। মা ওকে ট্রেনে তুলে দিয়েছিলেন। ট্রেন থেকে দিশাপুর স্টেশনে নেমে পঁচিশ-তিরিশ মিনিট হাঁটাপথ। পথের দুই পাশে ঘন গাছপালা। আঁকাবাঁকা রাস্তাটা কত দূর গেছে, জানে না তিনু। রাস্তার শেষটুকু এবার দেখেই ছাড়বে। মাশুক ভাইকে নিয়ে দারুণ একটা অ্যাডভেঞ্চার হবে।

ও ভেবেছিল, ট্রেন থেকে নেমেই মাশুক ভাইকে দেখতে পাবে। মামাতো ভাই মাশুক ওর চেয়ে তিন বছরের বড়। উনিও এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন। লেখাপড়াটা একটু পরই শুরু করেছিলেন। সে কারণে বয়সের তুলনায় কয়েক বছর পিছিয়ে আছেন। ওকে খুব আদর করেন।

ওর আসার খবর তো মাশুক ভাইয়ের জানার কথা। সে কারণেই ভেবেছিল, এখানে মাশুক ভাই বসে আছেন। কিন্তু...

ওই চেহারার দিকে দ্বিতীয়বার তাকানোর সাহস হলো না তিনুর। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে ও। এখন দরকার ব্রিদিং রিলাক্সেশন। শিথিলায়ন শ্বাসপ্রশ্বাস।

নাক দিয়ে ধীরে ধীরে গভীর শ্বাস নিল ও। বাতাসে ভরে নিল পুরো ফুসফুস। বাতাসটা দারুণ। ঝিরিঝিরি বসন্ত বাতাস। বাতাসে আমের মুকুলের সুবাস। সুবাসটা খুব ভালো লাগে তিনুর। কিছুক্ষণ দম আটকে রাখল ও। পুরো ফুসফুসে বাতাস ছড়িয়ে পড়ার সময় দিল। তারপর মুখ দিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস ছাড়ল। চোখ বুজে পরপর তিনবার কাজটা করল। তারপর আবার তাকাল। আর তাকিয়ে আরও অবাক হলো। এখন ও কাকে দেখছে? এ যে একেবারে অচেনা!

তিনু জানতে চাইল, ‘কী নাম তোমার?’

সমবয়সী মনে হয়েছে বলেই তুমি করে বলল তিনু।

‘মনা। তোমার নাম?’

‘তিনু। চট্টগ্রাম থেকে এসেছি। তুমি কোথায় থাকো?’

জবাবটা এড়িয়ে গেল মনা। উল্টো জানতে চাইল, ‘এখানে কোথায় এসেছ?’

‘নিশীথপুর। নানাবাড়ি। তুমি কোথায় থাকো?’

‘হাসিগাঁও।’

হাসিগাঁও! নামটা আগে কখনো শোনেনি তিনু। জানতে চাইল, ‘ওটা কোথায়?’

‘নিশীথপুরের পাশেই।’

‘এখানে কী করছ?’

‘একটা কাজে এসেছি।’

‘কী কাজ?’

বলেই তিনু বুঝল, প্রশ্নটা করা ঠিক হয়নি। কাজটা ব্যক্তিগত হতে পারে। তাই আবার বলল, ‘বলার মতো না হলে বলার দরকার নেই। এমনি জানতে চাইলাম।’

‘না, না। খুব ব্যক্তিগত নয়। আমি এসেছি একজনকে স্বাগত জানাতে।’

‘তাকে পেয়েছ? কোথায় সে? এ স্টেশনে একমাত্র আমিই নেমেছি ট্রেন থেকে। ট্রেন তো চলে গেল।’

‘নাহ্। তাকে নিয়ে আর ভাবার দরকার নেই। চলো।’

অবাক হলো তিনু। জানতে চাইল, ‘কোথায় যাব?’

‘তোমার নানাবাড়ি যাবে না? নাকি এখানেই কাটিয়ে দেবে সারা রাত?’ তারপর ফিসফিস করে বলল, ‘জায়গাটা কিন্তু ভালো নয়।’

আবার ভয় পেতে শুরু করল তিনু। ঢোঁক গিলে বলল, ‘ভালো নয় মানে?’

‘ভালো নয় মানে ভালো নয়। দ্যাখো, স্টেশনে আর কেউ নেই। স্টেশনমাস্টার তো নেই-ই, গার্ড পর্যন্ত নেই।’

আবার স্টেশনের দিকে তাকাল তিনু। খাঁ খাঁ করছে। স্টেশনঘর অন্ধকার। বাইরে কেবল হারিকেনের ওই আলো। টিমটিম করে জ্বলছে। হঠাৎ বাতাসের একটা ঝাপটা লাগল গায়ে। বেশ ঠান্ডা! ঝাঁকি দিয়ে উঠল তিনুর শরীর। নিভে গেল হারিকেনের আলো। আলো নিভে যাওয়ায় স্টেশনটা আরও ভালোমতো দেখা যাচ্ছে। এতক্ষণ টিমটিমে আলোতেই বরং ভালো দেখা যাচ্ছিল না। কোথায় যেন পড়েছিল তিনু—অন্ধকারেরও আলো আছে। কথাটার প্রমাণ পেল ও।

এই অন্ধকার নির্জন স্টেশনে বসে থাকার চেয়ে বরং নানাবাড়ির পথে নেমে পড়াই ভালো। তিনু বলল, ‘তুমি কোথায় যাবে?’

‘কোথায় আবার! হাসিগাঁও। নিশীথপুরের পাশের গ্রাম। চলো বেরিয়ে পড়ি। অন্ধকারে তোমার অসুবিধা হবে?’

‘নাহ্‌। কী অসুবিধা?’

‘শহরে থাকো। আলোঝলমল। হঠাৎ অন্ধকার গ্রামে এসে পড়েছ।’

‘কিন্তু এখানে বিদ্যুৎ থাকার কথা তো। বিদ্যুৎ নেই?’

‘দুই দিন আগে ঝড় হয়েছে। ঝড়ের পরে ৮-১০ দিন বিদ্যুৎ থাকে না। আর বিদ্যুৎ থেকেই–বা কী লাভ! কতক্ষণই–বা আর থাকে। যাওয়া–আসা করে কেবল।’

রেললাইনটা কেবল পেরিয়েছে দুজন। হঠাৎ থেমে গেল মনা। তিনুকে দেখিয়ে বলল, ‘ওটা কী!’

তিনুও তাকাল। একটা গাছের ডালে মনে হচ্ছে চারটা টর্চলাইট। দুই জোড়া উজ্জ্বল চোখ। তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। দৃষ্টিটা সুবিধার মনে হচ্ছে না। কলিজায় কামড় দিয়ে ওঠে। তিনু মনার দিকে তাকাল। মনা ওর ঠিক পেছনে। খুব ভয় পেয়েছে। ভয়ে কুঁচকে আছে। হাত দুটো মুঠো করে কপালে ঠেকিয়ে রেখেছে।

তিনু হাসল। বলল, ‘ভয় পেয়েছ মনা?’

‘হুঁ’।

‘তুমি তো গ্রামের ছেলে! তবু ভয় পেলে?’

‘জায়গাটা ভালো নয়।’

‘কী রকম খারাপ?’

আর কোনো কথা বলল না মনা। তিনুর কাছ থেকে সরে গেল।

আবার চোখ বুজে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস নিল তিনু। তারপর ধীরে ধীরে ছাড়ল। শ্বাসপ্রশ্বাস শিথিলায়ন। তারপর চোখ খুলতেই চমকে উঠল। ওর সামনে মনা। তিনু জানতে চাইল, ‘কোথায় ছিলে এতক্ষণ!’

মনার চোখজোড়া দেখতে পাচ্ছে তিনু। ভয়ে কাতর। বলল, ‘প্যাঁচাপেঁচি!’

হাসতে হাসতে বলল তিনু, ‘জানি তো। রাতের বেলা প্যাঁচার চোখ ও রকমই দেখায়। তুমি কি ভূত ভেবেছ?’

‘ভূতই তো! প্যাঁচাপেঁচি ভূত।’

‘আরে ধ্যাৎ। ভূত বলে কিছু নেই। চলো। আমার হাত ধরে হাঁটো।’

বলেই নিজের ডান হাত বাড়িয়ে দিল তিনু। আর তখনই চট করে একটু দূরে সরে গেল মনা। অবাক হলো তিনু। সেই তখন থেকেই মনা একটা দূরত্ব রেখে চলছে। কেন? কে জানে কেন?

হাতটা নামিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করল তিনু।

পথের ওপর শুকনা পাতা। সময়টা পাতা ঝরার। ঝরাপাতার ওপর দিয়ে যখন বাতাস বয়ে যায়, মনে হয় যেন পাতার ঢেউ। দেখতে দারুণ লাগে। জোরে জোরে পা ফেলে হাঁটতে লাগল তিনু। যত দ্রুত সম্ভব নানাবাড়ি পৌঁছাতে হবে।

শুকনা পাতার ওপর হাঁটলে মচমচ শব্দ হয়। সে শব্দ পাচ্ছে তিনু। কিন্তু মনার পায়ের শব্দ কোথায়? তবে কি মনা আবার হাওয়া হয়ে গেছে? ঘুরে যেই না পেছনে তাকাতে যাবে, অমনি হঠাৎ ওর সামনে কিছু একটা পড়ল ধুপ করে। সঙ্গে মচচ মচচ শব্দ। সামনে তাকাল তিনু। আরে! এটা আবার কী?

গোলাকার একটা জিনিস। ফুটবলের মতো। কিন্তু এই রাতে ফুটবল এল কোত্থেকে? সত্যিই কি ফুটবল?

কিছুটা ঝুঁকে ফুটবলের দিকে তাকাল তিনু। আর তখনই হঠাৎ ফুটবলে লেপ্টে থাকা দুটো চোখ পাঁপড়ি মেলল। এক জোড়া টকটকে লাল চোখ তাকিয়ে আছে ওর দিকে!

ধড়াস করে উঠল তিনুর বুকটা। বুকের ভেতর হাতুড়িপেটা শুরু হয়ে গেছে। ধড়াম! ধড়াম! ধড়াম!

হঠাৎ লাফিয়ে উঠল ফুটবল। যেন ড্রপ খেয়ে উঠে আসছে ওর দিকে। তীব্র বেগে। সঙ্গে সঙ্গে মাথাটা পেছনের দিকে হেলল তিনু। আর ফুটবলটা উঠে গেল ওপরে। জঙ্গল ছাড়িয়ে অনেক উঁচুতে।

ফুটবলের দিকে কড়া নজর রাখল তিনু। এটা কী! ভূত! কোন ধরনের ভূত?

ধীরে ধীরে নামতে শুরু করল লাল চোখঅলা ফুটবল। খুব ধীরে। নিজের পেট থেকে বের হওয়া সুতা বেয়ে যেমন মাকড়শা নামে, ঠিক সে রকম করে। তিনুর একবার মনে হলো, ছুট দিই। আবার মনে হলো, উঁহু। দেখা যাক কী হয়!

দাঁড়িয়ে পড়ল তিনু। লাল চোখঅলা ফুটবলের নিচে নামা দেখছে। নামতে নামতে একসময় ওর চেহারার সামনে চলে এল ফুটবল। আর এসেই থেমে গেল। বিশাল এক হাঁ করল। তারপর লম্বা একটা জিব বের করল।

আর সহ্য করতে পারল না তিনু। ডান হাত দিয়ে ঠাস করে ওটার বাঁ গালে একটা চড় বসিয়ে দিল। আর কী অবাক! চড় খেয়ে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইল মুণ্ডুটা। এবার বাঁ হাত দিয়ে আরেকটা চড় বসাল ওটার ডান গালে। তাতেও সরল না মুণ্ডুটা। এবার ফুলহাতা টি–শার্টের আস্তিন গোটাল। বলল, ‘বুঝেছি। ঘুষি না খাওয়া পর্যন্ত সরবি না।’

বলে যেই ওটার নাক বরাবর ঘুষিটা বাগিয়ে এনেছে, অমনি চোখের পলকে হাওয়া হয়ে গেল। কোথায় গেল?

এবারও কি মনা পালিয়েছে? পেছনে তাকাল তিনু। যা ভেবেছিল ঠিক তাই। মনা নেই। ওটা কি ভূত? ভূত না হলে কী! আর যদি কিছুই না হয়, তাহলে ও চড় মারল কাকে?

ঘেমে গেছে তিনু। বাঁ পকেট থেকে রুমাল বের করল। কপালের ঘাম মুছল। তারপর আবার হাঁটতে শুরু করল। এখন আর ও মনার চিন্তা করছে না। খুব দ্রুত নানাবাড়ি পৌঁছাতে হবে।

দুই কদম এগিয়েছে, অমনি একটা অস্বস্তি টের পেল তিনু। তাহলে কি পেছনে কেউ আছে? চট করে পেছনে তাকাল। নাহ। কেউ নেই। এবার সামনে তাকিয়ে যেই হাঁটতে যাবে, অমনি দেখল একটা মাথাহীন মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে। ওর অনেক সামনে। হাতে একটা ফুটবল। ফুটবলটা নিয়ে খেলতে খেলতে যাচ্ছে। ডান হাত থেকে বাঁ হাতে। বাঁ হাত থেকে ডান হাতে। লোকটার মাথা কোথায়?

হঠাৎ পাশে তাকিয়ে দেখল, মনা। ভয়ে আধমরা হয়ে আছে। তিনু জানতে চাইল, ‘ওটা কে?’

‘কবন্ধ ভূত। অনেক দিন পর মাথা খুঁজে পেয়েছে। তাই খেলতে খেলতে যাচ্ছে।’

‘এতক্ষণ আমার সঙ্গে খেলছিল, দেখেছ?’

‘ওটা দেখেই তো...’

মনাকে আর বাকিটা শেষ করতে দিল না তিনু। বলল, ‘পালিয়েছ। খুব ভালো করেছ। এরপর থেকে আর পালাবে না। আমার সঙ্গে থাকবে। দুজনকে একসঙ্গে দেখলে ভূতই উল্টো ভয় পাবে।’

বলেই আবার হাঁটতে শুরু করল। হাঁটতে একটু কষ্ট হচ্ছে ওর। পিঠের ব্যাগটা হঠাৎ বেশ ভারী মনে হচ্ছে। এতক্ষণ তো ভারী লাগেনি। হঠাৎ ভারী লাগল কেন? পেছনে তাকাল তিনু। মনা ওর ব্যাগ ধরে ঝুলে আছে।

‘এসব কী হচ্ছে মনা?’

খিকখিক করে হেসে উঠল মনা। খুব বিরক্ত হলো তিনু। চেঁচিয়ে উঠল, ‘নাম বলছি! নইলে...’

‘নইলে কী!’ বলেই আবার হাসতে লাগল মনা।

এবার ঘাড় থেকে ব্যাগ নামাতে চাইল তিনু। কিন্তু পারল না। ব্যাগটা যেন শরীরের সঙ্গে আটকে আছে। কিছুক্ষণ জোরাজুরি করল। তবু দুই কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামাতেই পারল না।

আবার দীর্ঘ একটা শ্বাস টানল তিনু। তারপর ধীরে ধীরে মুখ দিয়ে শ্বাস ছাড়ল। আর তাতেই ওর পিঠের ব্যাগটা হালকা হয়ে গেল। পাশে তাকিয়ে দেখল, ‘মাশুক ভাই।’

চমকে উঠল তিনু। ‘মাশুক ভাই! আপনি কখন এলেন?’

‘এইমাত্র। রাস্তায় কোনো সমস্যা হয়নি তো!’

‘হয়েছে। ভূতের যা উৎপাত!’

‘বলিস কী!’

‘মনাকে জিজ্ঞেস করেই দেখেন না। মনা!’

কিন্তু কোথায় মনা! চারপাশে তাকাল তিনু। মনা নেই। আবার পালিয়েছে। নিশ্চয়ই মাশুক ভাইকেও ভূত মনে করেছে মনা। এত ভিতু ও জীবনে দেখেনি।

আরেকটা বাঁক পেরোতেই একটা আলো দেখতে পেল তিনু। আর সামান্য পথ। নানাবাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে! যাক বাবা। গলা শুকিয়ে গেছে। ঘাড় থেকে ব্যাগ নামাল তিনু। ব্যাগের ভেতর থেকে পানির বোতল বের করে দুই ঢোঁক পানি খেল। তারপর মাশুক ভাইয়ের সঙ্গে হাঁটতে লাগল। এখন আর ভয় নেই। সঙ্গে মাশুক ভাই আছেন। মাশুক ভাই মনার মতো ভিতু নন। তিনু জানে।

অনেকক্ষণ ধরে মাশুক ভাইয়ের সঙ্গে হেঁটেই চলেছে। পা দুটোও আর চলছে না। জানতে চাইল তিনু, ‘আর কদ্দুর মাশুক ভাই?’

‘এই তো চলে এসেছি। ওই বাড়ি পেরোলেই তোর নানাবাড়ি।’

‘আর আপনার দাদাবাড়ি।’

বলেই একটা মুচকি হাসি দিল তিনু।

কিন্তু রাস্তাটা কোথায় ঢুকেছে! আরে! একটা বাড়ির সদর দরজা দিয়ে রাস্তাটা ভেতরে ঢুকে পড়েছে। এটা ওর নানাবাড়ি নয়। ওর নানাবাড়ির ভেতর দিয়ে কোনো রাস্তা নেই। কাছে গিয়ে আরও অবাক হলো তিনু। এটা তো বাড়ি নয়, রেলস্টেশন। রেলস্টেশনটা খুব চেনা চেনা লাগছে। আরে, এটা তো সেই রেলস্টেশন! ওই তো হারিকেন জ্বলছে। হারিকেনের টিমটিমে আলোটাই দূর থেকে দেখেছিল ও। রেলস্টেশনটা এখানে এল কী করে! আজব তো!

রেলস্টেশনের পাশে সেই বকুলগাছ। বকুলগাছের গোড়ায় সেই বসার জায়গা। আর সেই জায়গায় বসে আছে মনার মতো কেউ। এগিয়ে গেল তিনু। চেহারার দিকে তাকাতেই ওর গায়ের লোমগুলো দাঁড়িয়ে গেল। মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে এল ঠান্ডা স্রোত। মাশুক ভাই! তাহলে ওর পাশে কে!

পাশে তাকাল তিনু। ওর পাশেও তো মাশুক ভাই! দুজন মাশুক ভাই তো হতেই পারে না। আসল মাশুক ভাই কে?

কীভাবে ঘটছে এসব? কেন ঘটছে? মনে মনে আওড়াতে লাগল তিনু, এসব সত্যি নয়। সব মিথ্যা। সব মিথ্যা।

এখন কোন দিকে যাবে ও? হাঁক দিল তিনু, ‘মাশুক ভাই!’

দুই মাশুক ভাই-ই সাড়া দিলেন, ‘হুঁ?’

‘কোন দিকে যাব?’

তর্জনী তুলে দুই মাশুক ভাই দুই দিকে দেখালেন। একজন ডান দিকে, আরেকজন বাঁ দিকে।

ধাঁধায় পড়ে গেল তিনু। সত্যি আজ ও ভূতের পাল্লায় পড়েছে। এখান থেকে বেরোতেই হবে। ভূতের চক্কর ভালো কথা নয়। মনে সাহস রাখতে হবে। সাহস হারালেই বিপদ।

চেঁচিয়ে উঠল তিনু, ‘কে যাবে আমার সঙ্গে?’

এবারও দুজন একসঙ্গে বলে উঠল, ‘আমি।’

‘আমি।’

বলতে বলতেই দুজন চলে এল তিনুর দুই পাশে। কিন্তু রাস্তাটা কোথায়?

সামনে তাকাল তিনু। চোখের সামনেই রাস্তা। তাহলে রেলস্টেশনটা কোথায়? অবাক কাণ্ড! হাওয়া হয়ে গেল!

আবার চলতে লাগল তিনু। এবার খুব বেশি দূর যেতে হয়নি। আরেকটা বাঁক পেরোতেই নানাবাড়ির দেখা মিলল। রাস্তার ধারেই।

গলা ফাটিয়ে হাঁক দিল তিনু, ‘নানু! নানাজি!’

ঠাস ঠাস শব্দে খুলে গেল বাড়ির দরজা। বেরিয়ে এলেন নানা। হাতে হারিকেন। পেছন পেছন নানি। তারও পেছনে টর্চ হাতে আরেকজন। ছুটে আসছেন তিনুর দিকে। নানি আর নানাকে পেরিয়ে তিনুর কাছে এলেন। তিনুকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

আরে! মাশুক ভাই!

তাহলে সঙ্গে যারা এল, তারা কে? পেছনে তাকাল তিনু। কেউ নেই।

নানা জানতে চাইলেন, ‘তোমার সঙ্গে আর কেউ এসেছে তিনু?’

কী বলবে তিনু? যদি বলে আর কেউ সঙ্গে আসেনি, তাহলে মিথ্যা বলা হবে। আর যদি বলে সঙ্গে কেউ এসেছিল, তাহলেও কি সত্যি বলা হবে?

কী বলবে তিনু?