পরীক্ষায় যত কাণ্ড হলো

অলংকরণ: সব্যসাচী চাকমা

প্রায় দুই বছর পর পরীক্ষা দিলাম। কী একটা যে হলো না বললে বিশ্বাস করবে না। প্রথমেই যেটা হলো, অ্যাডমিট কার্ডের কথা একদম ভুলে গেলাম। স্কুলে গিয়ে দেখি সবাই অ্যাডমিট এনেছে, আমিই একমাত্র আনিনি! অগত্যা দিলাম এক দৌড় বাসার দিকে (আমার বাসা আবার স্কুলের কাছেই)। ওপরে ওঠার সময় সিঁড়িতে পা বেঁধে খেলাম এক হোঁচট। গেলাম পড়ে। কথায় বলে বিপদ একা আসে না, সাঙ্গপাঙ্গ সঙ্গে নিয়েই আসে। এলও। সিঁড়িতে পড়ে চশমা ভাঙল, হাতের স্কেল ভাঙল, ঘড়ির কাচ ফাটল। ভাগ্য ভালো খুব একটা ব্যথা পাইনি। বাসায় গিয়ে প্রথমে এক গ্লাস পানি খেলাম। মাথাটা ঠান্ডা করা দরকার। শুনেছি, সব সময় ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে হয়। তারপর অন্য একটা স্কেল, অন্য চশমা, অ্যাডমিট কার্ড আর এক বোতল পানি নিয়ে দিলাম উল্টো ছুট। গিয়ে দেখি, এখনো বেল পড়েনি। যাক বাবা! খুব বাঁচা বেঁচে গেছি। একটু পর স্যার খাতা নিয়ে এলেন। খাতা দিলেন। বেল পড়লে প্রশ্ন‌ দেবেন। আমি নামধাম লিখে বসে আছি। প্রশ্ন আসবে, তারপর একেবারে ফুল স্পিডে, সুপারসনিক গতিতে হাতের ইঞ্জিন চালাতে শুরু করব। সুপারসনিক, হাইপিরসনিক না হলে আর রক্ষে নেই। যে কম সময়! তো, হঠাৎ একটু পেছনে তাকিয়ে দেখলাম শাহরিয়ার মার্জিন করছে! আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। মার্জিন! মার্জিনের কথা তো বেমালুম ভুলে গেছি! খাতা তো খুলেও দেখিনি! ২ বছর পরীক্ষা না দেওয়ার ফল। এখনই তো প্রশ্ন দেবে। সত্যিই ভুলে গেছিলাম।

আমি সাইক্লোনের স্পিডে মার্জিন করা শুরু করলাম। মার্জিন হলো তেড়া-বেড়া-ছেঁড়া-ছেঁড়া। এক পৃষ্ঠার মাঝখান দিয়ে চলে গেল। একটু পর প্রশ্ন দেওয়া হলো‌। আমার অবস্থা তখন সত্যিই ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো! হাত তো নড়ছে না একটুও! শীতে ঠান্ডায় জমে গেছে একেবারে। নাম-রোল লেখার সময় একটু একটু হয়েছিল, ভেবেছি ও কিছু না, ঠিক হয়ে যাবে।‌ কিন্তু এ যে চিরস্থায়ী। আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম। ফেল! বেতের বাড়ি! স্যার-ম্যাডামদের তিরস্কার! পাশের বাসার আন্টির কথা শোনানো! আত্মীয়দের বকাঝকা! আর আব্বু-আম্মুর কথা, সেটা কল্পনা করতেও আমার ভয় হলো! চোখে শর্ষে ফুল দেখতে লাগলাম। তা–ও একটু একটু করে লিখেছিলাম। একসময় স্যার এলেন সিগনেচার করতে। ‘এই, রোল লেখিস নাই কেন?’ রোল লেখি নাই! ‘শিফট কই?’ শিফটও নাই! ‘আশ্চর্য! বিষয়টা পর্যন্ত নাই!’ অ্যা! বিষয়ও নাই! আমি তো আজ শেষ! এক্কেবার শেষ! লিখব না কাঁদতে বসব! খোদা বাঁচাও, বাঁচাও আমায়! একটু পরেই না হয় কাঁদব, এখন লিখি। লিখলাম। যা পারলাম লিখলাম। যা পারলাম না, আন্দাজে লিখলাম। বন্ধুদের কাছ থেকে দেখে নিয়ে লিখলাম। সেটা করতে গিয়ে দেখি সামনে থেকে খাতা নাই! আমার তো মাথায় হাত! সময় আছে মাত্র ২৫ মিনিট। লেখা আছে ১ ঘণ্টার মতো। আর যেটাই লিখি না কেন, লেখা আর হয় না, পৃষ্ঠা আর ভরে না। ৫ মিনিট পর অনেক কষ্টেসৃষ্টে স্যারের কাছ থেকে খাতা নিলাম। আমি যাকে বলে একেবারে... একেবারে...জান-প্রাণ লড়িয়ে দিয়ে লিখলাম। জান-প্রাণ নড়ে যাবে আর বেঞ্চ নড়বে না? বেঞ্চ নড়ে পানির বোতল পড়ে গেল। তুলতাম না, কিন্তু মন বলল, ঠান্ডা, মাথা ঠান্ডা, স্মরণ, মাথা ঠান্ডা। বোতলটা তুলতে গিয়ে মাথায় ঠোক্কর খেয়ে মাথা ফুলিয়ে ফেললাম। তা–ও পানি খেলাম ঠান্ডা মাথায়। আবার লিখলাম। লিখলাম। লিখলাম আর লিখলাম। তা–ও লিখে শেষ করতে পারলাম না। কার মুখ দেখে আজ উঠেছিলাম! আল্লাহ! তুমিই একমাত্র আজকে বাঁচাতে পার।

বেঞ্চ থেকে কলম-স্কেল তুলতে গিয়ে ছিপি খোলা পানির বোতলে হাত লেগে গেল। পানি গড়িয়ে পড়ল আমার প্যান্টে। পড়ল তো পড়লই, একেবারে ওই জায়গাতেই পড়ল। রুম থেকে বেরিয়েই বুঝলাম এর খেসারত খুব ভালোভাবেই দিতে হবে। বন্ধুরা সবাই যাকে বলে একেবারে হইহুল্লা শুরু করে দিল। ‘নাইম প্যান্টে হিসু করে দিয়েছে’, ‘প্রশ্ন দেখে ভয় পেয়েছে...।’ আমার মানসম্মান একেবারে ধূলিসাৎ হয়ে ধুলায় লুটোপুটি খেতে লাগল। পুরো স্কুলে মুহূর্তে খবরটা ছড়িয়ে পড়ল। পারলে সাংবাদিকদের দিয়ে ওরা বড়সড় একটা নিউজ করে দেশের সব টিভি চ্যানেলে একযোগে প্রচার করে। আমি দৌড়ে কোনোমতে পালিয়ে, সম্মান বাঁচিয়ে, ক্লিপবোর্ড দিয়ে সামনের অংশ ঢেকে, ছুটতে ছুটতে বাসায় এসে বাথরুমে ঢুকে পড়লাম। আর জীবনে পরীক্ষার হলে পানির বোতল নিয়ে যাব না! সে মাথা গরমই থাকুক আর ঠান্ডাই থাকুক। কচুকাটা করি ঠান্ডা মাথার!

লেখক: শিক্ষার্থী, শেরপুর সরকারি ভিক্টোরিয়া একাডেমি, শেরপুর