পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা

ছোটবেলায় সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে ভূগোল অংশের দেশের মানচিত্রগুলো বেশ আকৃষ্ট করত। বেশ আগ্রহ নিয়েই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম আর হাত বোলাতাম মানচিত্রের ওপর। দেশ ভ্রমণের একটা সুতীব্র ইচ্ছা মনের গহিনে লালন করছিলাম তখন থেকেই। পরে সময়-সুযোগ মিলে গেল দেশের এ প্রান্ত-ও প্রান্ত সাইকেলে চক্কর দেওয়ার। সাইকেল চালানোর চেয়েও যেটা বেশি উপভোগ করতাম, সেটা হলো মানুষের সঙ্গে ভাব বিনিময়। সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছি হয়তো চলতি পথে এমন কোনো টং দোকানে বিরতি নিলাম, যেটা হয়তো আমি কোনো দ্রুতগতির যানবাহনে চড়ে গেলে কখনোই হয়ে উঠত না। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে নিজেদের গল্প বলার পাশাপাশি উন্মুখ হয়ে থাকতাম সেসব মানুষের গল্প শোনার জন্যও। তখন থেকেই মাথায় ভূত চেপে বসেছিল এমন কোনোভাবে যদি ভ্রমণ করা যেত, যাতে লোকের সঙ্গে ভাব বিনিময়ের সুযোগটা আরও বেশি মেলে।

পদব্রজে দেশ ভ্রমণের আইডিয়াটা আসে তখনই। এর চেয়ে ধীরগতিতে দেশ ভ্রমণের উপায় তো আর আমার জানা নেই। মাঝে পাহাড়-পর্বত চড়া নিয়ে বেশি মেতে থাকায় পদব্রজে দেশ ভ্রমণের পরিকল্পনার পরি বারবার উড়ে গিয়ে কল্পনাটা রয়ে যাচ্ছিল। গত জুনে চাকরি ছাড়ার সময়েই ঠিক করে রেখেছিলাম এ বছরটাই মোক্ষম সময়। মাস দুয়েক ভারতের বিভিন্ন পাহাড়ে কাটিয়ে দেশে ফিরেই তোড়জোড় শুরু করে দিলাম বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত এই ভ্রমণের। দিন পনেরো লাগল ঠিকঠাক রুট প্ল্যান করতে। বাকি থাকে চলতি পথের থাকা-খাওয়ার মতো বিষয়গুলো। যেহেতু এই ভ্রমণটা একান্তই আমি নিজেই করতে চেয়েছি, সেহেতু স্পনসরের পেছনে ছোটার ইচ্ছা কখনোই ছিল না। কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষীর পরামর্শে গেলাম চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের কাছে। উদ্দেশ্য, তাঁর কাছ থেকে একটা প্রত্যয়নপত্র নেওয়া, একই সঙ্গে আবাসনের ব্যাপারে সরকারি ডাকবাংলোগুলো পাওয়া যায় কি না, সেটাও দেখা। নিচতলার ইনফরমেশন ডেস্ক ঘুরে ওপরতলায় তাঁর কামরা পর্যন্ত পৌঁছাতেই সময় লেগে গেল এক সপ্তাহ। আমার নিয়ে যাওয়া আবেদনপত্রটি পড়ে দেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব না করে বেশ রূঢ়ভাবেই জানালেন, এ ধরনের কোনো সহযোগিতা তিনি করতে পারবেন না। আমি একলা চলো রে নীতিতে পথচলাই শ্রেয় মনে করে যাত্রাপথে আবাসনের ব্যাপারে সাহায্য নিলাম বন্ধুবান্ধবের। আমার মেডিকেল কলেজের সহপাঠী, সিনিয়র-জুনিয়ররা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে দেশজুড়ে। চাকরিসূত্রে বন্ধুবান্ধবও আছে দেশের আনাচকানাচে। আর আমাদের দেশের ডাক্তার, ট্রেকিং-ট্রাভেলিং, সাইক্লিং, অ্যাডভেঞ্চার কমিউনিটির লোকজন তো আছেই। আবাসনের দায়িত্বটা ওদের কাঁধে সঁপে দিয়েই যাত্রার বাকি খুঁটিনাটি প্রস্তুতি নিতে লাগলাম।

এরই অংশ হিসেবে নিয়মিত দীর্ঘ পথ হাঁটছিলাম সুযোগ পেলেই। এর মাঝেই সতীশ আর আমি একদিন চট্টগ্রাম থেকে হেঁটে চলে গেলাম কাপ্তাই। ওই দিন ৪২ কিলোমিটার পথ হাঁটলেও তেমন কোনো অসুবিধা হয়নি। নিজের আত্মবিশ্বাসটা বাড়িয়ে দিয়েছিল সেদিনের সেই হাঁটা। আমার পদযাত্রার মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশ দেখা আর একই সঙ্গে চলতি পথে লোকের সঙ্গে ভাব বিনিময়। আরেকটা বিষয় নিয়ে আমার বহুদিন ধরেই কাজ করার ইচ্ছা ছিল। সেটা হলো সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে কাজ করা, সেটা যত ক্ষুদ্র পরিসরেই হোক না কেন। এ বিষয়টা নিয়ে আমি প্রথম প্রভাবিত হই আমার এক বিদেশি বন্ধুর দ্বারা। হিমালয়ের পাহাড়ে গিয়ে তার সঙ্গে পরিচয়। হোয়াটসঅ্যাপে মাঝেমধ্যে এ–বিষয়ক লিংক পাঠাত সে। একদিন ওর পাঠানো একটা প্রতিবেদন পড়ে মোটামুটি শিউরে ওঠার দশা। জিনিসটা ক্ষতিকর সে সম্পর্কে ধারণা ছিল, তবে এর ক্ষতিকর প্রভাব যে এতখানি হতে পারে, সেটা আমার দূরতম কল্পনাতেও ছিল না। তখনই মনে মনে ঠিক করেছিলাম পায়ে হেঁটে ৬৪ জেলা ভ্রমণে আমি এই বিষয়টা নিয়ে কাজ করব। হোক না সেটা একদম ক্ষুদ্র পরিসরে। এর মধ্যেই যাওয়ার দিন ঘনিয়ে আসছিল। ২৩ অক্টোবর আমার যাত্রা শুরুর স্থান পঞ্চগড়ের উদ্দেশে রওনা দিলাম চট্টগ্রাম থেকে। বাসস্ট্যান্ডে বিদায় জানাতে এল মিনহাজ, অপরাজিতা আপু, লাভলু ভাই, ফারাবী। অল্পের জন্য দেখা হলো না দেবুদা আর সাকিবের সঙ্গে। ২৪ অক্টোবর থেকে হাঁটা শুরুর পরিকল্পনা থাকলেও সেদিন দেরিতে পঞ্চগড় পৌঁছানোতে আর পদযাত্রা শুরু করা সম্ভব হয়নি। একা একা এত বড় একটা অভিযান করা নিয়ে আমার মনের মধ্যে দারুণ ভালো লাগা কাজ করছিল। একই সঙ্গে অনাগত অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে খানিকটা যে উৎকণ্ঠিত ছিলাম না, তা–ও কিন্তু নয়।

এক রাস্তা থেকে অন্য রাস্তা, এক গ্রাম পেরিয়ে পাশের গ্রাম, এক জেলা ছাড়িয়ে আরেক জেলা—এ যেন শুধুই ছুটে চলার গল্প। আমার পুরো পরিকল্পনাটা ছিল প্রায় ৮০ দিনের।

২৫ অক্টোবর পঞ্চগড় শহরের ডিস্টিলারি মোড়ের রকি ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে বেরোলাম কুয়াশা ফিকে হয়ে আসার আগেই। ‘পঞ্চগড় ০ (শূন্য) কিমি’ লেখাটা শহরের চৌরঙ্গী মোড়ের কাছেই। আমার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু এখান থেকেই। প্রথম দিন থেকেই আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী গুগল ম্যাপ এবং এন্ডোমন্ডো অ্যাপ। পথ বাতলানো, শর্টকাটের সন্ধান দেওয়ার ভার ন্যস্ত ছিল গুগল ম্যাপের ওপর। আর হাঁটাসংক্রান্ত যাবতীয় রেকর্ড, দিন শেষে হাঁটার হিসাব-নিকাশ নিয়ে পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিলাম এন্ডোমন্ডোর ওপর। কাকডাকা ভোরে এক ভ্যানওয়ালা দয়াপরবশ হয়ে একটা ছবি তুলে দিতেই আমার পা চালানো শুরু। এর পরের সময়গুলো শুধুই অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হওয়ার পালা। এক রাস্তা থেকে অন্য রাস্তা, এক গ্রাম পেরিয়ে পাশের গ্রাম, এক জেলা ছাড়িয়ে আরেক জেলা—এ যেন শুধুই ছুটে চলার গল্প। আমার পুরো পরিকল্পনাটা ছিল প্রায় ৮০ দিনের। এর মধ্যে পরিকল্পনামাফিক আমাকে হাঁটতে হতো ৭১ দিন আর বাকি দিনগুলো বরাদ্দ ছিল বিশ্রামের জন্য। প্রথম তিন-চার দিন হাঁটতে গিয়ে বেশ বেগই পেতে হচ্ছিল। বিশেষ করে চতুর্থ দিনে আমি যথেষ্ট পরিশ্রান্ত ছিলাম। তার ওপর সেদিনই পায়ের তলায় বিশাল দুটো ফোসকা প্রতিমুহূর্তে ব্যথার অনুভূতি জাগিয়ে তাদের উপস্থিতির কথা জানান দিচ্ছিল। তবে পঞ্চম দিন থেকেই আমি পুরোপুরি ফিট। শারীরিক ক্লান্তিগুলো খুব বড় করে দেখতে হয়নি এরপর থেকে। শরীর পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ায় পুরো যাত্রাপথে আমাকে এক দিনও বিশ্রাম নিতে হয়নি। শরীর ফিট থাকায় ৭১ দিনের হাঁটাকে ৬৪ দিনে নামিয়ে আনতেও খুব বেশি ঝামেলায় পড়তে হয়নি আমাকে। এই ৬৪ দিনে আমি মোট পাড়ি দিয়েছি ২৭০১ কিলোমিটার পথ।

পুরো অভিযানে বাংলার রূপ-রস-গন্ধে হয়েছি বিমোহিত। মানুষের অফুরান ভালোবাসা চলার পথের সঞ্জীবনী শক্তি হিসেবে তো ছিলই। চলতি পথে আমি যে শুধু মহাসড়ক ধরে পথ চলেছি এমন নয়। দেশের আঞ্চলিক মহাসড়ক থেকে শুরু করে খেতের মাঝখানের কাদামাখা আইল—সব ধরনের পথেই হাঁটার অভিজ্ঞতা হয়েছে। মহাসড়কে হাঁটার চেয়ে ছোট রাস্তায় হাঁটাটা বেশি টানত। অতি ব্যস্ত রাস্তায় দ্রুতগামী যানবাহনের হর্ন শুনে হাঁটার চেয়ে ছায়া সুনিবিড় রাস্তায় হাঁটাটা অধিক উপভোগ্য ছিল আমার কাছে। রাস্তার পাশে অবিরত ধানখেত দেখে চোখ জুড়িয়েছি। আকাশমণি, কড়ই কিংবা ইপিল ইপিলগাছে ছাওয়া রাস্তায় হেঁটে বেড়িয়েছি আপনমনে। যশোর-খুলনা অঞ্চলের হরেক রকমের সবজির খেতে চোখ রাখতে রাখতে ভুলেছি পথের ক্লান্তি। তুলসীমালা ধানের সূক্ষ্ম গন্ধ মনের মণিকোঠরে আছে শেরপুর অঞ্চলের ট্রেডমার্ক হিসেবে। গাছাপালাবিহীন অনেক রাস্তায় হাঁটতে লেগেছে প্রচণ্ড বিরক্তি। মাথার ওপর সবুজের চাঁদোয়া তৈরি করে ছায়া প্রদান করে সেই রাস্তাই হয়তো মন ভুলিয়েছে খানিকটা পরে। পুরো বর্ষাপানিতে গা ডুবিয়ে রেখে সদ্যই মাথা তোলা সুনামগঞ্জের রাস্তা ধরে হেঁটেছি হাওরের মাঝে। এ দেশের মানচিত্রে শিরা-উপশিরার মতো ছড়িয়ে আছে অসংখ্য নদ-নদী। মোহনীয় নামের এসব নদ-নদী সঙ্গ দিয়ে গেছে আমায় যাত্রাপথজুড়ে। উত্তরবঙ্গের মরা নদীগুলো দেখে খানিকটা মর্মাহত হলেও সে দুঃখ ঘুচিয়ে দিয়েছে দক্ষিণবঙ্গের নদীগুলো। পথচলতি রাস্তার ধারে অযত্নে পড়ে থাকা শিউলি ফুল থেকেও আমি খুঁজে নিয়েছি আনন্দ। বিলের পর বিলজুড়ে ফুটে থাকা পদ্ম চলার পথের গতিকে করেছে শ্লথ। রাস্তার ধারের ইলেকট্রিক পোল কিংবা ব্যানারে উদ্ভট বানান দেখে হেসে নিয়েছি একচোট। লোকের বিস্ময়ভরা চাহনির সঙ্গে খাপ খাইয়ে পাড়ি দিয়েছি কিলোমিটারের পর কিলোমিটার পথ। উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের অনেক রাস্তাই ব্যবহৃত হতে দেখেছি ধান শুকানোর জায়গা হিসেবে। গাড়ির সংখ্যা সেসব রাস্তায় এতই কম যে সেখানে গাড়ি চলাচলটা গৌণ। রাস্তার পাশাপাশি সমান্তরালে এগোনো রেললাইন পেয়েছি অনেক জেলাতেই। হেঁটেছি দুই পাশে সবুজ ঘাসের মাঝে এক ফালি পায়ে চলার রাস্তাতেও। নরম ঘাসে পা ডুবিয়ে পা চালিয়েছি বারকতক। রাস্তার ধারের কারেন্ট বাবার মাজার কিংবা তুফান ঘটকের অফিস এই দীর্ঘ পথচলায় এনে দিয়েছে বৈচিত্র্য। কিছু রাস্তায় যথেষ্ট ভুগতে হয়েছে ধুলাবালুর কারণে। অনেক কুয়াশাছন্ন সকালই ছিল আবছা। এই ধুলাবালুর কারণে অনেক ভরদুপুরই ছিল আবছা আবছা দৃশ্যমান। নাক ডুবিয়ে প্রাণভরে শ্বাস নিয়েছি গ্রামের রাস্তা ধরে পথ চলতে চলতে। বিপরীতভাবে অনেক রাস্তাই পেরোতে হয়েছে নাক-মুখ চেপে। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হয়েছে এই পদযাত্রায়। এই দেশের মাটিতেই বাংলাকে সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখেছি নীলফামারীর সৈয়দপুরে। পাবনার ঈশ্বরদীর ঈদে মিলাদুন্নবী পালনের আড়ম্বর দেখে হয়েছি অবাক।

পথচলতি অনেকেই জিজ্ঞেস করেছেন একা হাঁটতে আমার বিরক্ত লাগছে কি না। নিজের সঙ্গ আমার নিজের কাছে যথেষ্ট উপভোগ্য বলে আমি কখনোই বিরক্ত বোধ করিনি। তা ছাড়া প্রতিটি দিনই ছিল আমার কাছে নতুন। প্রতিটি দিন আমার ঘুম ভাঙত নতুন কোনো জেলায়, নতুন কোন মানুষের সান্নিধ্যে। চারপাশের এত বৈচিত্র্য থাকাতে একমুহূর্তের জন্যও একঘেয়েমিতে ভুগিনি আমি। রাস্তায় হাঁটার সময় অনেকে পাগল ঠাওরেছেন, কেউবা ভেবে নিয়েছেন সন্ন্যাসী। বিচিত্র বেশভূষার জন্য বিদেশি ভেবে অনেকে কথোপকথন শুরু করেছেন ইংরেজিতে। পরে আমার মুখে বাংলা শুনে কথা বলার আগ্রহ হারানো লোকের সংখ্যাও কম নয়। গ্রামের মাটির রাস্তা ধরে হাঁটার সময় ভারী ব্যাকপ্যাক দেখে কীটনাশক কোম্পানির লোক ভেবে ভুল করেছেন কৃষকেরা। বিকাশের সিম বিক্রি করি কি না, এমন উদ্ভট প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি লক্ষ্মীপুরে। যাত্রাপথে অনাহূত বিড়ম্বনা থেকে বাঁচতে আমার দীর্ঘদিনের লালিত চুল-দাড়িও ছেঁটেছি অনেকখানি। রাস্তায় গাড়ি থাকতেও আমি হেঁটে যাচ্ছি কেন? লোকে বেশি কৌতূহলী হতো এ কারণেই। এমনও হয়েছে কয়েক জায়গায় লোকে মোটামুটি জোর করেই উঠিয়ে দিচ্ছিল গাড়িতে। দিনাজপুরের কান্তজিউ মন্দিরের কাছে এক লোক আমাকে অনেকক্ষণ ধরে হাঁটতে দেখে বলেই বসেছিলেন, ‘আপনার মনে হয় টাকাপয়সার সমস্যা? আমি টাকা দেব?’ অনেকেরই ধারণা ছিল, হাঁটার জন্য নিশ্চয়ই সরকার আমার আর্থিক সাহায্য দিচ্ছে! না হলে এমন কষ্টসাধ্য কাজ কে করতে যাবে! রংপুরে আমার ওই দিনের সঙ্গী মণ্ডল ভাইয়ের আর্মি ছাঁটের চুল আর ক্যামোফ্লেজ টি–শার্ট দেখে এক কিশোর জিজ্ঞেস করে বসেছিল, হাঁটাটা আমাদের শাস্তির অংশ কি না। কল্লাকাডনি বলে সন্দেহ করার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এনজিও কর্মী ঠাওর করে উঠান বৈঠকে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিতে চেয়েছিল এক কিশোর।

পুরো যাত্রাপথে আমি আসলে পুরোপুরি একাও ছিলাম না। অনেক জেলাতেই আমি সঙ্গী হিসেবে পেয়েছি সেসব জেলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বন্ধুদের। নিজ জেলা থেকে হাঁটা শুরু করে পাশের জেলা পর্যন্ত হেঁটেছেন অনেকেই। খোকনদা, ফরহান ভাই, আরিফ ভাই, তসলিম ভাইয়েরা তাঁদের নিজেদের ব্যস্ত সময় থেকে সময় বের করে আমার সঙ্গে বেশ কদিন হেঁটে সঙ্গ দিয়ে গেছেন। ঘণ্টাখানেকের জন্য হাঁটতে এসে পুরো দুদিন হাঁটার সঙ্গী হিসেবে পেয়েছি আশরাফুলকে। ক্লাস নাইনপড়ুয়া নিসর্গকে যেমন পেয়েছি চলার পথের সাথি হিসেবে, ঠিক একই রকম উদ্দীপনা নিয়ে আমার সঙ্গে হেঁটেছেন বেশ কবছর আগেই বয়সের অর্ধশতক পেরোনো মুজিব ভাই। রানিংকে ধ্যানজ্ঞান করা ফরহান ভাই হাঁটতে এসেও ফাঁকে ফাঁকেই নিয়েছেন দৌড়ে। এসব পরিচিত মুখ চলতি পথে দিয়েছে অবিরাম শান্তি। আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, দিন শেষে আমার গন্তব্যে পৌঁছে পুরো দিনের রোজনামচা লেখা। ক্লান্তি-শ্রান্তি কিংবা বন্ধুদের আড্ডায় পড়ে বেশ কবারই রোজনামচা লেখাটা পড়ে গিয়েছিল হুমকির মুখে। তবে যাত্রার শেষ দিন পর্যন্ত ঠিকঠাকভাবে রোজনামচা লিখে সেটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপলোড করে গেছি ব্যতিক্রম ব্যতিরেকেই।

হরেক রকমের মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে পুরো যাত্রাপথেই। আমার শুধু ইতিবাচক মানুষের সঙ্গেই দেখা হয়েছে খুব সম্ভবত। হাঁটার সঙ্গী কিংবা বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় আমার হোস্টদের উষ্ণ ব্যবহার বাড়ির কম্ফোরট জোনের কথা মনে করিয়েছে বারবার। এর মধ্যে দু-চারজনের কথা না বললেই নয়। নীলফামারীর সাজিদ ভাই আমার পূর্বপরিচিত ছিলেন না। আমার পরিচিত এক বড় ভাইয়ের বন্ধু তিনি। মাত্র এক দিনের পরিচয়ে মানুষ কতটা আপন করে নিতে পারে, তা এই ভদ্রলোককে না দেখলে আমি বুঝতাম না। আগের দিন সন্ধ্যায় যাঁর সঙ্গে আমার জীবনে প্রথম দেখা, পরদিন সকালে বিদায় দেওয়ার সময় সেই লোকই বাঁধলেন গাঢ় আলিঙ্গনে। অশ্রুসজল নয়নে কথা দিলেন বাকি জীবনে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার যথাসম্ভব কম করবেন তিনি। ঠাকুরগাঁওয়ের রুবাইয়া আপুর বাবা আমার পদযাত্রা নিয়ে ছিলেন প্রচণ্ড আগ্রহী। প্রায় দিনই ফোন করে অতিক্রান্ত পথের খোঁজ নিতেন তিনি। মোস্তফা মামা, সাজু ভাই আর লালন ভাই বাকি জীবন জয়পুরহাটকে না ভোলার সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। অন্য সূত্রে পরিচয় হওয়া এই মানুষগুলোর সংস্পর্শে যতক্ষণ ছিলাম, মনেই হয়নি আমি তাঁদের চেনা গণ্ডির বাইরের কেউ। মৌলভীবাজারে প্রিয়াংকাদি-তীর্থদার বাসায় যাওয়াটা আমার জন্য ঘরে ফেরার মতোই ব্যাপার। শ্রেয়ান আর তিস্তার সংস্পর্শে উজ্জীবিত হয়েছি নিজেও। ঢাকার উত্তরায় বান্ধবী শবনম তার ডাইনিং টেবিল সাজিয়ে ফেলেছিল আমার পছন্দের সব খাবারে। দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বন্ধুদের সাক্ষাৎ চলতি পথে আমাকে দিয়েছে পরমানন্দ। আমাকে আতিথেয়তা দিতে অন্য জেলার কর্মস্থল কিংবা বাসস্থান থেকে নিজ জেলায় চলে এসেছিলেন পলাশ, দিগন্তসহ আরও বেশ কজন। জামালপুর মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী নাহিদের অসম্ভব উষ্ণ আচরণের জন্য বাকি জীবন জামালপুর আমার কাছে নাহিদপুর হয়েই হৃদয়ে থাকবে। শীতের ভোরে নিতান্তই স্বল্পপরিচিত লোকজন বিছানার ওম ছেড়েছেন আমাকে না খেতে দিয়ে বেরোতে দেবেন না বলে। নিজ নিজ অঞ্চলের সেরা খাবারটি খাইয়ে তবেই ছেড়েছেন পথে। মিষ্টি খেতে পছন্দ করা আমার জন্য এই পদযাত্রা ছিল দারুণ উপভোগ্য। রাস্তার ধারের অখ্যাত-বিখ্যাত হরেক রকমের মিষ্টি চেখেছি এই কদিনে। সঙ্গে বিভিন্ন জেলার সিগনেচার আইটেমগুলো তো ছিলই। চুকনগরের চুই ঝাল, সাতক্ষীরার পারশে মাছ কিংবা ধনবাড়ীর মেন্দার কথা মনে থাকবে বহুদিন। মহাস্থানগড়ের কটকটি, মেলান্দহের চাচির মালাই চা, নরসিংদীর নেপাল ঘোষের মিষ্টির স্বাদ যেন এখনো লেগে আছে মুখে।

দেশ দেখার সঙ্গে সঙ্গে চলছিল আমার বাকি দুই উদ্দেশ্য সাধনের কাজও। মানুষের সঙ্গে ভাব বিনিময় এবং সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করা।

দেশ দেখার সঙ্গে সঙ্গে চলছিল আমার বাকি দুই উদ্দেশ্য সাধনের কাজও। মানুষের সঙ্গে ভাব বিনিময় এবং সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করা। এর জন্য আমি মূলত বেছে নিয়েছিলাম স্কুল-কলেজগুলোকে। যাত্রাপথের স্কুল-কলেজগুলোতে যাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া সহজে করতাম না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দারুণ সাড়া পেয়েছি ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষকদের কাছ থেকে। উষ্ণ অভ্যর্থনার সঙ্গে মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন আমার কথা। এর ব্যতিক্রম ঘটনাও ঘটেছে একবার। পাবনায় এক স্কুলের শিক্ষকের তীব্র শীতল আচরণও মনে থাকবে অনেক দিন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক কী, সেটা সম্পর্কে শ্রোতাকে ছোট্ট একটা ধারণা দিয়েই আমাকে কথা বলা শুরু করতে হয়েছে। পুরো পদযাত্রায় আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি, এই বিষয়টা নিয়ে যত বেশি সম্ভব মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়। এর ক্ষতিকর দিকগুলো বিশদভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। পরিবেশগত ঝুঁকি, স্বাস্থ্যঝুঁকি, সামুদ্রিক প্রাণের ঝুঁকি ইত্যাদি বিষয়ে জানানোর চেষ্টা করেছি তাদের। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মাঝে সচেতনতা ছড়িয়েই ক্ষান্তি দিইনি আমি। যে জেলায় যেতাম, সেই জেলার সামাজিক সংগঠনগুলো মাঝেমধ্যেই আয়োজন করত সান্ধ্য–আড্ডার। সেই সান্ধ্য–আড্ডাগুলো ছিল আমার জন্য দারুণ প্ল্যাটফর্ম। তবে কিছু জেলা কিংবা উপজেলার ক্ষেত্রে দিন শেষে এত লম্বা সময় হাঁটার ক্লান্তি গ্রাস করায় কিংবা রাতের দিকে আমার গন্তব্যে পৌঁছানোতে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কোনো আড্ডায় যাওয়া অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হতো না। সে ক্ষেত্রে আমি বেছে নিতাম যে বাড়িতে আমি আতিথেয়তা নিতাম, সেই বাড়ির লোকজনকে। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি আমার মেসেজটা একজন লোকের কাছে পৌঁছানোর পর তার দ্বারা একটা সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক কম ব্যবহার হলে সেটাই আমার সার্থকতা। সবচেয়ে পীড়া দিত কোনো জেলা সদর বা উপজেলা সদরের শেষ সীমায় ওই জেলা বা উপজেলার ময়লার ভাগাড়ের ভয়াবহ অবস্থা দেখে। নাকে শ্বাস চেপে সেসব জায়গা পার হতে হতে ভাবতাম বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আমরা কতটা পিছিয়ে আছি। সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ সড়কে একটা প্রকল্প দেখে বেশ চমকিত হয়েছিলাম। মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলছিল সেখানে। মেডিকেল বর্জ্য এই দেশের অন্যতম অবহেলিত বস্তু। সেই বিষয় নিয়ে টনক নড়েছে দেখে ভালোই লাগল।

প্রকৃতির বিরূপতার মধ্যেও পড়েছি বার কয়েক। পদযাত্রার প্রথম দিনেই ঠাকুরগাঁও অভিমুখে যাত্রাকালীন বাগড়া বসিয়েছিল বৃষ্টি। পরবর্তী সময়ে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে বৃষ্টি সইতে হয়েছিল আরও একটা দিন। তবে এর জন্য আমার পথচলা থেমে থাকেনি এক দিনের জন্যও। এই পদযাত্রার খরচটা আমি কীভাবে জুগিয়েছি, সেটা নিয়েও অনেক কৌতূহল ছিল অনেকের। পায়ে পায়ে পথ চলাকালীন যেহেতু আমি সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানোর জন্য গণসচেতনতা তৈরির চেষ্টা করেছি, সেহেতু আমি চাইনি স্পনসরের ডামাডোলে এটা চাপা পড়ুক। তা ছাড়া ধারণা ছিল এই পদযাত্রায় আমার মিনিমাম টাকা খরচ হবে, যেটার জন্য আমি আসলে কোনো স্পনসরের প্রয়োজনীয়তাই অনুভব করিনি। আরেকটা ব্যাপারও কাজ করছিল মনের অবচেতনে। কত কম টাকায় এই ভ্রমণ শেষ করা যায়, সেটাও একদম প্রথম দিন থেকেই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। এই ৬৪ দিনের পদযাত্রায় আমার মোট খরচ হয়েছে ৪ হাজার ৯১০ (চার হাজার নয় শ দশ) টাকা। দিনলিপির মতোই এই খরচের বিবরণটা আমি প্রতিদিন লিখে রাখতাম মোবাইলের নোটসে। যেহেতু আমি বেশির ভাগ দিনই থেকেছি বন্ধু, আত্মীয়, পরিচিতজনদের বাড়িতে, সেহেতু আবাসন বাবদ আমার এক টাকাও খরচ হয়নি। সাকল্যে তিন–চার দিন আমি পরিচিতজনদের বাড়ির বাইরে ডাকবাংলো-হোটেলে থেকেছি। সেসব ক্ষেত্রেও আমাকে কোনো টাকা খরচ করতে হয়নি। কারণ, হোটেলমালিকেরা ছিলেন আমার বন্ধু। থাকার ক্ষেত্রে ডুপ্লেক্স বাড়িতেও যেমন থেকেছি, তেমনি থেকেছি মাটির বাড়িতে। কোথাও মানিয়ে নিতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়নি আমার। আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাতের খাবার কিংবা সকালের নাশতা সেরেছি পরিচিতজনদের বাড়িতে। যাত্রাপথে দুপুরেও অনেকের বাড়িতে নিয়েছি আতিথেয়তা৷ চলতি পথে আমার খরচ এ জন্যই অনেকটা কমে গেছে। 

২৫ অক্টোবরের সেই কুয়াশাছন্ন সকালে যে পথচলা শুরু হয়েছিল পঞ্চগড়ের ০ (শূন্য) কিলোমিটার থেকে, সে পথচলা থেমেছে ৬৪তম দিনে কক্সবাজার শহরের ০ (শূন্য) কিলোমিটারে এসে। পঞ্চগড়ে যে আমি শুরুর পয়েন্টে একটা ছবি তোলার জন্য মানুষ খুঁজে পাচ্ছিলাম না, সেই আমিই কক্সবাজারে হাঁটা শেষ করেছি আমার পাশে জনা পঞ্চাশেক মানুষ নিয়ে। আমার এই পদযাত্রায় বেরোনোর আগে আমাদের ডাইনিং টেবিলে বসে যখন এই পদযাত্রা ঠিকঠাকভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব কি না, সেটা নিয়ে যখন কথা হচ্ছিল, আমার বাবা তখন কথাচ্ছলে বলেছিলেন, ‘Nothing is impossible to your willing mind.’ পুরো রাস্তাজুড়ে আমার ঠিক এ কথাই মনে হয়েছে। অনেকেই জানতে চাচ্ছিলেন এ রকম পাগলামি আসলেই সম্ভব কি না। আমার তখন এ কথাটাই মনে হতো বারবার। জীবনে টানা ১০ কিলোমিটার না হাঁটা ক্লান্তিও উইলিং মাইন্ড নিয়েই এক দিনে পাড়ি দিয়েছে ৩৫ কিলোমিটারের বেশি পথ। মানুষ আসলেই জানে না তার সামর্থ্য কতটুকু। না জানার ফলে তার শারীরিক–মানসিক সামর্থ্যের অধিকাংশই সে ব্যবহার করতে পারে না। টানা ৬৪ দিনে ৬৪টি জেলা ঘুরে শেষ দিনে সবকিছুই খানিকটা শূন্য শূন্য বলেই মনে হচ্ছিল। কাল থেকে অপেক্ষায় নেই কোনো নতুন পথ, নেই নতুন কোনো অভিজ্ঞতা, নতুন কোনো মুখের সঙ্গেও হাসি বিনিময় করা হবে না চলতি পথে। গন্তব্যে পৌঁছে বারবার মনে পড়ছিল ট্রাভেলিংয়ের সেই অপ্তবাক্যটাই ‘It’s all about the journey, not about the destination.’