পেঁপের গুণ

অলংকরণ: সব্যসাচী চাকমা

আমার নাম নিউটন উদ্দিন বখ্ত। আমার বাবা পদার্থবিজ্ঞানের একজন শিক্ষক। বড় আশা করে তিনি আমার নাম নিউটন রেখেছিলেন। আইজ্যাক নিউটনের সঙ্গে কিঞ্চিত বাঙালিত্ব মেশানোর জন্য আমার দাদা বরকত উদ্দিন বখ্‌তের সঙ্গে মিল রেখে আমার এই নাম রেখেছিলেন আমার বাবা। এই নামের জন্য আমার বিড়ম্বনার শেষ নেই। গণিতে টেনেটুনে পাস করি, পদার্থবিজ্ঞানে তো তা–ও করতে পারি না। তার ওপর নাম নিউটন। প্রতিটি পরীক্ষার রেজাল্ট দেওয়ার পর এবং ক্লাসে পড়া না পারার পর ছাত্র–শিক্ষক সবাই মিলে নিয়ম করে আমার এবং নিউটনের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণের কাজে লেগে পড়েন।

গতকাল পড়া না পারার কারণে ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম। নানা কথা ভাবছি। আমাদের পদার্থবিজ্ঞানের স্যার আমার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎই আমার সামনে থামলেন। কিছুটা টিপ্পনীর সুরে বললেন, ‘কিরে নিউ-টাউন, স্যার বের করে দিয়েছেন নাকি?’

আমি মাথা নাড়ালাম।

স্যার বললেন, ‘তুই তো নিউটন। তোর মাথায় কিছু পড়লে বোধ হয় তুইও কিছু আবিষ্কার করতে পারতি। তুই এক কাজ করিস। কোনো একটা গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকিস। দেখিস, মাথায় কিছু পড়লে তুইও নিউটনের মতো সূত্র আবিষ্কার করতে পারবি। তবে তাল-নারকেলগাছের নিচে দাঁড়াস না আবার।’

হাসতে হাসতে স্যার চলে গেলেন।

স্যার মজা করে বলেছেন বটে। কিন্তু আমার কথাটা মনে ধরল। ভাবলাম, হতেও তো পারে এমন কিছু। স্কুল ছুটির পর সোজা চলে গেলাম মামার বাড়িতে। ওখানে একটা পেঁপেগাছ আছে। ভাবলাম, আপেল না হোক, পেঁপে খারাপ কী? এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পেঁপেটা আমি আমার মাথায় ফেলব কী করে? তাছাড়া পেঁপের সাইজটাও তো দেখতে হবে। কিন্তু সমাধান পেয়ে গেলাম। গাছটা বাসার ছাদ লাগোয়া। মামাতো ভাইকে উঠিয়ে দিলাম ছাদে। ছোট সাইজের একটা পেঁপে পেড়ে সোজা আমার মাথায়!

যাক, তেমন আঘাত পেলাম না, তবে নিউটনীয় বিদ্যার্জন পদ্ধতি কাজ করল কি না, তা এখন পরীক্ষা করতে হবে।

এক সপ্তাহ স্কুলে গেলাম না। পরের সপ্তাহে পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষা। কোনো প্রস্তুতি নিইনি। প্রতিদিন নিয়ম করে একবার নিউটনীয় বিদ্যার্জন পদ্ধতি অনুসরণ করেছি।

পরীক্ষার দিন আমি মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে এসেছি। সবাই বলল, কী হয়েছে। আমি বললাম, কিছুই হয়নি তেমন—একটু ছোটখাটো দুর্ঘটনা। পরীক্ষার প্রশ্ন দেখে তো আমি চোখে শর্ষেফুল দেখছিলাম। যাক, দিয়ে এলাম সব কটির উত্তর। এমসিকিউ পদ্ধতির পরীক্ষা ছিল বলে কিছু বানিয়ে বানিয়ে লেখার সুযোগও ছিল না। এবার বোধ হয় শূন্যই পাব। নিজের মাথাটার প্রতি কী যে মায়া হচ্ছিল।

রেজাল্টের দিন, স্যার শুধু ফলাফল নিয়ে এলেন। এমসিকিউ হওয়ায় সবাই খুশি, আমি বেজার। ক্লাসের ষাট শিক্ষার্থীর মধ্যে আমার রোল ষাট। স্যার একে একে নম্বর বলতে শুরু করলেন। চল্লিশের পরীক্ষা। স্যার বলছেন,

‘এক-আটত্রিশ, দুই-ছত্রিশ, তিন-সাঁইত্রিশ...’

যারা চল্লিশের আশা করছিল, তারাও আটত্রিশের বেশি পায়নি। স্যার বলতে থাকলেন,

‘আটান্ন-চার, উনষাট-দুই, ষাট-চল্লিশ!’

সবাই থ হয়ে গেল। স্যার বললেন, ‘তোমরা ভেব না আমি ভুল বলছি। আমি খাতাটা গুনে গুনে তিনবার দেখেছি। নিউটন চল্লিশ পেয়েছে—এটাই সত্য।’

আমি তো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না। স্যার অবাক, আমি অবাক, সবাই অবাক।

আমি আর কিছুই বললাম না। তবে মনে মনে ভাবলাম,

‘পেঁপের এত গুণ!’

লেখক: এসএসসি পরীক্ষার্থী, হাসান আলী সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, চাঁদপুর