প্রায় সবাই সাইকেল চালানো শেখে দুপুরে বা বিকেলে। কিন্তু আমি শিখেছি রাতে। কারণ সে সময়টাতেই আমাদের এলাকা লালমাটিয়ার রাস্তা ফাঁকা থাকে। এক সন্ধ্যায় সাহস করে বের হলাম সাইকেল নিয়ে। সমস্যা হলো সাইকেল চালানো নিয়ে আমার কোনো ধারণাই নেই। কীভাবে উঠতে হবে, নামার সময় ডান পা ফেলব না বাঁ পা ফেলব, তা-ও বুঝতে পারছিলাম না। তবু নামলাম। আমার লক্ষ্য ছিল ২০১৬ সালের মধ্যেই সাইকেল চালানো শেখা। ২০১৭ সালে জেএসসি পরীক্ষা, পড়ার বাইরে অন্য কিছু করার সুযোগ সীমিত।
আমাদের বাসার কেয়ারটেকার আমিনুল আঙ্কেল আমার ট্রেইনার। তাঁর সাইকেলই হলো আমার শেখার মাধ্যম। ট্রেইনার বললেন, ‘ভয় নাই। সামনে তাকায়া চালায়া যাও। ঘাড় সোজা রাখবা আর প্যাডেল চালাবা।’ সাহস করে রাস্তায় নামলাম। প্রথম পাঁচ মিনিট চালালাম। আমার ট্রেইনার সাইকেল ধরে ঠেলতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর আবিষ্কার করলাম, উনি তো সাইকেল ধরে নেই। এ তো সমস্যা, এখনই বোধ হয় পড়ে যাব। তারপর দেখি, আরে আমি তো নিজে নিজেই চালাচ্ছি। কিছুক্ষণ একা চালানোর প্র্যাকটিস করলাম। দুদিন পর যখন সাইকেল চালানোর বেসিকটা শেখা হলো (মানে এখনো শিখছি), তখন একদিন জোরে জোরে সাইকেল চালিয়ে পুরো লালমাটিয়া ঘুরলাম।
এখন তো আমার একটা সাইকেল দরকার। বাবা বললেন, ‘চলো তোমাকে সাইকেল কিনে দিই।’ ধানমন্ডির একটা দোকানে গেলাম আমরা। বাবার সাইকেল জ্ঞান আমার মতোই। নানা মডেলের সাইকেল থেকে একটা খুঁজে বের করা সহজ নয়। বাবা বলতে থাকলেন, ‘আমাদের সময় সবচেয়ে ভালো সাইকেল ছিল ‘ফনিক্স’ (উচ্চারণটা আসলে ‘ফিনিক্স’)। সামনে বেল আর পেছনে একটা ক্যারিয়ার থাকতেই হবে।’ কিন্তু দোকানের কোনো সাইকেলেই মাডগার্ড নেই। বাবার মতে সবই কেমন যেন ‘খালি খালি’ লাগে। দোকানের ভদ্রলোক বললেন, মাডগার্ড, বেল সব আলাদা কিনতে হবে। কাকতালীয়ভাবে আমরা ‘ফিনিক্স’ ব্র্যান্ডেরই একটা সাইকেল পেয়ে কিনে ফেললাম। সেই সাথে কিনলাম হেলমেট আর গ্লাভস। বাবা মাথায় টোকা দিয়ে বললেন, ‘সব সময় পড়বে, সেফটি ফার্স্ট’।
সাইকেল কেনার সময় বাবার দুই সহকর্মী (আরশাদ আর জামাল আঙ্কেল) ছিলেন। সাইকেল নিয়ে তাঁদের ছেলেবেলার স্মৃতিচারণা করলেন সবাই। আরশাদ আঙ্কেল বললেন, একটা সাইকেলের জন্য তিনি সারা দিন কেঁদেছিলেন। তাঁর বাবা কিনে দিতে পারেননি টাকা ছিল না বলে। শেষে তাঁর মা কোথা থেকে যেন জমানো টাকা বের করে দিয়েছিলেন ছেলের আবদার মেটানোর জন্য। জামান আঙ্কেল বোঝাচ্ছিলেন কীভাবে হাফ প্যাডেল থেকে ফুল প্যাডেল, তারপর রডে চড়া এবং শেষে সিটে বসে সাইকেল চালানো শিখেছিলেন তাঁরা। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না বলে তিনি ছবি এঁকে দেখাচ্ছিলেন। আমি বুঝলাম ওনাদের সময়ের সাইকেলগুলো ছিল ভিন্ন। তিনি আরও বলছিলেন, কীভাবে তাঁরা সব ভাই মিলে একটি সেকেন্ডহ্যান্ড সাইকেল জোগাড় করেছিলেন এবং তখন তা ছিল পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদের একটি। আমি ভাবছিলাম, সেদিক থেকে তো আমি অনেক ভাগ্যবান। সাইকেল চালানো শেখার দুদিনের মধ্যেই একটা নতুন সাইকেলের মালিক হয়েছি। সেদিন ফেরার পর বাবা জানতে চাইলেন, ‘তুমি পড়ে যাও নাই?’ আমি না বলায় তিনি বিস্মিত হলেন। আর বললেন, ‘সাইকেল চালাতে গিয়ে পড়ে না গেলে আবার সাইকেল চালানো শেখা হয় নাকি?’
শুরু হলো আমার নিজের সাইকেলে ঘোরাঘুরি। পরদিনই হঠাৎ জোরে ব্রেক করে তাল সামলাতে না পেরে আমি পড়ে গেলাম। বাম পায়ের হাঁটু বেশ খানিকটা ছিলে গেল। একটু ব্যথাও পেলাম। বাসায় ফিরে বাবাকে বললাম, ‘তোমার কথা আমি রেখেছি।’ বাবা জানতে চাইলেন, ‘কী কথা?’ আমি আমার ছিলে যাওয়া হাঁটু দেখালাম। তিনি বললেন, ‘দেখে না চালালে এমনই হবে।’ আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বললেন, ‘যখন কেউ সাইকেল বা গাড়ি চালানো শেখে, তখন বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে না। কারণ সবাই খুব সাবধানে থাকে। দুর্ঘটনা ঘটে তখনই, যখন সে ভাবে সে চালানো শিখে গেছে!’ আমিও বোধ হয় তাই ভেবেছিলাম।