প্রাণের গান

অলংকরণ: রাকিব রাজ্জাক

লোকটা কে? জানি না। তবে চিনি ভালো করেই। প্রতিদিন দেখি। স্কুল গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন একটা নির্দিষ্ট সময়ে। কারও অভিভাবক নন। তিনি আসেন ঠিক যখন আমাদের অ্যাসেম্বলি হয়, তখন। আরও পরিষ্কার করে বললে জাতীয় সংগীত শুরু হওয়ার ঠিক আগে। জাতীয় সংগীতের পর বাংলাদেশের নামে আমাদের জয়ধ্বনি দেওয়া শেষ হলেই চলে যান। কখনোই এদিক-ওদিক হয় না এই রুটিনের। আমি অনেকবার ভেবেছি, তাঁর সঙ্গে কথা বলব। অপ্রয়োজনীয় কৌতূহল আমার স্বভাব। কিন্তু কখনো কথা বলার সুযোগ পাইনি। যখন আসেন তখন আমি অ্যাসেম্বলিতে। আর যখন চলে যান, তখনো আমরা সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছি। নিয়ম ভাঙার উপায় নেই।

আজ সকালে ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসতেই লোকটার কথা মনে পড়ল। ঘড়ির দিকে তাকালাম। অ্যাসেম্বলি শুরু হতে অল্প কিছু সময় বাকি। অদম্য কৌতূহল জাগল। কথা বলার একটা সুযোগ আছে আজ। তাড়াহুড়া করে সাইকেল নিয়ে ছুটলাম স্কুলের দিকে। এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে বেকার আমি। ঘুমটা আজ অন্য দিনের চেয়ে আগেই ভেঙেছে। স্কুল গেটে যখন পৌঁছালাম, জাতীয় সংগীত তখন শুরু হয়েছে মাত্র। লোকটা দাঁড়িয়ে আছেন গেটের বাইরে। আজ তো আমার লাইনে দাঁড়াতে হবে না। আমি সাইকেল থেকে নেমে এগিয়ে গেলাম। ‘চাচা...!’ ‘শ শ শ শ!’ মুখে আঙুল দিয়ে কথা বলতে নিষেধ করলেন। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। খুব মনোযোগ দিয়ে লোকটা ‘আমার সোনার বাংলা’ শুনছেন। জয়ধ্বনি শেষে ঘুরে তাকালেন। বললেন, ‘কী?’

‘আপনার কি একটু কথা বলার সময় হবে?’

‘খুব হবে। বলো।’

‘আমি অনেক দিন থেকে আপনাকে দেখছি। এখানে ঠিক এই সময়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। কেন? অসুবিধা না থাকলে বলবেন, প্লিজ?’

‘এই গানটা শুনি, বুঝলা? এই গানে যে কী মায়া সেইটা তোমরা বোঝো না। তাই অনেকে গাওয়ার সময় হেলাফেলা করো। শুধু এই গান একবার শুনতে এখানে এসে দাঁড়াই, আহা! প্রাণটা ভরে যায়।’

অবাক হই। বোধ হয় আমার চেহারায় বোঝা যায় সেটা। এক পাশে নিয়ে গিয়ে লোকটা শার্টের একটা বোতাম খুলে কাঁধটা দেখান। শুকিয়ে যাওয়া ক্ষত। ‘বাবা, তোমাকে একটা কথা বলি। এই গান বড় সুন্দর, এই যে দেখো, এই গানটার জন্যই তো এখানে গুলি লাগছিল। রেডিওতে গানটা শুনে এত ভালোবাসছিলাম যে বর্ডার পার করে সোজা ইন্ডিয়া। তারপর আবার দেশে আসছি গেরিলা হয়ে। শুধু গানটারে মুক্তি দেওয়ার জন্য। সেদিনের কথা ভাবলে এখন গর্বের চেয়ে লজ্জাই বেশি লাগে। গানটারে এখন কেউ ভালোবাইসা গায় না।’

আমি অবাক, ‘আপনি মুক্তিযোদ্ধা?’ লোকটা আমার কথার উত্তর না দিয়ে ‘কেউ আর ভালোবাইসা গায় না’ বলে মাথা নাড়তে নাড়তে হতভম্ব আমাকে পেছনে ফেলে চলে যান। আমার কেন জানি না প্রচণ্ড কষ্ট হলো। দুহাতে মুখ ঢেকে ঝরঝর করে কেঁদে দিলাম। বুঝি না কেন, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি,’ গানটার প্রতি হঠাৎ প্রচণ্ড ভালোবাসা জন্মাল আমার। এত ভালোবাসলাম, এমনভাবে বাসলাম যেভাবে আগে কখনো কাউকে বাসিনি।

হিরঞ্জন

দশম শ্রেণি, চুয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, চট্টগ্রাম