প্রিয় জন্মভূমি, বাংলাদেশ

আঁকা: রাকিব রাজ্জাক

আমাদের স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ। এখানে আমাদের সব আছে। আমাদের বাংলা ভাষা আছে। লাল-সবুজের পতাকা আছে। মানচিত্র আছে। আমাদের গান আছে। কবিতা আছে। গল্পকথার ঝুলি আছে। নাটক আছে। রূপকথা আছে। রঙিন প্রজাপতি আছে। আছে জোনাকিদের মিষ্টিমুখর আলোর খেলা। মাথার ওপর অবারিত নীল আকাশ। এ আকাশ আমাদের। আকাশের বুকে ডানা মেলে উড়ে যাওয়া পাখি আমাদের। আমাদের ছয়টি ঋতু আছে। এই যে ফসলের মাঠ, উর্বরা জমিন—সবকিছু আমাদের। এই যে কারখানার ধোঁয়া, এ-ও আমাদের। শহর ছেড়ে গ্রাম পেরিয়ে ছুটে চলা রেলগাড়ি আমাদের। সাগর-নদী, পাহাড়-বনবনানি—সবকিছু আমাদের। সুন্দরবনের সবুজ আলোয় দাপিয়ে বেড়ানো রয়েল বেঙ্গল টাইগার আমাদের। ছুটে চলা হরিণের দল আমাদের। জেলেদের জালে আটকে পড়া মাছেদের ঝাঁক আমাদের। কক্সবাজারের বিশাল সমুদ্র আমাদের। ময়নামতি আমাদের। কান্তজিউ মন্দির আমাদের। কী নেই আমাদের? আমাদের সব আছে। সবকিছু নিয়েই সেজেছে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি, বাংলাদেশ। এ দেশ আমাদের মা। এখানেই আমাদের পরিচয়। আমরা বাঙালি।

কিন্তু একটা সময় ছিল, সবকিছু থাকার পরও কিছুই ছিল না আমাদের। না ভাষা, না গান, না ফসল, না অর্থ–সম্পদ। ছিল না কোনো কিছুতেই ন্যায্য অধিকার। কিন্তু অধিকার ছাড়া মানুষ তো বাঁচতে পারে না। মানুষের বাঁচতে হলে প্রয়োজন নিজের দেশ। নিজের ভাষা। প্রয়োজন মাতৃভূমির অধিকার।

এই অধিকার আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে আমাদের মধ্যে এলেন মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি আমাদের জাতির জনক। বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের সুদীর্ঘ ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। বাঙালির প্রাণে জাগিয়ে তুলেছিলেন স্বাধীন স্বদেশ গড়ার স্বপ্ন, বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন। বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বপ্ন দিয়েছেন। বাস্তবায়নও করেছেন। বাঙালি জাতির জন্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির যে সোপান তিনি রচনা করে দিয়েছেন, তার অন্তর্নিহিত শক্তি হচ্ছে দেশপ্রেমের নৈতিক আদর্শ।

তাঁর ছিল সংগ্রামমুখর জীবন। আত্মত্যাগ আর দেশপ্রেমের আলোকবর্তিকায় মুক্তচিন্তাসম্পন্ন মানবিকতার আলোয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একই সত্তা। বাঙালির ভাষা ও স্বাধীন চেতনা ধবল জ্যোৎস্নায় তুলে ধরাই ছিল তাঁর পূর্ণ আরাধনা। বাউলের একতারায় উঠে আসা যত সুর আর যত সৌন্দর্যভরা জীবনচিত্র, শুধু তাঁরই স্পর্শে শেফালি ফুলের মতো ঝরে পড়েছে বাঙালির হৃদয়ে।

আঁধারে ঘিরে থাকা সব ধরনের দুঃশাসন, নিপীড়ন, জুলুম ভেঙে দিয়ে তর্জনীর তুমুল ইশারায় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার জনগণের মধ্যে জাগিয়ে দিয়েছেন আবেগময় দেশাত্মবোধ। বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশকেই গড়ে তোলেননি, বিশ্বরাজনীতিতে বাংলা ও বাঙালিকে নিয়ে গেছেন উচ্চতর আসনে। দেশের নেতা হয়ে উঠেছেন বিশ্বের নেতা। বাঙালি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্তিসংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা দাবি ঘোষণার পর সমগ্র বাঙালি জাতি তাঁর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে স্বাধিকার আন্দোলন গড়ে তোলে। তাঁর ছয় দফাকে বলা হয় বাঙালির মুক্তির সনদ। ছয় দফা আন্দোলন ঘিরে বঙ্গবন্ধুকে মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করা হলে এর বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রচণ্ড বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। কারাগারে থেকেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন এই আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি। তখন স্লোগান উঠেছিল, ‘জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব’।

পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে বিজয়ের গৌরবে বঙ্গবন্ধু বাংলার মাটিতে পা রাখেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয় নিয়ে বঙ্গবন্ধু আমাদের উপহার দিলেন জাতীয় সংগীত, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’।

১৯৬৯ সালের মধ্য জানুয়ারিতে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন জেগে ওঠে। গণ-আন্দোলনের ফলে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়া হয়। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত গণসংবর্ধনায় সেই সময়ের ছাত্রনেতা, বর্তমানে আওয়ামী লীগের নেতা তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। নির্বাচনে জয়লাভ করার পরও বাঙালি শাসনক্ষমতা পেল না। এর বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে গর্জে উঠল বাঙালি জাতি। আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল পূর্ব বাংলা। একাত্তরের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিলেন। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বঙ্গবন্ধুর এ আহ্বানে জেগে উঠল বাঙালি। সেদিনের সেই বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ আজ ইউনেসকোর আন্তর্জাতিক প্রামাণ্য দলিলে স্থান করে নিয়েছে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গভীর রাতে নিরস্ত্র বাঙালি জাতির ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী নারী-পুরুষ, শিশুসহ হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করতে লাগল। ২৫ মার্চ গভীর রাতে ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের নিজ বাসভবন থেকে বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেন। নিপীড়িত, নির্যাতিত, লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত বাঙালি বীর বাঙালিতে পরিণত হলো। বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্ম হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে বিশ্ববাসীর সামনে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে দেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস। সেই থেকে সৃষ্টি হলো কত গান, কত সুর। কত কবিতার ছন্দ। সেই থেকে শুরু হলো স্বাধীন বাংলাদেশের এগিয়ে চলা।

স্বাধীন বাংলাদেশে বিজয়ের প্রথম গান ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ বাংলার ঘরে ঘরে’ প্রচারিত হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে। গানটি লিখেছেন গীতিকার শহিদুল ইসলাম। সুর করেছেন সুজেয় শ্যাম। গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন অজিত রায়, রথীন্দ্রনাথ রায়, তিমির নন্দী, রফিকুল আলম, মান্না হক, মৃণাল কান্তি দাস, প্রবাল চৌধুরী, তপন মাহমুদ, অনুপ ভট্টাচার্য, কল্যাণী ঘোষ, উমা খান, রূপা ফরহাদ, মালা খুররমসহ অনেকে। আমাদের গৌরবময় বিজয়ের ইতিহাসের সঙ্গে মিশে আছে এই গান। এই সুর।

পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে বিজয়ের গৌরবে বঙ্গবন্ধু বাংলার মাটিতে পা রাখেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয় নিয়ে বঙ্গবন্ধু আমাদের উপহার দিলেন জাতীয় সংগীত, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির গর্ব। সমগ্র জীবন তিনি উত্সর্গ করেছেন বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রামে। ধারাবাহিক সংগ্রাম-আন্দোলন, সর্বোপরি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে তাঁরই নেতৃত্বে বাঙালি জাতি ফিরে পায় বাংলা ভাষা, আত্মপরিচয়, সংস্কৃতি এবং স্বাধীন ভূখণ্ড, লাল-সবুজের পতাকা। মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী বীর শহীদদের স্মরণে আমরা ছুটে যাই জাতীয় স্মৃতিসৌধের কাছে। স্মৃতিসৌধের নকশা আঁকেন শিল্পী সৈয়দ মইনুল হোসেন। স্মৃতিসৌধটি সাত জোড়া ত্রিভুজ আকৃতিতে গঠিত। সাতটি স্তম্ভে উপস্থাপিত হয়েছে বাংলাদেশ গড়ার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ের আন্দোলন-সংগ্রামের কথা। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাতটি ঐতিহাসিক ঘটনাকে প্রতীক হিসেবে নিয়ে সাতটি স্তম্ভের মধ্য দিয়ে এই স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বিজয় দিবস উদ্‌যাপনের গৌরবময় মুহূর্তে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতিসৌধ নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তিনি ১৯৭২ সালের ২২ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধু নির্ধারণ করে দেন আমাদের জাতীয় পতাকা, জাতীয় প্রতীকগুলো। তিনি আমাদের সংবিধান তৈরি করে দেন, যার ভিত্তিতে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত।

আজ সূর্য হাসছে। বাতাসে দুলছে লাল-সবুজের পতাকা। জেগে আছে শহীদ মিনার। জেগে আছে মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় প্রতীক জাতীয় স্মৃতিসৌধ। আমরা পেয়েছি আমাদের জীবনের ব্যাকরণ। এগিয়ে চলার শক্তি–সাহস। বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ দিয়ে গেছেন। আমাদের জাতিসত্তার পরিচয় দিয়ে গেছেন। আমরা পেলাম বাংলাদেশ। আমরা পেলাম জয় বাংলা।