ফাঁদ

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

‘অপরাধ-টপরাধ বড় একটা হয় না এখানে।’ কিঞ্চিৎ হতাশ স্বরে মন্তব্য করলেন ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর নাসের পাশা, ‘সে জন্যই ফিরে যাচ্ছি হেডকোয়ার্টারে। নইলে মরচে পড়ে যাবে দক্ষতায়।’

মার্স স্পেসপোর্টের মেইন অবজারভেশন লাউঞ্জে বসে আছি আমরা। আধা ঘণ্টার মধ্যে উঠব পৃথিবীগামী মহাকাশযানে। যাত্রীদের বেশির ভাগই পা দেয়নি কখনো গ্রহটিতে, তারপরও ‘বাড়ি’ ভাবে ওটাকে।

বাইরে রৌদ্রস্নান করছে লাল গ্রহটির দুর্গম খাঁজকাটা পর্বতসারি।

‘দু-একটা ইন্টারেস্টিং কেস পাওয়া যায় বটে, যেগুলো মুক্তি দেয় একঘেয়েমি থেকে।’ বলে চলেছেন ইন্সপেক্টর, ‘মেরিডিয়ান সিটির চুরির ঘটনাটা শুনেছেন নিশ্চয়ই!’

না-সূচক মাথা নাড়তে হলো।

‘কাণ্ড বটে!’ হাসলেন ভদ্রলোক, ‘পৃথিবীর এক রত্নচোর সাইরেন দেবীর মূর্তি চুরি করতে গিয়েছিল মিউজিয়াম থেকে। কপাল মন্দ না হলে ঠিকই হাসিল করে ফেলত কাজটা।’

লাউডস্পিকারে ক্ষমা প্রার্থনা করা হলো: চূড়ান্ত জ্বালানি পরীক্ষার জন্য আরও খানিকটা দেরি হবে স্পেসশিপ ছাড়তে।

মূর্তিটি সম্বন্ধে কী জানি, স্মরণ করার চেষ্টা করলাম। সামনাসামনি ওটা দেখিনি কখনো। তবে টিপিক্যাল ট্যুরিস্টদের মতো আমার ব্যাগেও রেপ্লিকা রয়েছে ওটার। আসলটি আবিষ্কৃত হয় মেয়ার সাইরেনিয়ামে তৃতীয় এক্সপিডিশনের সময়।

মঙ্গলের বুদ্ধিমান আদিবাসীরা ছিল কঠিন খোলসযুক্ত প্রাণী। পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের আগেই ধ্বংস হয়ে যায় তাদের সভ্যতা, যে কারণে অমীমাংসিতই থেকে গেছে সাইরেন দেবীর রহস্য।

‘চমত্কার পরিকল্পনা ফেঁদেছিল আক্কেল আলী, মানে চোর বাবাজি।’ ব্যঙ্গের সুর ডিটেকটিভের কণ্ঠে, ‘জানেনই তো, রোববার কেমন জনশূন্য হয়ে যায় মঙ্গলের শহরগুলো। সবদিক বিবেচনা করে শুক্রবার বিকেলে পশ্চিম মেরিডিয়ানের এক সরাইখানায় ওঠে আক্কেল। পরদিন সকালে ছোট এক পার্কের ভেতর দিয়ে রওনা হয় আধা মাইল দূরের পূর্ব মেরিডিয়ানে। ওখানেই জাদুঘরটা।’

উচ্চমার্গের হাসি দিলেন ইন্সপেক্টর ভদ্রলোক। ‘এ ধরনের বিলাসিতার অবকাশ নেই ভাই মঙ্গলে! কারণটা বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই! এমনকি কোনো অ্যালার্ম সিস্টেমও ছিল না জাদুঘরে

‘জাদুঘরে ঘুরেফিরে দিনটা পার করে দেয় আক্কেল। পয়সা উশুল করে নিতে চায় যেন সেয়ানা পর্যটকদের মতো। মিউজিয়াম বন্ধ হওয়ার সময় হয়ে এলেও বেরোয়নি ও, ঘাপটি মেরে ছিল একটা গ্যালারিতে। মাঝরাত পর্যন্ত অপেক্ষা করে তারপরই বেরোয় আড়াল থেকে।’

‘দাঁড়ান...দাঁড়ান!’ বাধা দিই আমি, ‘ওয়াচম্যান কই ছিল?’

উচ্চমার্গের হাসি দিলেন ইন্সপেক্টর ভদ্রলোক। ‘এ ধরনের বিলাসিতার অবকাশ নেই ভাই মঙ্গলে! কারণটা বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই! এমনকি কোনো অ্যালার্ম সিস্টেমও ছিল না জাদুঘরে। স্রেফ কাচ আর ধাতুর শক্তপোক্ত কেসের ভেতর রাখা ছিল মূর্তিটা, কেউ যাতে স্পর্শ করতে না পারে।’

ভুলেই গিয়েছিলাম, হিমশীতল প্রায় বায়ুশূন্যতা থেকে মঙ্গলের বাসিন্দাদের রক্ষা করে চলেছে ইলেকট্রনিক ফোর্সফিল্ড, যেটির বাইরে গেলে মুহূর্তে মারা পড়বে মানুষ।

‘জহুরি যেভাবে হীরা কাটে, তেমন সতর্কতায় খুদে করাত দিয়ে কাচের বাক্সের নিচের দিকে কাটতে আরম্ভ করল আক্কেল আলী। কাটার পর নকল একটা মূর্তি রেখে দিত আসলটার বদলে। বছর কয়েক পর হয়তো বিশেষজ্ঞ কারও নজরে পড়ত অপকর্মটা। তার আগেই তো অরিজিনালটা পাচার হয়ে গেছে পৃথিবীতে!’ দম নিল গোয়েন্দা পুলিশ, ‘তো, কাটতে কাটতে রাত কাবার প্রায়। কিন্তু রোববার বলে দুশ্চিন্তা ছিল না আক্কেলের। বিরাট ধাক্কা খেল, সকালে যখন খুলে যেতে লাগল মিউজিয়ামের এন্ট্রান্স ডোর!’ বিমল হাসিতে উদ্ভাসিত হলো ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টরের মুখের চেহারা, ‘নিশ্চয়ই ধরতে পেরেছেন গলদটা!’

অসহায়ত্ব প্রকাশ করি ডানে-বাঁয়ে মাথা নেড়ে।

‘শহরটার নাম মেরিডিয়ান হওয়ার কারণটা কি জানা আছে আপনার?’ জিজ্ঞেস করলেন নাসের পাশা।

‘না নেই।’

‘কারণ, ১৮০ ডিগ্রি দ্রাঘিমার ওপর দাঁড়িয়ে ওটা।’

‘এখনো বুঝিনি।’

‘ওই যে পার্কটা...প্রধান মধ্যরেখা চিহ্নিত বড় এক পাথরের চাঁই আছে ওখানে, একসঙ্গে দুই গোলার্ধে পা রেখে ছবি তুলতে পারে দর্শনার্থীরা। পৃথিবীতে অবশ্য সে উপায় নেই, যেহেতু ওখানকার মধ্যরেখা পড়েছে প্রশান্ত মহাসাগরে। কিন্তু মঙ্গলের সবই তো শুকনা খটখটে। সে জন্য কখনোসখনো মুশকিলে পড়তে হয় বইকি ইন্টারন্যাশনাল ডেটলাইন নিয়ে।’ খোলাসা করলেন পুলিশ অফিসার, ‘পশ্চিম মেরিডিয়ানে সরাইয়ে উঠেছিল চোর বাবাজি। ধরা পড়ার সময় সেখানে তখন রোববার, ঠিক আছে। কিন্তু পূর্ব মেরিডিয়ানে সে সময় শনিবার চলছে! আর শনিবার তো ওয়ার্কিং ডে। তাই পার্কের ভেতর দিয়ে যাওয়ার কারণেই আক্কেলসেলামি দিতে হলো আক্কেল আলীকে!’

বিদেশি কাহিনির ছায়া অবলম্বনে