ফেউ

রাতদুপুরে ফেউ ফেউ শব্দে কী একটা জন্তু ডাকাডাকি করছে। কয়েক দিন ধরে শুরু হয়েছে এই কাণ্ড। গ্রামের লোকজন আগে কখনো এ রকম ডাক শোনেনি। তারা চিন্তিত। এই চিন্তা বেড়ে গেল যেদিন মতলেবের বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেল একটা ছাগলছানা। পরদিন ছানাটির ছেঁড়াখোঁড়া চামড়া আর হাড়গোড় পাওয়া গেল মাঠের ধারে।

এই গ্রামের নাম হিজলিয়া। অজপাড়াগাঁ বলতে যা বোঝায়, হিজলিয়া হচ্ছে তেমন গ্রাম। ফসলের মাঠ আছে বিস্তর। গরিব গৃহস্থ লোকের বাস। চাষি, মজুর, জেলে, কয়েকঘর তাঁতি, চায়ের দোকানদার, মুদি দোকানদার—এ রকম লোকজনই বেশি। একটা প্রাইমারি স্কুল আছে। হাইস্কুল আছে তিন কিলোমিটার দূরে। ধীরে ধীরে শিক্ষার আলো ঢুকছে গ্রামে।

আগে এই অবস্থাটা ছিল না। ক্বচিৎ একটু সচ্ছল পরিবারের কেউ কেউ যেত হাইস্কুল পর্যন্ত। ম্যাট্রিক পাস করে আইএ, বিএ পড়তে যেত কলেজে। গ্রামের প্রথম বিএ পাস করা লোক সরকারবাড়ির মালেক সরকার। বিএ পাস করে পুলিশের চাকরিতে ঢুকেছিলেন। ওসি হয়েছিলেন। কয়েক বছর আগে রিটায়ার করে গ্রামে বসবাস করছেন। ওসি সাহেবকে ওসি সাহেব বলেই ডাকা উচিত, কিন্তু গ্রামের লোকে তঁাকে ডাকে দারোগা, মালেক দারোগা। আড়ালে–আবডালে শুধু দারোগাও বললেও সাহেবটা সামনাসামনি বলে।

মালেক দারোগা নিঃসন্তান, তবে জাঁদরেল লোক। দেখতে যেমন দশাসই, তেমনি প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, প্রতাপশালী। তাঁর হাঁকডাকে বাঘে–গরুতে একঘাটে পানি খায়। গ্রামের শেষ প্রান্তে বিশাল বাড়ি। বড় বড় কয়েকটা ঘর, ফল–ফলারির বাগান, বাঁশঝাড়। বাড়ির লাগোয়া মাঠে অনেক জমি। বছরভর সেখানে ফসল ফলছে। কাজের লোকজন আছে বেশ কয়েকজন। পরিবার–পরিজন নিয়েই তারা বংশপরম্পরায় থাকছে এই বাড়িতে। তাদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার তদারক করেন মালেক দারোগা স্বয়ং। চার–পাঁচ বছর বয়স হলেই প্রাইমারি স্কুলে পাঠাচ্ছেন। প্রাইমারি শেষ হলে হাইস্কুলে পাঠাচ্ছেন। পড়াশোনার ব্যাপারে কেউ তেড়িবেড়ি করলে তার খবর আছে।

শুধু যে দারোগাবাড়ির ছেলেমেয়েদের ব্যাপারেই এ রকম শাসনজারি করেছেন মালেক দারোগা, তা নয়, গ্রামের প্রতিটি বাড়ির ছেলেমেয়েরই পড়াশোনার খোঁজখবর করছেন তিনি। পুলিশি একটা লাঠি সব সময়ই হাতে আছে তাঁর। ওই জিনিস হাতে নিয়ে সকাল–বিকেল গ্রামে চক্কর খান। কোন বাড়ির ছেলেমেয়ে স্কুলে যাচ্ছে না, পড়াশোনা করছে না—খোঁজখবর করেন। ওসি থাকা অবস্থায় চোর–ডাকাত, গুন্ডা–বদমাশদের এই লাঠি দিয়ে বেদম পিটিয়ে যেমন শায়েস্তা করতেন, নিজ গ্রামের শিশু–কিশোর ছেলেমেয়েদের ওপর তো আর তা প্রয়োগ করতে পারেন না, তবে ভয় দেখান। কী রে, মার খাবি, না পড়বি? পিটানি দেব, না স্কুলে যাবি?

মালেক দারোগা ছয় ফুটের মতো লম্বা। গায়ের রং ঝিম কালো। অতিকায় দেহ। পা দুখানা কলাগাছের মতো, হাত হচ্ছে গিয়ে ওই কলাগাছের মতোই, তবে প্রাপ্তবয়স্ক কলাগাছের মতো না, কিশোর কলাগাছ। চোখ ভাটার মতো, থ্যাবড়া নাকের তলায় ছাগলছানার লেজের মতো গোঁফ, মাথাভর্তি টাক, যেমন বিশাল বপু, তেমনি গলার আওয়াজ। ধমক–ধামক তো দূরের কথা, মালেক দারোগা কথা বললেই পিলে চমকে যায় লোকের। বাড়ির ছোট বাচ্চাকাচ্চা বেশি বিরক্ত করলে মালেক দারোগার কথা বলে তাকে ভয় দেখানো হয়। ওই যে মালেক দারোগা আইল...সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাকাচ্চারা ঠান্ডা। দূর থেকে মালেক দারোগাকে দেখলে, এমনকি তাঁর ছায়া দেখলেও পিঠটান দেয় শিশু–কিশোরের দল।

ছোটরা যেমন ভয় পায় মালেক দারোগাকে, বড়রা তেমন সমীহ করে। যেকোনো বিপদ–আপদে গ্রামের লোকের একমাত্র ভরসার জায়গা মালেক দারোগা।

তবে মনের দিক দিয়ে মালেক দারোগা অসাধারণ। শরীর যেমন দশাসই, মনও তেমনি। মানুষের বিপদ–আপদে পাশে আছেন। কথা বলবেন ধমক দিয়ে, কিন্তু কাজটা করবেন। কারও হয়তো টাকার অভাবে মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না, সাহায্যের জন্য এল দারোগার কাছে। বিনীত গলায় ডাকল, দারোগা সাহেব...

মালেক দারোগার প্রিয় পানীয় আদা চা। আদাকে তিনি আদর করে বলেন ‘আদ্রক’। সঙ্গে চা যুক্ত হলে হয় আদ্রক চা। তিনি হয়তো তখন বিশাল মগে তাঁর ওই আদ্রক চা পান করছেন। ধমক দিয়ে উঠলেন। কী? চাস কী?

আমার মেয়েটা সাহেব...

কী হয়েছে তোর মেয়ের?

বড় হয়ে গেছে সাহেব...

বিয়ে দিসনি?

না সাহেব। কীভাবে দেব... মানে...

এত মানে মানে করছিস কেন? একটা থাপ্পড়ে মুখের বত্রিশটা দাঁত ফেলে দেব, ফাজিল কোথাকার।

মুখে বত্রিশটা দাঁত বোধ হয় নাই সাহেব। দুই–চারটা পড়ে গেছে। তবে যে কয়টা আছে, সেই কয়টা ফেলে দেন। তারপরও মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থাটা করেন।

ব্যবস্থা করে দেন মালেক দারোগা। এককথায় তিনি হচ্ছেন গ্রামপ্রধান। তাঁকে না জানিয়ে গ্রামের কেউ কোনো সিদ্ধান্ত নেয় না। অচেনা জন্তুটার ফেউ ফেউ ডাকের কথাও তাঁকে জানানো হলো। তবে জানানো হলো তিনটা ঘটনা ঘটার পর।

মতলেবের ছাগলছানার ঘটনার তিন দিন পর খবিরের সাদা গরুর পাঁচ দিন বয়সী বাছুরটার হলো একই দশা। তারপর গেল দেলোয়ার মুন্সির বড় একটা রাজহাঁস।

না, আর তো বসে থাকা যায় না। দারোগার কাছে যেতে হয়।

এক বিকেলে গ্রামের লোকজন এল দারোগাবাড়িতে। দুপুরে ভাত খেয়ে ঘণ্টা দেড়েকের একটা ঘুম দেন সাহেব। উঠে তাঁর ওই বিশাল মগ ভর্তি করে আদ্রক চা নিয়ে বসেন। সেটি গলাধঃকরণ করে বেতের ওই লাঠি হাতে গ্রামে চক্কর খেতে বেরোন। পরনে আলখাল্লার মতো সাদা পাঞ্জাবি আর পাজামা। পায়ে নরম ধরনের পামশু। সেটি ধারণ করে আছে তাঁর গাত্রবর্ণ।

মালেক দারোগার বসার চেয়ারটা নিখিল মিস্ত্রি কয়েক বছর আগে বানিয়ে দিয়েছে। হাতলঅলা অতিকায় চেয়ার। মাঝারি মাপের তিনজন মানুষ ওই চেয়ারে পাশাপাশি বসতে পারবে। তবে চেয়ারটা মালেক দারোগার একেবারে সাইজমতো হয়েছে। তিনি সেই চেয়ারে সমাসীন। ঘুম ভাঙার আগেই তাঁর সর্বক্ষণের সহচর মোবারক আর তালেব দুজনে ধরে চেয়ারটা উঠানের কোণে এনে রেখেছে। ওই জিনিস তো একা বহন করা সম্ভব না। দুজনের আনতেই জান বেরিয়ে যায়।

যাহোক, বিকেলের চা তিনি ওখানে বসেই পান করেন। লোকজন দেখে স্বভাবসুলভ ধমকের গলায় বললেন, কী? ঘটনা কী? বিরাট বহর দেখছি!

গ্রামের মাতবর হচ্ছে মজিদ দেওয়ান। সে কাঁচুমাচু গলায় বলল, ঘটনা জটিল, দারোগা সাহেব।

তা আমি বুঝেছি। নইলে তোরা দল পাকিয়ে আমার কাছে আসতি না। হয়েছে কী? ঘটনা বল।

গ্রামে অচেনা একখান জন্তুর উত্পাত শুরু হয়েছে।

চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে বিষম খেলেন দারোগা। অচেনা জন্তু? উত্পাত? বলিস কী?

তাঁতিপাড়ার বিপিন দারোগা সাহেবকে বলে ‘কর্তা’। সে দুহাত লেবুর মতো কচলাতে কচলাতে বলল, আজ্ঞে, হ্যাঁ কর্তা। মোতালেবের ছাগলছানা খেয়েছে, দবিরের সাদা গরুর পাঁচ দিন বয়সী বকনাটা খেয়েছে আর খেয়েছে দেলোয়ার মুন্সির পালের গোদা রাজহাঁসটা।

কাশেম মোল্লা বলল, রাতদুপুরে ফেউ ফেউ করে ডাকে।

কাশেম কথা বলে অভিনয়ের ঢংয়ে। যেকোনো প্রাণীর ডাক নকল করতে পারে। মানুষের হাঁটাচলা, কথা বলার ধরন নকল করতে পারে। লোক হাসানোর ওস্তাদ। তার এই গুণের কথা দারোগাও জানেন। বললেন, ডাকটা শোনা তো!

সঙ্গে সঙ্গে আহ্লাদে আটখানা হয়ে ঠোঁট সরু করে ফেউ ফেউ করে বার কয়েক ডাকল কাশেম। শুনে লোকজন হেসে ফেলল। দারোগা গম্ভীর। হাসবি না, চিন্তার কথা।

খেয়াঘাটের মাঝির নাম উজির। সে বলল, গ্রামের সবাই ডাকটা দু–চারবার শুনেছে। আপনি শোনেননি সাহেব? ওই কাশেম যেমন করে শোনাল, ঠিক অমন করেই ডাকে।

দারোগা চায়ে চুমুক দিলেন। আমি কী করে শুনব, বল? রাতদুপুরে আমার কি অন্যের ডাক শোনার সময় আছে? নিজের নাক ডাকানোর ব্যাপক শব্দটাই পাই না তো ফেউ ডাক! ওসব তো আমার নাকডাকার কাছে কী বলে, নস্যি নস্যি।

দারোগাবাড়ির অদূরে আবুল ব্যাপারীর বাড়ি। সে বলল, আপনার নাকখান ডাকে বটে সাহেব। আমরা বাড়ি থেকে পরিষ্কার শুনতে পাই। ঠিকই বলেছেন সাহেব। ও রকম ডাকের কাছে বাঘের গর্জনও নস্যি।

ঠিক বলেছিস। একদম ঠিক। ঠা ঠা ঠা, ঠা ঠা ঠা...

মালেক দারোগার হাসিতে এই বিকেলে পুরো হিজলিয়া গ্রামখানায় বেদম একখানা কম্পন লাগল। যেন মৃদু ভূমিকম্প হয়ে গেল। তবে হাসিটা তিনি মাঝপথে থামিয়ে দিলেন। তাঁর প্রিয় আদ্রক চায়ে চুমুক দিতে ভুলে গেলেন। চিন্তিত হলেন। জলদগম্ভীর গলায় ডাকলেন, আবুল।

জি সাহেব।

তুই কী বললি? আমার নাকডাকার কাছে বাঘের গর্জনও নস্যি?

আবুল ভয় পেয়ে গেল। সাহেব কি মাইন্ড করলেন? সর্বনাশ! তাহলে তো মহাবিপদ। এখনই না এত লোকের সামনে বলেন, এক থাপ্পড়ে তোর বত্রিশটা দাঁত আমি ফেলে দেব, ফাজিল কোথাকার! আবার কান ধরে ওঠবসও করাতে পারেন। ভারি একটা বেকায়দায় পড়ে গেল আবুল। কী করবে বুঝতে পারল না। মিথ্যা বলবে? না না, আমি তো বলিনি সাহেব! আমি বলেছি...

মিথ্যাটা কী বলবে, তা–ও খুঁজে পেল না আবুল। দৌড়ে পালাবে কি না ভাবছে।

কিন্তু মালেক দারোগা কথা বলছেন না। চিন্তিত। আপন মনে বাঘ শব্দটা দু–তিনবার উচ্চারণ করলেন। বাঘ বাঘ...। তারপরই যেন কিছু একটা আবিষ্কার করেছেন, এমন গলায় বললেন, ফেউ ফেউ করে ডাকে...ফেউ ফেউ...

কাশেমের পরিকল্পনা বাতিল হয়ে গেল। সে বুঝে ফেলেছে, সাহেব অন্য চিন্তায় ডুবে গেছেন। যাক বিরাট বাঁচা কাশেম বেঁচে গেল। গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক লোক মমিন খাঁ। দারোগা তার দিকে তাকালেন। মমিন খাঁকে তিনি ডাকেন ‘মামু’। এখনো সেই ডাকটা ডাকলেন। মামু।

মমিন খাঁ লাঠি ভর দিয়ে উঠানের মাটিতে পিছন না ঠেকিয়ে বসে আছে। সেই অবস্থায় সাড়া দিল। জে সাহেব।

ফেউ নামে যে একটা জন্তু আছে...

তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই মমিন খাঁ বলল, জে সাহেব, আছে। বাঘের সঙ্গে থাকে। বাঘের সঙ্গে ফেউ বলে একটা কথা আছে না? এ জন্য গ্রামের লোকে চামচাদের বলে ‘ফেউ’; অর্থাৎ...

অর্থ বলতে হবে না। চামচা অর্থ সবাই জানে। মোসাহেব, তাবেদার, তেলবাজ। কিন্তু ঘটনা তো ভয়াবহ। বাঘের সঙ্গে ফেউ; অর্থাৎ গ্রামে একখানা বাঘের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তার সঙ্গে আছে ফেউ। বাঘ নিজে ডাকাডাকি করছে না, ডাকছে ফেউ আর ছাগল, বাছুর, রাজহাঁস ধরে খাচ্ছে ব্যাঘ্র।

গ্রামে বাঘ এসেছে শুনে লোকজন এ–ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগল। ভয়ে আতঙ্কে মুখ শুকিয়ে গেছে সবার। তারা ঘট ঘট শব্দে ঢোঁক গিলল। গ্রামে বাঘ এসেছে? হায় হায়! মহাসর্বনাশ! গরু–ছাগল তো খেয়ে সাফা করবেই, মানুষও মারবে। মানুষও খাবে। হায় হায়! এখন উপায়?

দারোগার চা শেষ হয়ে গেছে। তিনি হাঁক দিলেন। মোবারক।

মোবারক ছুটে এল। জি সাহেব।

আরেক মগ চা লাগা। উঠানে পাটি বিছিয়ে দে। সবাইকে গুড়–মুড়ি দে। দুধ চা দে। বিরাট সলাপরামর্শ আছে। তা–ও আবার সন্ধ্যার আগে আগে শেষ করতে হবে। তালেবকে সঙ্গে নে। বাড়ির লোকজন সবাইকে ডাক। গ্রামে বাঘ এসেছে।

বাঘের কথা শুনে মোবারকের প্রায় ভিরমি খাওয়ার দশা। বিস্ফারিত চোখে, ভয়ার্ত গলায় কোনো রকমে শুধু বলল, বাঘ? গ্রামে বাঘ? তবে তো সাড়ে সর্বনাশ!

এত কথা বলিস না, ফাজিল কোথাকার। যা বললাম তা–ই কর।

মুহূর্তে দারোগাবাড়িতে রটে গেল বাঘের খবর। বাড়ির লোকজন, বউঝি, বাচ্চাকাচ্চা সবাই এসে জড়ো হলো উঠানে। দারোগা গিন্নি তাঁর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে।

গুড়–মুড়ি এল, চা এল। লোকজন পাটিতে বসেছে ঠিকই, তবে উসখুস করছে সবাই। দারোগাবাড়ির মজাদার মুড়ি আর ডেলা ডেলা খেজুর গুড় কারও গলা দিয়ে নামছে না। ঘন দুধের চা চিরতার পানির মতো লাগছে। তবে প্রাণ খুলে কথা বলতে পারছে না কেউ। দারোগার সামনে কে মুখ খুলবে?

মালেক দারোগা অবস্থাটা বুঝলেন। ভরসা দেওয়ার গলায় বললেন, আমি তোদের মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। ভয়ে আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে গেছিস। সেটাই হওয়ার কথা। বাঘ বলে কথা। বনের বাঘ যখন লোকালয়ে আসে, তখন সমূহ বিপদ। গৃহস্থের গবাদিপশু খেয়ে সাফা করবে। ওগুলো সাফা হওয়ার পর খাবে মানুষ। এখনই ব্যবস্থা না নিলে বিপদ, মহাবিপদ। তবে বিপদে সাবধান থাকতে হয়। সাবধানতাটা কেমন হবে, সেই পথ আমি বাতলে দিচ্ছি। ফেউ ডাকটা যেহেতু রাতদুপুরে শোনা যায়, তার অর্থ হচ্ছে বাঘটা রাতে বেরোয়। দূর থেকে ওটাকে ফলো করে ফেউ। ফেউ হচ্ছে গৃহস্থের বন্ধু। এ জন্য ও রকম ফেউ ফেউ করে ডেকে গ্রামের লোককে সাবধান করে। ফেউ তো আর মানুষ না যে সাবধান শব্দটা উচ্চারণ করবে! ওই ফেউ ডাকটার অর্থই হচ্ছে সাবধান; অর্থাৎ সাবধান, তিনি বেরিয়েছেন।

মজিদ দেওয়ান শুকনা গলায় বলল, আমাদের এখন করণীয় কী?

করণীয় একটাই, ফেউ। মানে সাবধানতা।

পথটা বাতলে দেন। কীভাবে সাবধান হব?

সোজা। বিকেল শেষ হতে না হতেই পুরো গ্রাম ঘরের ভেতর ঢুকে যাবে। একজন মানুষও ঘরের বাইরে থাকবে না।

হাঁস–মুরগি, গরু–ছাগল?

রমিজ নামের চাষি লোকটা বলল, আমার ভেড়াগুলো? চৌদ্দটা ভেড়া, সাহেব।

ওদেরও সঙ্গে নিতে হবে।

কথাটা বুঝল না রমিজ। ফ্যাল ফ্যাল করে দারোগার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

বুঝিসনি মূর্খ? আরে মানুষজন, গরু–ছাগল–ভেড়া, হাঁস–মুরগি সবাইকে নিয়ে ঘরে ঢুকতে হবে। কুকুর–বিড়াল ছাড়া বাইরে কেউ থাকবে না। বাঘ যদি আসল বাঘ হয় তাহলে কুকুর–বিড়ালের কোনো ভয় নেই। বিড়াল হচ্ছে বাঘের মাসি। মাসির কোনো ক্ষতি বাঘ করে না। কোন বোনপো তার খালার ক্ষতি সাধন করে, বল? আর কুকুর জীবটাকে বাঘ খুবই ঘেন্না করে।

মমিন খাঁ মিনমিনে গলায় বলল, গরু–ছাগলের সঙ্গে একঘরে বসবাস, এটা কি সম্ভব?

রমিজ বলল, তা–ও গরু–ছাগলের গন্ধ সহ্য করা যায়। আমার ভেড়াগুলোর গায়ে যে বদগন্ধ, ওগুলোর সঙ্গে বউ–বাচ্চা নিয়ে একঘরে থাকব কেমন করে?

বিপদের সময় অনেক কিছু করতে হয়রে, মূর্খ।

আজিজ বলল, কিন্তু এভাবে কত দিন চলবে? বাঘ কবে বিদায় হবে, তা তো আমরা জানি না। যদি রাতের বেলা ঝোপজঙ্গল থেকে বেরিয়ে শিকার না পায়, তাহলে তো দিনের বেলাই আক্রমণ করবে। গরু–ছাগল পেলে খাবে, যদি মানুষ আক্রমণ করে? যদি মানুষ ধরে খায়?

দারোগা নির্বিকার। তা তো খাবেই।

তাহলে উপায়? আমরা কি দল বেঁধে গ্রাম পাহারা দেব? যদি ওটাকে মারতে পারি, তবেই তো কেল্লা ফতে।

এটা একটা পথ বটে। তবে আমি বেঁচে থাকতে তোদের সবাইকে এই তকলিফ আমি দিতে চাই না। বাঘ তাড়াব একা আমি। আজ থেকে আমার রাতের ঘুম হারাম। আমি ব্যাঘ্র শিকারে ব্যস্ত হব। মোবারক, তালেব! আমার দোনলা বন্দুকটা বের কর। কার্তুজ বের কর। বন্দুক সাফ করার বুরুসটা বের কর। বন্দুকে তৈল মর্দন করতে হবে। তৈল বের কর। দেওয়ান...

জি সাহেব।

তোমার ছাগল আছে কয়টা?

আটটা আছে, হুজুর।

ছোট সাইজের দুইটা ছাগল আমার কাছে বিক্রি করো। এখনই বাড়ি গিয়ে নিয়ে আসো। নগদ দাম পাবে। হয়তো ছাগল দুটো বাঘের পেটে যাবে অথবা তার হাতে খুন হয়ে যাবে। তাতে ক্ষতি নেই। বড় কিছু পেতে হলে ছোট কিছু খোয়াতে হয়। ছাগল নিয়া আসো। আর বাঘের একটা গতি না হওয়া পর্যন্ত যেভাবে বললাম ওইভাবে, ফেউ। মানে সাবধান। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, তোমরা বিদায় হও।

গ্রাম চলছে দারোগার কথামতোই। সন্ধ্যার আগে আগেই যে যার গবাদিপশু আর হাঁস–মুরগি নিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করছে। যে বাড়ির গৃহস্থ একটু সচ্ছল, বাড়িতে ঘরের সংখ্যা একটার বেশি, তারা আরামেই আছে। গরু–ছাগল–ভেড়া, হাঁস–মুরগি নিজেদের বসত ঘরে না ঢুকিয়ে অন্য ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বাইরে থেকে এমনভাবে বন্ধ করছে, বাঘের বাবারও সাধ্য নেই সেই দরজা ভাঙার। তারপরও সাবধানতার শেষ নেই। অনেকে ঘুমায়ই না রাতে। জেগে থাকে। বিকেল হলো কি গ্রামটা মরে গেল। একদম ঠান্ডা, চুপচাপ গ্রাম। এই গ্রামে যে মানুষ আছে, টেরই পাওয়া যায় না। এমনকি দিনের বেলাও একা একা চলাফেরা করা ছেড়ে দিল লোকে। দল না বেঁধে কেউ কোনো দিকে যায় না। হাতে লাঠিসোঁটা থাকে, সড়কি–বল্লম থাকে। মাছ ধরার ট্যাটাও থাকে কারও কারও হাতে। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে বাঘ যদি আক্রমণ করে, তাহলে তারা বসে থাকবে না। যে যেভাবে পারে উল্টো আক্রমণ করবে বাঘকে।

এটা একটা পথ বটে। তবে আমি বেঁচে থাকতে তোদের সবাইকে এই তকলিফ আমি দিতে চাই না। বাঘ তাড়াব একা আমি। আজ থেকে আমার রাতের ঘুম হারাম। আমি ব্যাঘ্র শিকারে ব্যস্ত হব। মোবারক, তালেব! আমার দোনলা বন্দুকটা বের কর।

ওদিকে বাচ্চাকাচ্চারা স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। বাড়ি থেকে বেরই হয় না ছোটরা। উঠান–আঙিনাতেই খেলাধুলা করে। এদিক–ওদিক চোখ রাখে সারাক্ষণ। এই বুঝি বাঘ এল!

বাজারঘাট বন্ধ হয়ে যায় দুপুর শেষ হতে না হতেই। খেয়াঘাটের মাঝিরা বিকেল হতে না হতেই নৌকা ঘাটে বেঁধে বাড়ি চলে যাচ্ছে। দোকানিরা দোকানপাট বন্ধ করে দিচ্ছে; অর্থাৎ পুরো গ্রাম অচল। ওদিকে রাতে হঠাৎ হঠাৎ শোনা যাচ্ছে ফেউ ডাক। সন্ধ্যারাতের দিকে, মাঝরাত আর ভোররাতের দিকে। কয়েকবার ডেকেই থেমে যায় জন্তুটা। গ্রামটাকে সাবধান করে। বাঘ বেরিয়েছে। সাবধান। সেই ডাকে ঘরের ভেতরই ভয়ে জড়সড় হয়ে যাচ্ছে মানুষ। শিশুরা ঘুম ভেঙে ভয়ে–আতঙ্কে মা–বাবার বুকে মুখ লুকাচ্ছে। ভয়াবহ এক আতঙ্কের পরিবেশ।

এই পরিবেশ কীভাবে স্বাভাবিক করা যায়, সেই চিন্তায় আহার–নিদ্রা প্রায় ত্যাগ করেছেন মালেক দারোগা। সেদিনের পর থেকে দোনলা বন্দুক হাতে মোবারক আর তালেবকে নিয়ে দিনের বেলা গ্রামের এদিক–ওদিক চক্কর খাচ্ছেন। মোবারক ও তালেবের একজনের হাতে চকচকে সড়কি আরেকজনের হাতে বল্লম। মোবারক সামনে, তালেব পেছনে মাঝখানে দারোগা। লোকজনের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের ভরসা দিচ্ছেন। ভয়ের কিছু নেই। আমি আছি। ওই বাঘ আমি মারবই। দিনে হোক বা রাতে হোক, হার্মাদটাকে আমি বাঁচতে দেব না।

দিনে চলে এই কাণ্ড আর সন্ধ্যার পর দারোগাবাড়িতে শুরু হয় আরেক কাণ্ড। বাড়ির পেছন দিকে বিশাল বাগান, ঝোপজঙ্গল আর বাঁশঝাড়। ওদিকে পরিত্যক্ত মালসামান রাখার বেশ বড় একটা ঘর। তিন দিন আগে মজিদ দেওয়ানরা চলে যাওয়ার পরপরই সেই ঘর সাফসুতরা করলেন দারোগা। নিজের বিশাল চেয়ার স্থাপন করলেন ঘরের পেছন দিককার বড় জানালাটার কাছে। লোহার শিক বসানো জানালা। দুই শিকের মাঝখান দিয়ে দোনলা বন্দুকের নল অনায়াসে বারমুখী করা যায়।

বাড়ি গিয়েই ছোট সাইজের দুটো ছাগল নিয়ে এসেছিল মজিদ দেওয়ান। সেই দুটোকে বাঁধা হয়েছে জানালার বাইরে, ঘর থেকে খানিকটা দূরে একটা কদমগাছের সঙ্গে। কাঁঠালপাতা হচ্ছে ছাগলের প্রিয় খাবার। প্রচুর কাঁঠালপাতা রাখা হয়েছিল জীব দুটোর সামনে। তখনো সন্ধ্যা হয়নি দেখে উহারা মনের আনন্দে কাঁঠালপাতা খেয়ে যাচ্ছিল।

ওদিকে দারোগা সাহেব তাঁর চেয়ারে সমাসীন হয়ে, জানালার দুটো কপাট সামান্য ফাঁক করে দুই শিকের মাঝখান দিয়ে দোনলা বন্দুকের মাথা বের করে দিয়েছেন বাগানের দিকে। ঘরে কোনো আলো নেই। চেয়ারের পাশে বিশাল দুখানা ফ্লাস্ক ভর্তি তাঁর প্রিয় আদ্রক চা। মগখানাও ভরা আছে চায়ে। ওসব রাখা হয়েছে ছোট একটা টেবিলে। তিনি যেভাবে বলেছেন, সেভাবেই সব ব্যবস্থা করেছে মোবারক আর তালেব। সে দুজনও চুপচাপ বসে আছে মেঝেতে।

তবে বেজায় মশা এদিকটায়। ছাগল দুটো জান–পরান দিয়ে ডাকতে শুরু করেছে। বাগানের ঝোপঝাড় আর পুকুর–ডোবায় যত মশা ছিল তারা সবাই এই ঘরে এসে ঢুকেছে। সমানে কামড়ে যাচ্ছে মোবারক আর তালেবকে। মালেক দারোগাকেও ছাড়ছে না। গ্রামের লোকে সমীহ করলে কী, মশারা কি আর দারোগা–পুলিশ চেনে? তারা তাদের কাজ চালিয়ে গেল। মোবারক আর তালেব এক–দুবার শব্দ করে মশা মারল। সঙ্গে সঙ্গে হিসহিস করে উঠলেন দারোগা। খবরদার শব্দ করবি না।

মোবারক ভয়ে ভয়ে বলল, বেজায় মশা, সাহেব।

কামড় খা, মুখ বুজে কামড় খা। আমিও খাচ্ছি।

তালেব বলল, আপনি খেলে তো কথাই নেই। আমাদেরও খেতে হবে। তবে সাহেব, বাঘের চেয়ে মশাটা বেশি হার্মাদ।

চুপ কর ফাজিল কোথাকার। এক থাপ্পড়ে বত্রিশটা দাঁত ফেলে দেব।

তালেব বলল, সাহেব, মশা না হয় সহ্য করলাম, কিন্তু ছাগলের ডাক! এই জিনিস তো রাতভর ভ্যা ভ্যা করবে?

ওটাই তো আমি চাই। উহারা যত ভ্যাবাবে, সম্ভাবনা তত প্রকট হবে। টর্চলাইট দিয়েছিস তো? হ্যাঁ, এই তো হাতের কাছেই আছে। নে, এখন একদম চুপ কর। যেন তোরা জীবিত না। আমিও সেই পথই ধরছি। আমারও এমন ভঙ্গি, যেন মরা মানুষ। আদ্রক চা পান করব এমন নিঃশব্দে, নিজেও টের পাব না।

বেদম আজাবে আছে মোবারক আর তালেব। বসে বসে মশার চতুর্দিককার আক্রমণ সয়েও তারা প্রায়ই ঘুমিয়ে পড়ছে। সেই অবস্থা গভীর অন্ধকার ঘরেও টের পাচ্ছেন মালেক দারোগা। টের পেয়েই পা দিয়ে দিচ্ছেন গুঁতা। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম হাওয়া দুজনার। দিনে সড়কি–বল্লম হাতে সাহেবের সঙ্গে গ্রাম চষা আর রাতে এই অবস্থা, দুজনের অবস্থাই কেরোসিন।

এই কেরোসিন জিনিসটা দ্বিতীয় রাত থেকে তাদের রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়াল। মশার কামড়ে হাত–পা আর শরীরের বিভিন্ন জায়গা ফুলে তো গেছেই, শরীরের রক্ত এক রাতেই বোধ হয় অর্ধেক সাবড়ে দিয়েছে মশায়। এত যে জাঁদরেল মালেক দারোগা, তাঁকেও রেহাই দেয়নি। তাঁকে কামড়েছে বেশি। ফলে মশাদের ওপর তাঁরও বিরক্তির সীমা–পরিসীমা নেই। অন্য সময় সন্ধ্যাবেলা বাড়িতে ধূপ দেওয়া হয়। ধূপের ধোঁয়ায় মশা পালায়। আর ঘুম তো মশারির তলায়। সুতরাং বাড়ির মশাগুলো যে এই প্রকারের হারামি, এ তাঁর জানা ছিল না। সারা রাত বাঘের অপেক্ষায় থেকে, বন্দুকের নল তাক করে বাঘের চেয়ে মশার কথাই ভেবেছেন বেশি মালেক দারোগা। রাতে কয়েকবার ফেউ ডাক শুনলেন। ছাগল দুটোর ভ্যাবানির ফাঁক গলেই ডাকটা বার কয়েক এল। দারোগা উদ্‌গ্রীব হলেন। এই বুঝি বাঘের টর্চলাইটসম চক্ষুদ্বয় দেখতে পাবেন আর গুলি চালাবেন। সেই কাজ হলো না। রাত নির্বিঘ্নে কেটে গেল। সকালবেলা ভাবলেন, মশারি টাঙিয়েই চেয়ারে বসে থাকবেন কিনা সারা রাত। মশারির ফাঁক দিয়ে, অথবা মশারি ফুটো করে সেই পথে বন্দুকের নল প্রবিষ্ট করিয়ে, দুই শিকের মাঝখান দিয়ে বাগান বরাবর তাক করে রাখবেন। তালেবের কথায় সেই পরিকল্পনা বাদ দিলেন।

তালেব আর মোবারক সকালের নাশতা খেতে বসে আলাপ করছিল। তাদের আলাপ এ রকম:

তালেব: ভাই মোবারক, শুনেছি বাঘ কোনো শিকার করলে প্রথমে তার টুঁটি কামড়ে ধরে। দমবন্ধ করে সেটাকে মেরে প্রথমে তার রক্তটা চুকচুক করে খায়। তারপর খায় গোশত। হাড়গোড়।

মোবারক: আমিও এমনই শুনেছি রে ভাই। সত্য–মিথ্যা জানি না। চোখে তো আর দেখিনি! কী করে তোর কথা মেনে নেই!

তালেব: মানতে তোকে বলিনি, ভাই। শোনা কথা তোকে বললাম। তবে কাল রাতের অভিজ্ঞতায় আমার মনে হয়েছে, বাঘের চেয়েও বহুগুণ কঠিন জিনিস হচ্ছে ওই মশা। বাঘ তো জীব মেরে তারপর রক্ত খায়, মশা বদমাশগুলো তো জ্যান্ত জীবের রক্তই শরীর থেকে টেনে নিচ্ছে!

মোবারক: এটা একদম খাঁটি কথা রে ভাই। কবে যে এই আজাব থেকে মুক্তি পাব, কে জানে। তত দিনে মশা–ই আমাদের খেয়ে ফেলবে। এভাবে তিলে তিলে মরার চেয়ে বাঘের হাতে মারা পড়া অনেক ভালো রে ভাই। বাঘের টোপ হিসেবে ছাগল না বেঁধে আমাদের দুজনকেই তো কদমগাছে বেঁধে রাখতে পারত! আমরা না হয় ছাগলের মতো ভ্যাবাতাম।

তালেব: ধুত্, কী যে বলিস ভাই। মশার যম আমি বের করে ফেলেছি। ওই জিনিস সন্ধ্যার আগেই শরীরে মেখে নেব। দেখবি মশা শরীরে বসা তো দূরের কথা, কাছেই আসবে না।

মোবারক: এ তো বিরাট আনন্দের কথা। তা বস্তুটা কী রে ভাই? কী মাখাবি শরীরে? গোবর নাকি?

তালেব: আরে না রে পাগল। মাখব কেরোসিন। শরীরে কেরোসিন মাখলে মশায় কামড়ায় না।

হঠাৎ পেছন থেকে জলদগম্ভীর গলায় কে যেন বলল, তাহলে আমার শরীরেও লাগিয়ে দিস। আমার রক্তও ওরা কম খায়নি।

দুজন চমকে পেছন ফিরে দেখে, অম্লান বদনে দাঁড়িয়ে আছেন দারোগা সাহেব। তাঁর গাল–মুখ, হাত–পা মশার কামড়ে এমন করে ফুলেছে যেন জলবসন্ত হয়েছে।

ভয়ে–আতঙ্কে মোবারক আর তালেব নাশতা খেতে ভুলে গেল।

মালেক দারোগা বললেন, তোদের আলোচনা পুরোটাই আমি শুনেছি। তবে মাইন্ড করিনি। আগে ব্যাঘ্রটা নিধন করি, তারপর এই নিয়ে মাইন্ড করব। তবে তোরা চাইলে মজিদ দেওয়ানের ছাগল দুটো ফেরত দিয়ে তোদের দুটিকে ওই ছাগলের কায়দায় কদমগাছে বাঁধতে পারি। বল, চাইছিস? তবে শর্ত একটাই, তোদের কিন্তু ছাগল দুটির অনুকরণে সারা রাত ভ্যা ভ্যা করতে হবে। তোদের ডাকে আকৃষ্ট হয়ে বাঘ আসবে আর আমি বন্দুক চালাব। আমার নিশানা খুব কমই ব্যর্থ হয়। কিন্তু বহুদিন বন্দুক চালাই না। বাঘের গায়ে না লেগে গুলি তোদের গায়েও লাগতে পারে। রাজি?

ভয়ে আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে মোবারক আর তালেব মালেক দারোগার প্রাপ্তবয়স্ক কলাগাছের মতো দুপা দুজনে জড়িয়ে ধরল। না না, সাহেব। ওই কাজ করবেন না। আমাদের ভুল হয়েছে। মাফ করেন।

যা মাফ করলাম। তবে কেরোসিন আগে আমার গায়ে মাখাবি, তারপর তোদের গায়ে।

তিনজন মানুষ শরীরে কেরোসিন মেখে দ্বিতীয় রাত শুরু করল।

দারোগা গিন্নি চুপচাপ ধরনের মানুষ। ঘর থেকে তেমন বেরোন না। হাঁটুতে গেঁটেবাত আছে। মরিয়ম নামের একটা মেয়ে তাঁর দেখাশোনা করে। তবে ঘরে বসেই তিনি সংসার পরিচালনা করেন। সংসারের সব দিকেই চোখ। স্বামীর চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন এলাকায় থেকেছেন। যে এলাকায় গেছেন, সেই এলাকার বউঝিরা তাঁর কাছে আসত। তাদের নানা রকম সমস্যা মেটাতেন তিনি। খুবই বুদ্ধিমতী, বিচক্ষণ মহিলা। হিজলিয়ার বউঝিরাও নানা রকম পরামর্শ নেওয়ার জন্য তাঁর কাছে আসে। তিনি শান্ত ভঙ্গিতে শুনে পরামর্শটা।

গ্রামে বাঘ এসেছে শোনার পর থেকে তিনিও চিন্তিত। গতকাল দল বেঁধে কোলে–কাঁখে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে নানা বয়সী মহিলারা এসেছিল তাঁর কাছে। তখন এগারোটার মতো বাজে। মোবারক আর তালেবকে নিয়ে বেরিয়ে গেছেন সাহেব। মহিলারা এসে তাদের ভয় আতঙ্কের কথা বলে গেছে। কী করণীয়, জানতে চেয়েছে। তিনি সবাইকে ভরসা দিয়েছেন। সাহেব যখন বাঘের পেছনে লেগেছেন, হয় ওটাকে তিনি গ্রামছাড়া করবেন, নয় মারবেন। ভয় পেয়ো না। তবে সাবধানে থাকো। সাহেব যেভাবে বলেছেন, সেভাবে চলো।

সকালে নাশতা করতে বসে সাহেবকে বললেন, বাঘ মারা পড়ছে না কেন?

এই একজন মানুষের কাছে মালেক দারোগা মেকুর হয়ে থাকেন। মেকুর মানে বিড়াল। তাঁর যাবতীয় জাঁদরেলপনা, গাম্ভীর্য আর ব্যক্তিত্ব এই একটা জায়গায় ধরা। মিনমিনে গলায় বললেন, আমি তো চেষ্টার কমতি করছি না। রাত জেগে জেগে দেখো কেমন রোগা হয়ে গেছি।

রাখো তোমার রোগা হওয়া! এই দেহ আর কত রোগা হবে? গ্রামের লোকজন ভয়ে আতঙ্কে মারা যাচ্ছে, গ্রাম আর গ্রাম নেই। যত তাড়াতাড়ি পারো, বাঘের ব্যাপারে ব্যবস্থা নাও।

তা ঠিক, তা ঠিক। আমি দেখছি। তবে তোমাকে একটা কথা বলে রাখছি। রাতের বেলা গুলির শব্দ পেলে বাড়ির কেউ যেন ঘর থেকে না বেরোয়। হার্মাদটাকে মারতে পারলে ওটিকে দেখার জন্য পাগল হয়ে যাবে লোকে। দেখবে, নিশ্চয় দেখবে। তবে দেখবে দিনের বেলা। রাতে না।

গিন্নির কথায় দারোগাও অতিসূক্ষ্ম একটা হাসি হাসলেন। মেরে ফেলব, দুয়েক রাতের মধ্যেই ওটাকে কতল করব।

গিন্নি তীক্ষ্ণ চোখে দারোগার মুখপানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। কী বুঝলেন, কে জানে! অতিমৃদু একখানা হাসি ফুটল কি ফুটল না, এমন অবস্থা হলো তাঁর মুখের। বললেন, কথাটা গ্রামের লোকজনকেও বলে দাও। গুলির শব্দ পেলে রাতের বেলায় যেন তারা না বেরোয়। সকালবেলা যেন দেখতে আসে, বাঘটা তুমি মারতে পেরেছ কি না।

ঠিক, একদম ঠিক। তবে বড় কষ্টের কাজে পড়েছি গো। রাত জেগে ওভাবে বসে থাকা, ছাগল দুটোর ভ্যাবানিতে কানের পোকা খসে যাচ্ছে। এক টিন কেরোসিন শুধু আমার জন্যই খরচ হয়ে গেছে, তারপরও মশার হাত থেকে রেহাই পাচ্ছি না...

তুমি একটা জনহিতকর কাজ করছ বলে তোমাকে আমি কিছু বলছি না। কেরোসিনের গন্ধ আমার খুবই অপছন্দ। তোমার গা থেকে কেরোসিনের গন্ধ ভক ভক করে আসছে। তারপরও তিনবেলা খাওয়ার সময় তোমাকে আমি এই ঘরে ঢুকতে দিচ্ছি। বাঘ–ফেউয়ের ঝামেলা তাড়াতাড়ি মিটাও। গ্রামের লোকজন হাঁফ ছেড়ে বাঁচুক, আমি বাঁচি কেরোসিনের গন্ধ থেকে।

গিন্নির কথায় দারোগাও অতিসূক্ষ্ম একটা হাসি হাসলেন। মেরে ফেলব, দুয়েক রাতের মধ্যেই ওটাকে কতল করব।

সেই রাতেই ঘটে গেল ঘটনা।

দিনের বেলা গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দারোগা বলে এলেন, রাতের বেলা গুলির শব্দ শুনলেই কেউ যেন অতিউত্সাহী হয়ে ঘর থেকে না বেরোয়। গুলি অনেক সময় ফসকেও যেতে পারে। দেখা গেল গুলি খেয়েও মরল না বাঘ, আহত হলো, তাহলে বিপদ আরও বাড়বে। আহত বাঘ আরও আরও বিপজ্জনক। এখন রাতে বেরোচ্ছে, আহত হলে দিনেও বেরোবে। গরু–ছাগল রেখে মানুষকে আক্রমণ করবে। সুতরাং ফেউ; অর্থাৎ সাবধান।

সন্ধ্যাবেলা বাগানের ঘরে ঢুকে দারোগা ডাকলেন, মোবারক, তালেব।

জি সাহেব।

সব ঠিকঠাক আছে?

একদম ঠিক আছে, সাহেব।

জিনিসগুলো এই ঘরে এনে রেখেছিস?

রেখেছি, সাহেব।

ভেরি গুড, ভেরি গুড।

শরীরে কেরোসিন মেখে গুছিয়ে নিজের চেয়ারে বসলেন দারোগা। বন্দুকের নল জানালা দিয়ে বের করে আদ্রক চায়ে চুমুক দিলেন। চায়ে প্রথম চুমুক দিয়ে আরামের একটা শব্দ করেন তিনি, সেই শব্দটা করলেন না। কেরোসিনের গন্ধে অস্থির লাগছে।

গভীর রাতে খুব কাছাকাছি তিন–চারবার ফেউ ফেউ ডাক শোনা গেল। এই ডাকের সঙ্গে সঙ্গেই গ্রামের নেড়িগুলো ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। বাজারঘাটে চরে বেড়ানো কুকুর থাকে দল বেঁধে। ঘেউ দিতে শুরু করে দল বেঁধেই। তবে গ্রামের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। এখন সেগুলোকে আর বাইরে রাখছে না লোকে। গবাদিপশু আর হাঁস–মুরগির সঙ্গে পোষা কুকুরগুলোকেও বসতঘরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। বিড়াল তো ঘরেই থাকে। তবে মানুষের আচরণে আর ওই ফেউ ডাকে অবোধ প্রাণীগুলোও বুঝতে পারছে, কিছু একটা অস্বাভাবিক ঘটনা গ্রামে ঘটেছে। মানুষের মতো তারাও চিন্তিত।

কাছাকাছি ফেউ ডাক আর সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের বিভিন্ন প্রান্তে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনে কদমগাছে বাঁধা ছাগল দুটো তারস্বরে ভ্যা ভ্যা শুরু করল। এতক্ষণ বসে ছিল, এবার উঠে দাঁড়াল। দারোগার একটু ঝিমুনি এসেছিল, ঝিমুনিভাব কেটে গেল। মোবারক আর তালেব কেরোসিন মেখে বোমভোলানাথ হয়ে বসে আছে মেঝেতে, তারা প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিল, ফেউ ডাকে, নেড়িদের ডাকে তারাও ঘুমভাব কাটিয়ে সোজা হয়ে বসল।

দারোগা অতি সাবধানে ফ্লাস্ক থেকে চা ঢাললেন মগে, নিঃশব্দে চুমুক দিয়ে একেবারে জিম করবেটের ভঙ্গিতে দোনলা বন্দুকের ট্রিগারে আঙুল রেখে ওত পাতলেন। আঙুল ট্রিগারে, চোখ বাইরের অন্ধকারে। হাতের কাছে টর্চলাইটটা আছে।

একসময় বাঁশঝাড়ের দিকটায় শিশুদের খেলনা টর্চলাইটের মতো দুটো আলো জ্বলতে দেখা গেল। বাঘের চোখ অন্ধকারে এভাবে জ্বলে। শিয়াল–কুকুর–বিড়ালের চোখও জ্বলে। গরু–ছাগলের জ্বলে। মালেক দারোগা বুঝে গেলেন, সে আসছে। এখন স্থির হয়ে আছে বাঁশঝাড়তলায়, অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে। ছাগল দুটোও সেই চোখ দেখতে পেয়েছে। তাদের ভ্যা ভ্যা চিত্কার যেমন বেড়েছে, ছটফটানি বেড়েছে তার চেয়ে শত গুণ। প্রাণপণে চেষ্টা করছে দড়ি ছিঁড়ে পালানোর।

চোখ দুটো ছাগলের দিকে এগোতে লাগল। অতিধীর ভঙ্গি। ছাগলদ্বয়ের ডাক তীব্র হয়েছে, ছটফটানি হয়েছে সীমাহীন। চোখ দুটো এগোচ্ছে, ছাগল দুটোর কাছাকাছি আসার আগেই মালেক দারোগা ট্রিগার টিপলেন। ভ্রুম করে বিকট শব্দ। পুরো হিজলিয়া গ্রাম কেঁপে উঠল। আর করুণ আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়ল জীবটি।

মালেক দারোগা আহ্লাদে আটখানা হয়ে বললেন, মোবারক, তালেব কেল্লা ফতে করে ফেলেছি। আলো জ্বাল, আলো জ্বাল।

অলংকরণ: তুলি

ওরা দুজন তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। হারিকেনবাতি জ্বালল।

মালেক দারোগা জানালার কপাট পুরো খুলে টর্চলাইটের আলো ফেললেন। যা অনুমান করেছেন, তা–ই। মোবারক আর তালেবকে নিয়ে বাইরে এলেন। তিনজনের হাতে তিন রকম আলো। তাঁর হাতে শক্তিশালী টর্চ জ্বলছে, মোবারকের হাতে হারিকেন আর তালেবের হাতে একটা কুপি। এই ত্রিমুখী আলোয় জীবটা দেখা গেল। গুলিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে মুখ–মাথা, বাকি দেহ অক্ষত। তালেব বেকুবের গলায় বলল, সাহেব, বাঘ তো মারা পড়েনি। এইটা তো একটা শিয়াল।

তাকে একটা ধমক দিলেন দারোগা সাহেব। চুপ কর ফাজিল কোথাকার। আগে ছাগল দুটোকে ঘরে নে। আজাব থেকে মুক্তি দে। তারপর এই বজ্জাতটাকে ঘরে নে। মোবারক, হলুদ রং আর আলকাতরা এনেছিস?

ওসব তো সাহেব তিন দিন আগেই এই ঘরে এনে রেখেছি।

ভেরি গুড, ভেরি গুড। চল, এখন কাজটা সারি।

প্রথমে ছাগল দুটোকে ঘরে আনা হলো, তারপর চ্যাংদোলা করে আনা হলো শিয়ালটা। নিজহাতে দরজা–জানালা বন্ধ করে মালেক দারোগা বললেন, এবার বজ্জাতটাকে বাঘ বানা। কীভাবে বানাতে হবে, বুঝেছিস তো?

মোবারক কেলানো গলায় বলল, কী যে বলেন, সাহেব? তা আর বুঝিনি?

তালেব বলল, আমিও বুঝেছি। হে হে।

তাহলে দেরি করছিস কেন? কাজে লেগে যা।

ছাগল দুটো ঘরে এসে প্রাণে বেঁচেছে। এখন আর ভ্যাবাচ্ছে না। নিশ্চিন্ত মনে এক কোণে বসে জাবর কাটছে। মোবারক আর তালেবের কাজ তদারক করতে বসলেন মালেক দারোগা। হাতে মগভর্তি আদ্রক চা।

দারোগাবাড়ির সামনের মাঠে গ্রামের লোকজন ভেঙে পড়েছে। এলাকায় বাঘ আসার খবর যেমন মুহূর্তে ছড়িয়েছিল চারদিকে, মালেক দারোগার তিন রাত্রির চেষ্টায় সেটা যে মারা পড়েছে, দারোগা নিজেই যে দোনলা বন্দুকের গুলিতে মেরেছেন, এই খবর রটতেও দেরি হয়নি। রাতে গুলির আওয়াজ পেয়েই তারা বুঝেছে, কাজ হয়ে গেছে। তা ছাড়া মালেক দারোগা কোনো কিছুর পেছনে লেগেছেন আর সেই কাজ হয়নি, এমন ইতিহাস নেই।

দারোগার সাবধান বাণীও তাদের মনে ছিল। এই কারণে দারোগাবাড়ির আশ্রিতরাও কেউ ঘর থেকে বেরোয়নি। বাগানের ঘরে বসে মোবারক আর তালেব দারোগার কথামতো কাজ যা করার করেছে।

কাজ শেষ হতে হতে ভোররাত। তখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছে তারা। মাঠের এক কোণে বড় একটা গর্ত খুঁড়েছে মোবারক আর তালেব। দারোগা টর্চ হাতে কাজের তদারক করেছেন। গর্তের চারপাশে বাঁশের খুঁটি পুঁতে একটা বৃত্ত তৈরি করা হয়েছে। মোটা দড়ি দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে বৃত্ত। বাঘ সাজানো শিয়ালটা এনে রাখা হয়েছে গর্তের পাশে। হারিকেন কুপি আর মালেক দারোগার টর্চের আলোয় জীবটাকে অদ্ভুত লাগছিল। তবে কাজটা যথাসম্ভব নিখুঁত করার চেষ্টা করেছে মোবারক আর তালেব।

প্রথমে বড় একটা বুরুস দিয়ে হলুদ রং করা হয়েছে শিয়ালটাকে। তারপর আলকাতরা দিয়ে ডোরাকাটা হয়েছে। দেখতে মন্দ হয়নি। আদ্রক চায়ের মগ হাতে খুবই পরিতৃপ্ত ভঙ্গিতে মোবারক আর তালেবের কাজ তদারক করেছেন সাহেব, একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে। কাজ শেষ হওয়ার পর দুজনের কর্মদক্ষতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। গদগদ গলায় বলেছেন, তোদের প্রতিভার কোনো তুলনা হয় না রে ফাজিল দুটি। আমি যা চেয়েছি ঠিক তা–ই করতে পেরেছিস। শহর–বন্দরে থাকলে তোরা বড়মাপের শিল্পী হতি। মেঠো ইঁদুর ধরে সেটাকে বিড়াল বানাতে পারতি, বিড়ালকে পারতি কুকুর বানাতে। চাইলে ছাগলের দাড়ি কামিয়ে সেটাকেও হলুদ রং আর আলকাতরা মাখিয়ে বাঘ বানাতে পারতি। আমি সত্যি তোদের কাজে মুগ্ধ। পাঁচটি করে টাকা বকশিশ পাবি। এখন মাঠের ধারে চল।

জীবটাকে গর্তের পাশে অতিযত্নে রাখার পর আনা হলো দারোগার চেয়ার। আনা হলো সেই টেবিল, দোনলা বন্দুক আর ফ্লাস্ক ভর্তি চা। দুটো ছাতা আনা হলো। দারোগা জাঁকিয়ে বসলেন চেয়ারে। বন্দুকটা চেয়ারের পাশে দাঁড় করানো।

দারোগা বসার পর তাঁর দুই পাশে মাঠের ঘাসে বসল মোবারক আর তালেব। এত কাজ করে তারা খুবই ক্লান্ত। ঘুমও পাচ্ছে খুব। ঘন ঘন হাই উঠছে। তারপরও মনের আনন্দে হাই তুলতে পারছে না। দারোগা বিরক্ত হবেন।

সকাল হলো। গ্রামের লোকজন একজন–দুজন করে আসতে লাগল। মৃত বাঘ দেখে তারা আনন্দে আটখানা। তবে দেখতে হচ্ছে দূর থেকে। দড়ির বৃত্তের ভেতর আসা যাবে না। মোবারক আর তালেব সমানে এই ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে।

আস্তে আস্তে ভিড় বাড়ছে। বাড়ির বউঝিরাও দল বেঁধে আসছে। বাচ্চাকাচ্চারা আসছে। ছেলে–বুড়ো কেউ বাদ নেই। রোদ ওঠার আগেই মাঠ এমন ভরা ভরল, লোক দাঁড়ানোর জায়গা নেই। মালেক দারোগার মুখে বিজয়ীর হাসি।

কিন্তু বাঘটা এত রোগা কেন?

এত সরু কেন?

গুলিতে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরও বাঘের মুখের মতো মনে হচ্ছে না মুখ। লেজটা যেন কেমন! একটু যেন শিয়াল শিয়াল ভাব। সকালবেলার রোদ এসে পড়েছে মাঠে। মোবারক আর তালেব দুখানা ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে আছে দারোগার দুই পাশে। রোদ পড়েছে মৃত জীবটার দেহে। হলুদ আর কালো রং চকচক করছে।

এ সময় মোবারক আর তালেব মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। দুজনেই ব্যাপারটা বুঝেছে। কাণ্ড একটা হয়ে গেছে! চার পা, শরীর পুরোটাই হলুদ আর কালোয় রং করা হয়েছে শুধু লেজে রং করতে মনে ছিল না। বাঘের লেজেও তো হলুদ কালোর মিশেল থাকে।

কী করা এখন?

সাহেবের চোখেও নিশ্চয় এখন ত্রুটিটা ধরা পড়বে। লোকজনের চোখেও পড়বে। তাহলে উপায়?

মোবারক আর তালেব দমবন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল। সাহেব নিশ্চয় বেতের লাঠি দিয়ে পিটিয়ে সোজা করবেন তাদের।

তখন চারদিকে নানা রকমের কথাবার্তা, ফিসফাস শুরু হয়ে গেছে। বড়রা কেউ পরিষ্কার করে কথা বলার সাহস পাচ্ছে না। মালেক দারোগার সামনে কে মুখ খুলবে? তারা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। কানাকানি করছে। সন্দেহ করছে।

দারোগা নিজেও ততক্ষণে লেজের ব্যাপারটা ধরে ফেলেছেন। ভুলটা তারও। তিনি নিজেও তো রং করার সময় সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তখন কেন তাঁর চোখে পড়েনি? এখন তো ব্যাপারটা সামাল দিতেই হবে। কীভাবে দেবেন?

চায়ের মগে বড় করে একটা চুমুক দিলেন দারোগা। গলা খাঁকারি দিলেন। তারপর শুরু করলেন বক্তৃতা। মানুষের মনোযোগ অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা নিলেন। বললেন, তিন দিনের, না না, তিন রাতের চেষ্টায় হতচ্ছাড়াটাকে কতল করার পর, হারিকেন–কুপি আর টর্চের আলোয় এটিকে দেখে আমিও তোমাদের মতো বেকুব হয়ে গেছি। এটি কোন প্রকারের বাঘ? এত রোগা পটকা সরু বাঘ আমি জীবনে দেখিনি। বাঘ তো আমি আর নতুন শিকার করছি না। সুন্দরবন এলাকায় দারোগা থাকার সময় তিনটা রয়েল বেঙ্গল মেরেছি। বনের পাশের গ্রামে এসে হানা দিচ্ছিল। আমাদের গ্রামের মতোই গৃহস্থের গরু–ছাগল মেরে খাচ্ছিল। তখন কয়েক মাসের ব্যবধানে দুটোকে এই বন্দুক দিয়েই মেরেছিলাম। কী রে মোবারক, কী রে তালেব, মেরেছিলাম না?

দুজন সমস্বরে বলল, জি সাহেব। মেরেছিলেন, মেরেছিলেন।

মোবারক নিজে একটু যোগও করল। সেই দুইটা বিরাট বাঘ ছিল সাহেব, বিরাট...

আরে সেই জন্যই তো আমি অবাক হয়েছি। আমাদের গ্রামে যখন এসেছেই, এ রকম বিকলাঙ্গ একটা, প্রায় শিয়াল–কুকুরের মতো বাঘ আসবে কেন? শরীরের রং কাঁচা, লেজে রংই নেই...না না এই বাঘ শিকার করে আমি একদমই খুশি হতে পারিনি। এই দুর্বল জীবটার ভয়ে গরু–ছাগল–ভেড়া, কুকুর নিয়ে এক ঘরে বসবাসের কোনো মানেই ছিল না। এটা মারার জন্য বন্দুকেরও দরকার ছিল না। বাঁশের একটা লাঠিই যথেষ্ট ছিল। আমার শিকারজীবনে এত বাজে বাঘ আমি কখনোই শিকার করিনি...

মুখ চাওয়াচাওয়ি, কানাকানি, ফিসফাস আবার শুরু হলো। লোকে গভীর সন্দেহের চোখে জীবটার দিকে তাকাচ্ছে। তবে মুখ ফুটে কেউ কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না।

মৃধাবাড়ির ছোট ছেলেটার নাম পল্টু। সেটা একটু পাকা টাইপের। বলল, আপনি সাহেব সুন্দরবন এলাকায় বাঘ শিকার করেছেন তিনটা, কিন্তু বললেন দুইটার কথা। তিন নম্বরটার কী দশা ছিল? ওটার সাইজ কেমন ছিল? আসল বাঘের মতন?

দারোগা খরচোখে পল্টুর দিকে তাকাল। আসল বাঘ মানে কী রে ফাজিল? বাঘের আবার আসল–নকল কী?

না, মানে এই যে বাঘটা যেমন...

এটা কি তোর নকল বাঘ মনে হচ্ছে?

না, মানে আপনিই তো বলছেন এত সরু রোগা শিয়াল–টাইপের বাঘ আপনি জীবনে শিকার করেননি...

আরও কী কী বলতে চাইল পল্টু, তার আগেই তার মুখ চেপে ধরল ফজল মৃধা, পল্টুর বাপ। চুপ কর। সাহেবের মুখে মুখে কথা বলবি না।

পল্টু চুপ করল বটে, তবে গোপনে তার বাহিনীটাকে উসকে দিল।

পল্টুর বাহিনী জনা দশেকের। প্রায় একই বয়সের তিনটা মেয়ে আর সাতটা ছেলে। পল্টুর পরই বাহিনীর মাতবরি যার হাতে, তার নাম নয়ন। বাহিনীটাকে ‘বিচ্ছু বাহিনী’ও বলা যায়। দুষ্টের শিরোমণি প্রায় প্রত্যেকেই। প্রকৃত অর্থেই ফাজিল। লোকজনকে নাস্তানাবুদ করার ওস্তাদ। বাপ মুখ চেপে ধরেছে। কথা বলার উপায় নেই পল্টুর। নয়নের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল সে। সঙ্গে সঙ্গে পল্টুর দায়িত্বটা নিয়ে নিল নয়ন।

পল্টুর মতো সরাসরি দারোগা সাহেবকে প্রশ্ন করল না নয়ন। তাকাল বুলবুলির দিকে। বুলবুলি নাকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটাও ইচ্ছাকৃতই। নয়ন বলল, তোর কী হয়েছে রে বুলবুলি? নাক চেপে রেখেছিস কেন?

বুলবুলি বলল, বাঘটার গা থেকে আলকাতরার গন্ধ আসছে। আলকাতরার গন্ধে আমার বমি আসে। এ জন্য নাক চেপে রেখেছি।

নয়ন দু–তিনবার গন্ধ নেওয়ার ভঙ্গিতে নাক টানল। ঠিকই বলেছিস তো! বাঘটার গা থেকে সত্যি দেখি আলকাতরার গন্ধ আসছে!

বিলু ছেলেটা বলল, তোরা শুধু আলকাতরার গন্ধই পাচ্ছিস? আমি তো রঙের গন্ধও পাচ্ছি। বাঘটা কি মরার পর, মানে গুলি খেয়ে রং আর আলকাতরার ড্রামে লাফিয়ে পড়েছিল নাকি?

মজনু বলল, হতে পারে। দারোগা সাহেবের বাড়িতে সব জিনিসই থাকে। গুলি খেয়ে বাঘটা নিশ্চয় বড় একটা লাফ দিয়েছিল। লাফ দিয়ে প্রথমে হলুদ রঙের ড্রামে পড়ে ছিল। তারপর আরেক লাফে গিয়ে আলকাতরার ড্রামে পড়েছে।

মিতু বলল, তাতেই কাজ যা হওয়ার হয়ে গেছে।

ওদের কথাবার্তা পুরোটাই শুনতে পাচ্ছিলেন মালেক দারোগা। এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন, এবার কটোমটো চোখে মিতুর দিকে তাকালেন। কাজ যা হওয়ার হয়ে গেছে মানে কী রে?

মিতু কথা বলার আগেই রাজা ছেলেটা বলল, ও আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারবে না, সাহেব। আমি বলছি। এই বাঘটা বোধ হয় আসল বাঘের মতো দেখতে ছিল না। ছিল শিয়াল–টাইপের। আপনার গুলি খেয়ে প্রথমে হলুদ রঙের ড্রামে গিয়ে পড়েছে। ড্রামে কয়েকটা চুবানি খেয়ে বাঘের মতন হলুদ রং হয়েছে। তারপর গিয়ে পড়েছে আলকাতরার ড্রামে। তাতে ওই কালো ডোরাটা পড়েছে শরীরে। তাতে একেবারে আসল বাঘের মতন হয়ে গেছে।

পরি মেয়েটা বলল, তবে বাঘ হয়েও এই বাঘটা প্রায় শিয়ালের মতনই চতুর। বেঁচে থাকা অবস্থায় বাঘের মতন গায়ে হলুদ আর কালো রঙের ডোরা না পেলেও মরে পেয়েছে।

রতন বলল, পেয়েছে ভারি সুন্দরভাবে রে। আলকাতরার ড্রামে চুবানি খাওয়ার পরও হলুদ রঙে আর আলকাতরার রঙে লেপটালেপটি হয়ে যায়নি। চামড়ার যেখানে যেখানে কালো দাগ পড়ার দরকার ঠিক সেভাবেই দাগটা ফেলতে পেরেছে।

বাদল বলল, শুধু লেজটা কেন যেন বাদ পড়েছে।

নয়ন বলল, বাদ পড়ার কারণ আছে। হলুদ রঙের ড্রামে ডুব দেওয়ার সময় লেজটা খাড়া করে রেখেছিল, আলকাতরার ড্রামেও করেছে একটা কাণ্ড। এ জন্য লেজে হলুদ রং আর আলকাতরা কোনোটাই লাগেনি। লেজটা শিয়াল রঙেরই রয়ে গেছে।

লোকজন ছেলেপুলেদের কথা শুনছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। দারোগার ভয়ে তারা যা বলতে পারছে না, ছেলেপুলেরা তা বলে দিচ্ছে।

কিন্তু এহেন কথাবার্তা কতক্ষণ সহ্য করা যায়? তা–ও মালেক দারোগার মতন লোক কি এই সব কথা বেশিক্ষণ শুনবেন? তিনি একটা হুংকার ছাড়লেন। চুপ কর, ফাজিলের দল। বাঘের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছি তো, এ জন্য এখন এত বড় বড় কথা। ধরে দুয়েকটাকে খেত বাঘে, তাহলে টের পেতি বাঘ কাহাকে বলে! তা রোগা পটকা সরু বাঘ হোক বা শিয়াল টাইপের বাঘ হোক, বাঘ বাঘই। ভয়ে তো মরার আগেই মরেছিলি সবাই। ভেড়ার সঙ্গে একঘরে থেকেছিস, গরু–ছাগলের সঙ্গে থেকেছিস। তাতেও শিক্ষা হয়নি, না? এরপর আসল বাঘ এলেও আমি তোদের বাঁচাব না...

বাবার হাত থেকে মুখ মুক্ত হয়েছে পল্টুর। সে ফট করে বলল, আসল বাঘের কথা কেন বলছেন দারোগা সাহেব? এটা কি তাহলে নকল বাঘ?

চুপ কর নালায়েক। মোবারক, তালেব! বাঘটাকে গর্তে ফেল। মাটিচাপা দে। রোদ উঠে গেছে বেদম। এখনই পচে–গলে বদ গন্ধ ছড়াবে। পরিবেশের ক্ষতি সাধন হবে। তাড়াতাড়ি কর, তাড়াতাড়ি।

নয়ন বলল, আরেকটু থাকুক না সাহেব। নয়ন ভরে বাঘটাকে একটু শেষ দেখা দেখি!

না না, পরিবেশের ক্ষতি হবে। পৃথিবীর পরিবেশ এমনিতেই ঠিক নেই। জলবায়ু ব্যাপক হারে পরিবর্তন হয়েছে। অ্যান্টার্কটিকায় গলতে শুরু করেছে হাজার হাজার বছর ধরে জমে থাকা বরফ। সব জেনে–বুঝে আমি তো আর পরিবেশের ক্ষতি করতে পারি না। মোবারক, তালেব...

ওরা দুজন ছাতা ফেলে, দড়ির বৃত্ত খুলে বাঘের কাছে চলে গেল। মৃত জীবটাকে চ্যাংদোলা করে ফেলল গর্তে। তারপর কোদাল চালিয়ে গর্তের চারপাশে জমিয়ে রাখা মাটি ফেলতে লাগল। দেখতে দেখতে চোখের আড়ালে চলে গেল মরে বাঘ হয়ে যাওয়া শিয়াল।

গ্রামের ছেলেমেয়েরা নাকি তোমার কারবারটা ধরে ফেলেছে?

দুপুরের ভাত খেতে বসেছেন মালেক দারোগা। গ্রামে ফেউ ডাক শুরু হওয়ার পর এক দিনও শান্তিমতো কোনো বেলার খাবারই খেতে পারেননি। আজ সেই ঘটনা শেষ হওয়ার পর বেশ জমিয়ে বসেছেন। নানা প্রকারের তরকারি সহযোগে আয়েশ করে খাবেন। গিন্নিও আছেন তাঁর সঙ্গে। নিজের প্লেটে কাতলা মাছের পেটির দিককার ছোট একটা টুকরা নিয়ে কথাটা তিনি বললেন। শুনে দারোগা বললেন, শুধু ছেলেমেয়েরা না, আমার ধারণা, সবাই ধরে ফেলেছে। আমার ভয়ে মুখ খোলেনি। তবে ধরতে পারত না। ওই গরু দুটোর ভুলের জন্য, মানে মোবারক আর তালেবের ভুলের জন্য ধরাটা খেতে হয়েছে। সব নষ্টের গোড়া হচ্ছে বজ্জাত শিয়ালটার লেজ।

বুঝলাম। কিন্তু এ রকম একটা কাঁচা কাজ তুমি করতে গেলে কেন? আমি সেদিনই তোমার মতলব বুঝে গিয়েছিলাম। বুঝে মুচকি হেসেছিলাম। একসময় দেখি তুমিও আমার মতোই মুচকি একটা হাসি দিলে।

এবার কথা বললেন দারোগা। হ্যাঁ। দ্বিতীয় দিন সকালের ঘটনা। নাশতা খেতে বসেছিলাম। তখনই মনে মনে পরিকল্পনাটা আমি আঁটছিলাম। কিন্তু তুমি যখন বুঝেই গিয়েছিলে তাহলে আমাকে বাধা দিলে না কেন?

বাধা না দেওয়ার কারণ আছে। ফেউ জিনিসটা যে আসলে শিয়াল, এটা আমি জানি।

দারোগা অবাক। বলো কী? তুমি জানো?

জানব না? আমি কি মূর্খ নাকি?

তবে ফেউ সাধারণ শিয়াল না। পাগলা শিয়াল। পাগলা বলেই একা একা বাঘের পেছন পেছন ধাওয়া করে আর চিত্কার করে। একা চিত্কার করে বলে ডাকটা ‘হুক্কা হুয়া’ না হয়ে ‘ফেউ’ হয়ে যায়। কুকুরের যেমন ‘ঘেউ’ পাগলা শিয়ালের হচ্ছে ‘ফেউ’। ফেউ কথাটা মানুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যে লোক পেছন ছাড়ে না, পেছনে লেগে থেকে যে লোক অবিরাম বিরক্ত করে, তাকে বলে ফেউ। এই তোর পেছনে ফেউ লেগেছে, বুঝেছিস? তবে ওই যে বললাম একা ‘হুক্কা হুয়া’ ডাকতে পারে না, ‘ফেউ’ শব্দে ডাকে, এর সঙ্গে আরেকটা তথ্য যোগ করছি। দলের যে শিয়াল পাগল হয়ে যায়, তাকে দল থেকে বের করে দেওয়া হয়। পাগলা শিয়াল তখন আর কী করে, মনের দুঃখে বাঘের পিছু নেয় আর ফেউ ফেউ করে ডাকে। তাতে অবশ্য গৃহস্থের উপকারই হয়। গৃহস্থ বুঝে যায়, আশপাশে বাঘ আছে। এসব কিন্তু আমার নিজস্ব মতামত। ফেউ ডাক শোনার পর থেকে এভাবে আমি ভেবেছি। কোথায় যেন কবে পড়েছিলাম ক্ষিপ্ত শিয়ালও অনেক সময় ফেউ ফেউ শব্দ করে। বাগানের ঘরে ওভাবে আমি শুধু বন্দুক তাক করে বসেই থাকিনি, শুধু আদ্রক চা পান করিনি, ভেবেছিও। ফেউ নিয়ে অনেক ভেবেছি। জীবটা তিনটা প্রাণী খেয়েছে। ছোট একটা ছাগল, একটা পাঁচ দিন বয়সী বাছুর আর একটা রাজহাঁস। এই নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমার মনে হলো আর যা-ই হোক, এটা বাঘ না। যদি বাঘ হতো, তাহলে প্রমাণসাইজের ছাগলই শিকার করত, বড় গরুও ধরত। হাঁস–মুরগি শিকার করত না। এটা নিশ্চয় শিয়ালের কাজ। ক্ষিপ্ত শিয়াল বা পাগলা শিয়াল।

এ কথা তুমি তাহলে গ্রামের লোকজনকে জানাওনি কেন?

বাঘের সঙ্গে ফেউ থাকে—এ রকম একটা ধারণা মানুষের আছে। আমি মামু ডাকি, ওই প্রবীণ মমিন খাঁ, সেই বিকালে ফেউ নিয়ে কথা তুলেছিল। তখনই লোকে ধরে নিয়েছে, গ্রামে বাঘ এসেছে। ফেউ জিনিসটা যে শিয়াল, এটা খুব কম লোকই জানে। আমি যদি তাদের বোঝাতামও, তারা হয়তো আমার ভয়ে বুঝত, কিন্তু ভেতরে সর্বক্ষণ একটা ভয় তাদের থাকত। একটা আতঙ্ক থাকত। ওই যে কথায় বলে না, ‘বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায়’। লোকগুলোকে তখন মনের বাঘে খেত। আমার এত পরিশ্রম, এত রাত্রি জাগরণ অতঃপর শৃগালনিধন এবং উহাকে ব্র্যাঘ্রে রূপান্তর এবং ছেলেপেলের হাতে ধরা খাওয়া, সবকিছুর মূলে একটাই ভাবনা কাজ করেছে। হিজলিয়া গ্রামের মানুষগুলোর মনে যে বাঘটা ঢুকেছিল, যে বাঘ তাদের কুরে কুরে খাচ্ছিল, সেই বাঘটা আমি মারতে চেয়েছি। মনের ব্যাঘ্রটা নিধন করতে চেয়েছি। এখন আর বাঘও নেই, ফেউও নেই। সাবধানতাও নেই।

অনেক দিন পর প্রাণ খুলে হাসলেন মালেক দারোগা। ঠা ঠা ঠা, ঠা ঠা ঠা...

তাঁর হাসির শব্দে জামগাছে বসা দুটো কাক ভয়ে কা কা রব তুলে আকাশ–পাতালে উড়াল দিল।