বছর শেষে তারুণ্যের ঝলক

বঙ্গবন্ধু টি-২০ কাপে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের দারুণ নৈপুণ্যে আশার আলো দেখছেন ক্রিকেটভক্তরা। যেমন ব্যাট চালিয়েছেন তামিম-মুশফিকরা, তেমনি বল করেছেন মুস্তাফিজ-রুবেলরা। তবে এর মধ্যেই আলো কেড়ে নিয়েছেন নতুন তারকারা, যাঁদের জন্য পরবর্তী ধাপ এখন বাংলাদেশ জাতীয় দল।

করোনা পরিস্থিতি একটু ভালো হওয়ার পরপরই বিসিবি যখন বঙ্গবন্ধু টি-২০ কাপের ঘোষণা দিল, তোমাদের সবার মতো আমার মনেও বেশ আনন্দের ঢল উঠেছিল। প্রথমত ছিল এত দিন পর বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের আবার মাঠে দেখতে পারার আনন্দ। সাকিব আল হাসান নেই এক বছর ধরে, বাংলাদেশও মাঠে নেই সেই গত মার্চ থেকে। এত বড় ছুটিতে বাড়িতে বসে না ছিল কোনো খেলা, না ছিল কোনো আনন্দ। সেটা মেটাতেই বিসিবি নিয়ে এসেছিল বঙ্গবন্ধু টি-২০ কাপ। তবে আমার উত্তেজনা ছিল অন্য জায়গায়। সামনের বছরই টি-২০ বিশ্বকাপ ভারতে। এ বছরই হওয়ার কথা ছিল বটে, কিন্তু বেরসিক কোভিড-১৯–এর প্রকোপে সবকিছুর মতো পিছিয়ে গেছে আমাদের টি-২০ বিশ্বকাপটাও। এই টুর্নামেন্টই শাপেবর হতে পারে বাংলাদেশের জন্য। একে তো কোনো বিদেশি নেই, তার ওপর দলের সিনিয়রদের সঙ্গে জুনিয়রদের ঝালিয়ে নেওয়ার সুযোগ। ৭৫ জন খেলোয়াড় যখন পাঁচ দলে ভাগ হয়ে খেলতে নামলেন, তখনই দামামা বাজল সৌহার্দ্যপূর্ণ কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এক টুর্নামেন্টের। দারুণ এই টুর্নামেন্টে শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন মাহমুদউল্লাহ-মাশরাফি-সাকিবের জেমকন খুলনা। ৫ রানের জন্য হারতে হয়েছে মিঠুন-লিটন-মুস্তাফিজের গাজী গ্রুপ চট্টগ্রামকে। তবে আজকের কথা জয়-পরাজয় নিয়ে নয়; বরং এই টুর্নামেন্ট থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্তি নিয়ে।

টুর্নামেন্টের মূল উদ্দেশ্যই ছিল সিনিয়র খেলোয়াড়দের আবার খেলায় ফিরিয়ে আনা। এর সঙ্গে সদ্য বিশ্বকাপজয়ী অনুর্ধ্ব-১৯ দলের খেলোয়াড়দের পরখ করে নেওয়া। সামনের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নতুন কাউকে নেওয়া যায় কি না, তা নিয়ে আরেকবার ভাবনাচিন্তা করা। টি-টোয়েন্টি শুরু হওয়ার ১৩ বছর পরও আমাদের গায়ে মাঝেমধ্যেই ট্যাগ লাগে, ‘বাংলাদেশ আসলে টি-২০ খেলাটাই বুঝে ওঠে না’। তাই আজকে লিখব এই বঙ্গবন্ধু টি-২০ কাপের সেরা পারফরমারদের নিয়ে, যাঁদের হাতে বাংলাদেশের ঝান্ডা উঠতে যাচ্ছে শিগগিরই।

মোহাম্মদ নাইম শেখ

ওপেনিং নিয়ে যখন কথা হচ্ছে, তখন আরেক ওপেনারের কথাও বলা যাক। বেক্সিমকো ঢাকার ওপেনার মোহাম্মদ নাইম শেখকে নিয়ে কথা উঠেছিল বিপিএলে। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ থেকে বিপিএল, এরপর সোজা জাতীয় দলে স্থান পেয়েছিলেন নাইম। ভারতের বিপক্ষে ৪৭ বলে ৮১ রানের ইনিংসটা প্রত্যাশার পারদ আরও ওপরে উঠিয়ে দিয়েছিল। সেই পারদ নামাতে দেননি নাইম; বরং নিজের পুরোনো ফর্ম টেনে এনেছেন এখানেও। ১০ ম্যাচে করেছেন ২৬০ রান। স্ট্রাইক রেট ১২৮.৭১। সঙ্গে একটা সেঞ্চুরি। আদর্শ টি-টোয়েন্টি ওপেনিং যাকে বলে, সেটাই করে দেখিয়েছেন পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে। নাইমকে নিয়ে তাই আশার ফুলঝুরি ছোটানোই যায়।

নাজমুল হোসেন শান্ত

বিসিবির পরিকল্পনায় সব সময়ই ছিলেন নাজমুল হোসেন শান্ত। বাংলাদেশের ক্রিকেট নতুন মোড় পাওয়ার পর থেকে খুব ভালোভাবে তাঁর যত্ন নেওয়া হয়েছে। সেই অনুর্ধ্ব-১৬ থেকে নিজের নামের প্রতি সুবিচার করে যাচ্ছেন শান্ত। মাঝে দু–একবার জাতীয় দলে খেলেছেন, কিন্তু আশার ফুল ফোটাতে পারেননি সেভাবে। তাই এই টুর্নামেন্ট ছিল তাঁর কাছে প্রমাণ করার চ্যালেঞ্জ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল রাজশাহী দলের অধিনায়কত্ব। অধিনায়কত্বে পাস মার্ক না পেলেও ব্যাটিংয়ে তাঁর তুলনা শুধুই তিনি। আট ম্যাচে ৩০১ রান, সেই সঙ্গে টুর্নামেন্টের প্রথম সেঞ্চুরি। স্ট্রাইক রেটটাও টি-টোয়েন্টি ওপেনারের মতোই—১৫৫.৭৭। রাজশাহী দল নিজেদের সেরাটা না দিতে পারলেও প্রতি ম্যাচেই ওপেনিংয়ে প্রতিপক্ষের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছেন শান্ত। অশান্ত শান্ত যেন বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপের পুরোনো আবিষ্কার নতুন খোলসে।

পারভেজ হোসেন ইমন

এবারের বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপের তৃতীয় সেঞ্চুরিয়ান ছিলেন ইমন। ফরচুন বরিশালের হয়ে ৯ ম্যাচে ২৩৩ রান করেছেন ১৩০ স্ট্রাইক রেটে। অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে চমক দেখানো ইমন কতটা মানিয়ে নিতে পারেন এই সিনিয়রদের ভিড়ে, তা নিয়ে বড্ড ভয় ছিল। কিন্তু সেই ভয়কে জয় করেছেন ইমন। এমনকি রাজশাহীর বিপক্ষে টপ ফোর ডিসাইডিং ম্যাচে বাগিয়ে নিয়েছেন সেঞ্চুরি। দলকে নিয়ে গেছেন শেষ চারে। বাংলাদেশ দলের মিডল অর্ডারে ধরে খেলার মতো ভালো সম্ভাবনাময় তারকা হতে পারেন ইমন।

ইয়াসির আলী

ধরে খেলার কথাই যখন আসে, তখন বেক্সিমকো ঢাকার ইয়াসির আলীর কথা না বললেই নয়। ২৪ বছর বয়সী এই মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান প্রায় প্রতি ম্যাচেই ধরে রেখেছেন ঢাকার মিডল অর্ডার। ঠিক যখন যেভাবে প্রয়োজন হয়েছে, নিজের ইনিংসকে সামলেছেন। চার–ছয়ের চেয়ে বলে বলে রানের চাকা ঠিক রেখে খেলেছেন ভালো স্ট্রাইক রেটে। মিডল অর্ডারে নতুন করে কারও নাম বলতে হলে সেটা অবশ্যই ইয়াসির আলী। ৯ ম্যাচে রান তাঁর ২৯৪।

আকবর আলী

আকবর আলীকে নিশ্চয় মনে আছে? থাকবে না কেন? বাংলাদেশকে প্রথম কোনো বিশ্বকাপ এনে দেওয়া অধিনায়ককে কি সহজে ভুলে যাওয়া সম্ভব? তাঁর দৌড় যে সে পর্যন্তই ছিল না, সেটা প্রমাণ করেছেন এই টুর্নামেন্টেও। ১০ ম্যাচে ১৫০ স্ট্রাইক রেটে করেছেন ১৭১ রান। মিডল অর্ডারে ছিলেন ঢাকার প্রাণভোমরা। আরেকটু উন্নতি করলে জাতীয় দলে ঢোকা তাঁর জন্য বেশ সহজই হয়ে যাবে।

হাসান মাহমুদ

তরুণদের মধ্যে দারুণ ছিল হাসান মাহমুদের ধারাবাহিকতা। কোভিড-১৯ আক্রমণের আগেই জাতীয় দলে অবশ্য নাম লিখিয়েছিলেন এক ম্যাচের জন্য। সে ম্যাচে কিছু করে দেখাতে না পারলেও অনেক দিন পর বাংলাদেশে পিওর ফাস্ট বোলার পাওয়ায় বেশ খুশিই হয়েছিল সবাই। এই বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপেও দেখা মিলল তাঁর গতির। টানা ১৪০+ গতিতে বল করে যাওয়া হাসান ৯ ম্যাচে নিয়েছেন ১১ উইকেট। রানরেটটাও সহনীয়, ৭.৬৩ করে। এভাবে ধরে রাখতে পারলে বাংলাদেশের জার্সিতে নতুন ফাস্ট বোলার পাওয়া হয়ে উঠবে সময়ের ব্যাপার।

শামীম হোসেন পাটোয়ারী

পুরো টুর্নামেন্ট দেখলে তুমিও বুঝবে, এই নামটা কেন রেখেছি তালিকায়। বাংলাদেশকে নিয়ে সবচেয়ে বড় যে কথা শোনা যায়, সেটা হলো ফিল্ডিংয়ে ২০টা রান ছুটে গেছে। কম হলেই ম্যাচটা হাতে থাকত। ঠিক সে জায়গাতেই বাজিমাত করেছেন শামীম। পুরো টুর্নামেন্টের গ্রাউন্ড লেভেল ফিল্ডিংয়ে তিনি ছিলেন অনন্য। জেমকন খুলনার হয়ে পুরো টুর্নামেন্টে শুধু ফিল্ডিং দিয়েই ৬০ থেকে ৭০ রান বাঁচিয়েছেন শামীম। নিয়েছেন ১০ ম্যাচে ১২ ক্যাচ। ব্যাট হাতে তেমন বলার মতো কিছু না করতে পারলেও ১০ ম্যাচে করেছেন ১১৬ রান। লোয়ার অর্ডারে পাওয়ার হিটের জন্য খারাপ নয়। সঙ্গে ছিল পার্টটাইম বোলিং। তবে জাতীয় দলে আসতে হলে অনুর্ধ্ব-১৯ তারকা শামীমকে আরও ধারাবাহিক হতে হবে ব্যাটিংয়ে।

শরিফুল ইসলাম

পুরো মৌসুমে বল হাতে খেল দেখিয়েছেন মুস্তাফিজ। কিন্তু তরুণদের তালিকায় ধরলে নাম আসে ৪ নম্বরে থাকা শরিফুল ইসলামের। মুস্তাফিজের সঙ্গে দারুণ জমেছিল শরিফুলের জুটি। একই রকম বোলিংয়ের ধরন, একই রকম মুভমেন্টে প্রতিপক্ষকে বিপর্যস্ত করেছেন শরিফুল। ১০ ম্যাচে নিয়েছেন মোট ১৬ উইকেট। জাতীয় দলেও শরিফুলের আক্রমণাত্মক বোলিং দেখার অপেক্ষায় বাংলাদেশি সমর্থকেরা।