বাঁশ+সাইকেল=বাঁশকেল

তোমাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব যানবাহন কোনটি? নিশ্চয়ই তোমার উত্তর হবে, সাইকেল। তবে সাইকেল পরিবেশবান্ধব হলেও সাইকেল তৈরির প্রক্রিয়াটি কিন্তু মোটেই পরিবেশবান্ধব নয়। আমরা সাধারণত যে সাইকেলগুলো ব্যবহার করি, সেসব সাইকেলের ফ্রেম বানানো হয় অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে। লোহা অনেক প্রক্রিয়াজাত করার পর অ্যালুমিনিয়াম তৈরি হয়। লোহাকে প্রক্রিয়াজাত করতে গিয়ে প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই–অক্সাইড নিঃসরণ হয়, যা আমাদের পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এ ছাড়া এ প্রক্রিয়াজাতকরণে প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। কিন্তু সাইকেল চালাতে হলে তো সাইকেল বানাতেই হবে। অ্যালুমিনিয়াম ছাড়া কীভাবে সাইকেলের ফ্রেম বানানো সম্ভব? এই কঠিন সমস্যার সহজ সমাধান দিয়েছে বাঁশকেল, বাঁশ দিয়ে তৈরি সাইকেল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেছেন সজীব বর্মণ। তাঁর মাথা থেকেই প্রথম বাঁশকেলের আইডিয়া আসে। ২০১৪ সালে সজীব ও তাঁর বন্ধু সানজিদুল একটি বিজনেস প্ল্যান কর্মশালায় অংশ নেন। সেখানে একটি বিজনেস প্ল্যান দিতে বলা হয়। সে সময় সজীবের মাথায় আসে বাঁশ দিয়ে সাইকেলের ফ্রেম বানানোর আইডিয়া। বাঁশ দিয়ে তৈরি প্রথম সাইকেল ফ্রেমটি তৈরি করতে দুই বন্ধুর ২০ দিন সময় লেগে যায়। নাম দেওয়া হয় বাঁশকেল। সেই থেকে ছয় বছর ধরে চলছে বাঁশকেলের জার্নি।

বাঁশ দিয়ে আবার সাইকেল কীভাবে তৈরি হয়? ইতিমধ্যে তোমার মনে হয়তো এমন প্রশ্ন চলে এসেছে। বাঁশ দিয়ে ফ্রেম তৈরিতে প্রথমে পরিপক্ব বাঁশের প্রয়োজন। গাজীপুর, চট্টগ্রাম ও সিলেট থেকে তিন ধরনের বাঁশ সংগ্রহ করতে হয়। কারণ, সাইকেলের ফ্রেমের ভিন্ন ভিন্ন পয়েন্টে ভিন্ন রকম চাপ পড়ে। তাই তিন রকমের বাঁশ ব্যবহার করতে হয়। এরপর শুরু হয় বাঁশের কেমিক্যাল ট্রিটমেন্ট। একধরনের রাসায়নিক দ্রব্যে বাঁশগুলো চুবিয়ে রাখা হয়। এতে বাঁশগুলো মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী হয়। বাঁশগুলোতে ঘুণে ধরার আর কোনো আশঙ্কা থাকে না। এরপর আসে খুঁটিনাটি হিসাব–নিকাশ করে ডিজাইনের কাজ। ফ্রেম তৈরি সবচেয়ে কঠিন কাজ। ডিজাইনের কাজটি করেন সজীব। বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল ও চাপ অনুযায়ী ডিজাইনের পর আসে কারিগরির কাজ। এতগুলো কঠিন ধাপ শেষে চকচকে বাঁশকেলের দেখা মেলে।

তবে দেশের বাইরে এর চাহিদা প্রচুর। এর কারণ, বিদেশে বাঁশের তৈরি সাইকেলের ফ্রেমের দাম বাঁশকেলের চেয়ে দ্বিগুণ। ফ্রেম অর্ডারের সময় গ্রাহকেরা জানিয়ে দেন কেমন সাইকেলের জন্য তিনি ফ্রেম বানাতে চান।

বাঁশ চমৎকার একটি প্রাকৃতিক ঘাস। বাঁশের তৈরি সাইকেলের কাঠামো পরিবেশবান্ধব। বাঁশ দিয়ে তৈরি করা ফ্রেমের ওজন সাধারণ সাইকেল ফ্রেমের তুলনায় অনেক কম। বাঁশ দিয়ে এক থেকে দুই কেজি ওজনের ফ্রেমও তৈরি করা সম্ভব। অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি ফ্রেমের চেয়ে বাঁশের তৈরি ফ্রেমের সাইকেল বেশি ভর নিতে সক্ষম। সাইকেলের এ ফ্রেম ১০ বছর পর্যন্তও ব্যবহার করা যায়।

আমাদের দেশে নির্দিষ্ট একটি দামের আশপাশেই সবাই সাইকেল কিনতে চান। তাই দাম অনুযায়ী দেশের মানুষের কাছে বাঁশকেলের খুব একটা চাহিদা নেই। ছয় বছরের জার্নিতে দেশে মাত্র একজন গ্রাহক পেয়েছে বাঁশকেল। সজীব মনে করেন, এর কারণ হলো, বাংলাদেশে হাতে তৈরি যেকোনো জিনিসের প্রতি মানুষের আগ্রহ সব সময় কম। এ ছাড়া এ ধরনের সাইকেলের ফ্রেমের দাম সাধারণত ব্যবহৃত সাইকেলের চেয়ে তুলনামূলক বেশি। দেশের সাইক্লিস্টদের বাঁশের তৈরি ফ্রেমের প্রতি আগ্রহী না হওয়ার এটাও একটা কারণ।

তবে দেশের বাইরে এর চাহিদা প্রচুর। এর কারণ, বিদেশে বাঁশের তৈরি সাইকেলের ফ্রেমের দাম বাঁশকেলের চেয়ে দ্বিগুণ। ফ্রেম অর্ডারের সময় গ্রাহকেরা জানিয়ে দেন কেমন সাইকেলের জন্য তিনি ফ্রেম বানাতে চান। সে অনুযায়ী ডিজাইনের পর তৈরি হয় ফ্রেম। অনেকে ফ্রেমে লিখে নেন নিজের নাম। বাঁশের তৈরি এই লোভনীয় সাইকেল ফ্রেম সংগ্রহ করতে চাইলে যোগাযোগ করা যাবে বাঁশকেলের ফেসবুক পেজে।

প্লাস্টিক বা লোহা ব্যবহারের পরিবর্তে যেন সব ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক জিনিসপত্রের ব্যবহার বাড়ে, সেটা নিয়ে ভবিষ্যতে আরও কাজ করতে চান সজীব। আর বাঁশকেল নিয়ে তাঁর ইচ্ছাটা অন্য রকম। সজীবের ইচ্ছা, একটা সময় তিনি তাঁর নিজের তৈরি বাঁশকেল সঙ্গে করে দেশজুড়ে ঘুরে বেড়াবেন।