বিজয়ী হয়েছি, আরও আরও জয় আনব আমরা

অলংকরণ: তীর্থ

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হলো। কোনো কিছুর ২৫ পূর্ণ হলে বলা হয় রজতজয়ন্তী, ৫০ হলে সুবর্ণজয়ন্তী। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছি আমরা।

তোমরা জানো, ১৯৭১ সালের আগে স্বাধীন বাংলাদেশ নামে কোনো দেশ ছিল না। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল আমাদের আজকের বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তানের একটা অংশ, একে বলা হতো পূর্ব পাকিস্তান। আর আজকের পাকিস্তানকে বলা হতো পশ্চিম পাকিস্তান। পাকিস্তানে বাঙালিরাই ছিল সংখ্যায় বেশি, পাট রপ্তানি করে বাংলাই আয় করত বেশি, কিন্তু পাকিস্তানের রাজধানী ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে; সরকারি চাকরি সেনাবাহিনীর চাকরি পেত সব পশ্চিম পাকিস্তানের লোকেরা। কলকারখানা, বিশ্ববিদ্যালয় সব গড়ে তোলা হচ্ছিল পশ্চিম অংশে। আর সবচেয়ে বড় কথা, পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালিদের তাদের পরিচয় ভুলিয়ে দিতে চেষ্টা করল, রাষ্ট্রভাষা করতে চাইল উর্দুকে। বাঙালিরা প্রতিবাদ করতে লাগল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষার দাবিতে বড় আন্দোলন করল বাংলার মানুষ, ঢাকায় ছাত্ররা মিছিল বের করল। পুলিশ গুলি চালাল। শহীদ হলেন বরকত, সালাম, রফিক, শফি, জব্বার। কবি আল মাহমুদের ছড়ায় পাই:

ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ

দুপুর বেলার অক্ত

বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়?

বরকতের রক্ত।

হাজার যুগের সূর্যতাপে

জ্বলবে এমন লাল যে,

সেই লোহিতেই লাল হয়েছে

কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে!

তখন থেকেই বাঙালি শুরু করল, পাকিস্তানের দাস হয়ে থাকা যাবে না। স্বাধীন হতে হবে।

শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিবাদ করতেন সবচেয়ে বেশি। সে জন্য তাঁকে বারবার কারাগারে নেওয়া হতো। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব ছয় দফা দাবি তুলে ধরলেন। এই ছয় দফা দাবি মেনে নিলে আসলে পাকিস্তান আর বাংলাদেশ দুটো আলাদা দেশই হয়ে যায়। শাসকেরা আবার আটক করল শেখ মুজিবকে। তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করে ক্যান্টনমেন্ট তাঁকে বন্দী করে বিচার শুরু করল তারা। ১৯৬৯ সালে বাংলাদেশের মানুষ প্রচণ্ড আন্দোলন করল। একে বলা হয় উনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থান। আসাদ শহীদ হলেন। শহীদ হলো ছোট্ট বালক মতিউর।

আল মাহমুদের ছড়ায় পাই:

ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!

শুয়োরমুখো ট্রাক আসবে

দুয়োর বেঁধে রাখ।

কেন বাঁধবো দোর জানালা

তুলবো কেন খিল?

আসাদ গেছে মিছিল নিয়ে

ফিরবে সে মিছিল।

ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!

ট্রাকের মুখে আগুন দিতে

মতিয়ুরকে ডাক।

কোথায় পাবো মতিয়ুরকে

ঘুমিয়ে আছে সে!

তোরাই তবে সোনামানিক

আগুন জ্বেলে দে!

দেশের মানুষ রাজপথে আগুন জ্বেলে রক্ত দিয়ে শেখ মুজিবকে মুক্ত করে আনল। তাঁকে উপাধি দিল বঙ্গবন্ধু।

এরপর পাকিস্তানে নির্বাচন হলো ১৯৭০ সালে। শেখ মুজিব বললেন, এই ভোট মানে ছয় দফার প্রশ্নে গণভোট। দুই পাকিস্তান মিলেই ভোটে জিতল বঙ্গবন্ধুর নৌকা মার্কা। পাকিস্তানিরা প্রমাদ গুনল। এবার তো বাঙালিরা হবে শাসক, ওরা হবে শাসিত। তারা বাংলার মানুষের ওপরে আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিতে লাগল। বঙ্গবন্ধুর জীবনের স্বপ্ন ছিল তিনি বাংলার মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বেন। তিনি ৭ মার্চ ১৯৭১ বিশাল জনসমুদ্রে ভাষণ দিলেন:

এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে এলেন। দেশের মানুষ চোখের জলে বরণ করে নিল তাঁকে।

নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়:

শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,

রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে

অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।

তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,

হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার

সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?

গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি :

‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,

এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

সেই থেকে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি আমাদের।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা ট্যাংক, কামান, মেশিনগান নিয়ে আক্রমণ করল বাংলার মানুষের ওপর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে হত্যা করল ছাত্র–শিক্ষকদের। রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে বাঙালি পুলিশদের ওপরে তারা আক্রমণ চালাল। ইপিআরের ওপরে আক্রমণ চালাল। বঙ্গবন্ধু ওয়্যারলেসের মাধ্যমে জানিয়ে দিলেন: আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।

বঙ্গবন্ধুকে ধরে নিয়ে গেল পাকিস্তানি মিলিটারিরা।

বাঙালি ছাত্র, জনতা, পুলিশ, ইপিআর, সৈনিকেরা প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করল।

বঙ্গবন্ধুর যোগ্য সহকর্মীরা ভারতে চলে গেলেন। তাঁরা মুজিবনগর সরকার গঠন করলেন। মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত করলেন। দলে দলে তরুণ–যুবারা ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে দেশে এসে যুদ্ধ করতে লাগল। দেশের ভেতরেও গড়ে উঠল নানা মুক্তিবাহিনী।

পাকিস্তানিরা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিল। মানুষ মারতে লাগল নির্বিচার। ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করল তারা। লাখ লাখ নারীর ওপর অত্যাচার করল। প্রায় এক কোটি মানুষ পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলো।

কবি শামসুর রাহমানের ভাষায়:

তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,

সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,

সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর।

তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,

শহরের বুকে জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক এলো

দানবের মতো চিৎকার করতে করতে

তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,

ছাত্রাবাস, বস্তি উজাড় হলো। রিকয়েললেস রাইফেল

আর মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র।

তুমি আসবে বলে, ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম।

তুমি আসবে বলে, বিধ্বস্ত পাড়ায় প্রভুর বাস্তুভিটার

ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে একটানা আর্তনাদ করলো একটা কুকুর।

তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,

অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিলো পিতা–মাতার লাশের ওপর।

ভারত বাংলাদেশের সহযোগিতায় এগিয়ে এল। ভারতীয় বাহিনী আর মুক্তিবাহিনী একযোগে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ল। তারা চলে এল ঢাকার চারপাশে। আকাশ থেকে আক্রমণ চালাল বিমান। আর লিফলেট ছড়িয়ে বলা হলো, পাকিস্তানি বাহিনী, তোমরা সারেন্ডার করো।

পাকিস্তানিরা পরাজয় স্বীকার করে নিল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দান আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমর্পণ করল পাকিস্তানি সৈন্যরা। বিজয়ী হলো বাংলাদেশ।

বিজয়ের আনন্দ ম্লান হয়ে গেল, যখন জানা গেল, পাকিস্তানি সৈন্য আর তাদের সহযোগী রাজাকার আল–বদরেরা বেছে বেছে হত্যা করেছে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে এলেন। দেশের মানুষ চোখের জলে বরণ করে নিল তাঁকে।

তারপর কেটে গেছে ৫০ বছর। এই ৫০ বছরে বাংলাদেশ বহু ক্ষেত্রে ভালো করেছে। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। ১৯৭১ সালের আগে পাকিস্তান ক্রিকেট দলে একজনও বাঙালি খেলোয়াড় থাকত না। কিন্তু এখন বাংলাদেশের ১১ জন খেলোয়াড় পাকিস্তানকেই হারিয়ে দিতে পারে। বাংলাদেশ দ্রুত উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তার পেছনে কাজ করছে মুক্তিযুদ্ধ জয়ের সেই গতিবেগ।

তবে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিসংগ্রামের আরও কতগুলো প্রেরণার দিক আছে।

পাকিস্তান ছিল একটা সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র। অভিজাতেরা মিলিটারির সহযোগিতায় নিজেদের শোষণ অব্যাহত রাখার জন্য দেশটিতে কোনো দিনও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে দেয়নি। শোষণের হাতিয়ার হিসেবে তাঁরা ধর্মকে ব্যবহার করতে চেয়েছে।

আমাদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার পেছনে আছে গণতন্ত্র, আছে বৈষম্যমুক্ত সমাজ। আছে অসাম্প্রাদয়িকতা। আছে প্রগতি। আছে আধুনিক মন ও মনন নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার শপথ।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সেই শপথগুলো নতুন করে নিতে হবে, বাস্তবায়িত করতে হবে। সবাই যাতে লেখাপড়ার সুযোগ পায়, সবাই যেন খাবার পায়, বাসস্থান পায়, স্বাস্থ্য পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।

আমাদের কাজ হবে নিজের নিজের কাজ ঠিকভাবে করা।

মাশরাফি বিন মর্তুজা বলেছেন, এই যারা ক্রিকেটে দেশপ্রেম দেশপ্রেম বলে চিৎকার করে, এরা সবাই যদি একদিন রাস্তায় কলার খোসা ফেলা বন্ধ করত, একটা দিন রাস্তায় থুতু না ফেলত বা একটা দিন ট্রাফিক আইন মানত, দেশ বদলে যেত। এই প্রবল এনার্জি ক্রিকেটের পেছনে ব্যয় না করে নিজের কাজটা যদি সততার সঙ্গে একটা দিনও সবাই মানে, সেটাই হয় দেশপ্রেম দেখানো। আমি তো এই মানুষদের দেশপ্রেমের সংজ্ঞাটাই বুঝি না।

আমরা সবাই নিজের কাজ ঠিকভাবে করতে থাকব, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, দেশকে আরও এগিয়ে নেব। ১৯৭১ সালে আমরা বিজয়ী হয়েছি, তা থেকে সাহস নিয়ে, শক্তি নিয়ে আমরা আরও সামনে এগিয়ে যাব, নতুন নতুন ক্ষেত্রে আনব নতুন নতুন জয়। দেশকে গড়ে তুলব সোনার বাংলা হিসেবে।