বিভূতিভূষণের অভাবনীয় ফন্দি

অলংকরণ: আরাফাত করিম

খেতে বড় ভালোবাসেন

বাংলায় ‘পেটুক’ বলে একটা শব্দ আছে, বিভূতিভূষণের সঙ্গে শব্দটা হয়তো যায় না। কিন্তু ভোজনরসিক বলতে তো আর আপত্তি নেই! তাঁর লেখার মতো, খাওয়াটাও যে তাঁর কাছে একটা আর্ট ছিল, সেই গল্প উঠে এসেছে দেশ পত্রিকার সাবেক সম্পাদক সাগরময় ঘোষের সম্পাদকের বৈঠকে নামের বইটিতে। এমনিতে বিভূতিভূষণের মতো সহজ-সরল ভালো মানুষটি সাহিত্যজগতে বিরল। তবু পেটের ভেতরের ক্ষুধা নােমর দৈত্যটাকে তুষ্ট করতে মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব কাণ্ড করে ফেলতেন।

একবার বিভূতিভূষণের সাধ হলো একটু ভালোমন্দ খাবেন। তা নিজের বাড়ির খাবার কি রোজ রোজ মুখে রোচে? তাই এক অভাবনীয় ফন্দি বের করলেন—ভাইয়ের বিয়ে দেবেন। এ জন্য বেরিয়ে পড়লেন গ্রামবাংলার পথে–প্রান্তরে। আগেই খোঁজ নিয়ে বিবাহযোগ্য কন্যা আছে, এমন বাড়িতে হাজির হতেন। মেয়ের বিয়ে বলে কথা, মেয়ের মায়েরা ধুমধাম করে রান্নার আয়োজন করতেন। মেয়ে পরের ঘরে গিয়ে রাঁধতে না জানলে মান-ইজ্জত তো থাকবে না। দশ-এগারো বছর বয়সে সেকালে মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত। তারা আর এমন কী স্বাদের রান্না করবে? কিন্তু মেয়ের মায়েদের রান্নার হাত খারাপ হওয়ার নয়, বিশেষ করে যখন নতুন বিয়ের ব্যাপার, তখন মায়ের হাতের রান্নাই মেয়ের বলে চালিয়ে দেওয়া হতো। বিভূতিভূষণ সেই খাবার খেয়ে কনের রান্নার হাতের তারিফ করতে করতে ফিরে আসতেন। বলে আসতেন, এত ভালো রান্নার হাত যার, তার সঙ্গে ভাইয়ের বিয়ে আটকায় কে! এভাবে দিনের পর দিন কনে দেখার ছুতোয় বাংলার বহু গ্রামের মায়েদের রান্নার স্বাদ তিনি নিয়েছেন। পরে এসব অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করেই সে বছর পত্রিকাগুলোর পুঁজোবার্ষিকীতে লিখে গেছেন মর্মস্পর্শী সব গল্প।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন ছাড়ে হুইসেল বাজিয়ে। বিভূতিভূষণ খেয়াল করলেন, আরও দুজন রয়েছে কামরায়, বন্দুকসহ দুই পুলিশ। টাকার বস্তা পাহারা দিয়ে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে। বিভূতিভূষণ ভাবলেন, যাক, বেশ আরামেই যাওয়া যাবে। কিন্তু টের পেলেন আরামটা।

একবার হলো কি, দল বেঁধে বিভূতিরা গেলেন জঙ্গল অভিযানে। বনবাদাড়ে ঘুরে ঘুরে প্রকৃতি দেখা তাঁর নেশা ছিল। সে যাত্রায় তাঁর সঙ্গী বিখ্যাত সাহিত্য সম্পাদক পরিমল গোস্বামীসহ বেশ কয়েকজন জুনিয়র বন্ধু। যথারীতি বেরিয়ে পড়লেন ওডিশার সম্বলপুরের জঙ্গলের উদ্দেশে। একে তো অচেনা এলাকা, তার ওপর ভারতবর্ষে পর্যটন কেন্দ্র-টেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। সুতরাং বনে ঢোকার আগে বিভূতির বন্ধুরা কয়েক দিনের শুকনো খাবার কিনতে চাইলেন। কিন্তু যাঁর পেটের জ্বালা সবচেয়ে বেশি, সেই বিভূতিভূষণই বাদ সাধলেন। বললেন, বনজঙ্গলে ঘুরলে অত খাবার-টাবারের কথা ভাবলে চলে! অ্যাডভেঞ্চার বলে একটা ব্যাপার আছে। বনপথে চলতে গিয়ে যদি একটু খাদ্য-সংকটেই না পড়লে, জঙ্গলের ফলমূল খেয়ে যদি কয়েক দিন না কাটালে, তাহলে অ্যাডভেঞ্চারের সার্থকতা কোথায়!

বন্ধুদের অনুরোধ-উপরোধ সত্ত্বেও বিভূতিভূষণ নিজে খাবার কিনলেন না, অন্যদেরও কিনতে দিলেন না। কিন্তু দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে না–হতেই পেটের ভেতরে ছুঁচোর দৌড়ানি আরম্ভ হলো। অন্য সঙ্গীদেরও একই অবস্থা। কিন্তু তাঁরা বিভূতির কথা শোনেননি। ঠিক বিভূতিকে লুকিয়ে রুটি আর মাখন কিনে ব্যাগে ভরে নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই রুটি মাখনের চার ভাগের তিন ভাগই বিভূতিভূষণ একাই জবরদখল করে খেয়ে ফেলেছিলেন।

পুলিশের কবলে

পুলিশে ছুঁলে কেন ছত্রিশ ঘা, সে কথা বিভূতিভূষণ একবার টের পেয়েছিলেন হাড়ে হাড়ে। ১৯২০ কি ২১ সালের কথা। চাকরি সূত্রে তাঁকে গোটা পূর্ববঙ্গ ঘুরতে হয়েছিল। পূর্ববঙ্গ মিশনটা শুরু হয়েছিল কুষ্টিয়া দিয়ে। সেখানে কয়েক দিনের কাজ শেষে ট্রেনে চড়ে রওনা দিয়েছিলেন রাজবাড়ী হয়ে ফরিদপুরের পথে। ট্রেনে প্রচণ্ড ভিড়। কিন্তু একটা বগি পুরোই খালি। আগপিছ না ভেবে বিভূতিভষণ উঠে পড়েন সেই কামরায়।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন ছাড়ে হুইসেল বাজিয়ে। বিভূতিভূষণ খেয়াল করলেন, আরও দুজন রয়েছে কামরায়, বন্দুকসহ দুই পুলিশ। টাকার বস্তা পাহারা দিয়ে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে। বিভূতিভূষণ ভাবলেন, যাক, বেশ আরামেই যাওয়া যাবে। কিন্তু টের পেলেন আরামটা। পুলিশ ব্যাটারা পাঁড় মাতাল। কামরায় অন্য কারও উপস্থিতি তারা বরদাশত করবে না। আর মাতালে কী করতে পারে, তা বিভূতির অজানা নয়। একজন আরেকজনকে বলে, চল লোকটাকে ফেলে দিই। চলন্ত ট্রেন, পাথর আর লোহায় মোড়ানো রেললাইন, তার নিশ্চিত মৃত্যু! প্রমাদ গুনলেন বিভূতিভূষণ।

ওদের একজন এসে বিভূতিভূষণের হাত ধরে টানতে লাগল। কিন্তু পাঁড় মাতাল, নিজের ভারসাম্য রাখতেই কষ্ট হচ্ছে, বিভূতিকে ফেলে দেওয়া একার কম্ম নয়। তা ছাড়া বিভূতিভূষণ অন্য হাত দিয়ে কিছু একটা শক্ত করে ধরে আছেন। পুলিশের হাত থেকে ছুটে চেইন টানবেন, সে উপায়ও নেই, ওটা অন্য সেপাইয়ের মাথার ওপর। এক কামরা থেকে অন্য কামরাতেও যাওয়ার উপায় ছিল না সেই ট্রেনে। ওদিকে অন্য পুলিশটা তাঁকে ভয় দেখাচ্ছে গুলি করে দেবে বলে।

বিভূতিভূষণ তখন গীতা, বেদ, রামায়ণ, মহাভারত আওড়ে পুলিশদের উপদেশ দিতে লাগলেন। বললেন, নরহত্যা মহাপাপ, রামচন্দ্র এতে ভীষণ খেপে যান, স্বর্গের দরজা বন্ধ হয়ে যায় চিরকালের জন্য। কিন্তু মাতাল না শোনে ধর্মের বাণী।

ওরা যথাসম্ভব চেষ্টা করছে বিভূতিকে ফেলে দেওয়ার, পারছে না। কারণ ট্রেনের দরজা শুধু ভেতরের দিকেই খোলা যায়। বাতাস এসে বারবার করে দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে। একজন সেটা ধরে না থাকেল খোলা রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু শেষমেশ তাঁকে ফেলতে পারেনি মাতাল পুলিশরা। তার আগেই ট্রেন পৌঁছে যায় রাজবাড়ী স্টেশনে। মাতাল পুলিশ তাঁকে ছেড়ে দেয়, দ্রুত নেমে অন্য কামরায় চলে যান।