বেচারা

অলংকরণ: সব্যসাচী চাকমা

লকডাউনের আগের কথা। আমাদের স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছিল। তখন আমি ছিলাম ক্লাস সেভেনে। প্রতিবছরের মতো চারটি হাউসে ভাগ করা হয়েছিল পুরো স্কুলকে। যেদিন লটারির পর নোটিশ বোর্ডে কে কোন হাউসে তার লিস্ট দেওয়া হতো, সেদিন পুরো স্কুল হুমড়ি খেয়ে পড়ত নোটিশ বোর্ডের সামনে। আমি আর আদিবা, দুই বান্ধবী, অনেক কষ্টে যখন লিস্ট দেখলাম, তখন মোটামুটি নিরাশ হয়ে ফিরতে হলো। কারণ, আমরা এক হাউসে নই, ভিন্ন হাউসে। যাহোক, কিছু আর করার নেই। ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণি মিলে ‘ক’ গ্রুপ আর অষ্টম-দশম ‘খ’ গ্রুপ। তো, যে যার মতো বিভিন্ন ইভেন্টে অংশগ্রহণ করলাম। সবচেয়ে শেষ ইভেন্ট ছিল বিতর্ক। আমাদের হাউস থেকে ‘ক’ গ্রুপের বিতর্কের দলনেতা হলাম আমি (কপাল ভালো থাকলে যা হয় আরকি)। ও হ্যাঁ, আমার ভাই মাহিরও আমার সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ে। সেও আদিবাদের হাউসে। তাদেরও তাদের হাউসে ‘ক’ গ্রুপে নেওয়া হয়েছে। সেমিফাইনালে আমরা একটা হাউসকে হারিয়ে ফাইনালে উঠললাম। মাহিররাও আরেকটা হাউসকে হারিয়ে ফাইনালে উঠল। মানে এবার আমরা VS ওরা। কিন্তু আসল প্রতিযোগিতা শুরুর আগে ঘরের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল! কেউ কাউকে নিজের রুমে যেতে দিতাম না, শুনবে বলে দরজা বন্ধ করে আস্তে আস্তে প্র্যাকটিস করতাম, ঘুমানোর আগে তো গুপ্তধন লুকানোর মতো স্ক্রিপ্ট লুকানোর জন্য যুদ্ধ শুরু করে দিতাম...ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষ পর্যন্ত ফাইনালের দিনও চলে এল। আম্মু আমাদের অবস্থা দেখে বের হওয়ার আগে অনেকক্ষণ ধরে উপদেশ শোনালেন, ‘দেখ, অবশ্যই একদল হারবে এবং একদল জিতবে। তাই মন খারাপ করার কিছু নেই...।’

স্কুলে পৌঁছে আমি আর আদিবা এত স্বাচ্ছন্দ্যে একসঙ্গে ঘুরেছি যে কেউ বিশ্বাস করবে না এরা প্রতিপক্ষ। অবশেষে মঞ্চে উঠলাম। মোটামুটি দুই দলই ভালো পারফরম্যান্স করল। এবার ফলাফল দেওয়ার পালা। প্রিন্সিপাল স্যার অনেক মজা করে ফলাফল ঘোষণা করলেন। আমরাই জিতলাম। স্টেজ থেকে নেমে সবার সঙ্গে মজা করতে এত ব্যস্ত হয়ে গেলাম যে আদিবাদের খবর নিতে আর মনেই ছিল না।

কিছুক্ষণ পর সিনিয়র গ্রুপের বিতর্ক শুরু হলো।

এরপর দেখলাম একটা মেয়ে আমার সামনে থাকা ম্যাডামকে বলছে, ‘ম্যাডাম, মঞ্চের পেছনে আদিবা কাঁদতে কাঁদতে বেহুঁশ হয়ে গেছে।’ হায় আল্লাহ! ম্যাডামরা সবাই না বুঝে মঞ্চের পেছনে চলে গেলেন। কারণ, সবাই জানলে অবস্থা বেগতিক হতে পারে। আমিও কোনোমতে চলে গেলাম। আদিবাকে একটা বেঞ্চে শোয়ানো হলো, পানি ছিটানো হচ্ছে। কী অবস্থা! আমিও যা পারলাম ম্যাডামদের সহায়তা করলাম। এরই মধ্যে দারোয়ান আঙ্কেল গাড়ি নিয়ে এলেন। আদিবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে। নার্গিস ম্যাডাম কারও সাহায্য ছাড়া একাই কীভাবে যেন ওকে কোলে নিয়ে লম্বা করিডর পার হয়ে গাড়ির দিকে নিয়ে গেলেন (যা এখনো রহস্য)। তবে হাসপাতালে গিয়ে কিছুক্ষণ পর আদিবার হুঁশ ফিরেছিল।

রাতে শুনলাম স্কুলে মিটিং হয়েছিল, সব টিচাররা আদিবাকে দেখতে গিয়েছিলেন। পরের দিন যখন স্কুলে গেলাম, তখন আরেক মজার কাণ্ড ঘটল। সবাই আদিবাকে দেখতে আসতে লাগল। এমনকি যারা চেনে না তারাও এসে জিজ্ঞেস করতে লাগল, ‘ও আচ্ছা, তুমি আদিবা...তো এখন কেমন আছ?...ইত্যাদি।’ কিছুক্ষণ পর আমাদের কাছে এসে আদিবা বলতে লাগল, ‘বাপ রে বাপ! দরকার হলে অন্য কিছু হয়ে যাবে, তারপরও আর কোনো দিন বেহুঁশ হওয়ার মতো ভুল করব না।’

লেখক: অষ্টম শ্রেণি, চকরিয়া গ্রামার স্কুল, কক্সবাজার