বোতল চিঠি

১০ অক্টোবর ২০১৯। দক্ষিণ ফ্রান্সের কন্তিস আর মিমিজান এলাকার মাঝামাঝি সৈকতে হাঁটছিলেন দুবোয়া। হঠাৎ সৈকতে পড়ে থাকা একটা বোতল দেখতে পান ভদ্রলোক। গল্প-উপন্যাস আর সিনেমায় দেখা দৃশ্যের কথা মনে পড়ে গেল দুবোয়ার। সৈকতে পড়ে থাকা পুরোনো বোতল... খুললেই হয়তো বেরিয়ে আসবে দৈত্য! কোনো এক জাদুকরের অভিশাপে যে বন্দী হয়ে আছে শত শত বছর। দৈত্য না হোক, কোনো জলদস্যুর বোতল তো হতেই পারে। হয়তো সাগরের মাঝখানে নির্জন কোনো দ্বীপে আটকা পড়েছিল দস্যুটা। খাবারের অভাবে যখন প্রাণ যায় যায় অবস্থা, তখন হয়তো একটা চিঠি লিখে ভাসিয়ে দিয়েছিল সমুদ্রে। চিঠির সঙ্গে তার লুকিয়ে রাখা গুপ্তধন উদ্ধারের নকশা!

২০১৯ সালেও এমন চিন্তা মাথায় আসছে দেখে বেশ হাসি পেল দুবোয়ার। কিন্তু রোমাঞ্চের নেশা পেয়ে বসল তাঁকে। বোতলটার দিকে এগোলেন তিনি।

সত্যিই বেশ পুরোনো বোতলটা। কী আশ্চর্য! ভেতরে তো কাগজও দেখা যাচ্ছে! খুলে দেখতে হয় তাহলে। ভাবল দুবোয়া। একটু চেষ্টা করতেই খুলে গেল বোতলের ঢাকনা। ব্যস্ত হাতে ভেতর থেকে কাগজটা বের করে আনলেন দুেবায়া। কাগজটা খুলতেই তাঁর আক্কেলগুড়ুম। এ তো সত্যি সত্যি একটা চিঠি! আমেরিকান এক শিশু লিখেছে। তা–ও ৯ বছর আগে! ৯ বছর ধরে বোতলের ভেতরে থাকা চিঠিটা সমুদ্রে ভেসে ভেসে এখন তাঁর হাতে এসেছে! দূরত্বটাও তো কম নয়, আমেরিকা থেকে ফ্রান্স! কী আশ্চর্য! তুমি একটা চিঠি লিখে পাঠালে সেটা পৌঁছাতে কতক্ষণ লাগবে? ই–মেইল হলে কয়েক সেকেন্ড, ডাকযোগে হলেও বড়জোর কয়েক দিন। কিন্তু বোতলের এই চিঠিটা দুেবায়ার হাতে পৌঁছাতে লেগেছে ৯ বছর। মানে ৩ হাজার ২৮৫ দিন!

রিকার ছোট্ট ম্যাক্স ভ্রেডেনবার্গ। সমুদ্রসৈকতে বসেই চিঠিটা লিখেছিল সে। খুবই শিশুতোষ চিঠি ‘হ্যালো, আমার নাম ম্যাক্স। চিঠিটা যে পড়ছ, প্লিজ উত্তর দিয়ো। নিজের সম্পর্কে কিছু বলব আমি। আমার বয়স ১০। আমার ভালো লাগে আপেল, সমুদ্রসৈকত। আমার পছন্দের রং নীল। প্রাণী খুব পছন্দ করি আমি। ভালো লাগে গাড়ি। প্লিজ আমাকে চিঠি লিখো’ এ ধরনের। চিঠিতে ম্যাক্সের ঠিকানাও ছিল। এরপর চিঠিটা বোতলে ভরে উত্তাল সমুদ্রে ভাসিয়ে দেয় ছোট্ট ম্যাক্স। পশ্চিমা দেশের মানুষদের মধ্যে এই বোতলে চিঠি লেখাটা বেশ জনপ্রিয়। নিছক কৌতূহল আর মজা করার জন্যই এমন চিঠি লেখে অনেকে। যদিও বাস্তবে দেখা যায়, এ ধরনের অধিকাংশ চিঠিই যায় মাছের পেটে। আর নয়তো জাহাজের ধাক্কায় ভেঙে গিয়ে হারিয়ে যায় গভীর সমুদ্রে। ফিরতি মানুষের আর তা খোলার সৌভাগ্য হয় না।

কিন্তু ম্যাক্সের চিঠির ক্ষেত্রে হয়েছে চূড়ান্ত ব্যতিক্রম। আমেরিকার রকপোর্ট বিচ থেকে যাত্রা শুরু করেছিল বোতলটা। সেখান থেকে শুরু করে তা এগিয়েছে আটলান্টিক মহাসাগরের বুক চিরে। কে জানে, এর মধ্যে কত হাঙর-তিমির পেটে যেতে যেতেও বেঁচে গেছে বোতলটা। এড়িয়েছে কতশত জাহাজের ধাক্কা! যে পথে শত শত নাবিক আমেরিকা থেকে ইউরোপ পাড়ি দেন, সেই পুরো আটলান্টিক মহাসাগরের পাক্কা ছয় হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ফ্রান্সে এক সমুদ্রসৈকতে পৌঁছায় ম্যাক্সের বোতলটা। আমেরিকা থেকে ফ্রান্সে আসতে আসতে কত কিছু বদলে গেছে! বদলে গেছে আমেরিকা, ফ্রান্স দুই দেশেরই রাষ্ট্রপ্রধান। ফুটবল বিশ্বকাপ গেছে স্পেন থেকে জার্মানি হয়ে ফ্রান্সে! চিঠি লেখা সেই ছোট্ট ম্যাক্স এখন তরুণ! সে-ও ভুলেই গিয়েছিল তার বোতলের চিঠির কথা।

কিন্তু পুরো ঘটনাটা সবার নজরে আনল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। চিঠিটা পাওয়ামাত্র দ্রুত ম্যাক্সের ঠিকানায় উত্তর পাঠিয়ে দেন দুবোয়া। এবার আর ৯ বছর লাগল না। কদিন পরই ম্যাক্সের কাছে পৌঁছে গেল চিঠি। ১৯ বছরের তরুণ ম্যাক্স প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেনি। কিন্তু ৯ বছর আগে লেখা শিশুসুলভ বোতল চিঠিটা সত্যিই কেউ পেয়েছে এবং সেটা ছয় হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছে—এটা নিশ্চিত জানার পর ম্যাক্সের উত্তেজনা এবং আনন্দের সীমা ছাড়িয়ে যায়। সেই ছোট্ট ম্যাক্সের মতোই বাঁধনহারা আনন্দে মেতে ওঠে ম্যাক্স। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে করে প্রাপ্তিস্বীকার করে পোস্ট করল ম্যাক্স। সেকেন্ডের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল ঘটনা। শত শত টুইট, শেয়ার। খবর পোঁছে গেল সেই দুবোয়ার কাছেও। ম্যাক্সের সঙ্গে যোগাযোগ হলো তাঁর। ১১ নভেম্বর ২০১৯–এ ম্যাক্স সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখে, ‘যে আমার বোতল চিঠির উত্তর দিয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছে। ব্যাপারটায় আমরা খুবই উত্তেজিত!’

ম্যাক্স আর দুবোয়ার সেই উত্তেজনা ছুঁয়ে যায় বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষকেও। তুমিও পাঠাবে নাকি এমন চিঠি? পাঠাতেই পারো। তবে অবশ্যই কাচের বোতলে পাঠিয়ো। প্লাস্টিকের বোতল যে পরিবেশদূষিত করে, সে কথা তো আমার চেয়ে তোমরাই ভালো জানো। তা–ই না?

তথ্যসূত্র: বোরডপান্ডা