ভাঙা হাতে চিঠি

করোনাকালে সান্তাকে পাঠানো এক শিশুর চিঠি

ছোট্ট ববি মাত্রই লিখতে শিখেছে। এখনো ইংরেজি অক্ষর এন (N) উল্টো করে লেখে। তবু সে রংবেরঙের পেন্সিল দিয়ে একটা সুন্দর কাগজে তার এক বছরের যাবতীয় ভালো কাজের বিবরণ লিখে ফেলল। সেটাকে একটা খামে পুরে খামের ওপর বড় বড় করে লিখল, ‘To, Santa Claus. North Pole’। এন উল্টো। বাবার হাত ধরে সেই চিঠি ফেলে দিয়ে এল ডাকবাক্সে। এবার শুধু অপেক্ষা চিঠির জবাবের। নিশ্চয়ই মি. ক্লজ তার ভালো কাজের কথা শুনে খুব খুশি হবে।

ডিসেম্বর মাস এলেই পৃথিবীর সব প্রান্তে সান্তা ক্লজকে চিঠি লেখার ধুম পড়ে যায়। বড়দিনের আগেই সাদা চুল-দাড়িওয়ালা বুড়োকে চিঠি লিখে জানাতে হয় সারা বছর কত ‘গুড বয়’, ‘গুড গার্ল’ হয়ে ছিল সবাই। সঙ্গে পছন্দের উপহারের আবদার। কিন্তু কাল্পনিক চরিত্র সান্তা ক্লজকে চিঠি কীভাবে পাঠায়? পাঠালেও সেই চিঠিগুলো যায় কোথায়? লাখ লাখ চিঠির কথা শুনে মনে এমন প্রশ্ন জাগাটাই স্বাভাবিক।

শিশুদের পাঠানো চিঠির একাংশ

সান্তাকে চিঠি লেখার ব্যাপারটা অবশ্য আগে এমন ছিল না। আগে শুধু সান্তাই চিঠি পাঠাত বাচ্চাদের বাড়ি বাড়ি। আসলে মা-বাবারাই সান্তা হয়ে চিঠি রেখে যেত বাচ্চাদের বালিশের নিচে কিংবা চিঠির বাক্সে। চিঠিতে লেখা থাকত দুষ্টুমি না করতে, মা-বাবার কথা মেনে চলতে। আর সঙ্গে থাকত উপহার। বাচ্চারা সান্তার কথা খুব মেনে চলত। না মেনে চললে যে পরের বছর প্রিয় উপহারটাই পাবে না। বিখ্যাত লেখক জে আর আর টলকেইন আরও একধাপ এগিয়ে। তিনি তাঁর সন্তানদের কাছে ব্যাপারটা আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে চিঠির পাশাপাশি সান্তা ক্লজের নর্থ পোলের জীবনযাপনের কিছু ছবিও এঁকে দিতেন।

সান্তা যখন চিঠি লিখছে, তাহলে তো বাচ্চাদেরও চিঠি লিখে জানাতে হবে যে তারা কোনো দুষ্টুমি করেনি। কিন্তু এখনের মতো তখন পোস্ট অফিস ছিল না। তাই তারা চিঠি লিখে চিমনিতে ফেলে দিত। আর বিশ্বাস করত, সেগুলো ছাই হয়ে উড়ে উড়ে চলে যাবে সান্তার কাছে। লাতিন আমেরিকার বাচ্চারা আবার অত বোকা নয়। ছাই যে মি. ক্লজের কাছে পৌঁছাবে না, তা ভালো করে জানত। তারা বেলুনে বেঁধে উড়িয়ে দিত চিঠি। তবে স্কটিশ বাচ্চারা এত লম্বা প্রক্রিয়ায় যেতই না। তারা সোজা চিমনির ভেতর মাথা ঢুকিয়ে বড়দিনের উপহারের জন্য কান্নাকাটি করত।

সান্তার চিঠিতে যোগ হয় বিশেষ পোস্টকার্ড

তারপর এল ডাকব্যবস্থা। বাচ্চারা তাদের চিঠি ডাকে পাঠাতে শুরু করে। কিন্তু নর্থ পোল বরফের রাজ্যে তো তাদের চিঠিগুলো পৌঁছাত না। পরিপূর্ণ ঠিকানা ছাড়া চিঠি যে কোথাও যাবে না, সে খেয়াল তো আর বাচ্চাদের নেই। তাদের কাছে তো সান্তার একটাই ঠিকানা আছে, ‘নর্থ পোল’। তাই সান্তাকে লেখা সব কটি চিঠি জমা হতো ‘ডেড লেটার অফিসে’। চিঠিগুলো পড়ে থাকত সেখানেই। অন্য কারও চিঠি খুলে পড়া আইনত অপরাধ হওয়ায় অনেকের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও চিঠির উত্তর পাঠানো সম্ভব হতো না।

অবশ্য ১৯১৩ সালের দিকে আমেরিকায় এই নিয়মের পরিবর্তন আসে। ডাকঘরগুলো শুধু সান্তা ক্লজকে পাঠানো চিঠিগুলোর উত্তর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা ও স্বেচ্ছাসেবকদের এই দায়িত্ব দেওয়া হয়।

ডাকঘর কর্তৃক এই বিশাল পরিবর্তনের আগে অবশ্য আরেকটা মজার ব্যাপার হতো। ডিসেম্বরের শুরুতেই পত্রিকাগুলোতে বিজ্ঞাপন দেওয়া হতো যেন বাচ্চারা তাদের চিঠিগুলো পত্রিকার ঠিকানায় পাঠায়। সেখান থেকে সেরা চিঠিদাতাদের পুরস্কৃত করা হতো আর কয়েকটা চিঠি পত্রিকায় ছাপা হতো। আবার সান্তার উত্তরটাও চিঠির নিচে থাকত।

ইউএস পোস্টাল সার্ভিস অফিসে চলছে চিঠি বাছাই
এক শিশুর আবদার

যাহোক, সে গেল পুরোনো কথা। আগে খুব কম বাচ্চাই চিঠি পাঠাত। দিন দিন ক্লজের পরিচিতি বাড়ছে, সঙ্গে বাড়ছে চিঠির সংখ্যা। এখন এত পরিমাণ চিঠি আসে যে সেগুলো সামাল দিতে ডাকঘরের কর্তাদের বেশ বেগ পেতে হয়। তাই ১৯৫৬ সালে আমেরিকায় নতুন একটি নীতি প্রণয়ন হয়, যার নাম ‘অপারেশন সান্তা’। তারা দেশের সব প্রান্ত থেকে সান্তাকে পাঠানো চিঠিগুলো সংগ্রহ করে। সেগুলো তাদের ডেটাবেসে যুক্ত করে এবং শিশুদের নাম–ঠিকানা গোপন রেখে উন্মুক্ত করে দেয় সবার জন্য। তাদের ওয়েবসাইট থেকে যে কেউ পছন্দমতো একটি চিঠি নিয়ে শিশুদের চাহিদামতো উপহার এবং সুন্দর করে একটি চিঠি লিখে স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে পাঠিয়ে দিতে পারে। এই আয়োজনের স্বেচ্ছাসেবকদের একটি মজার নাম আছে। ‘এল্ফ’। মানে সান্তার বামন। একমাত্র তাদের কাছেই চিঠিদাতা শিশুদের তথ্য থাকে। ১৯ ডিসেম্বরের ভেতর সব দাতার কাছ থেকে উপহার ও চিঠি সংগ্রহ করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় শিশুদের ঠিকানায়। বড়দিনের আগেই পৌঁছে যায় সেসব উপহার।

সামরিক বাহিনীর সহায়তায় আলাস্কায় পৌঁছে গিয়েছে উপহার

সম্প্রতি কোভিড-১৯ মহামারির ফলে এই কার্যক্রম কীভাবে হবে, তা নিয়ে অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। কিন্তু সেই দ্বন্দ্ব দূর করতে প্রতিবারের মতো এগিয়ে এল সামরিক বাহিনী। তারা শুরু থেকেই এই সুন্দর উদ্‌যাপনের সঙ্গী হয়ে এসেছে। ‘অপারেশন সান্তা’ প্রতিবছর শিশুদের উপহার পাঠানোর পাশাপাশি দুটো অথবা তিনটে গ্রামকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী দিয়ে সাহায্য করে থাকে যেন সবাই মিলে সুন্দরভাবে বড়দিন পালন করতে পারে। তবে এবার চিত্র একটু ভিন্ন। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো এমনিতেই বিভিন্ন কারণে অবহেলিত থাকে। তার ওপর এবার এই মহামারি। তাই এই অপারেশন এবার বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় ৯০টি গ্রামের সবার কাছে বড়দিনের উপহার পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রবল তুষারপাত, স্বাস্থ্যবিধি সব ধরনের বাধা অতিক্রম করে সেসব উপহার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়ে সহায়তা করেছে সামরিক বাহিনী।

মহামারির ফলে মানুষের জীবনে যেমন ভিন্নতা এসেছে, তেমনই ভিন্নতা দেখা গিয়েছে বাচ্চাদের পাঠানো চিঠিগুলোতে। সান্তাকে লেখা চিঠিতে তাদের দুষ্টু-মিষ্টি আবদারের পাশাপাশি অনেকে সান্তার কাছে চেয়েছে কোভিড–১৯ ভাইরাসের প্রতিকার। বড়দিনের আগে অবশ্যই সান্তা তাদের আবদার পূরণ করবে, এই আশায় বসে আছে সবাই। আর যা–ই হোক, সান্তার একটা চিঠি পেলে বড়দিনে আনন্দের কমতি হয় না।

সূত্র: ইনসাইডার, ইউএসপিএস অপারেশন সান্তা