ভালো থাকিস তুই

অলংকরণ: রাকিব রাজ্জাক

আমি সিরাত। দশম শ্রেণিতে পড়ি। পড়ালেখায় ভালোই আছি। কিন্তু আমার একটি মুদ্রাদোষ আছে। যে কাউকেই আমি অল্প সময়ের মধ্যেই আপন করে নিই। কেউ কেউ এটাকে নেতিবাচকভাবেও দেখে। তবে মিশুকে স্বভাব থাকার কারণে আমার ফ্রেন্ড সার্কেলটা অনেক বড়, কিন্তু সবাই তো আর কাছের বন্ধু বা সত্যিকারের বন্ধু হয় না, তাই না?

রিশা নামের মেয়েটির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় যখন আমি নার্সারিতে পড়তাম। ক্লাসের এক কোণে চুপচাপ বসে ছিল সে, আমি কাছে গিয়ে নাম জিজ্ঞেস করলাম, নাম বলল রিশা। ওর সঙ্গে আমি বন্ধুত্ব করলাম। রিশা বেশ চুপচাপ স্বভাবের। পড়ালেখায় খুবই ভালো! তার সঙ্গে ধীরে ধীরে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্ক গভীর হতে থাকে। আমরা প্রতিদিন একসঙ্গে টিফিন খেতাম, খেলাধুলাও করতাম। একজন আরেকজনকে পড়াশোনায়ও অনেক সাহায্য করতাম। আর সবচেয়ে মজার কথা হলো, পরস্পরকে প্রতিদিন একটা করে ছবি এঁকে দিতাম আমরা। একে অপরকে বিভিন্ন নামেও ডাকতাম। ভালোই চলছিল সবকিছু। যত দিন যেতে লাগল, আরও ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠছিলাম আমরা। একজন আরেকজনকে কথা দিয়েছিলাম যে কোনো দিনও ছেড়ে যাব না, সব সময় পাশে থাকব। দুজনেই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ–৫ পেয়ে বৃত্তিও পেয়েছিলাম। শহরের নামকরা হাইস্কুলগুলোর মধ্যে একটিতে সুযোগ পেয়েছিলাম দুজনই। কিন্তু রিশার জন্মের পরই ওর খালামণি ওদের পুরো পরিবারের যুক্তরাজ্যে যাওয়ার জন্য আবেদন করে রেখেছিলেন। যার কারণে ও যুক্তরাজ্যে চলে যায়। অনেক খারাপ লাগেছিল। কিন্তু বাস্তবতা তো মেনে নিতেই হবে। রিশা যুক্তরাজ্যে গিয়েও আমার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছিল। প্রতিদিন ওর সঙ্গে কথা হতো।

কিন্তু হঠাৎ করেই রিশা আর আমার সঙ্গে কথা বলে না। কোনো মেসেজের জবাবও দেয় না। কল দিলাম, কলও তুলল না। আমার আরও বান্ধবীদের জিজ্ঞেস করলাম, ওরাও কিছুই জানে না রিশার সম্পর্কে। এভাবেই এক মাস কেটে যায়। তারপর আবারও ওকে কল করলাম, এবার আন্টি (রিশার মা) কল তুললেন। রিশার কথা জিজ্ঞেস করতেই উনি কাঁদতে শুরু করলেন। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আন্টি কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘রিশা আর নেই সিরাত!’

আমি বুঝতে পারছিলাম না যে আন্টি কী বলছিলেন। আমি বললাম, ‘আন্টি আপনি কী বলছেন?’ আন্টি বললেন, ‘গত মাসে যখন আমরা রিশার খালার বাসা থেকে আসছিলাম, তখন একটা ট্রাক ব্রেকফেল করে আমাদের গাড়ির ওপর এসে উঠে যায়। অনেক বড় একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যায়। আল্লাহর শুকরিয়ায় এক মাস হাসপাতালের চিকিৎসায় আমি আর রিশার বাবা বেঁচে গেলাম। কিন্তু ওই দুর্ঘটনায় রিশা স্পটেই মারা যায়।’

আন্টির মুখ থেকে এসব কথা শুনে আমার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। আমার প্রাণপ্রিয় বান্ধবী আর এ পৃথিবীতেই নেই! আমি আন্টিকে কোনোমতে সান্ত্বনা দিয়ে কলটি কাটলাম। আমি আর আমার অশ্রু ধরে রাখতে পারিনি। কাউকে হারানো যে কী কষ্টদায়ক, তা সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম! সেই কষ্ট আজও মনের মধ্যে বয়ে বেড়াচ্ছি। অনেক কাঁদলাম! তা–ও যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না যে রিশা আর নেই। আমার পরিবারের সবাই রিশার পরিবারের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করলেন। আমার মা আন্টিকে কল করে কথা বললেন, সান্ত্বনা দিলেন। আজ আমি আমার বান্ধবীকে কিছু কথা বলব যা আমি শেষবারের মতো ওকে বলতে পারিনি। রিশা, তোর সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্তই ছিল অসাধারণ! প্রতিটি দিনই ছিল সোনালি সূর্যের মতো উজ্জ্বল। কিন্তু আজ সবকিছুই শুধু স্মৃতি। এমন স্মৃতি যা আমি সারা জীবন আগলে ধরে থাকতে চাই। হয়তো স্মৃতিগুলো তোর অভাব একটু হলেও আমার জীবনে পূরণ করবে। আর একটি কথাই বলতে চাই, যেখানেই থাকিস, তুই ভালো থাকিস।

লেখক: অষ্টম শ্রেণি, সরকারি এসসি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, সুনামগঞ্জ