আজকে রাতুলকে ভূত দেখানোর কথা ছোট মামার। মিথ্যামিথ্যি ভূত না। সত্যিকারের জলজ্যান্ত ভূত। সেই ভূত দেখতে কেমন হবে, লম্বা নাকি বেঁটে, চিকন নাকি মোটা, আধা নাকি গোটা—এসব কিছুই ছোট মামা বলেনি। শুধু বলেছে, ‘রাত নয়টা পর্যন্ত জাইগ্যা থাকিস। ভূত দ্যাখাবোনে।’
রাতুলের ছোট মামা বর্তমানে বেকার। বেকার বলাটা ঠিক ভালো শোনাবে না। আয়–রোজগার কিছু করছে না, এই আরকি। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সায়েন্সের কী একটা বিষয় নিয়ে যেন বছরখানেক আগে পাস করেছে। এখন গ্রামে এসে ছোটবেলার বন্ধুদের সঙ্গে তাস খেলা আর আড্ডাবাজির পাশাপাশি মাঝেমধ্যে ঢাকায় রাতুলদের বাসায় গিয়ে থাকা এবং সেই থাকার ফাঁকেফোকে দু–এক জায়গায় চাকরির চেষ্টা করাই তার কাজ।
রাতুলের ছোট মামা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার পরও কথা বলে একেবারে আঞ্চলিক বাংলায়। নিজের বাপ–দাদার উচ্চারণে কথা বলাই তার কাছে সত্যিকারের স্মার্টনেস।
কয়েক দিন আগে রাতুলের এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এখন ছুটি। ছোট মামা রাতুলদের বাসায় ছিল। সে গ্রামে আসার সময় রাতুল তার ন্যাজ ধরে গ্রামে, মানে নানাবাড়ি চলে এসেছে। নানা-নানি দুজনই রাতুলের জন্মের আগে মারা গেছেন। এখন এই বাড়িতে বড় মামা বউ–ছেলেপেলে নিয়ে থাকেন। বারান্দার ছোট একটা কামরায় থাকে ছোট মামা।
ছোট মামা রাত নয়টা পর্যন্ত জেগে থাকতে বলেছে। ঢাকায় রাত ১০টা পর্যন্ত জেগে থাকাও রাতুলের কাছে কোনো ঘটনা না। ১১টা, এমনকি ১২টা পর্যন্তও সে জেগে থাকতে পারে। কিন্তু নানাবাড়িতে সেটা কঠিন। কারণ, রাত আটটার পরই সবাই খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
এখন রাত নয়টা। কিন্তু ছোট মামার বাড়ি ফেরার নামে খবর নেই। কী একটা জরুরি কাজে সে পাশের গ্রামে গেছে। সন্ধ্যায় যাওয়ার আগে সে বলে গিয়েছিল, ফিরতে নয়টা বাজতে পারে।
ছোট মামার ফেরার অপেক্ষায় রাতুল এতক্ষণ বারান্দার কামরায় হারিকেন জ্বালিয়ে শীর্ষেন্দুর ভূতের গল্প পড়ছিল। গল্পগুলো ভূতের, কিন্তু সেসব ভূতের কাজ কারবারে মনে মোটেও ভয় জাগে না। উল্টো হাসি পায়। কী সব ফাজিল টাইপের ভূত নিয়ে গল্প।
নয়টার পর রাতুল বইয়ের যে জায়গা পর্যন্ত পড়া হয়েছে, সেখানে একটা কলম রেখে মলাট ভাঁজ করে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। একটু বাইরে আসতে মন চাইল।
নানাবাড়ির ঘরটা আধা পাকা। টিনশেড ঘরটা বেশ বড়। ঘরে ঢোকার প্রধান দরজার সঙ্গে ইট দিয়ে পাকা করা বেঞ্চির মতো একটা বসার জায়গা বানানো আছে। রাতুল বেঞ্চিটায় বসল।
রাতুল ঘড়ি দেখল। নয়টা ছয় মিনিট বাজে। কিন্তু মনে হচ্ছে মধ্যরাত। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিজের হাত-পাও দেখা যাচ্ছে না। একটা ঝিমধরা নীরবতা চারদিকে। মাঝেমধ্যে দু–একটা বাদুড়ের ওড়াউড়ি, প্যাঁচার ক্যাঁচক্যাঁচ আর কুকুরের ঘেউ ঘেউ কানে আসছে। কাছাকাছি কোনো ডোবা থেকে ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর শোনা যাচ্ছে। এর বাইরে জনমানবের সাড়াশব্দ নেই। দু–এক দিনের মধ্যে অমাবস্যা লাগবে অথবা দু–এক দিন আগে অমাবস্যা চলে গেছে। অথবা হতে পারে আজই অমাবস্যা।
কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকারকে আরও কালো করে দিয়েছে বাড়িটার চারপাশের অসংখ্য গাছপালা আর ঘন ঝোপঝাড়।
রাতুলের মামাদের গ্রামে এখনো বিদ্যুৎ আসেনি। কারও কারও বাড়িতে সোলার প্যানেল বসিয়ে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানো হয়। কিন্তু ঘরের বাইরে কেউ সে ধরনের বাতি জ্বালায় না। একেবারে মনোযোগী ছাত্রছাত্রী ছাড়া প্রায় সবাই আটটা–নয়টার মধ্যে গভীর ঘুমে চলে যায়। ফলে সন্ধ্যারাতেই এই গ্রামে মধ্যরাত নেমে পড়ে। ঝোপঝাড় আর পিনপতন নীরবতায় কেমন একটা ভৌতিক পরিবেশ তৈরি হয়।
ক্লাস ফোর–ফাইভ থেকেই রাতুল জেনে এসেছে, ভূত বলে কিছু নেই। ভূতের সব কথাই বানানো কথা। কুসংস্কার। এ কথায় রাতুলের শতভাগ বিশ্বাস আছে। তারপরও ভূতের গল্প তার ভালো লাগে। ‘ভূত’ শব্দটার মধ্যে গা ছমছম করা একটা ব্যাপার আছে বলে তার মনে হয়। হরর মুভি দেখার সময়ও তার একটা ভয় ভয় ধরনের অনুভূতি হয়। এই অনুভূতি রাতুলের মন্দ লাগে না। তবে ফাইনালি সে বিশ্বাস করে, ভূত বলে কিছু নেই।
কিন্তু ছোট মামা আজ সন্ধ্যায় এত কনফিডেন্টলি ভূত দেখানোর কথাটা বলল যে ভূত আসলেই আছে কি না, তা নিয়ে রাতুলের মনের মধ্যে একটা দোনোমোনো ভাব তৈরি হয়েছে। সত্যিই ভূত আছে—এটি মনে মনে স্বীকার করতে তার নিজের কাছেই লজ্জা লাগছে। নিজেকে ভিতু টাইপের ছেলে বলে মেনে নেওয়ার মতো ঠেকছে। কিন্তু ছোট মামা বলেছে, আজ সে রাতুলকে যেটা দেখাবে, তাতে ভূত বলে যে সত্যিই কিছু একটা আছে, তা রাতুলকে বিশ্বাস করতেই হবে। এরপর থেকে রাতুলের মনের মধ্যে একধরনের রোমাঞ্চ কাজ করছে।
রাতুল বাঁধানো বেঞ্চিতে বসে উঠোনের দিকে চেয়ে আছে। উঠোন মানে তো এখন উঠোন নয়। ঘন অন্ধকার। সামনে এখন উঠোনও যা, বেডরুমও তা। তবে এই ঘন অন্ধকারে মাঝেমধ্যে মিটমিট করে জোনাকি জ্বলছে–নিভছে। জোনাকিরা ওড়াউড়ি করছে।
রাতুল এর আগে এমনভাবে খেয়াল করে জোনাকি দেখেনি। অন্ধকারে একেকটি জোনাকি আধা সেকেন্ডের মতো জ্বলছে। আবার নিভছে। একটি হয়তো নিভতেই আরেকটা জ্বলে উঠছে। কেমন নীলাভ আলো। ওয়েল্ডিং মেশিন দিয়ে লোহা ঝালাই করার সময় নীল আগুনের শিখার যে রং, এই জোনাকির আলোর সঙ্গে সেই আলোর রঙের ভারি মিল।
উঠোনের এক পাশে দশ–বারোটা কাগজি লেবুর গাছ আছে। গাছগুলোর ডালপালা ঝাপটে একটা আরেকটার সঙ্গে জড়াজড়ি করে জট পাকিয়ে আছে।
রাতুল খেয়াল করল, একটা–দুটো করে জোনাকিগুলো ওই জট পাকানো ঝোপের মধ্যে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। ৫টা, ১০টা, ২০টা, ৫০টা, আস্তে আস্তে আরও বেশি। কয়েক মিনিটের মধ্যে অগণিত জোনাকি লেবুগাছের ঝোপে জড়ো হচ্ছে। বিয়েবাড়ির লম্বা তারে বাঁধা ছোট ছোট মরিচবাতি স্তূপ করে রেখে জ্বালালে যেমন দেখা যাবে, অনেকটা সেই রকমের একটা আবহ সেখানে তৈরি হচ্ছে। ঝোপের মধ্যে যে নিকষ অন্ধকার ছিল, আস্তে আস্তে তা কেটে যাচ্ছে।
এত জোনাকি কোত্থেকে আসছে, কেনই–বা তারা মৌমাছির মতো এক জায়গায় এসে জড়ো হচ্ছে, রাতুল তার কোনো ব্যাখ্যা পাচ্ছে না। মিনিট দশেকের মধ্যে চারপাশ থেকে মাছির মতো ঝাঁক বেঁধে জোনাকি আসা শুরু হলো।
রাতুলের চোখের পলক পড়ছে না। দিঘির মধ্যে শোল মাছের লাল টুকটুকে পোনা দলা পাকিয়ে পাকিয়ে যেভাবে টোপা শেওলার ফাঁকে ফুটকি কাটে, সে রকম একটা আগুনের বলের মতো আকৃতি নিয়ে জোনাকিগুলো জ্বলছে।
বিশাল উঠোন পার হলেই বড় রাস্তা। রাস্তা বড় হলেও পাকা হয়নি। এখন বর্ষাকাল। ভারী বৃষ্টিতে পুরো রাস্তা কাদায় থিক থিক করছে। নদীর খেয়াঘাট পর্যন্ত রাস্তা গিয়ে শেষ হয়েছে।
রাতুল খেয়াল করল একটু আগে গলিত আগুনের বলের মতো যে আকৃতিটা ছিল, এখন সেটা আস্তে আস্তে ভেঙে যেতে শুরু করেছে। জোনাকিগুলো পরস্পরের কাছ থেকে সরে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে গোলাকার পিণ্ডটা মানুষের মুখের আদল নিতে শুরু করেছে। একটা আলোর মুখাবয়ব লেবুগাছের ঝোপের মধ্যে স্পষ্ট হচ্ছে। রাতুল দেখতে পাচ্ছে এক জায়গায় কিলবিল করা জোনাকির আলোয় যে অবয়ব তৈরি হয়েছে, তা অবিকল তার ছোট মামার মতো। চোখ, মুখ, কান, কপাল সব স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। রাতুলের মনে হলো, মুণ্ডুটা তার দিকে চেয়ে আছে। তার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। সে খেয়াল করল, তার সব চুল শজারুর কাঁটার মতো খাড়া হয়ে গেছে।
—কী রে বিজ্ঞানী, কী করিস?
রাতুল প্রচণ্ড ভয়ে ‘ও মাহ!’ বলে চমকে উঠল। পেছনে তাকিয়ে দেখল দরজায় ছোট মামা দাঁড়িয়ে। বারান্দার হারিকেনের আলো আর বাইরের অন্ধকারের মাঝখানে আলো-আঁধারিতে ছোট মামার হাসি হাসি মুখ দেখা যাচ্ছে।
—ছোট মামা! তুমি আসলা কখন? ঘরে ঢুকলা কখন? আমি তো দরজায় বসা সেই তখন থেকে।
—পেছনের দরজা দিয়া ঢুকছি আধা ঘণ্টা আগে। চোরের মতো পাকঘরে গিয়া খাওয়াদাওয়া শ্যাষ করছি। চল এইবার মিশনে যাব।
রাতুলের হার্টবিট তখনো স্বাভাবিক হয়নি। তবে ভয় পাওয়ার বিষয়টি সে টের পেতে দিতে চাইছে না।
—নাহ্, থাক ছোট মামা। আজকে মিশন বাদ। কাল যাব।
—ক্যান, ভয় পাইছিস? আচ্ছা, ভয় পাইলে বাদ দে। যা ঘুমা।
ছোট মামার কথায় রাতুলের মানসম্মানে টান পড়ল। মামা তাকে আদর করে ‘বিজ্ঞানী’ বলে ডাকে। সেই বিজ্ঞানী ভূতের ভয়ে ঘুমাতে যাবে, সেটা কোনো কাজের কথা না।
—দূর, কিসের ভয়? ভূতের? তুমি তো জানো আমি বিজ্ঞানী। ভূতে আমার বিশ্বাস নেই।
কথাটা বলতে বলতে ভয় ভয় নিয়ে রাতুল ঝোপের দিকে তাকাল।
কী আশ্চর্য! এই তো খানিক আগে এত জোনাকি ছিল, এখন সেগুলো নাই হয়ে গেল কী করে? এখন সেখানে মোটে ১০–১২টি টিপটিপ করে জ্বলছে।
—হুম, আমি জানি তুই বিজ্ঞানী। আমরা যেই জিনিসরে কই পানি, তোরা বিজ্ঞানীরা কস ‘এইচ টু ও’। কিন্তু তোর চেহারা দেইখে তো মনে কয় ভয় পাইছিস। ভূত দেখার আগেই ভয়? যা, ভূত দেখানো প্রজেক্ট বাদ। ক্যানসেল।
রাতুল এবার যেন একটু সহজ হলো। সে ছোট মামার কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে বলল, ‘ছোট মামা, সত্যিই একটু ভয় পাইছি। কিন্তু ভূত দেখে না। একটু আগে ঝোপের মধ্যে একদলা জোনাকি দেখলাম। একদম মানুষের মতো, উঁহু মানুষ না, একদম তোমার মুখের মতো একটা শেপ নিয়ে জোনাকিগুলো কিলবিল করছিল।
—আহ্হা রে বিজ্ঞানী!
ছোট মামা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসছে। হাসির সঙ্গে কাশি মিশিয়ে ছোট মামা বলল:
—ওইটা ভূতটুত না রে পাগলা। এখন লেবুর ফুল ফোটার সিজন। লেবুর ফুলের মইধ্যে হাজার হাজার মিহি বালুকণার মতো কীট বাসা বান্ধে। ওই কীট খাওয়ার জন্য ঝাঁক বাইন্ধা জোনাকিরা আসে।
—কিন্তু হঠাৎ করে সব জোনাকি নাই হয়ে গেল কেন?
—তার জবাবও সোজা। ব্যাঙ আর কিছু নিশাচর পাখি আছে, যেগুলান জোনাকি পোকা ধইরা খায়। বাবুই পাখি যা করে, তা শুনলি তো তোর আক্কেল গুড়ুম হয়ে যাবে। বাচ্চা ফুটলে বাচ্চারা আন্ধার বাসায় ভয় পাইতে পারে, এই ভাইব্যা মা পাখি খানিক ক্যাদামাটি আইন্যা বাসার ভেতরের দেয়ালে লাগায়ে দেয়। তারপর গোডা দশেক জোনাকি ধইরা সেই ক্যাদায় পুঁইত্যা রাখে। পুরো বাসায় বিনা পয়সার লাইটিংয়ের কাজ সারে তারা। হয়তো বড় ব্যাঙ কিংবা বাবুই পাখি জোনাকিদের ধরতে গেছিল। সে জন্য যে যেদিক পারছে, সেদিকে ভাগছে।
—হু, বুঝলাম। কিন্তু মানুষের মাথার মতো দেখলাম কেন? তোমার মুখের মতো মাথা একটা।
—ওইটার জবাব তো তুই নিজেও দিতে পারিস। ওইটা তো ইল্যুশন। বিভ্রম। আলোডা ইট্টু গোল ধরনের ছিল। তুই, মানে তোর ভয় পাওয়া আউলানো ব্রেন কষ্টকল্পনা দিয়া সেইটারেই আমার মুখ বানায়ে ফেলছে। নাউ ইজ ইট ক্লিয়ার টু ইউ?
ছোট মামার কথায় রাতুল টের পেল, তার ভয় কেটে গেছে। বুকের ধড়ফড়ানি থেমে গেছে। সে বলল:
—চলো মিশনে যাব। আজই যাব। ভূত দেখে আসি। কত দূর যেতে হবে?
ছোট মামা হাসতে হাসতে বলল:
—চল, সত্যি ভূত দেখায়ে নিয়ে আসি। বেশি দূরে না। রাস্তার পাশেই।
—চলো।
বিশাল উঠোন পার হলেই বড় রাস্তা। রাস্তা বড় হলেও পাকা হয়নি। এখন বর্ষাকাল। ভারী বৃষ্টিতে পুরো রাস্তা কাদায় থিক থিক করছে। নদীর খেয়াঘাট পর্যন্ত রাস্তা গিয়ে শেষ হয়েছে। রাস্তার পাশ দিয়ে খালের মতো পাগার। আসলে নিচু জমির মাটি কেটে রাস্তাটা বানানো হয়েছিল। সেখান থেকে মাটি কাটা হয়েছিল—সেটাই এখন পাগার হয়ে আছে। পাগারে বুকসমান পানি। কচুরিপানায় ঠাসা। রাস্তার দুই ধারে অসংখ্য গুই বাবলার গাছ।
রাতুলদের মামাবাড়ির উঠোন পার হয়ে রাস্তায় উঠলেই তার উল্টো পাশে পাগার ঘেঁষে একটা দিঘি আছে। বিরাট দিঘিটার পাড়ে কলা আর পেঁপেগাছের সারি। সাপখোপের রাজ্য।
ছোট মামা রাতুলকে এই দিঘির পাড়ে একটা পেঁপেগাছের তলায় এনে বসিয়েছে। ছোট মামার হাতে দুই ব্যাটারির একটা টর্চলাইট। সাবধানে আলো ফেলে তারা একটু পরিষ্কারমতো জায়গায় পেঁপের পাতা বিছিয়ে বসেছে।
শোন বিজ্ঞানী, খালি গেরস্তের মুরগি চুরি করে শিয়ালের প্যাট চলে না। তারা ব্যাঙ খায়। মাছ খায়। রাত্তির বেলা তারা ব্যাঙ আর মাছ শিকারে বাইর হয়।
—শোন, খেয়াঘাটের দিকে ভালো করে চায়া থাক। কিছুক্ষণের মইধ্যেই উনারা আসবে।
ছোট মামা রাতুলকে ফিসফিস করে বলল।
রাতুল কিছু বলল না। সে কৌতূহল আর ভয় ভয় মন নিয়ে খেয়াঘাটের দিকে চেয়ে থাকল। দিঘির পাশ দিয়েই রাস্তাটা খেয়াঘাটের দিকে গেছে। রাতুলের দৃষ্টি ওই পথ বেয়ে খেয়াঘাটে যাচ্ছে আবার ফিরে আসছে।
৫ মিনিট। ১০ মিনিট। কিছুই দেখা গেল না। এর কিছুক্ষণ পরে ঠিক খেয়াঘাটের কাছে একটা আলো জ্বলে উঠল। আলোটা অদ্ভুত রকমের। মনে হচ্ছে কেউ হারিকেন জ্বালিয়েছে। আলোটা টিপটিপ রাস্তার পাশ দিয়ে পাগারের পাড় ঘেঁষে রাতুলদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। একটু পরেই দেখা গেল রাতুলদের খুব কাছেই আরেকটা আলো জ্বলেছে। সেটা টিমটিম করে খেয়াঘাটের দিকে যাচ্ছে। মিনিটখানেক পর আরেকটা জ্বলল। তারপর আরেকটা। তারপর আরেকটা। মাঝে মাঝে আলোগুলো নিভছে। আবার জ্বলে উঠছে।
আলোগুলো খুব উজ্জ্বল নয়। আবার একেবারে নিষ্প্রভও নয়। প্রতিটি আলো সচল। কোনোটা খেয়াঘাটের দিকে যাচ্ছে। কোনোটা খেয়াঘাট থেকে রাতুলদের দিকে আসছে। একটা আলো আস্তে আস্তে রাতুলদের প্রায় ৫০ গজের মধ্যে চলে এসেছে। রাতুল উত্তেজনায় কাঁপছে। ভয়ও করছে খুব।
—অ্যাই কিডারে? কিডা তুই?
ছোট মামা চিৎকার করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে টর্চলাইটের আলো ফেলল। সুনসান নীরবতার মধ্যে ছোট মামার চিৎকার এক মাইল দূর পর্যন্ত চলে গেছে বলে মনে হলো। চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে সব আলো দুপ করে নিভে গেল। টর্চের আলো যত দূর যায়, ততটা দূরত্বের মধ্যে কাউকে দেখা গেল না। সব আলোর উৎস যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে।
রাতুল ভয়ে ছোট মামাকে জড়িয়ে ধরেছে।
—দূর বিজ্ঞানী, ডরাইস না। অরা আমার কাছে আসবে না। তুই চুপচাপ বইসা থাক। দেখবি ১০ মিনিট পর আবার তারা আসবে।
ছোট মামার কথাই ঠিক হলো। মিনিট সাত–আটেকের মধ্যে আবার টিমটিম করা আলোর হাঁটাচলা শুরু হলো। রাতুলের মনে হচ্ছে অশরীরী ১০–১২ জন লোক একটা করে হারিকেন হাতে রাস্তার পাশে আঁতিপাঁতি করে কিছু খুঁজছে।
—ছোট মামা, এই রকম কতক্ষণ চলবে?
—ফজরের আজান পর্যন্ত।
—আমরা যদি ওখানে যাই?
—যাবি? চল যাই।
—নাহ্ থাক, চলো, ঘরে চলো।
রাতুল বেশ বুঝতে পারছে, ওই রহস্যময় আলোর উৎস খুঁজতে গেলে ভয়ে সে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। তার হাত–পা এখনই কাঁপছে।
—চল তাহলে।
ছোট মামা রাতুলকে হাত ধরে টেনে তোলে। রাতুলের পায়ে ঝিঁঝি ধরে গেছে। তার কপাল ঘামে ভিজে গেছে।
দিঘির পাড়ে অনেকগুলো ব্যাঙ একসঙ্গে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর করা শুরু করেছে। ঝিঁঝি পোকারাও চিল্লাচিল্লি চালাচ্ছে। কলাগাছের সারির মধ্য দিয়ে সাবধানে এগোতে এগোতে রাতুল মাথার ওপরে তাকাল। অযুত–নিযুত তারা অন্ধকারের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে। লেবুগাছের ঝোপের মধ্যে জোনাকির জ্বলজ্বলে দলার মতো অনন্ত নক্ষত্রবীথি কেমন ঝিলমিল করছে।
বাড়ির উঠোনে ঢুকে ছোট মামা বলল:
—কী রে বিজ্ঞানী? ভূত কেমন দেখলি? ভয় লাগছে?
—হুম, ছোট মামা ভয় করছে।
—ডরানোর কিছু নাই বিজ্ঞানী। ওইগুলান ভূত না। তবে মানুষও না।
—তাহলে?
—ওইগুলান শিয়াল। খ্যাঁকশিয়াল।
—মানে?
ছোট মামা রাতুলের কাঁধে হাত রেখে বলল:
—শোন বিজ্ঞানী, খালি গেরস্তের মুরগি চুরি করে শিয়ালের প্যাট চলে না। তারা ব্যাঙ খায়। মাছ খায়। রাত্তির বেলা তারা ব্যাঙ আর মাছ শিকারে বাইর হয়। বড় বড় চিংড়ি আর অন্য কিছু জাতের মাছ রাতে একেবারে পাড়ে চলে আসে। সেইগুলান শিয়ালে খপ খপ কইরে ধরে। তাগের গালের মইধ্যে এমন কিছু রাসায়নিক পদার্থ আছে যা জ্বলে। অনেকটা জোনাকির আলোর মতো। শিয়াল হাঁ কইরে পাগারের পাড় ধইরে হাঁটে। তার গাল থেইকে আলো বাইর অয়। সেই আলোতে মাছ দেইখে তারা কটাস কইরে ধরে ফেলে। আমরা এতক্ষণ শিয়ালের মাছ তালাশ করা দেখছি। ভূতটুত কিচ্ছু দেখি নাই।
ছোট মামা হাসছে। তার দাঁত অন্ধকারে চিকচিক করছে। চোখ দুটো জ্বল জ্বল করছে। ছোট মামা হাসতে হাসতে ফিসফিস করে বলল:
—বিজ্ঞানী, তোর কথাই ঠিক। ভূত বলে কিছু নাই। তুই ঘরে যা। শুয়ে পড়। আমি বাথরুম সাইরে আসি।
রাতুল দরজায় এসে দেখল ভেতর থেকে খিল আঁটা। সে ঠক ঠক করে নক করল। ভেতর থেকে ঘুমজড়িত কণ্ঠে বড় মামা বলল:
—কিডা? এত রাত্তিরে কিডা?
-আমি বড় মামা। আমি রাতুল। দরজা খোলো।
বড় মামা দরজা খুললেন। চোখ রগড়াতে রগড়াতে বললেন:
—কী ব্যাপার? এত রাতে তুই বাইরে ক্যান? কই গেছিলি?
—ছোট মামার সাথে দিঘির পাড়ে গেছিলাম।
—কার সাথে?
বড় মামা ভ্রু কোঁচকালেন।
—বললাম না, ছোট মামার সাথে।
‘ও আচ্ছা, ভেতরে আয়’ বলে বড় মামা রাতুলকে ঘরে ঢুকিয়ে বারান্দার কামরায় নিয়ে গেলেন। খাটে গভীর ঘুমে ডুবে নাক ডাকতে থাকা একজনকে দেখিয়ে বললেন, ‘ওইডা কিডা?’
রাতুল বিস্ফারিত চোখে লোকটার মুখের দিকে এক সেকেন্ড তাকিয়ে, অস্ফুট ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘ছোট মামা!!!’