ভূতের গল্প

অলংকরণ : আরাফাত করিম

‘চারদিকে শনশন বাতাস বইছে। মনে হচ্ছে ঝড় হবে খুব। বিকেলে হাসান ভাই কবরস্থানে গিয়েছিল নানার কবরে বেড়া দিতে। তারপর থেকেই চাবি খুঁজে পাচ্ছিল না। তাই একটা টর্চলাইট হাতে বেরিয়ে পড়ল কবরস্থানের দিকে। গ্রামের কেউ সন্ধ্যার পর কবরস্থানের ধারেকাছেও যেত না। সবাই বলত, কবরস্থানে নাকি ভূত আছে। হাসান ভাই অবশ্য ভূতে বিশ্বাস করত না। তাই ছোট মামা নিষেধ করা সত্ত্বেও রাতের বেলা চাবি খুঁজতে বের হলো। হাসান ভাইয়ের পেছন পেছন মামাও বের হয়েছিলেন, কিন্তু কবরস্থান পর্যন্ত যাননি। একটু দূরে তালগাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলেন। দ্রুত দোয়া পড়ে যাচ্ছিলেন। চারপাশে হঠাৎ শিয়াল ডাকতে শুরু করল। বাতাসে গাছগুলো এত জোরে দোল খাচ্ছিল, দেখে মনে হচ্ছিল কেউ বুঝি সেগুলোকে ধরে নাড়াচ্ছে। তার মধ্যেই হাসান ভাই টর্চ দিয়ে এদিক–সেদিক চাবি খুঁজছিল। হঠাৎ মামা দেখলেন টর্চের আলো একেবারে স্থির হয়ে গেছে। একেবারে নড়ছে না। মামা দূর থেকে ডাকলেন। কোনো সাড়া এল না। তার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই টর্চের আলোটা নিভে গেল। অন্ধকারে মামা ধবধবে সাদা রঙের কী যেন একটা উড়ে যেতে দেখলেন। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি জ্ঞান হারান।’ এইটুকু বলে থামল রাতুল।

রবিন ভয়ে কুঁকড়ে গেছে। তবু কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘তারপর?’

‘এদিকে তাদের ফিরতে দেরি হচ্ছে বলে মামি লোক পাঠান। সবাই গিয়ে দেখে মামা পড়ে আছেন গাছের নিচে। তুলে বাড়ি নিয়ে আসা হয় তাকে। জ্ঞান ফিরলে মামার মুখে পুরো ঘটনা শুনে সবাই খুব ভয় পেয়ে যায়। তবু সবাই মিলে দল বেঁধে কবরস্থানে যায় হাসান ভাইকে খুঁজতে। কবরস্থান, তার আশপাশের সব জায়গায় খোঁজাখুঁজি শুরু হয়।’

‘তারপর কী হলো?’

রাতুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘তারপর আর কোনোদিন খুঁজে পাওয়া যায়নি তাঁকে। সবাই বলে রাতের বেলা কবরস্থানের ভূতদের ডিস্টার্ব করেছে, তাই তাঁকে গায়েব করে দিয়েছে ভূতেরা।’

‘দূর! কী বলিস! ভূত বলে কিছু আছে নাকি! তুই আমাকে খামোখাই ভয় দেখাচ্ছিস এসব বলে।’ ঢোঁক গিলে বলল রবিন।

‘যা ব্যাটা! ভয় দেখাব কেন! আর আমিও তোর মতো এমন ভূতে বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু হাসান ভাইকে কোথাও খুঁজে না পাওয়ায় আর বিশ্বাস না করে পারলাম না।’

রবিন রাতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল, সে মজা করছে না তো! রাতুলের মুখ দেখে অবশ্য তেমন কিছু বোঝা গেল না। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। জোরে বাতাস বইছে। মনে হচ্ছে রাতে ঝড় হবে। রবিন রাতুলকে বলল, ‘চল। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা উচিত আমাদের।’

রাতুল হি হি করে হেসে বলল, ‘কী, ভয় পেয়েছিস নাকি বেশি?’

‘না...ইয়ে। ভয় পাব কেন? মানে...মনে হচ্ছে ঝড় হবে। তাই বলছি তাড়াতাড়ি বাড়ি চল।’

‘হাহাহা। আচ্ছা চল।’ বলে দুজনে লেকের পাশ থেকে উঠে দাঁড়াল। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায়। রবিন দ্রুত পা চালিয়ে বাড়ি চলে গেল। রাতুলও একটু এদিক–সেদিক হেঁটে চলে গেল বাড়িতে।

রবিনকে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলে বেশ ভয় পাইয়ে দিয়েছে সে। আজ রাতে ভিতুটা বাথরুমে যেতেও ভয় পাবে। এসব ভেবে মনে মনে বেশ আনন্দ বোধ করল রাতুল। রাতুল এ রকম বানিয়ে বানিয়ে ভুতুড়ে গল্প বলে তার ছোট বোনকে আর বন্ধুদের ভয় দেখায়। বানিয়ে গল্প বলায় এত পটু সে, যে কেউ তার গল্প শুনলে ভয় পেয়ে যায়। রাতে খেতে বসে রাতুল মনে মনে গল্প ফাঁদল কাল আবার কীভাবে ভয় দেখানো যায় রবিনকে।

পরদিন রাতুল স্কুলে পৌঁছে দেখে রবিন আসেনি। মনটাই খারাপ হয়ে গেল তার। রবিনকে শোনানোর জন্য একটা দারুণ গল্প ফেঁদে এসেছিল সে। আর রবিন ছাড়া আর কাউকে এই গল্প শোনানো যাবে না। কারণ তাদের ক্লাসে রবিনই ছিল সবচেয়ে ভিতু। এ রকম ভুতুড়ে গল্পগুলো বিশ্বাস করে ফেলে। মুখে অস্বীকার করলেও রবিন ভূতে ভয় পায় ভীষণ।

‘রাতুল, আজ রবিন স্কুলে আসেনি কেন রে?’

রাতুল পেছনে তাকিয়ে দেখে তাদের ক্লাস ক্যাপ্টেন মিশু দাঁড়িয়ে। সে কিছু না ভেবেই জবাব দিল, ‘আরে ঘটনা শুনিসনি? রবিন নাকি কাল রাত থেকে কেমন যেন আচরণ করছে।’

মিশু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন আচরণ?’

রাতুল মিশুর কানের কাছে মুখ এগিয়ে নিয়ে বলল, ‘সারা রাত নাকি সে বিড়বিড় করে কার সঙ্গে যেন কথা বলছিল। আমার বাড়ি আর ওর বাড়ি পাশাপাশি হওয়ায় জানতে পারলাম ঘটনা। আশপাশের মানুষ বলাবলি করছিল জিনে ভর করেছে।’

মিশু কেমন যেন একটু চমকে উঠল। মনে হলো ভয় পেয়েছে। হুট করে এত সুন্দর গল্প ফাঁদায় নিজের পিঠটাই চাপড়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল রাতুলের। যাক, রবিনকে ভয় না দেখানো গেলেও রবিনের গল্প বলে মিশুকে ভয় পাইয়ে দেওয়া গেল। কাল যখন রবিনের কাছ থেকে সত্য জানতে পারবে, তখন সবাই মিলে বেশ ঠাট্টা করা যাবে মিশুকে নিয়ে। অল্পেই ভয় পেয়ে গেছে ভিতুটা।

স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে রাতুল দেখে, থমথমে মুখে বসে আছেন মা। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই মা বলল, ‘তোর ছোট মামার ফোন এসেছিল। গতকাল থেকে হাসানকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। রাতের বেলা কবরস্থানে চাবি খুঁজতে গিয়েছিল। সবাই বলছে, কবরস্থানের ভূতের কাজ এটা।’

কথা শুনে চোখ কপালে উঠে গেল রাতুলের। ধপ করে বসে পড়ল চেয়ারে। তারপর মা যে বর্ণনা দিল, তা হুবহু তার গতকাল বানানো গল্পের মতো। রাতুলের মাথা ঘুরছে। সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছে, পুরোটাই কাকতালীয়। তার বানানো গল্পের সঙ্গে এই ঘটনার কোনো যোগসূত্র নেই। একটু শান্ত হলেও পুরোপুরি স্থির হতে পারল না সে। রবিনের কথা মনে পড়তেই তার বাড়ির দিকে ছুটল সে। রবিনের বাড়ি গিয়ে পুরোপুরি হতভম্ব হয়ে গেল সে। বাসার নিচে বড় জটলা। কিছু মানুষ বলাবলি করছে রবিনের ওপর নাকি জিনে ভর করেছে। বাড়ির ভেতর ঢুকতে পারল না রাতুল। হড়হড় করে বমি করে দিল। মাথা ঘুরছে তার। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। কোনোরকমে দৌড়ে বাড়ি ফিরল সে। লিফটের বোতাম চেপে ভাবতে লাগল এসব কী হচ্ছে? কেন হচ্ছে? নাকি পুরোটাই কাকতালীয়! সে এসব নিয়ে বেশি ভেবে ফেলছে না তো! তার শান্ত হয়ে বসে ঠান্ডা মাথায় একটু চিন্তা করতে হবে। বাসায় গিয়ে ভাববে এসব নিয়ে। তখনই হুট করে একটা প্রকাণ্ড শব্দ হলো। নিজেকে বেশ হালকা অনুভব করছে সে। মনে হচ্ছে ক্রমেই নিচের দিকে নামছে সে। কয়েক দিন আগেই ছোট বোনকে লিফট ছিঁড়ে পড়ার গল্প শুনিয়েছিল। আজ কি সেই গল্পটা সত্যি হতে যাচ্ছে! নাকি সে খুব অসুস্থ, তাই এমন মনে হচ্ছে?