ভোগা কাইন

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

সে অনেক অনেক দিন আগের কথা। যেখানে এখন ভোগা হ্রদের কালো জল টলটল করছে, একদিন সেখানে ছিল একটি খুমি গ্রাম। সেই গ্রামের মানুষের অবস্থা ছিল খুবই ভালো। গোয়ালভরা গরু, ছাগল, মহিষ ছিল। বনে ছিল হরিণ, গয়াল ও খরগোশ। খুমিরা সেই হরিণ ও গয়াল ধরে পুষত। সেই গ্রামের সরদারের নাম ছিল ম্রোইলং। সবাই তাকে মান্যগণ্য করত। মিলেমিশে থাকত। সুখে-শান্তিতে ছিল সবাই।

সেই সুখের গ্রামে একদিন উৎপাত শুরু হলো। কোথা থেকে কে জানে, একটি অদৃশ্য প্রাণী এসে প্রতি রাতে তাদের গরু, বাছুর, মহিষ ধরে নিয়ে যায়, আর তার হদিস পায় না কেউ। গ্রামের সরদার পালা করে পাহারা বসাল। গ্রামের চারদিকে সতর্ক নজর রাখল সারা রাত। কিন্তু চোর আর ধরতে পারে না। শেষে স্রিলং সরদারের নির্দেশে গ্রামের বিশেষ বিশেষ জায়গায় জাল বসাল তারা। মস্ত বড় একটা কাবুক বা বড়শি বানাল। পুরোনো দা-কুড়াল দিয়ে তৈরি করল সেই বড়শি। সেই বড়শিতে একটা শূকর গেঁথে অপেক্ষা করতে লাগল তারা। ঠিক মাঝরাতে তারা দেখল, বিরাট একটা সাপ শূকরটাকে গিলে একটা কালো পাথরের নিচের গর্তে ঢুকে যাচ্ছে। গ্রামবাসী সবাই মিলে সেই সাপের লেজ ধরে টানতে লাগল। ততক্ষণে সাপ মাথা ঢুকিয়ে দিয়েছে গর্তে। শরীরের বেশ কিছু অংশও ঢুকে গেছে। গ্রামের মানুষ কিন্তু ছাড়ল না। অনেক কষ্টে লেজের কিছু অংশ তারা ধরে রাখতে পারল। কিন্তু গোটা সাপটাকে বের করে আনতে পারল না। শেষে লেজের বেশ কিছু অংশ কেটে রাখল তারা। সেটুকু কেটেকুটে ভাগ করে নিয়ে এল বাড়িতে। তারপর তারা মহা আনন্দে রেঁধে খেয়ে ফেলল। খেল না শুধু বুড়ো রিয়াংলাল ও তার বউ। সেই কালো পাথরটাকে বুড়ো রিয়াংলাল খুব শ্রদ্ধা করত। একদা সে যখন যুবক ছিল, তখন সেই পাথর নিয়ে তার জীবনে একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটে যায়।

রিয়াংলাল একদিন বন থেকে শিকার করে বাড়িতে ফিরছিল। হঠাৎ দেখল, তাদের সরদারের মেয়ে লিয়ানাকে এক বাঘ তাড়া করছে। লিয়ানা ছুটতে ছুটতে সেই পাথরে উঠতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু পাথরটা উঁচু ছিল বলে উঠতে পারছিল না। রিয়াংলাল ছুটে গিয়ে লিয়ানাকে টেনে তুলে নিল পাথরের ওপর। তারপর বর্শা নিয়ে রুখে দাঁড়াল বাঘের সামনে। প্রচণ্ড যুদ্ধে বাঘটাকে বর্শায় গেঁথে ফেলে সে। আস্তে আস্তে মরে গেল বাঘটা। যুবক রিয়াংলাল খুব খুশি হলো, সরদারের মেয়েকে বাঁচাতে পেরেছে বলে গর্বে বুক ফুলে উঠল তার। সে মনে মনে ভাবল, এ জন্য সরদার নিশ্চয়ই তাকে পুরস্কার দেবে।

কিন্তু যাকে বাঁচানোর জন্য এত যুদ্ধ করল সে, চরম ক্ষতি হয়ে গেল তার। লিয়ানা সেই পাথর থেকে আর নামতে পারে না। পা দুটি অবশ হয়ে গেছে তার। কী কাণ্ড! খুব দুঃখ পেল রিয়াংলাল। লিয়ানা করুণ চোখে রিয়াংলালের দিকে তাকিয়ে রইল।

সেই পাথরটার আশ্চর্য গুণ ছিল, ছিল আশ্চর্য এক অভিশাপও। কোনো যুবক সেই পাথরে উঠে কোনো যুবতীকে স্পর্শ করলে একজনের ক্ষতি হয়ে যেত। সেই দণ্ডই পেল লিয়ানা। সে লিয়ানাকে কাঁধে তুলে নিয়ে বাড়িতে পৌঁছে দিল। লিয়ানার বাড়িতে গিয়ে সে সরদারের কাছেই ওই প্রথম কালো পাথরটার অদ্ভুত দোষ-গুণের কথা জানতে পারল। তারপর থেকে রিয়াংলাল ভাবতে লাগল, কী করে লিয়ানাকে সে ভালো করে তুলবে, কীভাবে তার পঙ্গুত্বের অভিশাপ দূর করা যায়। কী করে যুবতী লিয়ানার মুখে হাসি ফোটানো যায়!

সেই থেকে কোনো কাজে রিয়াংলালের মন বসে না। কালো পাথরটার কাছে গিয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকে। তার পাশ দিয়ে আসতে–যেতে ভাবে। সারাক্ষণ তার মনে ওই এক চিন্তা, কীভাবে লিয়ানার উপকার করা যায়! একদিন স্বপ্নে মস্ত বড় এক সাপ তাকে বলল, ‘রিয়াংলাল, শোনো আমার কথা। পবিত্র জলে কালো পাথরটাকে ধুয়ে নাগকেশর ফুল দিয়ে পুজো করলে লিয়ানা ভালো হয়ে যাবে।’ পরদিন রিয়াংলাল সেই কালো পাথরটি পবিত্র জলে ভালো করে ধুয়ে দিল। পাহাড় থেকে তোলা নাগকেশর ফুল দিয়ে পুজো করল। কী আশ্চর্য! তারপর লিয়ানা আপনাআপনি ভালো হয়ে গেল। খুশি হলো লিয়ানা, খুশি হলো লিয়ানার বাবাও। তারা রিয়াংলালের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানাল। সেই থেকে সরদার খুব ভালোবাসতে শুরু করল রিয়াংলালকে। রিয়াংলালের মনের দুঃখও দূর হলো।

সেই ঘটনা থেকে রিয়াংলাল আশ্চর্য পাথরটাকে মনে মনে শ্রদ্ধা করে। কালো পাথরের নিচে ওই সাপটা থাকত বলে গ্রামবাসীকে সে মানা করেছিল সাপের মাংস খেতে। কিন্তু কেউ তার কথা শুনল না, কেউ গ্রাহ্য করল না। বরং তারা মহা আনন্দে সেই মাংস খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

সাপের লেজ কেটে নেওয়ার পর সেই রাতে আবার অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখল রিয়াংলাল। আবার সেই সাপটা দেখা দিয়ে বলল, ‘রিয়াংলাল, তুই একমাত্র আমার প্রতি শ্রদ্ধা দেখালি। তাই তোকে বলছি, তোর বউকে নিয়ে এই গ্রাম ছেড়ে চলে যা।’ তারপর তার স্বপ্ন ভেঙে গেল। ধড়ফড় করে উঠে বসল সে। চোখ কচলে পাশে শুয়ে থাকা বউকে দেখল। সে-ও ততক্ষণে জেগে উঠেছে। বউ বলল, ‘ওগো, আমি এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি।’ তারপর দুজনেই দুজনের স্বপ্নের কথা খুলে বলল। আশ্চর্য! দুজনেই ঠিক এক রকম স্বপ্ন দেখেছে। সেই রাতে ওরা আর ঘুমাতে পারল না। কথা বলতে বলতে ভোর হয়ে গেল।

বিছানা থেকে উঠে কাজকর্ম সেরে রিয়াংলাল ছুটল সরদারের কাছে। সরদারকে সব কথা খুলে বলল সে। ম্রোইলং তার কথা একটুও বিশ্বাস করল না। উল্টো স্বপ্ন নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করল। তখন গ্রামের বুড়ো–বুড়িদের কাছে গিয়ে সব কথা খুলে বলল রিয়াংলাল। তারাও কেউ তাকে বিশ্বাস করল না। বরং ওই সাপকে গর্ত থেকে কী করে বের করা যায়, সেই তোড়জোড় শুরু করল। রিয়াংলাল সেখান থেকে ফিরে এল বিষণ্ন মনে।

গ্রামবাসী যখন সাপটাকে মারার চেষ্টা করছে, তখন বুড়ো রিয়াংলাল ও তার বুড়ি গ্রাম ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে তারা গিয়ে বসল আরেক পাহাড়ের ওপর। খুব ক্লান্ত তারা। বুড়ো বয়সে একনাগাড়ে অত হাঁটার দরকার তাদের কোনো দিন পড়েনি। কিন্তু যে সর্বনাশা কাণ্ড গ্রামের মানুষ করতে বসেছে, তাতে তারা আহত হলো খুব। সাপটির জন্য তাদের মন বিষাদে ভরে গেল। এসব ভাবতে ভাবতে ওদিকে গ্রামজুড়ে শুরু হলো প্রলয়কাণ্ড। দেখতে দেখতে ভূমিকম্প এসে তাদের গ্রামটি গ্রাস করে নিল, পুরো গাঁয়ে আগুন জ্বলে উঠল। তারপর ভূমিকম্প যখন থামল, আগুন যখন নিভল, তখন দেখা গেল সেই গ্রামের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। তার বদলে সেখানে ছবির মতো ভেসে উঠল বিশাল এক সরোবর। কাকচক্ষু তার পানি। টলমল নীল জল। মনোরম তার শোভা। স্বপ্নের মতো ঘটে গেল সব ঘটনা। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর দৃশ্য দেখে বুড়ো রিয়াংলাল ও তার বউ শিউরে উঠল। সরোবরের অপরূপ দৃশ্য দেখে ভাবতে বসল। আর সে সময় তারা চোখ বুজে শুধু বলতে লাগল, হায় ঈশ্বর! তারা অনেকক্ষণ পর্যন্ত আর কোনো কথা বলতে পারল না।

তাদের গ্রামটিকে একটি হ্রদ ভোগ করে নিল বলে সেই হ্রদের নাম হলো ভোগা হ্রদ বা ভোগা কাইন।

(খুমি কিংবদন্তি। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাইংখ্যং-এর সংরক্ষিত বনের দক্ষিণে রেমাক্রির উত্তর-পূর্ব দিকে ভোগা কাইন এখনো আছে। মনোরম সেই হ্রদ। স্থানীয় লোকেরা এই হ্রদকে মান্য করে। এতে মাছ বা কচ্ছপ নির্ভয়ে চলাফেরা করে, কিন্তু কেউ ধরে খায় না। হ্রদে কেউ হাঁড়ি-পাতিল ধোয় না। স্থানীয় লোকেরা একে পবিত্র হ্রদ বলে মনে করে। তারা নানাভাবে এই হ্রদকে শ্রদ্ধা জানায়, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে চেষ্টা করে। খুমিরা এই কাহিনিটিকে সত্য বলে মনে করে। এই হ্রদই বগা লেক নামে পরিচিত।)