মহাকাশে মহাতঙ্ক

অলংকরণ: রিদম

‘আম্মিইইই!’ গোটা বাড়ি কাঁপিয়ে চেঁচিয়ে উঠল পিচ্চি আয়মান।

ছেলেদের বেডরুমের দরজায় এসে থামলেন দুই ছেলের মা মিসেস নাদিয়া ইকরামুল্লাহ।

‘কী...হচ্ছে কী, আয়ান!’ শাসন করলেন তিনি বড় ছেলেকে, ‘ছাড়! ছাড় বলছি ওকে!’

‘আমাকে বকা দিচ্ছ কেন? ও-ই তো শুরু করেছে প্রথমে! দেখো না, কী হাল করেছে এটার!’ খেলনা গাড়িটা মায়ের সামনে পেশ করল আয়ান ইকরামুল্লাহ। বাঁকা হয়ে আছে ওটার অ্যানটেনা।

‘ইচ্ছা করে কি আর করেছে নাকি?’ ছোট ছেলের পক্ষে সাফাই গাইলেন আম্মু।

‘আরে, কই তুমি?’ আমান ইকরামুল্লাহর হাঁক শোনা গেল নিচতলা থেকে, ‘দেরি হয়ে যাচ্ছে তো!’

‘আসছি!’ পাল্টা গলা তুললেন মহিলা স্বামীর উদ্দেশে। ঝুঁকে চুমু দিলেন তিনি পুত্রদ্বয়কে, ‘ফিরতে দেরি হবে না আশা করি। তা–ও তৈরি রইল ডিনার। খিদে পেলে খেয়ে নিস, কেমন?’

‘ওকেও নিয়ে যাও না সাথে করে!’ কাতর অনুরোধ ত্যক্তবিরক্ত আয়ানের।

ছেলের কথায় কর্ণপাত করলেন না মিসেস ইকরামুল্লাহ। হেসে চলে গেলেন তিনি অপেরা দেখার জন্য। বাংলাদেশের পাট চুকিয়ে মাস কয়েক হলো আমেরিকায় থিতু হয়েছে পরিবারটি।

বাবা-মা বেরিয়ে গেলে টিভির সামনে গিয়ে বসল আয়ান। বাড়ি যেহেতু খালি, সুতরাং কার্টুন দেখা যাবে ইচ্ছেমতো।

‘চলো না, ভাইয়া, বাইরে গিয়ে খেলি!’ আবদার জুড়ল আয়মান। যমজ ওরা। দুজনের বয়সের পার্থক্য মাত্র দেড় মিনিট।

‘যা, ভাগ!’ ধমকে উঠল আয়ান।

মাথা থেকে ক্যাপটা খুলে বড় ভাইয়ের দিকে ছুড়ে দিল আয়মান। কেয়ারই করল না ওর সহোদর। এবার একটা বেসবল ধেয়ে গেল আয়ানের দিকে। সোজা গিয়ে লাগল ওটা মাথায়।

এবার আর সহ্য করা সম্ভব হলো না আয়ানের পক্ষে। উঠে দাঁড়াল সে তড়াক করে। ‘তবে রে, বজ্জাত...শখ মেটাচ্ছি তোর খেলার!’

আর কি থাকে ওখানে আয়মান? বসার ঘর থেকে হলরুম, ওখান থেকে এক দৌড়ে দরজা খুলে বাইরে। পেছন পেছন তাড়া করল ওকে আয়ান।

বাড়ির সামনের রাস্তাটা পেরিয়ে পার্কে চলে এল দুই ভাই।

‘আরে, কী ওটা?’ কী যেন দেখে তর্জনী তাক করেছে আয়মান।

‘অ, ওটা?’ দেখে মুখ বাঁকাল আয়ান, ‘ফালতু একটা বোর্ডগেম। তোর মতন বাচ্চাদের জন্য।’

ওদের ঠিক সামনের গাছটার গুঁড়ির সঙ্গে লম্বা ধরনের, চ্যাপ্টা এক বাক্স ঠেস দিয়ে রাখা। কাছে গিয়ে ওঠাল ওটা আয়মান, ‘মিরান্ডা। মহাকাশের অ্যাডভেঞ্চার।’ পড়ল সে বাক্সের ওপরকার লেখাটা।

কাঠের বাক্সটা আলতালা (আলমারি, দেরাজ ইত্যাদি বন্ধ করে বাইরে থেকে তালা লাগানোর জন্য যে ধাতব কবজা থাকে) সিস্টেমের। তবে এ মুহূর্তে তালা নেই কোনো। বাক্সটা বগলদাবা করে বাড়ির পথ ধরল আয়মান। সময় কাটানোর খোরাক পেয়ে গেছে।

আয়ান আর কী করে, সেও হাঁটা ধরল বাড়ির দিকে।

বাসায় এসেই বৈঠকখানার কার্পেটের ওপর জিনিসটা নিয়ে পড়ল আয়মান। ডালাটা খুলে মেলে ধরতেই লুডু কিংবা মনোপলি বোর্ডের মতো নিখুঁত এক বর্গক্ষেত্রে পরিণত হলো আয়তাকার বাক্সটা। ফ্লাইং সসার, রকেট আর গ্রহ-উপগ্রহ খোদাই করা বোর্ডের জায়গায় জায়গায়। বুড়ো আঙুলের মাপে লাল আর নীল দুটি গোল বাটন দেখতে পেল ও নিচের দিকের দুই প্রান্তে। ঠিক মাঝখানে রয়েছে ব্রিফকেসের ডায়ালের মতো এক অঙ্কের বড় এক ডায়াল।

ডায়াল ঘোরাবে, নাকি বাটন দাবাবে? বুঝতে পারছে না আয়মান। আগে কখনো খেলেনি এই খেলা। বাটনই বোধ হয় চাপতে হবে আগে। প্রশ্ন হচ্ছে, কোন বাটনটা?

একটা হলেই হয়। ধারণা করছে আয়মান, অন্তত দুজন মিলে খেলতে হয় এটা। দুজনের জন্য দুটি বাটন।

বাঁ দিকের লাল বাটনটায় চাপ দিল ও। সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে শুরু করল ডায়াল। এত দ্রুত ঘুরছে যে ঝাপসা দেখাচ্ছে নম্বরগুলো।

ডায়ালটা স্থির হতেই ছোট এক সবুজ কার্ড সড়াৎ করে বেরিয়ে এল বোর্ডের বাঁ দিকের চোরা-স্লট থেকে।

চমকে গিয়েছিল আয়মান, পরম কৌতূহলে তুলে নিল কার্ডটা। ওটার এক পিঠে উল্কাপাতের ছবি, অন্য পিঠটায় লেখা: ‘দুর্যোগ এড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নাও।’

‘আচ্ছা, ভাইয়া, পদক্ষেপ মানে কী?’ জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল আয়মান, কিন্তু ‘পদক্ষেপ’ উচ্চারণটা পুরো না হতেই বিচ্ছিরি একটা র‌্যাট-ট্যাট-ট্যাট-ট্যাট’ আওয়াজ থামিয়ে দিল ওকে।

ফের টিভির সামনে গিয়ে বসেছিল আয়ান, ঘাড় তুলে তাকাল সিলিংয়ের দিকে। ওখান থেকেই আসছে আওয়াজটা।

‘আরে...আরে!’ যারপরনাই বিস্মিত ও শুনে, ‘শিলাবৃষ্টি শুরু হলো নাকি?’

‘শিলাবৃষ্টি না! শিলাবৃষ্টি না!’ সভয়ে চেঁচিয়ে উঠল আয়মান, ‘মনে হচ্ছে উল্কাবৃষ্টি!’

ভয়ানক ধুমধামে রূপ নিয়েছে এখন আওয়াজটা। হাজার হাজার গলফ বল পড়ছে যেন আকাশ থেকে। বাতি জ্বলা সত্ত্বেও কিসের যেন ঠান্ডা ছায়া ভর করেছে সারা বাড়িতে!

ফুটবলের সাইজের একটা উল্কাপিণ্ড দোতলা বাড়িটির ছাদ দুটি পরপর ভেদ করে এসে চুরমার করে দিল টিভিটা!

ভয়ের চোটে মাথা নিচু করে ফেলেছিল দুই ভাই, হাঁ করে তাকিয়ে আছে এখন ছাদের গর্তটার দিকে। চোখ দুটো রসগোল্লা।

বিরাট ওই ফুটো দিয়ে আব্বু-আম্মুর দোতলার বেডরুম আর আরও ওপরের তারাভরা আকাশটা দেখতে পাচ্ছে ওরা। কিন্তু এত কালো দেখাচ্ছে কেন আকাশটা? আর...স্লো মোশনে সরে যাচ্ছে না তারাগুলো?

বাইরে যাওয়ার দরজাটার দিকে এগোচ্ছে আয়ান পায়ে–পায়ে। কাছে গিয়ে হাট করে খুলে দিল দরজাটা।

হায়, খোদা! সামনের রাস্তাটা, অদূরের পার্কটা, আশপাশের বাড়িঘরগুলো—সব উধাও হয়ে গেছে বাইরে থেকে! নক্ষত্রভরা অনন্ত মহাশূন্যে ভাসছে ওদের বাড়িটা! এ কী ভানুমতীর খেল!

গুটিগুটি পায়ে দরজায় এসে দাঁড়াল আয়মানও। চোখ দুটোয় অপার বিস্ময়।

বিহ্বলের মতো দরজাটা লাগিয়ে দিল আয়ান। ছোট ভাই ওকে কার্ডটা দেখালে বুঝতে পারল, এসব ওই খেলারই কারসাজি।

বড় করে দম নিল আয়ান। ওর পালা এবার। আঙুল চাপল ডান দিকের নীল বাটনে। যথারীতি ঘুরতে লাগল ডায়াল, বেরিয়ে এল আরেকটি কার্ড। নিঃশব্দে কার্ডের লেখাটা পড়ে বোর্ডের ওপর ছুড়ে ফেলল ওটা আয়মানের বড় ভাই।

‘মনে হচ্ছে, চালিয়ে যেতে হবে খেলাটা।’ মন্তব্য করল দেখেশুনে, ‘নইলে হয়তো চিরকালের জন্য হারিয়ে যাব মহাকাশে!’

জোরে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে একমত হলো আয়মান, জীবনে এই প্রথমবার।

বড় করে দম নিল আয়ান। ওর পালা এবার। আঙুল চাপল ডান দিকের নীল বাটনে। যথারীতি ঘুরতে লাগল ডায়াল, বেরিয়ে এল আরেকটি কার্ড। নিঃশব্দে কার্ডের লেখাটা পড়ে বোর্ডের ওপর ছুড়ে ফেলল ওটা আয়মানের বড় ভাই।

‘উঠে যাও মাধ্যাকর্ষণের টান ছাড়িয়ে।’ সামনে ঝুঁকে লেখাটা পড়ল আয়মান, ‘মানে কী এর?’ তাকাল ভাইয়ের দিকে।

কিন্তু কোথায় ওর ভাই?

‘ভাইয়া!’ ডাকল আয়মান এদিক-ওদিক তাকিয়ে।

‘আমি এখানে!’ ভেসে এল ওপর থেকে।

দুচোখ ছানাবড়া হয়ে গেল আয়মানের ওপরে তাকিয়ে। সিলিংয়ে পিঠ দিয়ে লেপটে রয়েছে ওর ভাইটা, রীতিমতো হতভম্ব! মাধ্যাকর্ষণ সূত্র কাজ করছে না ওর ওপর। নিদারুণ অস্বস্তির সঙ্গে লক্ষ করল আয়মান, মহাজাগতিক টানে একটু একটু করে সিলিংয়ের গর্তটার দিকে এগিয়ে চলেছে বড় ভাই। একবার যদি বেরিয়ে যায় ওখান দিয়ে, চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাবে মহাশূন্যের অজানায়! ভাবতেই পাক দিয়ে উঠল আয়মানের পেটের মধ্যে।

আয়ানও হৃদয়াঙ্গম করতে পারছে বিপদটা। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে সরে যেতে চাইল ও গর্তটার কাছ থেকে। খুব একটা কাজ হলো না তাতে।

আশপাশে তাকাচ্ছে আয়মান উপায়ের খোঁজে। দৃষ্টি আটকে গেল আক্ষরিক অর্থেই ভর্তা হয়ে যাওয়া টেলিভিশনের পাওয়ার কর্ডটায়।

যথেষ্ট লম্বা ওটা। আঘাতটার কারণে আলগা হয়ে এসেছে গোড়াটা। একটানে টিভি থেকে ছুটিয়ে আনল ওটা আয়মান। তারপর গায়ের জোরে প্লাগের দিকটা ছুড়ে দিল আয়ানের দিকে। একবারেই তারটার নাগাল পেয়ে গেল আয়মানের ভাই।

কর্ড টেনে নামিয়ে আনা হলো আয়ানকে। অভিকর্ষজ বল ফিরে পায়নি ও, এখনো মহাশূন্যচারীদের মতো দুলছে-ভাসছে শরীরটা। কর্ড ছাড়লেই উড়ে যাবে আবার। হয়তো এর সমাধান রয়েছে রহস্যময় গেমটাতে।

ঝটপট সোফার পায়ার সঙ্গে পেঁচিয়ে বেঁধে ফেলল আয়মান কর্ডের আরেক প্রান্ত। লাল বাটনে চাপ পড়তেই ঘুরতে শুরু করল ডায়াল, আর ঘোরা শেষ হতেই—সড়াৎ। যে কার্ডটি বেরিয়ে এসেছে, লেখা রয়েছে ওতে—চেঁচিয়ে পড়ল আয়মান: ‘রোবট হইতে সাবধান!’

‘কিন্তু এখানে রোবট কোথায়!’ বিস্মিত মন্তব্য আয়ানের। দাঁড়িয়ে রয়েছে পায়ের ওপর। হাত থেকে ছেড়ে দিল কর্ডটা। অ্যান্টি-গ্র্যাভিটির প্রভাব কেটে গেছে ওর ওপর থেকে। দেখে স্বস্তি ফিরতে ফিরতেও ফিরল না আয়মানের মনে। ভীতিকর একটা ‘ঘটাং! ঘটাং!’ ভেসে আসছে হলওয়ে থেকে।

ওদের আতঙ্কিত দৃষ্টির সামনে চকচকে রুপালি একটি রোবট উদয় হলো হলের মুখটাতে! ঘাড়ের ওপর একবার পেছনে, একবার সামনে ঘুরছে মাথাটা। অশুভ ভঙ্গিতে খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে ধাতব থাবা। চোখের মতো দেখতে গোলক দুটি স্থির হলো আয়মানের ওপর। উজ্জ্বল নীল আলো ঝলসে উঠল চোখজোড়ায়।

‘ঝিঁইইইইইইই...!’ বিজাতীয় একটা যান্ত্রিক আওয়াজ অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিল ওদের। ভাবগতিক ভালো ঠেকছে না রোবটটার। ওটা কিছু করে বসার আগেই তত্পর হওয়ার তাগিদ অনুভব করল আয়ান। ওরই এবার চাল দেওয়ার পালা। ঝাঁপিয়ে পড়ল সে বোর্ডটার ওপর।

কার্ড বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে এক হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল রোবটটা। ওভাবেই পড়ে রইল তিন সেকেন্ড। তারপর খটাং করে মুখ থুবড়ে পড়ল কাঠের মেঝেতে।

কার্ডে কী উঠেছে, দেখার সুযোগ হলো এবার। ‘টম্যাঙ্গো-থার্টিনের ব্যাপারে হুঁশিয়ার!’

টম্যাঙ্গো-থার্টিন! পরস্পরের মুখ চাইল দুই ভাই। এটা আবার কী?

সঙ্গে সঙ্গেই পেয়ে গেল জবাবটা। কোত্থেকে যেন জানালার বাইরে এসে হাজির হয়েছে একটা স্পেসশিপ। সরলরেখার আকারে দুই রাউন্ড মারাত্মক ফোটন রশ্মি বেরিয়ে এল যানটা থেকে। আলোর প্রথম ঝলকানিটা আঘাত করল চিমনিতে। ভাঙা ইটের বৃষ্টি নামছে ফায়ারপ্লেসে, এরই মধ্যে এল দ্বিতীয় আঘাত—এবার ওপরতলার বাথরুমে।

আতঙ্ক! আতঙ্ক! শকওয়েভের মতো ভয়ানক বিপদের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে যেন বাতাসে। উটপাখির মতো মেঝেতে মাথা ঠেসে রেখেছে ইকরামুল্লাহ ভাইয়েরা, দুই হাত দিয়ে আড়াল করছে যার যার মাথা। পারলে যেন সেঁধিয়ে যায় ওয়ালনাট কাঠ ভেদ করে। ওই অবস্থাতেই এক হাত তুলে সজোরে নীল বাটন দাবাল আয়মান।

ডায়াল ঘুরল, কার্ডও বেরোল, কিন্তু কই, যাওয়ার নামই তো নেই শিপটার! ভয়ে ভয়ে মাথা তুলে কার্ডটা পড়ল আয়মান বিড়বিড় করে: ‘দস্যু ভায়োলিক্স আসছে তেড়ে!’

পড়ে সারতে পারল না, পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল ওপরতলায়। ঘাড় উঁচু করে দেখতে পেল ওরা, কেউ অথবা কিছু একটা উঁকি দিচ্ছে গর্তটা দিয়ে!

হাত ধরাধরি করে হলওয়ের দিকে পিছিয়ে যেতে লাগল আয়ান-আয়মান। অনড় রোবটটার কাছাকাছি হতেই ফ্রিজ হয়ে গেল ওরা। ভাইব্রেশনের অনুভূতি পায়ের তলায়। আসছে কোত্থেকে কম্পনটা?

ঘাড় ঘোরাতেই পেয়ে গেল উত্তরটা। দপ করে জ্বলে উঠল ‘মৃত’ রোবটটার চোখজোড়া। ধীরেসুস্থে মাথা তুলল ওটা। সটান পায়ের ওপর খাড়া হলো ভারী কলকবজার শরীরটা।

ঝুপ করে লাফিয়ে নামল ভায়োলিক্স। মাছের আঁশের মতো আঁশযুক্ত লেজ আর গিরগিটির মতো পাওয়ালা কিম্ভূত এক প্রাণী। হলদে, বিদ্বেষপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আট ফুটি যন্ত্রমানবের দিকে।

নিরাপদ দূরত্বে সরে দাঁড়াল ছেলেরা। রোবট আর দস্যু তেড়ে গেল পরস্পরের দিকে।

কাছে আসতেই মুঠো করা একটা থাবা তুলল রোবট। অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে কিল বসিয়ে দিল আকাশদস্যুর মাথায়। আত্মা কাঁপানো প্রলম্বিত চিত্কার ছাড়ল ভায়োলিক্স। পিছু হটতে চাইছে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত পাল্টে। কপাল মন্দ। বজ্র আঁটুনিতে জাপটে ধরল ওকে রুপালি রোবট।

এই বেকায়দা অবস্থাতেই লাফ দিয়ে ফুটো গলে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল মহাকাশদস্যু। সেটাও না পেরে সিলিংয়ের গায়ে আছড়ে ফেলল নিজেকে। এমনভাবে করেছে কাজটা, পুরো আঘাতই গেল রোবটটার ওপর দিয়ে। জোরদার এই সংঘর্ষে বিদ্‌ঘুটে গোঙানি ছাড়ল যন্ত্রমানব।

আরও কয়েকবার করল ও রকম আধা-মানুষ-আধা-গিরগিটিটি। শিথিল হয়ে পড়ল রোবটের নাগপাশ। এই সুযোগে পালিয়ে বাঁচল ভায়োলিক্স। মুহূর্ত পরেই সাঁই করে অদৃশ্য হলো টম্যাঙ্গো-থার্টিন।

চিত হয়ে পড়ে ছটফট করছে বিশালদেহী রোবট। আবারও জ্যোতি হারাচ্ছে চোখজোড়া।

একে অপরের দিকে তাকাল আয়ান-আয়মান। দুজনই ওরা মাথা নাড়ল নীরবে। শেষ করতে হবে খেলাটা।

‘কৃষ্ণগহ্বরে প্রবেশ করছ তুমি!’ কার্ড বেরিয়ে এলে পরে পড়ে শোনাল আয়ান।

‘কৃষ্ণগহ্বর কী?’ আয়মানের জিজ্ঞাসা।

‘ব্ল্যাক হোল।’

‘সেটাই–বা কী জিনিস?’

জবাব না দিয়ে ইতিউতি খুঁজতে লাগল আয়ানের চোখ দুটি—কোথায় মুখ ব্যাদান করে আছে ব্ল্যাক হোলটা। জায়গা থেকে নড়তেই আবিষ্কার করল ওটা।

গোল হয়ে ছড়িয়ে পড়া একতাল কালো ‘কালি’র ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে আয়ান। সরে আসতে চাইলেও সফল হলো না এবার। আঠা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে যেন পায়ের তলায়। নিরেট মেঝেতে দেবে যাচ্ছে পা দুটি, এ রকম একটা অনুভূতিও হচ্ছে।

‘ভাইয়া!’ চিত্কার ছাড়ল আয়মান। সত্যি সত্যিই কালো জিনিসটা চোরাবালির মতো টেনে নিচ্ছে আয়ানকে! কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক টানে নামিয়ে আনল বুক পর্যন্ত!

খপ করে ভাইয়ের একটা হাত ধরে ফেলেছিল আয়মান, পারল না ধরে রাখতে। সুড়ুৎ করে গিলে নিল ওদের ক্ষুধার্ত গহ্বর! আলকাতরার মতো, নিঃসীম শূন্যতায় ডিগবাজি খেয়ে চলেছে ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র দেহ দুটি।

ধপ!

শক্ত-আবার-নরম কিসে যেন আছড়ে পড়েছে আয়ান। ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভূতি শরীরের নিচে। শক্ত করে বুজে রেখেছিল, চোখ মেলতেই বাড়ির কাছের পার্কে আবিষ্কার করল নিজেকে!

‘আরে, কী ওটা?’ পরিচিত একটা কণ্ঠ কানে এল।

সিধে হলো আয়ান। সামনের একটা গাছের দিকে আঙুল তাক করেছে আয়মান। লম্বা ধরনের, চ্যাপ্টা এক বাক্স ঠেস দিয়ে রাখা গুঁড়ির সঙ্গে।

বিচিত্র অনুভূতি হচ্ছে আয়ানের। কেন যেন মনে হচ্ছে ওর, আগেও ঘটেছে এই ঘটনা! কেন মনে হচ্ছে এ রকম, কে জানে!

বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে