মানুষকে সাহসী করে তোলা এক মায়ের গল্প

শহীদজননী জাহানারা ইমাম

একজন সাহিত্যিক কিংবা অনুবাদক হিসেবেই যথেষ্ট নাম করতে পারতেন জাহানারা ইমাম। শিক্ষক হিসেবেও যথেষ্ট নামডাক ছিল তাঁর। আড়ালে অনেকে তাঁকে ‘সুচিত্রা সেন’ বলত সৌন্দর্যের কারণে। ছোটবেলা থেকেই সেরা সেরা বই হাতে পেয়েছেন তিনি। সেরা সেরা গান শোনার সৌভাগ্য হয়েছে। এগুলোর প্রভাবেই গড়ে উঠেছিল তাঁর চিত্তভূমি। ১৯২৯ সালের ৩ মে তাঁর জন্ম, অবিভক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুর গ্রামে। কলকাতার লেডি ব্রাবোর্ন কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়েছেন। বিএড করেছেন। ছিলেন সিদ্ধেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাইভেটে এম এ পাস করেছেন বাংলায়। বেশ স্বচ্ছন্দেই কাটছিল তাঁর জীবন।

সেই জীবনকে ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিল একাত্তর। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তো বিশাল এক বিজয়ের কাহিনি। সেই বিজয় অর্জন করতে গিয়ে দিতে হয়েছে অনেক রক্ত। শহীদজননী জাহানারা ইমাম মুক্তিযুদ্ধে হারিয়েছেন তাঁর বড় ছেলে শাফি ইমাম রুমীকে। স্বামী শরীফ ইমামও মারা যান বিজয়ের মাত্র কয়েক দিন আগে। দিনলিপির আকারে একাত্তরের দিনগুলিতে নানা খুঁটিনাটি লিখে রাখেন জাহানারা ইমাম। প্রথমে তা প্রকাশিত হয় সচিত্র সন্ধানী নামে একটি ম্যাগাজিনে। এরপর ১৯৮৬ সালে তা বই আকারে প্রকাশিত হয়। এই বইটি শুধু এক সন্তানহারা মায়ের হৃদয়-আবেগের সমাহার নয়, এতে ফুটে উঠেছে একাত্তর সালের ঢাকা, যুদ্ধ, সাধারণ মানুষের জীবন।

সেই একাত্তর সালের সব অর্জনকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। যারা একাত্তরে মানুষ মেরেছে, অত্যাচার করেছে, লুট করেছে, জ্বালিয়ে দিয়েছে বাড়ি, তাদের কোনো শাস্তি হয়নি। বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা পেয়েছিল চুনোপুঁটি অপরাধীরা। কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল তাদের বিচার চলছিল। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর দালাল আইন বাতিল করায় এসব অপরাধীও বেরিয়ে এল। বিচার আর হলো না এদের। নাটের গুরুগুলো আবার শুরু করল ষড়যন্ত্র।

শহীদজননী জাহানারা ইমাম ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি ১০১০ সদস্যবিশিষ্ট ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গড়ে তোলেন। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’র আহ্বায়ক হন ১১ ফেব্রুয়ারিতে।

সে বছরেরই ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমবেত হাজার হাজার মানুষের সামনে জাহানারা ইমাম পড়ে শোনালেন গণ-আদালতের রায়। ১২ জন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত গণ-আদালতের চেয়ারম্যান জাহানারা ইমাম ঘোষণা করলেন—অন্তত ১০টি অপরাধে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডযোগ্য।

যত সহজে বলে দেওয়া গেল কথাটা, সেদিন তত সহজ ছিল না পরিবেশ। পুলিশ আর বিডিআর ঘিরে রেখেছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, পণ্ড করতে চেয়েছিল গণ-আদালতের কার্যক্রম। কিন্তু সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো প্রবল বেগে মানুষ ছুটে চলেছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। একাত্তর মানুষের মনজুড়ে আছে, সে কথাই প্রমাণিত হয়েছিল সেদিন।

শহীদজননী জাহানারা ইমাম মানুষকে সাহসী করে তুলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে সার্থক করে তুলেছিলেন, মানবতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শিখিয়েছিলেন। বলা যায়, তাঁর হাত ধরেই মুক্তিযুদ্ধের অর্জন খুঁজে পেয়েছিল সঠিক চলার পথ।

মুখের ক্যানসারে আক্রান্ত শহীদজননী জাহানারা ইমাম ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে মারা যান। ৪ জুলাই তাঁর মরদেহ আসে বাংলাদেশে, ৫ জুলাই শহীদ মিনারে তাঁর মরদেহ রাখা হয়। শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফনের আগে মুক্তিযুদ্ধের আটজন সেক্টর কমান্ডার শহীদজননীকে গার্ড অব অনার দেন।

(কিশোর আলোর ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সংখ্যায় প্রকাশিত)