মিশন মিসর

অলংকরণ: রাজীব

এমন দিন আর আসেনি বিল্লুর জীবনে। দিন না বলে বলা উচিত দুর্দিন। কার যে মুখ দেখেছিল ঘুম থেকে ওঠার পর! মনে পড়েছে। টাইগার শ্রফ। পোস্টার হয়ে লটকে আছে দেয়ালে।

মাঝদুপুর এখন। এপ্রিলের ঝাঁ-ঝাঁ রোদ বাইরে। ঝকঝক করছে কামরার ভেতরটা। কিন্তু যার কামরা, শ্রাবণ মাসের মেঘাচ্ছন্ন আকাশ হয়েছে যেন তার চেহারাটা। বৃষ্টি হব হব করছে। কিন্তু না, কাঁদবে না বিল্লু। রীতিমতো ঘৃণা করে সে কান্নাকাটিকে। তা ছাড়া ওর ধারণা, আম্মুর ঝাড়ি খেয়ে কাঁদার জন্য বয়সটা একটু বেশিই ওর।

রাগ অবশ্য হওয়ারই কথা মিসেস রহমানের। তাঁর অত শখের চিনামাটির ভাসটা! সরাসরি চীন থেকে আমদানি করা। একমাত্র বোনের জন্য ভাইজান, অর্থাৎ বিল্লুর বড় মামার উপহার। চাইলেই তো আরেকটা কিনে আনা যাবে না দোকান থেকে।

ভালোমতো প্যাক করা ফুলদানির বাক্সটার গায়ে স্টিকার সাঁটা ছিল লাল রঙের। তাতে বড় বড় করে লেখা: ফাজিল। প্রথমে তা-ই ভেবেছিল বিল্লু। ভালো করে খেয়াল করতেই দেখল, F-এর পর একটা r রয়েছে ইংরেজি শব্দটায়। ফাজিল নয়, ফ্র্যাজাইল। মানে ভঙ্গুর (ডিকশনারি দেখে জেনেছে)। অপেক্ষাকৃত ছোট হরফে আরও তিনটা শব্দ ছিল Fragile-এর নিচে, যার বাংলা করলে দাঁড়ায়: সাবধানে নাড়াচাড়া করতে হবে। আর সেই জিনিসটারই কিনা দফারফা করে দিয়েছে বিল্লু!

সাতসকালে পত্রিকাওয়ালার কলবেল শুনলেই দোতলা থেকে এক দৌড়ে নেমে আসে গ্যারাজে। আজও সেটার ব্যতিক্রম হয়নি। ততক্ষণে মেইন গেটের নিচ দিয়ে প্রথম আলো বিলি করে উধাও হয়েছে হকার ভাইয়া। গরমাগরম পত্রিকা পেয়ে সবার আগে ‘বেসিক আলী’তে চোখ বোলানো চাই বিল্লুর। এ পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল রোজকার মতো। আধঘণ্টা বাদে শুরু হলো শনির দশা।

নাশতা-টাশতা শেষ করে বিল্লু তখন সবে বসেছে হোমওয়ার্ক নিয়ে, শনিবার স্কুল নেই ওর, এমন সময় ডাইনিং রুম থেকে ভেসে এল রেবেকা রহমানের কণ্ঠ।

‘বিল্লু! পেপারের বিল দেয়নি?’

‘আনছি, আম্মু!’

ওই মুহূর্তে বিল্লুর মনে হলো, সুপারহিরো ফ্ল্যাশের অতিমানবীয় ক্ষমতা ভর করেছে ওর মধ্যে। শোঁ করে আওয়াজ তুলে চোখের নিমেষে (কথার কথা আরকি!) হাজির হলো নিজের ঘর থেকে ড্রয়িংরুমে। এক টান দিয়ে বিলের কাগজটা তুলে নিয়েই অ্যাবাউট টার্ন করল খাবারঘরের—

ঠাস (আমি যেমন আগের বাক্যটা শেষ করতে পারিনি, পেছনের পীড়াদায়ক আওয়াজটা শুনে ওকেও তেমনি থেমে যেতে হলো ব্রেক কষে)!

লাফ দিয়ে কলজেটা গলার কাছে চলে এল যেন বিল্লুর। ঘুরে তাকাতেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এল নিমেষে। যা ভয় করছিল! চায়নাপ্রবাসী শরাফত সাহেবের প্রেজেন্ট এখন পাস্ট টেন্স। এক শ টুকরো হয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে মেঝেতে।

ফুল ছাড়া ফুলদানি সাইড-টেবিলে সাজিয়ে রাখার অর্থ কী, ভেবেই পায় না বিল্লু। আম্মুর যত খেয়াল! ওটা ওখানে না থাকলে তো ওর নিচে কাগজটা চাপা দেওয়ার প্রশ্নই উঠত না। দূর্ঘটনাটাও ঘটত না টান দিয়ে বিলটা বের করে নেওয়ার কারণে।

স্ট্যাচু হয়ে গেছে বিল্লু। চিনামাটির টুকরোগুলো যেন সম্মোহন করেছে ওকে। মুখ হাঁ। দুর্ঘটনাটাকে ‘দূরের ঘটনা’ বলে পিঠ বাঁচানোর উপায় আছে কোনো!

দুদ্দাড় পায়ের আওয়াজ টের পেল মেঝেতে। ধেয়ে আসছেন হারিকেন রেবেকা! পথ নেই পালানোর।

কঠিন এই পরিস্থিতিতেও কৈফিয়ত খোঁজার বদলে বিল্লুর মগজে তোলপাড় তুলল অমোঘ সত্যটা: চায়নিজ মাল টেকে না বেশি দিন। টেকে না...টেকে না...টেকে না!

বুক ভেঙে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস। আহ্...কম্পিউটারের মতো ব্যাকস্পেস বাটন চেপে মুছে ফেলা যেত যদি জীবনের কালো এই অধ্যায়টা!

‘এই মুহূর্তে কী ইচ্ছে করছে, জানিস?’ করুণ শোনাল বিল্লুর গলাটা।

জবাবে ঘড়ঘড় করল কেবল হুলো।

নিজের খাটে বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছে বিল্লু। কোলে ওর পোষা বিড়ালটা। ছেলেটার খুব ন্যাওটা ওটা। কে জানে, বিল্লু নামটা বিড়ালঘেঁষা বলেই হয়তো।

‘ইচ্ছে করছে।’ চোখ বুজল বিল্লু, ‘দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে পারতাম যদি! দূরে...অনেক দূরে!’

ঘড়ঘড়ানি বন্ধ হলো বিড়ালটার। ‘যাওয়া যায়।’

মাকড়সা দেখলে যে কাণ্ডটা করে, সেটাই করল বিল্লু এবারও। বসা অবস্থাতেই লাফ দিল তিড়িং করে। চোখ দুটি রসগোল্লা।

কে বলল কথাটা! স্বয়ংক্রিয়ভাবে এদিক-ওদিক ঘুরে গেল ঘাড়টা। নাহ্, নেই তো কেউ! অবিশ্বাসভরা দৃষ্টিতে তাকাল হুলোর দিকে। এতক্ষণ আদর করছিল ওটাকে। মনে তো হলো ও-ই। কিন্তু...এ যে অসম্ভব!

খুদে মনিব চমকে ওঠায় কোল থেকে ছিটকে গেছে হুলো। কিছুই হয়নি, এমন ভাব করে আড়মোড়া ভাঙল পিঠ উঁচু করে। তারপর বার দুই চেটে নিল কালো থাবা। কালো বিড়াল নিয়ে যদি অ্যালার্জি থাকত এ বাড়ির লোকদের, ওর হয়তো জায়গা হতো না এখানে।

‘ধন্যবাদ, বিল্লু!’ ঢুলুঢুলু চোখে, ঘুম জড়ানো গলায় বলল বিড়ালটা।

‘তু...তু...তুমি...তুমি...।’ তোতলাতে লাগল বিল্লু। নিজের অজান্তেই বদলে গেছে সম্বোধন। কথা বলা বিড়ালকে তো আর তুই-তোকারি করা যায় না।

‘হ্যাঁ, আমি।’ আধবোজা চোখে রহস্যময় মনে হচ্ছে হুলোকে।

‘ক...ক...কথা...কথা...’

‘হ্যাঁ, কথা।’

‘ব...ব...বলতে...বলতে...’

‘হ্যাঁ, বলতে পারি।’

‘কিন্তু কীভাবে?’ প্রশ্ন এল তীক্ষ্ণকণ্ঠে।

‘কীভাবে আবার! মুখ দিয়ে!’

‘কিন্তু...কিন্তু...।’ কথা হাতড়াচ্ছে মগজটা, সঠিক শব্দগুচ্ছ খুঁজে না পেয়ে বলল, ‘তা, ধন্যবাদটা কিসের জন্য?’

হাসি হাসি হয়ে গেল হুলোর রাশভারী মুখটা। ‘তুমি যে আমাকে ফাঁসিয়ে দাওনি, তার জন্য।’

‘মানে?’

‘ইচ্ছে করলেই আমার ঘাড়ে দোষ চাপাতে পারতে তুমি...’

‘কী বলছ, কিছুই তো বুঝতে পারছি না! কার দোষ? কোন দোষ?’

‘কেন, ফুলদানি ভাঙার!’

এবার বুঝল বিল্লু। সুপারহিরোর ভূমিকায় ও যখন হাস্যকর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, ‘সত্যিকারের’ ফ্ল্যাশ হিসেবে দেখা গেছে তখন হুলোকে। বিল্লুর আগেই বুলেটের গতিতে (এটাও কথার কথা) পৌঁছে গেছে বসার ঘরে। ইশ্! আফসোস হচ্ছে এখন। সহজেই উদোর পিণ্ডি চাপানো যেত বুধোর ঘাড়ে। তখন কেন খেয়াল হয়নি এটা?

ফ্ল্যাশের প্রসঙ্গে আরেকটা কথা মনে হলো বিল্লুর। ‘তুমি...তুমি কি সুপারক্যাট, হুলো?’ জিজ্ঞেস না করে পারল না।

‘সুপার—কী? আরে, ধুর!’

‘তাহলে কথা বলছ কেমন করে? কথা বলা বিড়াল তো দেখা যায় শুধু কার্টুনে!’

‘বলেছে তোমাকে!’

‘বলতে চাইছ, সব বিড়ালই বলতে পারে কথা?’

‘কেন নয়?’ পাল্টা প্রশ্ন হুলোর।

‘কই...আমি তো কখনো কথা বলতে দেখিনি কোনো বিড়ালকে!’

‘এই তো দেখছ।’

‘তুমি না...অন্য বিড়ালের কথা বলছি।’

‘কথা না বললে দেখবে কীভাবে?’

‘মানে কী?’

‘সামনাসামনি বলেনি, তাই দেখোনি হয়তো। তৃতীয় কারও উপস্থিতিতে মানুষের ভাষায় কথা বলি না আমরা। আর দরকার ছাড়া বলবই বা কেন?’

‘এখন যে বলছ!’

‘ওটা অন্য কারণে। দেখলাম, যারপরনাই মুষড়ে পড়েছ তুমি। পালাতে চাইছ এখান থেকে দূরে। ভাবলাম, এই উপকারটা করি তোমার—সাধ্যে যখন রয়েছে। কম তো খাইনি তোমাদের।’

‘বুঝলাম না তোমার কথা। সাধ্যে রয়েছে মানে?’

‘একটু আগে জিজ্ঞেস করলে না, সুপারক্যাট কি না আমি? তা, তোমাদের দিক থেকে দেখলে সুপারক্যাটই আমরা।’

‘কী রকম?’

‘যেখানে ইচ্ছা সেখানেই যেতে পারি আমরা।’

‘এ আর এমন কী!’ ঠোঁট উল্টে বলল বিল্লু।

‘যেকোনো জায়গায়।’ রহস্যের ছোঁয়া হুলোর কণ্ঠে।

‘এ আর এমন—’ বলতে গিয়ে থেমে যেতে হলো বিল্লুকে। মাথায় ঢুকছে যেন বিড়ালের বক্তব্যের তাত্পর্য।

‘যেকোনো সময়ে।’ বোম ফাটাল হুলো।

‘মানে টাইম-ট্রাভেল?’ চোখ দুটি বড় বড় হয়ে উঠেছে বিল্লুর।

‘ইয়েস, স্যার। অতীত, ভবিষ্যৎ—সবখানে।’

‘ওয়াও!’ আর কিছু পেল না বিল্লু বলার মতো। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ কেটে যাওয়ার পর বলল, ‘সব বিড়ালই কি পারে এটা?’

‘সব্বাই।’

‘যাহ্!’

‘যাহ্ না, সত্যি।’

আবারও কথা হারাল বিল্লু। মুহূর্ত কয়েক পর জিজ্ঞেস করল, ‘অনেক ঘুরেছ তুমি, তাই না?’

‘উঁহু, একবারও না।’

‘কেন?’ অবাক বিল্লু।

‘ক্ষমতাটার আসলে সীমা আছে একটা।’ ব্যাখ্যা করল হুলো, ‘নয়বারের বেশি ব্যবহার করার উপায় নেই। চেরাগের দৈত্য যেমন তিনটা ইচ্ছে পূরণ করে, সে রকম আরকি। অনর্থক ঘোরাঘুরি করে নষ্ট করতে চাইনি তাই ক্ষমতাটা। এখন মনে হচ্ছে, তোমার খাতিরে হলেও কোথাও থেকে ঘুরে আসা যায়। বেটার লেট দ্যান নেভার।’ ইংরেজি ঝাড়ল হুলো নামের হুলো বিড়াল।

‘কিন্তু...’ মাত্রই একটা কথা মনে উঁকি দিয়েছে বিল্লুর, ‘বুঝলাম, যেখানে খুশি যেতে পারো তুমি। আমাকেও কি নিয়ে যেতে পারবে?’

‘দেখোই না। খালি বলো, রাজি কি না।’

‘রাজি মানে? এক শ বার!’ ফুটছে বিল্লু উত্তেজনায়, ‘কোথায় যাওয়া যায়, বলো তো!’

‘একটা জায়গা ভেবে রেখেছি অবশ্য। চলো, গেলেই দেখবে।’

চোখে প্রশ্ন নিয়ে ইতিউতি তাকাচ্ছে বিল্লু।

‘খুঁজছ কিছু?’ হুলোর জিজ্ঞাসা।

‘হুম।’

‘কী সেটা?’

‘ম্যাজিক কার্পেট। জাদুর গালিচা। ওতে করেই তো নিয়ে যাবে, তাই না?’

‘দূর!’

‘তবে?’

‘চোখের পলকে!’ রহস্য করল হুলো।

‘আর ইউ সিরিয়াস?’

‘একদম আক্ষরিক অর্থে।’ হাসি খেলা করছে হুলোর চোখে।

কেন যেন শিউরে উঠল বিল্লু। বিজাতীয় অনুভূতির চক্কর পেটের মধ্যে।

‘রেডি?’ জিজ্ঞাসা হুলোর।

একটা ঢোঁক গিলে দ্রুত মাথা ওপর-নিচ করল বিল্লু।

‘এবার।’ নাটকীয় স্বরে বলল হুলো বিড়াল, ‘তাকাও আমার চোখের দিকে।’

চোখে চোখ রাখল বিল্লু। প্রসারিত হচ্ছে সবুজ বিড়ালচোখের মণিজোড়া।

চোখ দুটি পিটপিট করল হুলো। পরপর তিনবার।

দুই

গরম। পরিষ্কার নীল আকাশে স্বর্ণমুদ্রার মতো ঝলসাচ্ছে দুপুরের সূর্যটা। মরচে পড়া পুরোনো একধরনের ঘ্রাণ বাতাসে।

‘মিসর!’ ফিসফিস করল বিল্লু।

এটা যে মিসর, কেউ বলে না দিলেও বুঝতে পারছে ও। কীভাবে বুঝল, সেটা অবশ্য বলতে পারবে না। এমনকি এই জানার সপক্ষে তেমন কোনো আলামতও দেখতে পায়নি এখন পর্যন্ত। ধারণা করল, হুলোই কোনোভাবে তথ্যটা ঢুকিয়ে দিয়েছে মাথার মধ্যে।

অবাক কাণ্ড, পরনের পোশাকগুলোও মিসরীয় ওর! লিনেন কাপড়ের আজানুলম্বিত ঢিলেঢালা সাদা টিউনিক। পায়ে চামড়ার চপ্পল। এটাও হয়তো চারপেয়েটার আশ্চর্য ক্ষমতার আরেকটা নমুনা।

বিশাল এক প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে ওরা। জায়গাটা যেন মাইলকে মাইল বিস্তৃত।

‘সত্যি সত্যি চলে এসেছি এত দূর!’ বলল বিল্লু রুদ্ধ স্বরে। ‘বিশ্বাস হতে চাইছে না কেন জানি। মনে হচ্ছে স্বপ্ন।’

‘হ্যাঁ। যিশু খ্রিষ্টের জন্মের দুই হাজার সাত শ বছর আগে।’

‘কীহ্!’ এক লাফে চোখ কপালে উঠেছে বিল্লুর। একেই বোধ হয় বলে আকাশ থেকে পড়া।

মিটিমিটি হাসছে হুলো। চমকে দিতে পেরে মজা পাচ্ছে যেন। ‘জানো নিশ্চয়ই, ইজিপশিয়ানরা পূজা করে আমাদের?’

‘পূজা করে?’

‘মানে, করত। তবে এই মুহূর্তে অতীতে চলে এলেও এটাই এখন যেহেতু আমাদের জন্য বর্তমান, সে জন্য বলছি প্রেজেন্ট টেন্সেই।’ খোলাসা করল হুলো। ‘...হ্যাঁ, পূজা। বিড়াল ভালোবাসে মিসরের লোকেরা। যত্ন-আত্তির চূড়ান্ত করে। করবে নাই–বা কেন? চাঁদ আর সূর্যের মহান দেবী বাস্টেট যে বিড়ালমুখো!’

‘ও, আচ্ছা!’ এবার বুঝতে পেরেছে বিল্লু।

‘আরও অনেক প্রাণীরই পূজা করে মিসরবাসী, কিন্তু আমাদের—মানে বিড়ালের স্থান সবার চেয়ে উঁচুতে।’

এ সময় বাজনার আওয়াজ কানে এল বিল্লুর। ভেসে আসছে দূর থেকে। জোরালো হচ্ছে ক্রমেই।

চত্বরে স্থাপিত বাস্টেটের একটা মূর্তির সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল হুলো। ঘাড় উঁচু করে তাকিয়ে আছে দেবীর দিকে। সম্ভ্রম ঝরে পড়ছে দৃষ্টি থেকে।

আঁটসাঁট, লম্বা রোব বিড়াল-মাথা দেবীর পরনে। এক হাতে ঝুমঝুমি, ছোট এক ঢাল ধরে রেখেছে আরেক হাতে। পায়ের কাছে গুটিসুটি মেরে বসে আছে চারটে বিড়ালছানা। জ্যান্ত নয়, পাথরের।

ছোট এক লাফ দিয়ে মূর্তি বসানো পাথরের বেদিটায় উঠে পড়ল হুলো।

‘একটা উত্সব হয় এখানে প্রতিবছর—’ বলতে গেল।

‘এক মিনিট।’ বাগড়া দিল বিল্লু, ‘কোন জায়গা এটা? কায়রো?’ কায়রো হচ্ছে মিসরের রাজধানী, জানা আছে ওর।

‘না, বিউবাস্টিস।’

‘এটা আবার কোন জায়গা?’

‘বিড়ালদেবীর পবিত্র নগরী। এখন অবশ্য অস্তিত্ব নেই।’

‘মানে বর্তমানে?’

‘হুঁ।’

‘হ্যাঁ, কী যেন বলছিলে?’

‘উত্সবের কথা। খুব ধুমধাম করে উদ্‌যাপিত হয় প্রতিবছর। শুনতে পাচ্ছ না? উত্সবের বাজনা ওটা।’

‘এদিকেই আসছে বলে মনে হচ্ছে!’

‘ঠিকই ধরেছ।’ ব্যস্ত ভাব প্রকাশ পেল বিড়ালের কণ্ঠস্বরে, ‘এই মূর্তিটার পেছনে লুকিয়ে পড়ো তুমি। কারও চোখে পড়লে সমস্যা হতে পারে। ইচ্ছা করলে দেখতে পারো উঁকিঝুঁকি মেরে। তবে সাবধান! কেউ যাতে টের না পায়।’

‘আর তুমি?’

আজব একটা ব্যাপার ঘটল তখন। রূপান্তর ঘটতে আরম্ভ করল হুলোর! ছোট হতে হতে একটা বিড়ালছানার সমান হয়ে গেল! লেজটা গুটিয়ে অন্য চার বিড়ালের মাঝে মূর্তির মতো নিশ্চল বসে রইল মিনি-হুলো। এখন আর ওটাকে আলাদা করার উপায় নেই কোনো।

অলংকরণ: রাজীব

হাজারো মানুষের ভিড়ে দেখতে দেখতে ভরে উঠল প্রাঙ্গণ। ভক্ত-উপাসকের মিছিল চলেছে মন্দিরের দিকে। মিছিলের অগ্রভাগে রয়েছে সফেদ আংরাখা পরা পুরোহিতেরা। কারও হাতে পবিত্র ঝুমঝুমি, কাঠ কুঁদে বানানো সোনালি বিড়াল বহন করছে কেউ কাষ্ঠদণ্ডের আগায়। ওদের সঙ্গে রয়েছে বাঁশি আর ঢাক নিয়ে বাজনদারের দল।

মূল মিছিলের পিছু নিয়েছে স্লোগানমুখর জনতা। আলখাল্লা আর লিনেনের ঘাগরা পরেছে ওরা। ফলভর্তি ট্রে আর প্রকাণ্ড সব ফুলের ঝুড়ি শোভা পাচ্ছে হাতে।

প্রশস্ত অ্যাভিনিউ ধরে এগিয়ে চলল শোভাযাত্রা। দীর্ঘ সড়কটার শেষে পামগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে বাস্টেটের মন্দির।

সূর্যের শির, থোথের নাসিকা,

ওসাইরিসের কর্ণ;

এসব নিয়ে অন্তর্যামী

দেবী, তুমি অনন্য।

স্লোগান কিংবা গানের ভাষাটা বুঝতে এতটুকু কষ্ট হচ্ছে না বিল্লুর। যেন এটাই ওর মাতৃভাষা। আর কত জাদু রয়েছে হুলোর ঝুলিতে?

কিন্তু থোথ! ওসাইরিস! কী এগুলো?

‘থোথ হচ্ছে আইবিস পাখিরূপী দেবতা।’ কে যেন বলে গেল কানে কানে, ‘আর পুনরুত্থানের দেবতা হচ্ছে ওসাইরিস। সূর্যদেবতারা হলো ওসাইরিসের পিতা। সূর্যের শির বলতে রা-কেই বোঝানো হয়েছে।’

কেমন যেন কাঁপা কাঁপা বাঁশির আওয়াজটা। স্যাঁতসেঁতে ধরনের বিষাদমাখা। উত্সবের চেয়ে শোকের বাজনাই মনে হলো বেশি বিল্লুর কাছে। গানবাজনার যুগলবন্দীতে ঝিমঝিম করতে লাগল ওর সারা শরীর।

স্লোগানের বিরাম নেই ওদিকে:

আটামের মুখ, প্‌টাহের হৃদয়,

চন্দ্রের দাঁতে তুমি মোহময়।

একইভাবে জানা হয়ে গেল বিল্লুর আটাম, প্‌টাহ আর চন্দ্রদেবতা খোনসু সম্বন্ধে।

শেষ দুটি লাইন শোনা গেল এরপর:

দৃষ্টি তোমার সূর্যরশ্মি,

কান্তি তোমার জোছনার ধারা।

অবশেষে সাঙ্গ হলো গান, বাজনা—সবকিছু। কবরখানার নীরবতা নেমে এসেছে যেন প্রাচীন নগরীতে।

সহসা গর্জে উঠল এক পুরোহিত, ‘হে, দয়াময়ী! শোনাও তোমার অমৃতবাণী!’

সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল মন্দিরের দুয়ারগুলো। পিঁপড়ার মতো পিলপিল করে শ্বেতপাথরের সিঁড়ি ভাঙতে লাগল পূজারির দল।

শেষ লোকটা সিঁড়িতে ওঠার পর দেবীমূর্তির পেছন থেকে বেরিয়ে এল বিল্লু। ইচ্ছে: লুকিয়ে লুকিয়ে দেখবে, কী হচ্ছে ওই উপাসনালয়ে।

দুকদমও এগোয়নি, খপ করে বাঘের থাবা পড়ল পেছন থেকে!

ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল বিল্লু। কোনো রকমে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পেল, পলকহীন দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে একজোড়া রক্তচক্ষু। তেল–চকচকে মাথাটায় একটা চুলও নেই লোকটার। গোটানো প্যাপাইরাস অন্য হাতটায়।

প্রমাদ গুনল বিল্লু। কোত্থেকে উদয় হলো এই টাকলু?

ঘাড় ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দিল ওকে টাকমাথা। ‘অ্যাই, কে রে তুই?’ ধমকে উঠল বাজখাঁই গলায়, ‘কী করছিলি মূর্তির পেছনে?’

আরও কয়েকজন এসে ঘিরে ধরল ওদের। প্যাপাইরাস কাগজের গোটানো বান্ডিল, না হয় কাদামাটির তৈরি লিপিফলক প্রত্যেকের হাতে। নকলনবিশ এরা, দলিল-দস্তাবেজের অনুলিপি তৈরি করে। টাকমাথা লোকটা এদের সরদার।

ছাড়া পাওয়ার জন্য মোচড়ামুচড়ি করছে; সবার মনোযোগ বিল্লুর দিকে—দেখতে পেল না, স্বাভাবিক আকৃতিতে ফিরে এসেছে ওর পোষা বিড়াল।

চোখের কোণে একটা নড়াচড়া ধরা পড়তেই সেদিকে তাকাল এক অনুলিপিকার। বেদি থেকে বিড়ালটা নেমে আসতেই চেঁচিয়ে উঠল সবিস্ময়ে। ‘দেখুন, সরদার! দেখুন...দেখুন!’

সব কটা চোখ ঘুরে গেছে কালো বিড়ালটার দিকে। চোয়াল ঝুলে পড়ল প্রধান লিপিকারের। আপনা-আপনিই আলগা হয়ে গেছে বজ্রমুষ্টি।

রাস্তার ওপরই হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল গোটা দলটা। ভক্তিতে মাথা হেঁট করল বিল্লুর বিড়ালের উদ্দেশে।

হুলো অবশ্য নির্বিকার। বুকডন দেওয়ার ভঙ্গিতে টানটান করল শরীরটা। তারপর আলস্যভরে তাকাল হাঁটু গেড়ে বসা লোকগুলোর দিকে।

সিধে হয়েই বিল্লুর দিকে ঘাড় ফেরাল প্রধান লিপিকার। দেখছে ওকে নতুন দৃষ্টিতে।

‘ওটা কি তোমার বিড়াল?’ জিজ্ঞেস করল কমুহূর্ত পার।

ঘটনা কোন দিকে গড়াচ্ছে, অনুমানও করতে পারছে না বিল্লু। ঘাড় নাড়ল বিমূঢ়ের মতো।

কোমরের কাছে হাত চলে গেল লিপিকারের। চামড়ার একটা বটুয়া উঠে এল হাতে। ‘কত চাও এটার জন্য?’

বিল্লু কিছু বলার আগেই মুখ খুলল অধীন এক লিপিকার। চোখে তার কুটিল দৃষ্টি। ‘বেয়াদবি মাফ করবেন, সরদার। ছোঁড়াটাকে যদি ছেড়ে দেওয়া হয় পবিত্র কুমিরের জিম্মায়, তাহলে তো আর পয়সা খরচের দরকার পড়ে না।’

চিবুকে হাত বোলাচ্ছে টাকলু লিপিকার। ‘উত্তম প্রস্তাব।’ বলল শেষমেশ, ‘আমিও আসলে এ কথাই ভাবছিলাম।’ ছোট হতে চায় না সে অধীনদের কাছে।

‘না, সরদার।’ ভীরু গলায় আপত্তি জানাল আরেকজন। ‘ভুলে যাবেন না, পবিত্র আন্‌খ্ চিহ্ন রয়েছে বিড়ালটার পিঠে। যদি বদলা নেয়!’

‘আমিও তো সে কথাই বলি!’ কথা ঘুরিয়ে ফেলল টাকলু। সতর্কতার সঙ্গে নিরিখ করছে বাঘের আত্মীয়টিকে।

‘জানি না, কারা আপনারা!’ সক্ষোভে ফেটে পড়ল বিল্লু। গড়গড় করে মিসরীয় ভাষা বেরোচ্ছে ওর মুখ দিয়ে, ‘কিন্তু মনে হয় না, কারও বিড়াল কেড়ে নেওয়ার অধিকার আপনাদের আছে!’

‘ছোট্ট বন্ধু!’ চিনি মেশানো মোলায়েম গলায় বলল টাকমাথা লিপিকার। বিনয়ের অবতার যেন, ‘প্রথমেই মাফ চেয়ে নিচ্ছি। উপযুক্ত মূল্য দিয়েই কিনে নিচ্ছি ওটা।’

‘কিন্তু কেন?’

‘কেনই বা নয়? গত কয়েক মাসের মধ্যে এই প্রথম একটা বিড়াল পেলাম, যেটা সন্তুষ্ট করতে পারবে মহান শাসক রাজা নেতের-খেতকে। আহ্...দীর্ঘ জীবন, শক্তি আর সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হোন তিনি!’

‘জীবন! স্বাস্থ্য! শক্তি!’ প্রতিধ্বনি তুলল সহ-লিপিকারেরা।

‘আন্‌খের ব্যাপারটা কী?’ জানতে চাইল কৌতূহলী বিল্লু।

‘জানো না তুমি?’ বিস্মিত হয়েছে লিপিকার-সরদার। ‘জীবনচিহ্ন ওটা। সে জন্যই তো এত কদর বিড়ালটার।’

‘পিঠের ওই সাদা দাগটা?’

‘হ্যাঁ।’ শ্রদ্ধাভরে উচ্চারণ করল সরদার।

‘কিন্তু আমি তো ওটাকে বিক্রি করব না।’

থমকে গেল লোকটা। ‘না’ শুনতে অভ্যস্ত নয় সে। আবার জোরাজুরি করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। কী ভেবে বলল তাই, ‘আচ্ছা, কী আর করা! তবে ফারাওকে একবার দেখতে দিতে আপত্তি নেই নিশ্চয়ই?’

‘বেশ তো।’ নিমরাজি বিল্লু, ‘দেখতে চাইলে দেখতে পারেন।’

তিন

নীল নদের ধারে চলে এল ওরা। শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে মিসরের প্রাণভোমরা।

বিল্লুর কোলে হুলো। অন্যদের সঙ্গে নেমে এল ও বাঁধানো ঘাটের পাথুরে ধাপ বেয়ে। রাজকীয় বজরা অপেক্ষা করছে সেখানে।

সব কজন বজরায় উঠলে নোঙর তুলল দাঁড়ি, সর্বোচ্চ গতিতে বাইতে লাগল দাঁড়।

একসময় পৌঁছে গেল ওরা গন্তব্যস্থলে। নৌকা থেকে নেমে রাজকীয় প্রাসাদের উদ্দেশে পা চালাল লিপিকারেরা।

কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রাসাদবাড়ির একটা হলে নিয়ে আসা হলো দুই অতিথিকে। কাদামাটির ফলক খোদাইয়ে ব্যস্ত একদল মোহাফেজ ছাড়া আর কিছু নেই হলঘরটায়। আসছে-যাচ্ছে ব্যস্তসমস্ত বার্তাবাহক। একমুহূর্তের বিরাম নেই তাদের। উচ্চকণ্ঠে জানিয়ে দিচ্ছে নেতের-খেতের আদেশ-নির্দেশ। অল্পক্ষণেই পাঁচটি যুদ্ধের ঘোষণা হতে শুনল বিল্লু, স্বাক্ষরিত হলো তিনটি শান্তি চুক্তি, নতুন একটি পিরামিড নির্মাণের হুকুম দেওয়া হলো আট হাজার পাথরমিস্ত্রিকে। তার ওপর চলছে মালসামান নিয়ে মজুরদের লাগাতার টানাহেঁচড়া। মৌমাছির ব্যস্ততা হলজুড়ে।

এক কেরানির দিকে এগিয়ে গেল অনুলিপি-সরদার।

‘লেখো।’ বলল লোকটা কর্তৃত্বপূর্ণ স্বরে, ‘পঁয়তাল্লিশ হাজার বুশেল খাদ্যশস্য...’

খসখস করে নলখাগড়ার কলম চালাল হিসাবরক্ষক।

‘ষাট হাজার বয়াম তেল...’

খসখস...খসখস।

‘চার হাজার আউন্স স্বর্ণ...’

খসখস...খসখস।

‘আর একটা কালো বিড়াল...’

খসখস...

‘এসব যোগ হবে ফারাওয়ের সম্পত্তি হিসেবে।’

‘না!’ আঁতকে উঠল বিল্লু, ‘আমার বিড়াল এটা! অন্য কারও সম্পত্তি হতে পারে না ও!’

শীতল হাসল কুচক্রী সরদার, ‘এরই মধ্যে হয়ে গেছে!’

চার

পাথরের ভারী দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল বিল্লুর পেছনে। ধাক্কা দিয়ে ভরে দেওয়া হয়েছে ওকে খুপরিমতো এক কামরায়।

বৃথাই কিল পড়ল দরজায়। নিজের ওপরই খেপে উঠেছে বিল্লু। আহাম্মকের মতো পা দিয়েছে ও চতুর লিপিকারের ফাঁদে! বাকি জীবনটা কি কাটাতে হবে পাথুরে এই কয়েদখানায়?

ফোঁস করে শ্বাস ফেলল একটা। তারপর ধপ করে বসে পড়ল মেঝেতে। ডুকরে উঠল দুহাতে মুখ ঢেকে। একটাই সান্ত্বনা, বুঝ দিচ্ছে নিজেকে, আদর-যত্নের কমতি হবে না বিড়ালটার। একে তো প্রাণীটাকে পছন্দ করে মিসরীয়রা, তার ওপর পবিত্র বলে বিবেচিত হচ্ছে ওর হুলো।

দুজন প্রহরী প্রবেশ করল ভেতরে। কোনো কথা না বলে অজস্র স্তম্ভবেষ্টিত হলওয়ে ধরে নিয়ে চলল ওরা বিল্লুকে। পৌঁছে দিল করিডরের শেষে বিশাল এক হলরুমে।

কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে একটু পরেই খুলে গেল দরজাটা।

হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়াল বিল্লু।

দুজন প্রহরী প্রবেশ করল ভেতরে। কোনো কথা না বলে অজস্র স্তম্ভবেষ্টিত হলওয়ে ধরে নিয়ে চলল ওরা বিল্লুকে। পৌঁছে দিল করিডরের শেষে বিশাল এক হলরুমে। সেখানে উঁচু প্ল্যাটফর্মের ওপর সিংহাসন আলো করে বসে রয়েছেন সম্রাট নেতের-খেত।

মেষপালকদের ছড়ি আর দেবসুলভ কর্তৃত্বের পরিচয়বাহী কস্তনী (শস্য মাড়ানোর যন্ত্রবিশেষ) মিসররাজের দুই হাতে। অন্ধকার হয়ে আছে মুখটা। কপালে ভ্রুকুটি। উঁচু হেডড্রেস, বিনুনি করা দাড়ি আর পাথুরে মুখাবয়বের কারণে পার্থক্য করা মুশকিল দরবারকক্ষের মূর্তিগুলো থেকে।

জনাকয়েক ভৃত্য দাঁড়িয়ে ফারাওয়ের দুই পাশে। মাছি তাড়ানোর ঝাড়ু নাড়ছে কেউ প্রবল বেগে, কেউবা নাড়ছে রত্নখচিত দণ্ডের মাথায় বসানো পালকের পাখা।

খিটখিটে চেহারা করে ন্যাড়া মাথা লিপিকার উপস্থিত রয়েছে কামরাটায়। হুলোও রয়েছে, বসে আছে সিংহাসনের সামনে। দৃষ্টি ওর নেতের-খেতের দিকে। যদিও খুব একটা কৌতূহলী মনে হচ্ছে না ওকে বিল্লুর।

‘এই সেই ছেলে!’ চাবুকের মতো সপাং করে উঠল প্রধান লিপিকারের কণ্ঠ। নালিশ জানাচ্ছে যেন, ‘এর কথাই বলছিলাম আপনাকে।’

‘হুম।’ তির্যক দৃষ্টিতে বিল্লুকে দেখছেন মিসরের রাজা।

‘আমরা তো পারলাম না।’ বিব্রত শোনাল প্রধান লিপিকারের গলাটা, ‘ছোঁড়াটা নিশ্চয়ই ব্যর্থ হবে না। আগের মালিক যেহেতু।’

‘দেখা যাক।’ শান্ত, গম্ভীর স্বরে কোনো আশাবাদ ফুটল না নেতের-খেতের।

‘অ্যাই, ছোকরা!’ কী ঘটছে, বুঝে ওঠার আগেই বিষাক্ত ধমক শুনতে হলো বিল্লুকে, ‘আগে বাড়ো! ফারাওয়ের মনোরঞ্জন করতে বলো ওটাকে।’

ইতস্তত করছে বিল্লু। তারপর এগিয়ে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল বিড়ালটার পাশে।

একটা খেলনা ছুড়ে দেওয়া হলো ওর দিকে—সোনার তৈরি একটা ইঁদুর, যেটার চোখের জায়গায় পান্না বসানো।

হুলোর সামনে আগুপিছু করল ওটা বিল্লু। কাজ হলো না। খেলাধুলার মুডেই নেই বিড়ালটা।

কী করা যায় এখন! ওই গানটা গেয়ে দেখবে নাকি? নাচ, আমার ময়না, তুই পয়সা পাবি রে...

মাথা ঝাঁকিয়ে দূর করে দিল আজেবাজে চিন্তাগুলো। উঠে দাঁড়াল নিরুপায় মুখভঙ্গি করে। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, রেগে উঠেছেন নেতের-খেত। তাকাল লিপিকারের দিকে। ফুঁসছে ও-ব্যাটাও।

কী মনে হলো, ঝুঁকে দুহাতে বিড়ালটাকে তুলে নিল বিল্লু। পা বাড়াল প্ল্যাটফর্মের দিকে। তারপর কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সম্রাটের কোলে বসিয়ে দিল অনিচ্ছুক মার্জারটিকে।

প্রায় একই সঙ্গে আঁতকে ওঠার শব্দ হলো অনেকগুলো। হাঁ হাঁ করে উঠল প্রধান লিপিকার।

কে জানে, কেন—একটা সেকেন্ডও নেতের-খেতের কোলে থাকতে রাজি নয় হুলো। স্প্রিংয়ের মতো ছুটে বেরিয়ে গেল ফারাওয়ের হাতের নিচ থেকে।

‘আইইই!’ ঝট করে ডান হাতের বুড়ো আঙুল মুখে পুরে দিলেন সম্রাট। দুর্ঘটনাবশত বিড়ালের থাবার আঁচড় লেগেছে আঙুলে।

লিপিকারকে দেখে মনে হচ্ছে, চিবিয়ে খেয়ে ফেলে বিল্লুকে। প্রায় ছুটে এসে একটা কান পাকড়াও করল ছেলেটার। মুচড়ে দিতেই ব্যথায় চিত্কার ছাড়ল বিল্লু। তারপরও কান ছাড়ছে না বদমাশটা।

‘দূর করো বেয়াদব বিড়ালটাকে!’ ভয়ানক চেহারা হয়েছে ক্রোধান্বিত নেতের-খেতের।

‘জো হুকুম, জাহাঁপনা।’ মাথা হেঁট করল ন্যাড়া, ‘বাচ্চাটাকে কী করব?’

‘ওকেও দূর করো আমার সামনে থেকে!’

‘পবিত্র কুমিরের ভোগে লাগিয়ে দিই, প্রভু?’

‘অ্যাঁ! না না...কী বলছ এসব?’

শুনে কাঁচুমাচু চেহারা হলো লিপিকারের। দুহাত কচলাতে লাগল লোকটা।

‘বেরিয়ে যাও!’ ঝামটে উঠলেন নেতের-খেত, ‘সব কজন বেরিয়ে যাও এখান থেকে!’

প্রহরীদের দিকে ইঙ্গিত করল টাকমাথা। বিল্লুকে নেওয়ার জন্য পা বাড়াতে উদ্যত হলে ছড়ি তুলে বারণ করলেন ওদের রাজা। ‘থাকুক ও...বিড়ালটাও থাকুক।’

ক্ষীণ কুঞ্চন দেখা দিল লিপিকারের ভুরুজোড়ায়, মুহূর্তের মধ্যেই মিলিয়ে গেল তা।

বিল্লু আর হুলো ছাড়া একে একে বেরিয়ে গেল প্রত্যেকে।

ফাঁকা হলঘরে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রাজা নেতের-খেত। হঠাৎই ক্লান্ত মনে হচ্ছে তাঁকে। ক্লান্ত আর বিষণ্ন। বহু কষ্টে উঠে দাঁড়ালেন যেন রাজকীয় আসন ছেড়ে। তারপর দুই পা এগিয়ে ধপ করে বসে পড়লেন প্ল্যাটফর্মের কিনারে।

শঙ্কা ও স্বস্তি দুই-ই অনুভব করছে বিল্লু। স্বস্তি, আপাতত কয়েদখানায় ফিরে যেতে হচ্ছে না বলে। কিন্তু সামনে কী অপেক্ষা করছে, সেটা নিয়েই শঙ্কিত ও।

হেডড্রেসটা খুলে ফেললেন মিসরের নৃপতি। পরচুলা পরে ছিলেন, খুলে ফেললেন সেটাও; এমনকি বিনুনি করা দাড়িসুদ্ধ। হাঁ হয়ে গেল বিল্লু। না, দাড়িটা নকল বলে নয়; ওগুলো খুলে ফেলার পর নেতের-খেতের চেহারা দেখে। কাঠিন্য উবে গিয়ে নিতান্তই সাদাসিধে মানুষ মনে হচ্ছে এখন তাঁকে। তবে অসুখী মানুষ।

লোকটার জন্য করুণা হলো বিল্লুর। রাজ্য শাসনের মতো বিশাল দায়িত্ব যাঁর কাঁধে, তিনি কিনা মাথা ঘামাচ্ছেন তুচ্ছ এক বিষয় নিয়ে। দুঃখজনক।

‘ভাগ্যবান তুমি।’ কেমন দুঃখ মেশানো গলায় মন্তব্য করলেন নৃপতি।

‘...জি?’

‘নিজের একটা বিড়াল আছে তোমার।’ ব্যাখ্যা নয়, আপন মনে বলছেন যেন নেতের-খেত। ‘আর আমাকে দেখো! এখন পর্যন্ত একটাকেও পেলাম না কোলে নিয়ে আদর করার মতো।’ ছলছল করছে ফারাওয়ের চোখ দুটি।

লোকটার জন্য করুণা হলো বিল্লুর। রাজ্য শাসনের মতো বিশাল দায়িত্ব যাঁর কাঁধে, তিনি কিনা মাথা ঘামাচ্ছেন তুচ্ছ এক বিষয় নিয়ে। দুঃখজনক।

‘কত দিন থেকে অপেক্ষা করছি নিজের একটা বিড়ালের জন্য!’ ব্যাকুলতা ঝরল মিসর-সম্রাটের কণ্ঠ থেকে। ‘ছেলেবেলায় কিন্তু বিড়ালের অভাব ছিল না আমার। ওরাও খুব ন্যাওটা ছিল আমার। যখন ফারাও হলাম, এরপর থেকে যেন মনটন উঠে গেল ওদের আমার ওপর থেকে।’

শুনতে শুনতে একটা সম্ভাবনা খেলে গেল বিল্লুর মাথায়। ‘ফারাও হওয়ার আগেও কি হেডড্রেস আর নকল দাড়ি পরতেন আপনি?’ জিজ্ঞেস করল ও।

‘কেন, বলো তো!’ বিস্মিত দেখাচ্ছে নেতের-খেতকে।

‘এগুলোই হয়তো ভয় পাইয়ে দিচ্ছে ওদের।’

সম্ভাবনাটা নিয়ে মনে মনে নাড়াচাড়া করলেন মিসরের সম্রাট। ‘উম...হতেও পারে।’

‘আরেকটা ব্যাপার...’

‘বলো!’ সাগ্রহে সামনের দিকে ঝুঁকে এলেন নেতের-খেত।

‘সব সময়ই কি এ রকম গম্ভীর হয়ে থাকেন আপনি? ধমকের সুরে কথা বলেন সব সময়?’

‘না...মানে...।’ আমতা আমতা করছেন মিসরের অধিপতি। লজ্জা পেয়েছেন ক্ষমতাধর মানুষটি।

‘তাহলে শুনে রাখুন।’ বলল বিল্লু, ‘ধমকাধমকি কিন্তু পছন্দ করে না বিড়ালেরা।’

‘দেশ চালানোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।’ মলিন কণ্ঠে বললেন সম্রাট। তবে একটু যেন উজ্জ্বল মনে হচ্ছে তাঁকে আগের চেয়ে। ‘নকল চুল, নকল দাড়ির মতোই আলগা একটা ব্যক্তিত্ব ধরে রাখতে হচ্ছে বেশির ভাগ সময়।’

‘ওসব কৈফিয়ত-টৈফিয়ত চলবে না বিড়ালের কাছে।’ সাফ জানিয়ে দিল বিল্লু। ওর নিজের অভিজ্ঞতাও তা-ই বলে, ‘আমার তো মনে হয়, সহজ-স্বাভাবিক আচরণ করলে আবারও ওরা ভিড়তে শুরু করবে আপনার আশপাশে।’

‘হুম...যুক্তি আছে তোমার কথায়।’

‘একটা টিপস দিতে পারি আপনাকে। আদুরে আদুরে নাম ধরে ডাকবেন বিড়ালকে।’ বিশেষজ্ঞ মত দিল বিল্লু, ‘দেখবেন, কাজ হবে এতে।’

‘কী ধরনের নাম?’ ছেলেমানুষি ধরনের কৌতূহল বোধ করছেন নেতের-খেত। চোখজোড়া চকচক করছে তাঁর।

‘যেমন, আমি আমার বিড়ালকে সবচেয়ে বেশি যে নামে ডাকি, সেটা হচ্ছে: আলাবুতু।’

‘আলাবুতু? মানে কী এর?’

‘মানে কি থাকতেই হবে?’ পাল্টা প্রশ্ন বিল্লুর।

স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছেন নেতের-খেত। ধীরে ধীরে মিষ্টি এক টুকরো হাসিতে উদ্ভাসিত হলো সম্রাটের মুখমণ্ডল। ‘আলাবুতু...আলাবুতু...।’ দুবার আওড়ালেন তিনি শব্দটা।

কাছাকাছিই ছিল হুলো, নামটা শুনে এগিয়ে এসে মুখ ঘষতে লাগল ফারাওয়ের গোড়ালিতে।

‘দেখলেন! দেখলেন!’ আধহাত ফুলে উঠল বুকটা বিল্লুর, ‘বলেছিলাম না আপনাকে?’

লাফ দিয়ে প্ল্যাটফর্মে উঠে পড়ল হুলো। মন্থর পায়ে এগিয়ে গেল সিংহাসনের দিকে। তারপর আরেক লাফে রাজকীয় চেয়ারটার ওপর।

সম্রাটের মতো অভিজাত ভঙ্গি নিয়ে সিংহাসনে বসে আছে হুলো। ডাক ছাড়ল: ‘ম্যাঁও।’

‘রাজকীয় আর্কাইভে অন্তর্ভুক্ত করেছ তুমি বিড়ালটাকে। বদলাতে হবে রেকর্ডটা। এখন থেকে কোনো বিড়ালই ফারাওয়ের সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হবে না। বিড়ালের প্রভু নন ফারাও, বরঞ্চ মেজবান ও শুভাকাঙ্ক্ষী।’ প্রধান লিপিকারকে ডেকে পাঠিয়েছেন আবার নেতের-খেত। টাকমাথা লোকটার উদ্দেশে বললেন তিনি কথাগুলো।

‘যথা আজ্ঞা, জনাব।’ তেলতেলে হেসে বলল লিপিকার।

এবার বিল্লুর দিকে ঘুরলেন মিসররাজ। ‘খুবই সম্মানিত বোধ করব, তোমরা যদি আমার সঙ্গে থেকে যাও।’

‘থাকতে পারলে তো ভালোই হতো, মহারাজ।’ আন্তরিক স্বরে বলল বিল্লু, ‘কিন্তু...’

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে।’ হেসে বললেন সম্রাট, ‘থাকতে না চাইলে জোর করব না।’

নিজের গলা থেকে সোনার কণ্ঠহারটা খুলে নিলেন তিনি। পরিয়ে দিলেন ওটা বিল্লুর গলায়।

‘ধন্যবাদ, জাহাঁপনা, অসংখ্য ধন্যবাদ।’ শুকরিয়া জানাল অভিভূত বিল্লু।

‘মন ভালো হয়েছে?’ হুলোর কণ্ঠে কৌতুক।

হেসে ফেলল ছেলেটা। জবাব দেওয়ার প্রয়োজন পড়ল না।

‘থ্যাঙ্ক ইউ, হুলো। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ!’ বলল বিল্লু কৃতজ্ঞ গলায়।

নীল নদের নির্জন এক কিনারায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা। বেলা মরে এসেছে। বইছে মৃদুমন্দ হাওয়া।

‘এবার কী, বাড়ি?’ কৌতূহলী গলায় জিজ্ঞেস করল বিল্লু।

‘দেখাই যাক না।’ রহস্যের প্রলেপ হুলোর কণ্ঠে, ‘রেডি?’

বড় করে দম নিল বিল্লু, ‘রেডি।’

‘ভেরি গুড। এবার।’ নাটকীয় ভঙ্গিতে বিরতি দিল হুলো, ‘তাকাও আমার চোখের দিকে।’

তা-ই করল বিল্লু।

সবুজ চোখজোড়া পিটপিট করল বিড়ালটা। পরপর তিনবার।