মেয়েটার কোনো বন্ধু ছিল না

অলংকরণ: আরাফাত করিম

লিন্ডা নামের একটা মেয়ের কোনো বন্ধু ছিল না। সে মা-বাবার একমাত্র মেয়ে—কোনো ভাইবোন ছিল না তার, ছিল না কোনো বন্ধুও। বলতে পারো সে ভীষণ একা। কেউ তাকে চা খেতে ডাকত না। শনিবারের সকালগুলোয় লিন্ডাকে বাগানে খেলার জন্য ডাকত না কেউ। কেউ স্কুল থেকে বাড়িতে হেঁটে যেতেও চাইত না ওর সঙ্গে।

ব্যাপারটা কিন্তু বেশ অদ্ভুত, কারণ লিন্ডা মোটেও রূঢ় স্বভাবের ছিল না। হিংসুক বা অহংকারীও ছিল না। যেসব কারণে একটা বাচ্চাকে কেউ অপছন্দ করতে পারে, তার কোনোটিই ছিল না লিন্ডার মধ্যে। খুব সুন্দর করে কথা বলত সে, ভদ্রতা জানত, আর দেখতেও বেশ সুন্দর ফুটফুটে একটা মেয়ে।

‘এটা আশ্চর্য ব্যাপার,’ তার মা বলেন, ‘লিন্ডা এত ভালো একটা মেয়ে, তবু কেউ তাকে পছন্দ করে না। কেউই তার বন্ধু হতে চায় না। বেচারা বাচ্চাটা খুব লাজুক, কীভাবে কারও সঙ্গে খেলতে হয়, সেটাই ঠিকমতো জানে না।’

লিন্ডা নিজেই ব্যাপারটা নিয়ে সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় ছিল! যখন মেরি আর জোয়ানকে একসঙ্গে খেলতে দেখত, চোখে পানি এসে যেত ওর। তারা কখনো ওর সঙ্গে মজা করত না। যখন জর্জ আনাকে চা খাওয়ার জন্য ডাকত, খারাপ লাগত লিন্ডার। জর্জ বলত, শুধু আনার জন্যই জর্জ তার ক্লকওয়ার্ক রেলওয়েটা বের করবে। ওটা দেখার জন্য লিন্ডা শুধু অপেক্ষাই করে যেত। কিন্তু জর্জ একবারও ডাকেনি তাকে।

একদিন কিনিথ খুব সুন্দর একটা পেনসিল নিয়ে এল স্কুলে। পেনসিলটার মাথায় একটা স্ক্রু লাগানো ছিল। স্ক্রুটা একদিকে ঘোরালে পেনসিলটা লাল রঙে লিখত, অন্যদিকে ঘোরালে নীল রঙে। কিনিথ সবাইকে দেখাল পেনসিলটা। শুধু লিন্ডা ছাড়া সব্বাইকে! লিন্ডার ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছিল ওটা দেখতে। তবু আশা নিয়ে বসে থাকল সে। হয়তো কিনিথ হঠাৎ বলে উঠবে, ‘লিন্ডা, দেখো!’ অথচ কিছুই বলল না কিনিথ।

‘কিনিথ আমাকে পেনসিলটা দেখাল না কেন?’ ভাবল লিন্ডা, ‘নিশ্চয়ই আমি খুব মন্দ একটা মানুষ, এ জন্যই আমার কোনো বন্ধু নেই। একটাও না! আমাকে কিছু একটা করতেই হবে।’

জানো, এই পৃথিবীতে দুই ধরনের মানুষ আছে—এক ধরনের মানুষ খারাপ সময় এলে কেবল বসেই থাকে, অবসন্ন, বিধ্বস্ত, ভীত হয়ে যায় কিংবা কিছুই করে না। আর অন্য দলটা এ সময় বিষয়টা নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা করে, সমস্যাগুলো থেকে উতরানোর একটা পথ খুঁজে নেয়। লিন্ডার সৌভাগ্য যে সে দ্বিতীয় ধরনের মানুষ। তাই সে বসে চিন্তা করা শুরু করল। ‘আমি নিজেও জানি না আমার কেন কোনো বন্ধু নেই—এমনকি মা-ও জানেন না, তা না হলে আমাকে সাহায্য করতেন।’ লিন্ডা ভাবল। ‘যদি আমি এমন কাউকে খুঁজে পাই যে সত্যিই বুঝতে পারবে কেন আমার কোনো বন্ধু নেই, সে-ই হয়তো আমাকে বলতে পারবে আমার কী করা উচিত। কোনো বন্ধুবান্ধব ছাড়া আমি আমার সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারি না।’

লিন্ডার স্কুলের টিচার তখন মিস ব্রাউন। মিস ব্রাউন খুবই ভালো একজন মহিলা। তিনি শাসন করতেন ঠিকই, কিন্তু আদরের কোনো সীমা ছিল না। লিন্ডা খুব পছন্দ করত তাকে, আবার ভয়ও পেত কিছুটা। ‘মিস ব্রাউন আমাদের সবার সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন!’ মনের ভেতর নিজের সঙ্গেই আলাপ চালায় লিন্ডা। ‘তিনি সত্যিই অনেক কিছু জানেন। আমি তার কাছে গিয়ে আমার দুশ্চিন্তার কথা বলব। তিনি হয়তো বলতে পারবেন, কী করতে হবে আমাকে।’

সুতরাং সেদিন বিকেলে মিস ব্রাউনের বাড়িতে হাজির হলো লিন্ডা। দরজায় টোকা দিতেই দরজা খুললেন মিস ব্রাউন। বেশ অবাক হলেন লিন্ডাকে দেখে। ‘ভেতরে চলে এসো,’ বললেন তিনি, ‘কী হয়েছে লিন্ডা? কোনো সমস্যা?’

‘আছে, আছে মিস,’ বলল লিন্ডা, ‘আমি জানি না আপনাকে কীভাবে বলব, কোত্থেকে শুরু করব—তবে মিস, আমার কোনো বন্ধু নেই, একটাও না। আর এটা আমাকে ভীষণ দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। আমি অনেক ভেবেছি এ নিয়ে। আচ্ছা মিস, আমার মধ্যে কি খুব খারাপ কিছু আছে?’

মিস ব্রাউন হাসলেন। লিন্ডাকে তার বসার ঘরে নিয়ে গেলেন তিনি। পরদিন সেলাইয়ের ক্লাস, তাই পেঁচিয়ে যাওয়া কিছু সুতোর প্যাঁচ খুলে আলাদা করছিলেন মিস ব্রাউন। লিন্ডার কথা শুনতে শুনতে কাজটা চালিয়ে গেলেন।

‘মিস ব্রাউন, আমার মধ্যে সত্যিই কি খারাপ কিছু আছে?’ লিন্ডা জিজ্ঞেস করল, ‘প্লিজ, আমাকে বলুন, আমি হয়তো সেটা ঠিক করে ফেলব।’

‘তোমার মধ্যে মোটেও মন্দ কিছু নেই,’ মিস ব্রাউন বললেন, ‘কিন্তু—’। একটু থেমে, আবার শুরু করেন মিস ব্রাউন, ‘তোমার মধ্যে খুব ভালো বা চমৎকার কিছুও নেই! তুমি হলে একজন মাঝামাঝি মানুষ। খুব ভালোও নয়, আবার খুব মন্দও নয়। একটু মাঝামাঝি।’

‘ওহ,’ বিভ্রান্ত হয়ে বলল লিন্ডা, ‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না আপনি কী বোঝাতে চাইছেন! কেউ যদি আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার না করে তাহলে আমি কীভাবে ভালো মেয়ে হব?’

‘তাহলে মা মন দিয়ে শোনো এখন,’ সুতোগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে দরদি কণ্ঠে বললেন মিস ব্রাউন, ‘এই পৃথিবীতে বন্ধু বানানোর একটাই উপায় আছে—বন্ধু হওয়া! সবার ভালো বন্ধু হও, বন্ধুর মতো আচরণ করো, তখনই কেবল তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে অন্যরা, তোমার ভালো বন্ধু হবে। তুমি তো আর মায়াদয়াহীন নও, যে কাউকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে। আবার তুমি এমন দয়ালুও না যে কেউ পড়ে গেলে ছুটে গিয়ে তাকে সাহায্য করতে যাবে। তুমি কাজটা ছেড়ে দাও অন্য কারও ওপর। বুঝতে পারছ?’

‘বুঝতে পারছি,’ লিন্ডা বলল, ‘অন্যরা বন্ধুর মতো আচরণ করবে ভেবে বসে থাকলে হবে না। নিজেকেই আগে বন্ধু হতে হবে।’

‘একদম ঠিক বলেছ,’ মিস ব্রাউন বললেন, ‘দেখো, এই তো আমি এখানে বসে প্যাঁচানো সুতোগুলোর জট ছাড়াচ্ছি। মেরি বা জোয়ান এখানে থাকলে হয়তো বলত, “মিস, আমি আপনাকে সাহায্য করি?” আর আমিও ওদের ওপর খুব খুশি হতাম। কিন্তু তুমি, বোকাসোকা মেয়েটা, ওখানে হাত গুটিয়ে বসে আছ, আমাকে সাহায্য করার কথা বলছ না—তাই তোমার প্রতি আমার কোনো উষ্ণ অনুভূতি হচ্ছে না। দোষটা কিন্তু আমার নয় লিন্ডা, দোষটা তোমারই।’

‘ওহ, মিস ব্রাউন!’ লিন্ডা লজ্জায় লাল হয়ে বলল, ‘আমি ভাবছিলাম আপনাকে সাহায্য করার কথা। কিন্তু আমি মনে করেছিলাম আপনি না করে দেবেন।’

‘তুমি আমাকে হ্যাঁ বা না বলার সুযোগটা তো দিতে পারতে!’ বললেন মিস ব্রাউন।

‘শোনো, আর মাঝামাঝি হয়ে থেকো না। মানে, ভালোও না খারাপও না, এমন হয়ে থেকো না। মানুষ যদি তোমাকে “না”-ও বলে, সেটা নিয়ে ভেবো না। তুমি তো অন্তত চেষ্টা করলে ভালো ব্যবহার করার! মার্জারির কথা চিন্তা করো, সে ভীষণ দুষ্টু, খাপছাড়া, অগোছালো। তোমার মতো শান্তশিষ্ট, পরিপাটি নয় মোটেও, তবু ওকে সবাই ভালোবাসে। সে সবাইকে সাহায্য করতে ছুটে যায়। সবার প্রতিই ওর আগ্রহ। কেউ অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যায়, সঙ্গে নিয়ে যায় খেলনা অথবা বই। সে শুধু সবার বন্ধু হবে—তাই সবাই ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে! কেমন হয় যদি তুমিও এমনটা করা শুরু করো?’

‘তখন কি সবাই আমার বন্ধু হবে?’ লিন্ডা জিজ্ঞেস করল। সে এখন সুতোগুলো নিয়ে কাজ করছে। ভালোই লাগছে কাজটা।

‘সেটা তোমাকে নিশ্চিত হয়ে বলি কীভাবে বলো?’ মিস ব্রাউন বলেন, ‘তবে অন্তত ওরা তোমাকে একটু হলেও খেয়াল করবে। তুমি আসলে কেমন মানুষ, সেটা আমরা কেউ জানি না! তুমি শুধু ক্লাসের পেছনে বসে বলো, “জি মিস ব্রাউন” কিংবা “না মিস ব্রাউন”, আর আমার মনে হয় না ক্লাসের সবাই বিশ্বাস করে যে তুমি একটা সত্যিকারের মানুষ। তুমি সব সময় কেমন অদৃশ্য হয়ে থাকো। তাই বলি, সত্যিকারের মানুষ হয়ে দেখো একটা সপ্তাহের জন্য, তারপর দেখো কী হয়। কেউ তোমাকে নিয়ে হাসাহাসি করলেও সেটা নিয়ে ভেবো না, দূরে সরিয়ে দিলেও না। শুধু তোমার মনটাকে বোঝাও, যে যা-ই বলুক না কেন, তুমি সবার বন্ধু হবে।’

‘ঠিক আছে, মিস,’ বলে লিন্ডা খুব খুশি খুশি মনে বাড়ি ফিরল। সে এখন অন্তত বুঝতে পারবে, বন্ধু বানানো আদৌ তার পক্ষে সম্ভব কি না! কাজটা বেশ সহজই মনে হলো।

‘আমি পুলিশ হই, কিনিথ?’ কিনিথ ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘উঁহু, আমি চাই না তোমাকে আমার দলে। তোমাকে নিয়ে কোনো লাভ হবে না আমার

‘বন্ধু বানানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে বন্ধু হওয়া!’ বারবার নিজেকে বলতে থাকে সে। ‘আগে কেন এটা মাথায় এল না?’

পরদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর বেশ উত্তেজনা অনুভব করল লিন্ডা। দ্রুত রওনা দিয়ে সময় থাকতেই পৌঁছে গেল। যাওয়ার পথে দেখা হলো বিলি আর জনের সঙ্গে। বিলি তার নতুন বিড়ালের কথা বলছিল জনকে। দুজনের কেউই লিন্ডাকে খেয়াল করল না।

‘জানিস, আমার বিড়ালছানাটা বইয়ের আলমারি বেয়ে ওপরে উঠে গিয়েছিল। সেখানে মা গোল্ডফিশের পাত্রটা রাখেন—বিড়ালটা মাছটাকে ধরার জন্য তার একটা পা ঢুকিয়ে দিয়েছিল পাত্রের ভেতর!’ বলল বিলি। লিন্ডা বিলির পাশে হাঁটছিল শুনতে শুনতে।

‘বলো তো তোমার বিড়ালছানাটা আর কী কী দুষ্টুমি করে?’ বিলিকে জিেজ্ঞস করল লিন্ডা। বিলি অবাক হয়ে লিন্ডার দিকে তাকাল। তারপর জিজ্ঞেস করে, ‘বিড়ালছানা ভালো লাগে তোমার?’

‘অনেক ভালো লাগে,’ বলল লিন্ডা, ‘বলো না তোমার বিড়ালটা আর কী কী দুষ্টুমি করে?’ বিড়াল নিয়ে গল্প করতে কখনো ক্লান্ত হয় না বিলি। স্কুলে যাওয়ার পথে সে তার বিড়ালের নানা কুকীর্তির কথা বলে গেল লিন্ডাকে। লিন্ডাও শুনল।

‘একদিন এসে তুমি আমার বিড়ালটা দেখে যেয়ো,’ স্কুলের গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বলে বিলি, ‘এখনো নাম দেওয়া হয়নি ওর। নামের ব্যাপারে তুমিও সাহায্য করতে পারো! বিকেলে চা খাওয়ার পর এসো, ঠিক আছে?’

খুশিতে গদগদ হয়ে উঠল লিন্ডা। জীবনে এই প্রথমবার কেউ তাকে বলল, ‘এসে দেখে যেয়ো।’ লিন্ডা বলল, ‘অবশ্যই, আসলে আমারও খুব ভালো লাগবে।’

সবাই যখন ক্লাসরুমে নিজেদের ব্যাগ-ট্যাগ খুলে রাখছিল, তখন হাঁপাতে হাঁপাতে এসে ঢুকল মার্জারি—আবারও দেরি করে এসেছে অগোছালো মেয়েটা। এসেই বেঞ্চের ওপর ছুড়ে মারল ওর ব্যাগ—সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগটা খুলে ওর পেনসিল, রুলার, কলম, বই—সবকিছু বেরিয়ে পড়ে গেল মেঝেতে। ঝুঁকে ওগুলো তুলতে তুলতে মার্জারি বলে, ‘হায় রে! এখন আমার আরও লেট হবে!’

লিন্ডা তখন ছুটে গেল সাহায্য করতে। ‘আমি তুলে দিচ্ছি ওগুলো, আর তুমি ওদিকে তোমার অন্য জিনিসগুলো ঝুলিয়ে রেখে দাও। এভাবে করলে তোমার আর দেরি হবে না।’ মার্জারি বলল, ‘ওহ, অনেক অনেক ধন্যবাদ, লিন্ডা। তুমি সত্যিই খুব ভালো!’

খানিকক্ষণের জন্য লাল হয়ে গেল লিন্ডার ফরসা মুখটা। লিন্ডা হয়তো সত্যি সত্যি খুব ভালো মেয়ে না, তবু মার্জারির মুখে এমন কথা শুনে বেশ খুশি হলো। মেঝেতে পড়ে যাওয়া জিনিসগুলো তুলে ব্যাগে রেখে দিল সে। তারপর হাঁটতে শুরু করল বড় হলরুমের দিকে। তখন পেছন থেকে এসে লিন্ডার বাহুর ভেতর দিয়ে নিজের বাহু গলিয়ে দিল মার্জারি। বলল, ‘তুমি না থাকলে আমার আজ অনেক দেরি হয়ে যেত!’

কেউ কখনো লিন্ডার হাতে হাত রাখেনি এমন করে। খুব ভালো লাগল ওর। সেদিন সকালে প্রথমেই ছিল ড্রয়িং ক্লাস। পানি রাখার জন্য ছোট ছোট পাত্র থাকে ড্রয়িং ক্লাসে, প্রতি ক্লাসে কেউ না কেউ সেই পাত্রগুলোতে পানি ভরে দেয়। ক্লাসের শুরুতে লিন্ডা সাহস করে তার হাত তুলে বলল, ‘মিস ব্রাউন, আমি কি পানির পাত্রগুলো ভরে দিতে পারি?’ নিজের কণ্ঠ শুনে ওর নিজেরই ভয় লাগল।

‘ধন্যবাদ লিন্ডা, অবশ্যই করতে পারো,’ মিস ব্রাউন বললেন সঙ্গে সঙ্গে। লিন্ডা একটা ছোট জগ পানি দিয়ে ভর্তি করল, তারপর এক ফোঁটাও পড়তে না দিয়ে ভরল ছোট পাত্রগুলো। ক্লাসের জন্য একটা কাজ করতে পেরে বেশ আনন্দ হলো লিন্ডার। আগে কখনো এমন কাজ করার জন্য অনুরোধ করেনি সে। ‘বেশ ভালোই এগোচ্ছি আমি,’ লিন্ডা ভাবে, ‘আমি যতটা কঠিন ভাবছিলাম, ব্যাপারটা আসলে ততটা কঠিন নয়।’ কিন্তু এরপর যা হলো, তা লিন্ডার জন্য মোটেই সহজ ছিল না।

তখন দুপুর, স্কুলে টিফিন ব্রেক চলছে। বাচ্চারা সবাই মিলে চোর-পুলিশ খেলবে। কিনিথ ছিল পুলিশের প্রধান, সে যাদের তার দলে চায়, তাদের নাম ডেকে নিল। েমরি ছিল ডাকাত সরদার। লিন্ডা উৎসুক হয়ে বলে, ‘আমি পুলিশ হই, কিনিথ?’ কিনিথ ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘উঁহু, তোমাকে আমার দলে চাই না। তোমাকে নিয়ে কোনো লাভ নেই।’ লিন্ডার মুখটা লাল হয়ে গেল, নিজেকে খুব ছোট মনে হলো ওর। এবার মেরির কাছে গেল সে। ‘আমাকে নেবে তোমার দলে?’ লিন্ডা জিজ্ঞেস করে মেরিকে। ‘দরকার নেই আমার। তুমি খেলাধুলায় একটুও ভালো না।’

বেশ কষ্টের ছিল ব্যাপারটা। লিন্ডা ভাবে, ‘কিন্তু এটা আসলে আমারই দোষ, আমি তো আগে কখনো খেলতে চাইনি।’ সে দাঁড়িয়ে থেকে ওদের খেলা দেখতে লাগল। কী মজা করে খেলছে ওরা! চোরদের একজন লিন্ডার সামনে দিয়ে খুব জোরে ছুটে গেল। ওটা জোয়ান।

একটু দূর যেতেই কিছু একটাতে আটকে গেল জোয়ানের পা। হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল সে। লিন্ডা এগিয়ে গেল জোয়ানের কাছে। ‘আহা, তুমি তো হাঁটুতে খুব ব্যথা পেয়েছ,’ লিন্ডা বলল, ‘চলো আমার সঙ্গে, ধুয়ে দিচ্ছি।’ ব্যথায় কাঁদতে শুরু করেছে জোয়ান। লিন্ডার কাঁধে হাত রেখে কিছুটা স্বস্তি পেল সে। ক্লকরুমে গিয়ে ওর হাঁটুটা পানি দিয়ে ধুয়ে দিল লিন্ডা। জোয়ানকে জিজ্ঞেস করল, ‘রুমাল আছে তোমার কাছে?’

‘না, হারিয়ে ফেলেছি রুমালটা।’

‘ঠিক আছে, আমারটা দিচ্ছি তোমাকে,’ লিন্ডা বলল, ‘এই রুমালটা আমার খুব প্রিয়, কিন্তু সমস্যা নেই!’ রুমাল দিয়ে জোয়ানের হাঁটুটা ব্যান্ডেজ করে দিল সে।

‘মায়ের ঝাড়ি থেকে বাঁচালে তুমি আমাকে!’ স্কার্ফটা গলায় পরতে পরতে বলল জন, ‘তুমি যে এত ভালো, সেটা জানতাম না লিন্ডা! আমার সঙ্গে আজ বিকেলে নেচার র৵াম্বলে চলো না, দুজন একসঙ্গে হেঁটে যাই?’

‘তুমি যে এত দয়ালু আর ভালো, সেটা তো আগে জানতাম না, লিন্ডা,’ জোয়ান অবাক হয়ে বলে, ‘ধন্যবাদ তোমাকে। তোমার রুমালটা শিগগিরই ধুয়ে পরিষ্কার করে ফেরত দেব। এখন তো আর চোর-পুলিশ খেলতে পারব না। চলো, দুজনে মিলে বাগানে গিয়ে সহজ কোনো খেলা খেলি।’

ওরা দুজনে মিলে খেলল কিছুক্ষণ। ঘণ্টা পড়ার পর লিন্ডার হাতটা ধরে জোয়ান বলল, ‘কাল আমার সঙ্গে চা খেতে আসবে লিন্ডা?’

লিন্ডার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

‘হ্যাঁ অবশ্যই! ধন্যবাদ তোমাকে!’

স্কুলের পুরোটা সময় খুব আনন্দে কাটল লিন্ডার। ছুটির পর সবাই নিজেদের কোট আর হ্যাট আনতে গেল ক্লকরুমে। লিন্ডা খুব আশা করছিল কেউ না কেউ যাওয়ার পথে সঙ্গ দেবে তাকে। কাউকে জিজ্ঞেস করতেও কেমন কেমন লাগছিল ওর, কারণ সবারই প্রিয় বন্ধু আছে। যথারীতি কেউ তাকে বলল না একসঙ্গে হেঁটে বাড়ি যাওয়ার কথা। লিন্ডার খুব মন খারাপ হলো।

‘যা–ই হোক, একসঙ্গে সবকিছু তো আর পাব না আমি।’ নিজেকে সান্ত্বনা দেয় লিন্ডা। বাড়ি ফেরার পথ ধরতে যাচ্ছিল সে, এমন সময় জন দৌড়ে ফিরে এল।

‘লিন্ডা, তুমি আমার স্কার্ফটা দেখেছ? মা বলেছে ওটা হারিয়ে ফেললে খুব খারাপ হবে, আর আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম স্কার্ফটা নিতে।’

‘না তো, চোখে পড়েনি আমার,’ বলে চলে যাচ্ছিল লিন্ডা, হঠাৎ সে খেয়াল করল জন সত্যিই ভারি চিন্তিত। থেমে গেল সে। ‘তুমি চাইলে স্কার্ফটা খুঁজতে সাহায্য করতে পারি তোমায়, দুজনে মিলে খুঁজলে কিন্তু তাড়াতাড়ি পাওয়া যাবে।’

‘ওহ, খুবই ভালো হবে, অনেক ধন্যবাদ লিন্ডা!’

ওরা দুজনে মিলে স্কার্ফটা খোঁজা শুরু করল। অনেক খোঁজাখুঁজির পর স্কার্ফটা খুঁজে পেল লিন্ডা। ওটা অন্য একজনের ব্যাগের মধ্যে ঝোলানো ছিল। জন ভীষণ খুশি হলো স্কার্ফটা পেয়ে।

‘মায়ের ঝাড়ি থেকে আমাকে বাঁচালে তুমি!’ স্কার্ফটা গলায় পরতে পরতে বলল জন, ‘তুমি যে এত ভালো, সেটা জানতাম না লিন্ডা! আমার সঙ্গে আজ বিকেলে নেচার র৵াম্বলে চলো না, দুজন একসঙ্গে হেঁটে যাই?’

উৎফুল্ল হয়ে বাড়ি ফিরল লিন্ডা। বিকেলের চায়ের পর সে যাচ্ছে বিলির বিড়ালছানা দেখতে। জনের সঙ্গে হাঁটতে যাচ্ছে। পরদিন বোধ হয় জোয়ানের সঙ্গেও চা খেতে যাবে! লিন্ডাকে এমন খুশি খুশি দেখে বেশ অবাক হলেন তার মা। লিন্ডা সাধারণত খুব সিরিয়াস আর গম্ভীর হয়ে থাকে।

‘মা! আমি কি তোমাকে ডিনারের প্লেট সাজাতে সাহায্য করতে পারি?’ লিন্ডা বলল। সে এখন সবাইকে সাহায্য করতে চায় খুশিমনে।

‘আমার লক্ষ্মী মিষ্টি মেয়ে! মাকে সাহায্য করতে চাইছ!’ মা কিছুটা বিস্মিত, ‘হ্যাঁ, তাহলে এবার প্লেট আর গ্লাসগুলো সাবধানে নিয়ে এসো, কেমন?’ ডিনার করতে করতে লিন্ডা ওর স্কুলের ছেলেমেয়েদের কথা ভাবে। যাক, ওরা সত্যিই খুব ভালো আর বন্ধুবৎসল। মিস ব্রাউন ঠিক বলেছিলেন। সে তার মায়ের দিকে তাকাল, আর তখনই মাথার মধ্যে এল দারুণ একটা আইডিয়া।

‘মা! আচ্ছা, আমি কি আমাদের বাসায় কিছুদিন পর একটা পার্টি দিতে পারি? জন্মদিনে পাওয়া কিছু টাকা এখনো বাকি রয়ে গেছে। আমি সবার জন্য বেলুন কিনতে পারি...আর কিছু চিপস, যদি তুমি টাকাটা দাও...’

লিন্ডার মা এবার রীতিমতো হতবাক হয়ে গেলেন! লিন্ডা সব সময় বলে ওর কোনো বন্ধু নেই, ও পার্টি দিতে চায় না—আর এখন সে পার্টির জন্য অনুরোধ করছে মাকে! ‘অবশ্যই তুমি একটা পার্টির আয়োজন করতে পারো মামণি,’ তিনি বললেন, ‘বেলুন আর চিপস কিনলে খুবই ভালো হবে। আমি কেক আর মিষ্টি কিনে আনব, লেমোনেডও বানিয়ে দেব।’

‘আমি আজ বিকেলেই গিয়ে ওদের পার্টির নিমন্ত্রণ দেব!’

কথামতো লিন্ডা সবাইকে পার্টিতে আসার আমন্ত্রণ জানাতে যায়। সবাই-ই কিছুটা অবাক হয়, আবার খুশিও হয় দাওয়াত পেয়ে। ছেলেমেয়েরা পার্টি খুব ভালোবাসে, আর লিন্ডার বাসায় আগে কখনো পার্টিতে যায়নি কেউ।

হিলারি বলল, ‘আমার খুবই ভালো লাগবে তোমার পার্টিতে যেতে। অনেক ধন্যবাদ লিন্ডা!’ রবার্ট বলল, ‘আমিও আসব! আর হ্যাঁ, তোমাকেও কিন্তু আমার পার্টিতে আসতে হবে। ২৩ তারিখে, মনে থাকে যেন!’ মার্জারি বলল, ‘আমি অবশ্যই তোমার পার্টিতে যোগ দেব। আর আমার বার্থডে পার্টিতেও কিন্তু আসতেই হবে তোমায়!’

একটু থেমে ও যোগ করে, ‘লিন্ডা, এই কদিনে তোমাকে সত্যিই অন্য রকম মানুষ মনে হচ্ছে; অন্য যে কারও চেয়ে অনেক ভালো মানুষ!’

লিন্ডা মিস ব্রাউনকেও পার্টির নিমন্ত্রণ দিল। মিস ব্রাউন ছোট্ট মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। ‘আমি অবশ্যই আসব লিন্ডা। তুমি তোমার সব বন্ধুকে বেলুন আর চিপস দিচ্ছ, আনন্দ করছ—দেখতে খুবই ভালো লাগবে আমার। এখন কেমন লাগছে এতগুলো বন্ধু পেয়ে?’

লিন্ডা মিস ব্রাউনের হাতে হাত গলিয়ে বলে, ‘অসাধারণ! আর এটা খুব কঠিন কিছুও ছিল না, মিস ব্রাউন। আমি খুব, খুব খুশি যে আপনি আমাকে বলে দিয়েছিলেন, কী করতে হবে। ভাগ্যিস!’

আজ লিন্ডার প্রথম পার্টি। সে তার জমানো টাকার সবটুকু দিয়ে রঙিন বেলুন, দুই বক্স চিপস, আর সবার জন্য একটা করে ছোট্ট উপহার কিনেছে, এমনকি মিস ব্রাউনের জন্যও। লিন্ডাকে যদি দেখতে তখন! নীলরঙা পার্টি ফ্রকটা পরে সে দাঁড়িয়ে আছে দরজার পাশে, কী সুন্দর করে স্বাগত জানাচ্ছে তার বন্ধুদের। ‘এখন ওরা সবাই আমার বন্ধু!’ লিন্ডা ভাবে, ‘ইশ্‌, যদি সবাইকে বলতে পারতাম যে বন্ধু বানানোর সবচেয়ে সহজ উপায়টা হচ্ছে বন্ধু হওয়া! সবাইকে জানাতে পারলে কী যে ভালো হতো...’

আচ্ছা, এখন ওর হয়ে আমি তো সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছি, ঠিক না? আইডিয়াটা ফার্স্ট ক্লাস না, বলো তো?

লেখক: শিক্ষার্থী, দ্বাদশ শ্রেণি, নটর ডেম কলেজ, ঢাকাএনিড ব্লাইটন

এনিড ব্লাইটন বিখ্যাত ব্রিটিশ লেখক এনিড ব্লাইটনের জন্ম ১৮৯৭ সালের ১১ আগস্ট। শিশু–কিশোরদের জন্য লিখেছেন ছয় শতাধিক বই। বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় এই লেখকের বই বিশ্বব্যাপী বিক্রি হয়েছে প্রায় ৬০০ মিলিয়নেরও বেশি কপি। ব্লাইটনের জনপ্রিয় সিরিজগুলোর মধ্যে ফেমাস ফাইভ, নোবডি, সিক্রেট সেভেন অন্যতম। ১৯৬৮ সালের ২৮ নভেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। এখনো তাঁর বইগুলো রাঙিয়ে যাচ্ছে শিশু–কিশোরদের কল্পনার জগৎ।