ম্যাজিশিয়ান হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদ তখন ঢাকা কলেজে পড়েন, সম্ভবত ফার্স্ট ইয়ারে। থাকেন ঢাকা কলেজের হোস্টেলে। আর আমরা তখন থাকি বগুড়ায়, মফস্বল শহরে। তখন ঢাকা থাকা মানে যেন আমেরিকা–লন্ডনে থাকা, অন্তত আমার তা–ই মনে হতো। তো প্রথমবার িতনি ছুটিতে ঢাকা থেকে বাড়ি আসছেন। আমি আর মেজ ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল গেলাম স্টেশনে, তাঁকে রিসিভ করতে। তিনি ট্রেনে আসবেন, চিঠি লিখে জানিয়েছেন। যথাসময়ে ঢাকা থেকে মেইল ট্রেন বগুড়া স্টেশনে থামল। আমরা দুজন তাঁকে খুঁজতে লাগলাম। হঠাৎ একটা কম্পার্টমেন্টে দেখি তাঁকে, কালো একটা কোট পরা দাদাভাই (আমরা ছোট ভাইবোনেরা তাঁকে দাদাভাই ডাকতাম)। খুবই গম্ভীর। বিশাল একটা প্যাকেট হাতে করে নেমে আসছেন।

নামার পর জিজ্ঞেস করলাম, প্যাকেটে কী? বললেন, ‘বাসায় গেলেই দেখবি।’

বাসায় আসার পর হুলুস্থুল অবস্থা, যেন বিদেশফেরত কেউ এল বহুদিন পর। বিশাল সেই প্যাকেট খোলা হলো। দেখা গেল প্রমাণ সাইজের একটা ক্যারম বোর্ড। ব্যস, তারপর আর পায় কে আমাদের; সারা দিন টকাস টকাস ক্যারম খেলা চলতে লাগল। দিন নেই, রাত নেই, টকাস টকাস...টকাস। বরিক পাউডার দিয়ে বোর্ড পিচ্ছিল করে স্ট্রাইকার দিয়ে সাদা–কালো ঘুঁটি ফেলার প্রতিযোগিতা। দিন–রাত টকাস টকাস শব্দে বিরক্ত হয়ে মা ঘোষণা দিলেন, ‘খেলা বন্ধ, অনেক হয়েছে।’ ওদিকে দেখতে দেখতে দাদাভাইয়ের ছুটিও ফুরিয়ে গেল। একদিন সকালে িতনি চলেও গেলেন। যথারীতি সবার মন খারাপ।

তারপর অনেক দিন পর আবার একদিন তাঁর চিঠি এল, ছুটিতে আসছেন। আবার আমরা দুই ভাই ছুটলাম স্টেশনে। এবার অবশ্য সঙ্গে দুই বোন শিখু আর মনিও চলল তাঁকে রিসিভ করতে। বড় বোন শেফু শুধু রয়ে গেল ঘরদোর গোছাতে, আফটার অল ঢাকা থেকে বড় ভাই আসছেন। তখন কিন্তু আমরা কেউই ঢাকা যাইনি। ঢাকা তখন আমাদের কাছে বিদেশের মতো রহস্যময় এক শহর। এবারও সেই কালো কোট পরে নামলেন, গম্ভীর মুখ। হাতে মাঝারি আকারের একটা প্যাকেট। আমরা জানতে চাইলাম, প্যাকেটে কী? তাঁর সেই একই উত্তর, ‘বাসায় গেলেই দেখবি।’

জন্মদিনে এত আনন্দ করার কিছু নেই। জন্মদিন মানেই আমরা মৃত্যুর দিকে আরও একটি বছর এগিয়ে গেলাম...।
হুমায়ূন আহমেদ

বাসায় এসে সেই আগের মতো হই হই আনন্দ। প্যাকেট খোলা হলো। দেখা গেল একটা বেশ বড় রঙিন ছবিটবি আঁকা বোর্ড, কিছু ঘুঁটি, ডাইস, কিছু ছোট ছোট ঘরবাড়ি, গাড়ি। কিছু নকল টাকার সাইজের কাগজ, মানে টাকাই। ৫০০ টাকা, ১০০ টাকা আবার ১০০০ টাকার নোটও আছে। ব্যাপারটা কী? পরে িতনি বুঝিয়ে দিলেন। এটা একটা জটিল খেলা, নাম ‘মনোপলি গেম’। এটা একটা বিদেশি খেলা। এই খেলা খেলে বাড়ি–গাড়ি কেনা যায়, জমি কেনা যায়, ব্যাংক থেকে লোন নেওয়া যায়, অনেক টাকা জমিয়ে বিদেশে বেড়াতে যাওয়া যায়। অনেকই মজার খেলা। খুব শিগগির আমরা ছোটরাও বুঝে ফেললাম এই খেলা। খুবই মজার খেলা, দ্রুতই আমরা জমিজমা, বাড়ির মালিক হতে লাগলাম একের পর এক। দিন–রাত চলতে লাগল মনোপলি খেলা। যেহেতু ক্যারমের মতো টকাস টকাস শব্দ নেই, কাজেই আম্মাও কিছু বলে না। আমাদের আনন্দেরও আর শেষ নেই। প্রতিদিন সবাই চার–পাঁচটা করে গাড়ি-বাড়ির মালিক হতে লাগলাম আর জমিজমার তো কোনো হিসাব নেই; বিঘার পর বিঘা জমির মালিক হয়ে বসে আছি একেকজন। এবং দেখতে দেখতে আবারও তাঁর ছুটি ফুরিয়ে এল। আবার সবার মন খারাপ করে তিনি চলে গেলেন বিদেশে, মানে ঢাকায় আরকি।

দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায়। আবার দেখতে দেখতে তাঁর ছুটির দিন চলে এল। এবারও আমরা ছুটলাম স্টেশনে। কিন্তু কী আশ্চর্য! এবার তিনি ফিরল খালি হাতে। একেবারেই খালি হাত। গায়ে সেই কালো কোট। তবে এবার অতিরিক্ত আকর্ষণ গলায় কালো চিকন একটা টাই (আমরা ছোটরা বলতাম কুত্তার জিব্বা)। এবার মনে হলো তিনি আরও গম্ভীর। ভেতরে ভেতরে আমরা ছোটরা হতাশ। এবার তাহলে চমকে দেওয়ার মতো কিছুই নেই!

কিন্তু দেখা গেল বাসায় এসে তিনি কোট–টাই কিছুই খুলছেন না। মা কাপড়চোপড় খুলতে বলছেন, তিনি খুলছেন না, ঘটনা কী? নিশ্চয়ই কোনো রহস্য আছে। হঠাৎ কালো কোটের এক পকেট থেকে তিনি এক প্যাকেট নতুন তাস বের করলেন। আমি ভাবলাম, বোধ হয় এবার আমাদের মনোপলির বদলে তাস খেলা শেখাবেন। কিন্তু না, তিনি তাস সাফল করলেন। তারপর হঠাৎ সব তাস ফর ফর করে জোড়া লেগে গেল একটার সঙ্গে আরেকটা। যেন সাপের মতো লম্বা একটা চেইন তাঁর হাতে ছোটাছুটি করতে শুরু করেছে। আমরা হতভম্ভ। মুহূর্তে সেই তাস আবার পকেটে রেখে দিলেন। কালো কোটের আরেক পকেট থেকে বের হলো একটা ছোট্ট পিং পং বল। সেই বল তাঁর দুহাতের ১০ আঙুলে ছোটাছুটি করতে করতে একটা বল হয়ে গেল সাতটা বল। কী করে সম্ভব! মুহূর্তে সব বল অদৃশ্য হয়ে গেল আগের সেই একটা বলই রয়ে গেল তাঁর হাতে। সেটা মাটিতে দু–একটা ড্রপ খেয়ে ঢুকে গেল তাঁর পকেটে। এবার কোটের বুকপকেট থেকে বেরোল একটা বিশাল রঙিন রুমাল। আরে কী আশ্চর্য, আমাদের সবার চোখের সামনে সেই বিশাল রুমাল অদৃশ্য হয়ে গেল তাঁর হাতের তালুতে! তারপর তিনি বড় বোনকে বললেন, ‘যা তো, রান্নাঘর থেকে একটা কলা নিয়ে আয়।’ বড় বোন হুকুম পালন করলেন, কলা নিয়ে এলেন। তিনি কলা হাতে নিয়ে ছিলতে শুরু করলেন। আর কী আশ্চর্য... চাক চাক হয়ে কলা মাটিতে পড়তে লাগল!

আমরা বুঝতে পারলাম, আমাদের দাদাভাই এবার ম্যাজিশিয়ান হয়ে ফিরে এসেছেন। তাঁর কালো কোট–টাই হচ্ছে তাঁর ম্যাজিশিয়ানের ড্রেস (এই পোশাক পরে তিনি শো করতেন এবং টিভিতে একটা প্রোগ্রামও করেছিলেন। বাসায় টিভি ধার করে এনে আমরা সেই প্রোগ্রাম দেখেছিলাম পাড়ার সবাইকে নিয়ে, তখন কুমিল্লায় থাকি আমরা)। বিকেলের মধ্যে পাড়ার ছোটরা খবর পেয়ে গেল। সব এসে হাজির দাদাভাইয়ের ম্যাজিক দেখতে। আর কত রকম ম্যাজিক যে সেবার আমরা সবাই দেখলাম, তার কোনো হিসাব নেই। সবশেষে এক ছুটির দিনে বেরোল আরেক ম্যাজিক। নকল চুল আর দাড়ি। কোট–টাই পরা ম্যাজিশিয়ান মুহূর্তে হয়ে গেলেন খালি গায়ে ছেঁড়া লুঙ্গি পরে আপাদমস্তক এক ভিক্ষুক, যার বিশাল চুল আর দাড়ি–গোঁফে আসল চেহারা বোঝার কোনো উপায় নেই। একটা থালা আর ঝুলি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন ভিক্ষা করতে। আমরা পাড়ার ছোটরা চললাম তাঁর পিছু পিছু। তবে একটু দূরত্ব রেখে, কেউ যেন বুঝতে না পারে আমরা তাঁর সঙ্গে আছি। তাঁকে অবশ্য পাড়ার কেউই চিনতে পারল না। ভালোই ভিক্ষে দিল। তাঁর হঠাৎ ভিক্ষুক সাজার পেছনে নাকি তাঁর কী একটা এক্সপেরিমেন্ট ছিল। কী এক্সপেরিমেন্ট, সেটা অবশ্য আমাদের বলল না। তবে বাসায় এসে যখন মাকে ঝুলির কেজিখানেক চাল দিয়ে বললেন, ‘আম্মা এই যে ভিক্ষে করে এনেছি।’ তখন মা ভয়ানক রেগে গেলেন। যাহোক, এই হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদ, আমাদের দাদাভাই, পাড়ার ছোটরা ডাকত দাদুভাই।‌ ১৩ নভেম্বর তাঁর জন্মদিন। নিজের জন্মদিনে একবার তিনি বলেছিলেন, ‘জন্মদিনে এত আনন্দ করার কিছু নেই। জন্মদিন মানেই আমরা মৃত্যুর দিকে আরও একটি বছর এগিয়ে গেলাম...।’ সেই মৃত্যুকে অতিক্রম করার পর তাঁর আরও একটি জন্মদিন। এখন তিনি ওপারে বসে কী বলবেন তাঁর জন্মদিন নিয়ে, কে জানে!