যদি পৃথিবীতে কখনো ঋতু না বদলায়?

গ্রীষ্ম চলে গেছে। গ্রামে যারা থাকো তারা তো অনেক আগেই বুঝতে পেরেছ। খুব ভোর কিংবা সন্ধ্যা হলেই হিমহিম শীতভাব চলে আসে। কুয়াশায় আবছা হয়ে আসে চারপাশ। শহরের আবহাওয়াতেও কিন্তু খুব বেশি পরিবর্তন নেই। উত্তপ্ত গ্রীষ্মের দিন শেষে এমন শীতের দিন কিন্তু নেহাত খারাপ নয়। বরং ধোঁয়াওঠা পিঠা, মিষ্টি খেজুরের রস আর নয়নাভিরাম দৃশ্য এই শীতকে আরও উপভোগ্য করে তোলে। আবার এই ঋতু শেষে রুক্ষ গাছগুলোতে পাতা গজায়। নতুনভাবে সেজে ওঠে প্রকৃতি। কিন্তু আমাদের পরিবেশে যদি ঋতু না বদলায়? যদি সারা বছর একই ঋতু থাকে পুরো পৃথিবীতে? কী ঘটবে তাহলে?

ভূ–গোলার্ধের কাছাকাছি হওয়ায় আমাদের দেশে ঋতুর বৈচিত্র্য বেশি। পশ্চিমা দেশগুলোতে চারটি ঋতু হলেও আমাদের দেশে ঋতু ছয়টি। ঋতু পরিবর্তনে বিশেষ ভূমিকা রাখে পৃথিবীর অক্ষের হেলে থাকা। পৃথিবী সূর্যের সঙ্গে ২৩ ডিগ্রি কোণে হেলে থাকে। এ কারণে সূর্যের আলো সমানভাবে পৃথিবীর সব এলাকাতেই পৌঁছায়।

কিন্তু পৃথিবীর অক্ষ যদি সোজা থাকে, তাহলে বিষুবরেখা বরাবর সূর্যের আলো পড়বে শুধু। ফলে দুই পাশের মেরু অঞ্চলে ক্রমে ঠান্ডা বাড়তে থাকবে। তখন ঋতুর পরিবর্তন কমে আসবে। নির্ধারিত কোনো ঋতুই থাকবে সারা বছর। কিন্তু এই টানা একই ঋতু থাকার কারণে প্রাণিজগতে তৈরি হবে বিপুল পরিবর্তন।

পৃথিবীর দুই মেরু অঞ্চলের ঠান্ডার মাত্রা বাড়তে থাকলে সেসব অঞ্চলের প্রাণী বিষুবরেখার কাছাকাছি আসতে শুরু করবে। সামান্য উষ্ণতার জন্য একই এলাকায় অনেক প্রাণী অবস্থানের কারণে ঘনবসতির সৃষ্টি হবে। নানা রকম প্রাণী, মানুষ, ব্যাকটেরিয়া একই পরিবেশে অবস্থান করা শুরু করলে সাধারণ রোগব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। অনেক নির্মূল করা রোগের ভাইরাস আবার মানুষের শরীরে প্রবেশ করবে।

এরপর সবচেয়ে বড় চাপ তৈরি হবে খাদ্য উৎপাদনে। কৃষিজমির পরিমাণ কমে আসার কারণে পৃথিবীর সবার জন্য খাবার উৎপাদন করা কঠিন হয়ে পড়বে। ঋতু পরিবর্তন না হওয়ার কারণে ঋতুভেদে ভিন্ন ভিন্ন খাদ্য উৎপাদন করা সম্ভব হবে না। মানুষ ও সাধারণ প্রাণী একই সঙ্গে ছোট এলাকাতে খাবারের খোঁজ করবে।

ঋতুর পরিবর্তন না হওয়ায় সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়বে আমাদের শরীরে। সব সময় একই ঋতু থাকলে আমাদের শরীরে নানা রকম ব্যাকটেরিয়া তৈরি হবে। বেশি বা কম সূর্যের আলোর কারণে চারপাশের অনেক প্রাণঘাতী ব্যাকটেরিয়া খাবার, গাছসহ বিভিন্ন মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করবে। তখন এত মানুষের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করা আসলেও অসম্ভব হবে। সূর্যের আলোর উপস্থিতি–অনুপস্থিতি মিলিয়ে আমাদের ঘুমের সময় পরিবর্তন হবে, যা আমাদের নিয়মিত কার্যক্রমে প্রভাব ফেলবে। আমাদের ত্বকের ধরন আর চুলের রঙেও আসবে পরিবর্তন। বেশি শীতে মানুষের ত্বক হবে রুক্ষ। আবার চুলেও আসবে অমলিন ভাব। সারা বছর এমন ঠান্ডা আবহাওয়া থাকার কারণে মানুষের হৃৎপিণ্ডের ধমনি–শিরার আয়তন কমে আসবে। ফলে হৃৎপিণ্ড ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়বে, যা মানুষের গড় আয়ু কমিয়ে দিতে পারে।

সে ক্ষেত্রে মানুষের বেঁচে থাকার কৌশলটাই বদলে নিতে হবে। কেননা সারা বছর একই রকম ঋতুতে বেঁচে থাকার জন্য একই কৌশল অবলম্বন করা যাবে। এর জন্য আলাদা কোনো রসদের প্রয়োজন হবে না। তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সুবিধা হবে এটাই যে আমরা আবহাওয়া সম্পর্কে আগেই জানতে পারব। এখন ঋতুভেদে আবহাওয়ার তারতম্য হলেও তখন একই ঋতুতে সারা বছরের আবহাওয়া একই রকম থাকবে।

তবে প্রকৃতিতে এই বিশাল পরিবর্তন যে সবকিছু ভালো করবে, তা নয়। এই বৈরী আবহাওয়ায় অনেক প্রাণীই আর বাঁচতে পারবে না। আবার কিছু প্রাণী হয়তো বেঁচে থাকার জন্য নতুন কৌশল শিখে নেবে। কিন্তু তাদের পরিবর্তিত খাদ্যশৃঙ্খল মানুষের জন্য কতটা উপযোগী হবে, সেটা বোঝা কঠিন।

তাই মানুষের বেঁচে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই ঋতুর পরিবর্তন। বৃষ্টি, রোদ কিংবা ঠনঠনে কাঁপা শীত—সবটা মিলিয়েই প্রাণিজগতের টিকে থাকার আদর্শ পরিবেশ তৈরি হবে এই পৃথিবীর বুকে।

ব্রাইট সাইড অবলম্বনে