যেভাবে এল সপ্তাহ

মজার একটা প্রশ্ন দিয়ে শুরু করি। সপ্তাহে সাত দিন কেন? কেন ৮ দিন বা ১০ দিনে সপ্তাহ হয় না? সত্যি বলতে, প্রশ্নটা খানিকটা বোকার মতো হয়ে গেল। কারণ, সপ্তাহ মানেই ‘সপ্ত অহের সমাহার’। এই ‘অহ’ মানে দিন। অর্থাৎ সাত দিনের সমাহারকেই সপ্তাহ বলে। তাহলে সপ্তাহে সাত দিন না হয়ে উপায় কী?

তবে আমাদের প্রশ্নটা আরও গভীর। আমরা বুঝতে চাই, সপ্তাহ কীভাবে এল? সাতটা দিন মিলেই কেন তৈরি হলো ‘সপ্তাহ’ নামে সময়ের এককটি, ইংরেজিতে যাকে বলে উইক (Week)। মজার ব্যাপার কী জানো? বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় এই একক ৮, ৯ কিংবা ১০ দিনেরও হতো।

প্রাচীন রোমে ‘উইক’ ছিল আট দিনের। এর সাতটা দিন ছিল আমাদের মতোই, আরেক দিন নির্ধারিত ছিল বেচাকেনার জন্য—হাটবার। আট দিনের এই একককে ‘নানডাইনাল (Nundinal) সাইকেল’ বলা হতো। সাইকেল মানে চক্র, আর নানডাইনাল (রোমান nundinum থেকে এসেছে) মানে বাজার। সে জন্য ইংরেজিতে একে ‘মার্কেট উইক’ও বলা হতো। বাংলায় বলতে হবে ‘বাজার চক্র’। এখানে উইকের অর্থ সপ্তাহ না লিখে চক্র লেখার একটা কারণ, এটা সাইকেল থেকে এসেছে। আরেকটা কারণ, এটা আট দিনের সমাহার। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম অব্দে রোমান সাম্রাজ্যে সাত দিনের ব্যাপক প্রচলন হয়। তবু আরও ৩০০ বছরের বেশি টিকে ছিল এই বাজার চক্র। ৩২১ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট কনস্ট্যানটিন নতুন একটি ক্যালেন্ডার বা দিনপঞ্জি চালু করেন। ক্যালেন্ডারটি তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে সাত দিন বা সপ্তাহ একক ধরেই করেছিলেন। ফলে বিলুপ্ত হয়ে যায় বাজার চক্র। আর এর জায়গা দখল করে নেয় সপ্তাহ।

আবার আমরা আগের সেই প্রশ্নেই ফিরে এসেছি। কেন সাত দিন? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে আরও প্রাচীন পৃথিবীতে। যেখানে বিজ্ঞানের নামে রাজত্ব করত জ্যোতিষবিদ্যা।

২.

ঘটনা ঘটেছে মূলত প্রাচীন ব্যাবিলনে। সপ্তাহ, দিন–মাস গণনা, ক্যালেন্ডারের প্রচলন—এই সবকিছুই শুরু হয়েছে ব্যাবিলনীয় জ্যোতিষবিদদের হাত ধরে। হিসাব রাখার জন্য তাঁরা সূর্যের বদলে চাঁদকে ব্যবহার করতেন। কারণ, মাসের ৩০ দিন সূর্য একই রকম থাকে। কিন্তু চাঁদের আকৃতি বদলায়। কখনো একফালি চাঁদ, কখনো অর্ধগোলক কিংবা পূর্ণচন্দ্র। কখনো চাঁদহীন আকাশে নেমে আসে অমাবস্যার অন্ধকার। দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণ করে তাঁরা চাঁদের আচার-আচরণকে একটা নিয়মের মধ্যে নিয়ে এলেন।

দেখা গেল, মাসের প্রথম দিন আকাশে একফালি চাঁদ থাকে। বাড়তে বাড়তে সেটা সপ্তম দিনে অর্ধগোলকের আকৃতি নেয়। আরও সাত দিন পরে, ১৪তম দিনে দেখা যায় পূর্ণগোলক। এরপর চাঁদের আকৃতি ক্রমান্বয়ে ছোট হয়। ২১তম দিনে অর্ধগোলক হয়ে ২৮তম দিনে আবার ফিরে আসে সেই একফালি চাঁদ। তারপর কখনো এক দিন, কখনো দুই দিন আকাশে চাঁদ থাকে না। নিকষ অমাবস্যার এসব দিনকে তাঁরা অধিদিবস (Leap Day) বলতেন। চান্দ্রমাস তাই কখনো ২৯, কখনো ৩০ দিনে হয়। সে জন্যই রমজান শেষে ঈদের চাঁদ দেখা নিয়ে এত উত্তেজনা দেখা যায়।

বুঝতেই পারছ, সাত দিনের একটা চক্র এখানে স্পষ্ট। সে জন্য ব্যাবিলনীয়রা চান্দ্রমাসকে সুন্দর চার ভাগে ভাগ করে ফেললেন। প্রতিটি ভাগে পড়ল সাত দিন করে, মানে এক সপ্তাহ।

এবার একটা মজার জিনিস বলি। শুভ আর অশুভ পৃথিবীতে বরাবরই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে ছিল, আজও আছে। ব্যাবিলনীয়রা প্রতি সাত দিনের একটি দিনকে অশুভ দিবস (Eevil days) বলে জানতেন। সেই দিন সব ধরনের কাজকর্ম ছিল নিষিদ্ধ। অশুভের হাত থেকে বাঁচতে এই দিনগুলোতে তাঁরা তাঁদের বিভিন্ন দেবতার উদ্দেশে বলি দিতেন। এভাবেই ইভিল ডে বা অশুভ দিবস পরিণত হয় ‘হলি ডে’ বা শুভ দিনে।

৩.

বোঝাই যাচ্ছে, চান্দ্রমাস হিসাবের জন্য সপ্তাহ বেশ কাজের হলেও সূর্যবর্ষ গণনায় এটি ঠিক জুতসই নয়। প্রচলিত ১২ মাসের দিকে তাকালেও বোঝা যাবে, সাধারণত ৩০-৩১ দিনে এসব মাস হিসাব করা হয়। তাহলে সপ্তাহের ধারণা পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল কীভাবে?

ব্যাবিলনীয়রা সপ্তাহের প্রচলন করেন খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শতাব্দীর দিকে। তাঁদের জ্ঞান-গুণ ছড়িয়ে পড়েছিল প্রাচ্যের সবখানে। ফলে প্রাচ্যের অনেকটা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে সপ্তাহ গণনা। কাছাকাছি থাকা পারস্য ও গ্রিসের অধিবাসীরাও মেনে নেয় এই হিসাব।

এদিকে ইহুদিরা দীর্ঘদিন ব্যাবিলনীয়দের দাস হিসেবে ছিল। ফলে তারাও সপ্তাহের ধারণা মেনে নিতে বাধ্য হয়। ব্যাবিলনীয় সভ্যতার পতনের পর একটা দীর্ঘ সময় মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ড এই ইহুদিরাই শাসন করে।

কয়েক শতাব্দী পরে পৃথিবীতে এলেন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট। তিনি সেই গ্রিস থেকে ভারত পর্যন্ত জয় করে নেন, ছড়িয়ে দেন গ্রিক সংস্কৃতি। এভাবেই ভারতে চলে এল সপ্তাহ। আর বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগের মাধ্যমে এ ধারণা ছড়িয়ে পড়ল চীনে।

আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের পর গ্রিক সভ্যতার জায়গা দখল করে নেয় রোমান সভ্যতা। আগেই বলেছি, ৩২১ খ্রিষ্টাব্দে তারা সাত দিনের এই হিসাব মেনেই ক্যালেন্ডার প্রচলন করেছিল। পুরো মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ যখন রোমান সাম্রাজ্যের অধীন চলে এল, ছড়িয়ে পড়ল সপ্তাহের ধারণাও। এভাবেই পূর্ব থেকে পশ্চিমে, পৃথিবীর দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে সপ্তাহের ধারণা।

তথ্যসূত্র: ডিসকভার ম্যাগাজিন