রেলগাড়ি ঝমাঝম

অলংকরণ: মাহাতাব রশীদ

এক

লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে ট্রেনটা ছাড়ল যথাসময়েই। ইদানীং আমেরিকান ট্রেনের সেই রমরমা অবস্থা আর নেই, লোকজন চড়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছে—পুরো ট্রেনই ফাঁকা ফাঁকা দেখা গেল। ডা. গ্যারি পার্কারকে ঠিক রেলগাড়ির ভক্ত বলা যাবে না, তিনি টিকিট কেটেছেন ঠেকায় পড়ে। নইলে কোন পাগল চার-পাঁচ হাজার মাইল ট্রেনে পাড়ি দেয়? কিন্তু করার কিছু নেই। সামনে স্বাধীনতা দিবসের সরকারি ছুটি। বাড়ি-ফিরতি লোকজন সারা দেশে ছোটাছুটি করছে, সামনের এক সপ্তাহের মধ্যে প্লেনের কোনো টিকিটই নেই। অগত্যা ডেনভার যেতে হলে কলোরাডো এক্সপ্রেসই ভরসা।

ডা. পার্কারের সঙ্গে যাচ্ছেন তাঁর স্ত্রী—দুজনই ডেনভারে একটা মেডিকেল কনভেনশনে যোগ দিতে যাচ্ছেন। বাবা-মায়ের সঙ্গে যাচ্ছে জিমি পার্কার আর ওর বন্ধু অয়ন হোসেন। অয়ন অবশ্য শেষ মুহূর্তের যাত্রী। ডেনভার যাওয়ার ব্যাপারে ওর বিশেষ আগ্রহ ছিল না, তবে ট্রেনে যাওয়া হচ্ছে শুনে লাফিয়ে উঠেছে। এত লম্বা রেল জার্নি আগে কখনো করেনি ও, অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্যই আসা। কথাটা অবশ্য জিমির বেলায়ও খাটে।

ট্রেনটা বিশাল, দোতলা। একতলায় টয়লেট, মালপত্র রাখার জায়গা। দোতলায় থাকার ব্যবস্থা। ট্রেনের দুটো বিশাল কম্পার্টমেন্ট হলো অবজারভেশন ডেক। পুরো দেয়াল কাচের, ভেতরে রিভলভিং চেয়ার। সেখানে বসে চারপাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে যাওয়া যায়।

স্লিপিং কারের দুটো কেবিন পেয়েছে ওরা। একটাতে পারকার দম্পতি, অন্যটায় দুই বন্ধু উঠেছে। সে–ও হুলুস্থুল ব্যাপার। নরম গদিমোড়া বাঙ্ক, কার্পেট, অ্যাটাচড্ বাথরুম...এমনকি ছোট একটা টিভিও আছে। আরাম-আয়েশের চূড়ান্ত যাকে বলে।

‘ওয়াও!’ পোর্টারের পিছু পিছু কেবিনে ঢুকে বিস্ময়সূচক শব্দ করল অয়ন। ‘এ দেখছি এলাহি কারবার!’

‘ঠিকই বলেছিস,’ লাফ দিয়ে সিটে বসল জিমি। ‘দারুণ ব্যবস্থা!’

এ সময় দরজা খুলে উঁকি দিলেন ডা. পার্কার। পোর্টারকে বকশিশ দিয়ে বিদায় করলেন। তারপর ওদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘সব ঠিক তো? থাকার ব্যবস্থা পছন্দ হয়েছে?’

‘খুব হয়েছে!’ বলল অয়ন। ‘রীতিমতো চমৎকার।’

‘যা-ই বলো, বাবা,’ জিমি বলল, ‘ট্রেন জার্নির আইডিয়াটা কিন্তু দারুণ!’

‘হুঁ,’ বললেন ডা. পার্কার। ‘মাঝখান থেকে কটা দিন নষ্ট হলো আর কী! প্লেনে গেলে এক দিনেই পৌঁছে যেতাম, সেখানে চার দিন এই ট্রেনে বন্দী হয়ে থাকতে হচ্ছে।’

‘ভালো দিকটা দেখুন, আঙ্কেল।’ যুক্তি দেখাল অয়ন। ‘কলোরাডো এক্সপ্রেস অ্যামট্র্যাকের সবচেয়ে বড় ট্রেনগুলোর একটা। এটাতে চড়ার সুযোগ হলো, তা ছাড়া অনেকগুলো স্টেট দেখতে দেখতে যাব। রকি পর্বতমালা দেখতে পাব, নেভাদা রেঞ্জ দেখতে পাব, লবণ হ্রদ, কলোরাডো নদী...প্লেনে গেলে তো এই সুযোগ পাওয়া যায় না।’

‘আমার জন্য এসব নতুন নয়, অয়ন। আগে প্রচুর ট্রেন জার্নি করেছি...বিশেষ করে ছাত্রাবস্থায়। আহ্, কী সেসব দিন!’ উদাস হয়ে গেলেন ডা. পার্কার। ‘কতই–বা বয়স তখন আমার। মেডিকেলে মাত্র ঢুকেছি। ভীষণ ঘোরাঘুরি করতাম। তোমাদের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। ভালো কথা, অ্যামট্র্যাকের ইতিহাস জানো?’

‘আমি জানি, আঙ্কেল।’ চটপট বলল অয়ন।

‘হায় হায়!’ আঁতকে উঠল জিমি। ‘অয়ন, তোর পায়ে পড়ি, এখানে লেকচার শুরু করিস না।’

‘দূর, জিমি!’ তিরস্কার করলেন ডা. পার্কার। ‘ভালো ভালো ব্যাপারে তোমার একদমই আগ্রহ নেই। দেখিই না, অয়ন কতটুকু জানে!’

‘হ্যাঁ,’ শুরু করল অয়ন। ‘অ্যামট্র্যাক হচ্ছে ন্যাশনাল রেলরোড প্যাসেঞ্জার করপোরেশনের ডাকনাম। ১৯৭০ সালে কংগ্রেস এটা গঠন করে, সার্ভিস শুরু হয় ১৯৭১ থেকে। একসময় রেলপথই ছিল আমেরিকার প্রধান যোগাযোগব্যবস্থা। কিন্তু সড়কপথের উন্নতি, সেই সঙ্গে আকাশপথ চালু হওয়ায় রেলওয়ে মার খেয়ে যায়। প্রাইভেট কোম্পানিগুলো ব্যবসা গুটিয়ে সরে পড়ছিল, শেষ পর্যন্ত রেলপথে যাত্রী পরিবহন চালু রাখার জন্য সরকার অ্যামট্র্যাক চালু করে।’

‘কিন্তু রেলপথে তো শুধু যাত্রী নয়, মালামালও বহন করা হয়।’ প্রতিবাদ করল জিমি।

‘খুব কম,’ বলল অয়ন। ‘ট্রাক সার্ভিসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সেদিক থেকেও সুবিধা করতে পারছে না রেলওয়ে। শুধু কিছু পরিমাণ কয়লা, খাদ্যশস্য, কেমিক্যাল আর মোটরগাড়ি ট্রেনে বহন করা হয়, বাকি সব সড়কপথে। ট্রেন এখন বলতে গেলে পুরোপুরিই যাত্রী-পরিবহনব্যবস্থা। জানিস কি না, জানি না, অ্যামট্র্যাক পুরো দেশে প্রায় ২৪ হাজার মাইল দীর্ঘ রেলপথ অপারেট করছে, সার্ভিস দিচ্ছে পাঁচ শরও বেশি স্টেশনে।’

‘হয়েছে, এত লম্বা-চওড়া বক্তৃতা না দিলেও চলবে।’ হাত নেড়ে বলল জিমি। ‘তোর এসব জ্ঞানী জ্ঞানী কথাবার্তা অসহ্য লাগছে।’

‘যা-ই বলো।’ হাসলেন ডা. পার্কার। ‘অয়ন কিন্তু অনেক কিছু জানে। তুমিও একটু পড়াশোনা করলে পারো।’

‘খেয়েদেয়ে তো আর কাজ নেই! অ্যামট্র্যাকের ওপর ওর থিসিস করার ইচ্ছে থাকতে পারে। আমার নেই। অয়ন, একটু চেষ্টাচরিত্র কর—পিএইচডি একটা পেয়েও যেতে পারিস।’

‘কী বললি?’ চোখ রাঙিয়ে বলল অয়ন।

‘থাক থাক, ঝগড়াঝাঁটির দরকার নেই।’ তাড়াতাড়ি বললেন ডা. পার্কার। ‘আমি যাচ্ছি। খাবারের সময় দেখা হবে। ভালো কথা, জিমি, তোমাদের টিকিট সঙ্গে আছে তো?’

পকেট চাপড়ে জিমি জানাল, ‘আছে, বাবা।’

‘গুড। টিকিট চেকার এলে দেখিয়ে দিয়ো।’

‘আচ্ছা।’

চলে গেলেন ডা. পার্কার। সিটে কাত হয়ে অয়ন বলল, ‘আমার ভীষণ মজা লাগছে। অ্যাই জিমি, একটা ছড়া শুনবি?’

‘ছড়া!’ জিমি অবাক! ‘কী ছড়া?’

সুর করে অয়ন বলল:

‘রেলগাড়ি ঝমাঝম

পা পিছলে আলুর দম...’

‘এ আবার কেমন ছড়া?’ বিরক্ত গলায় বলল জিমি। ‘মানে কী এর?’

‘কোনো মানে নেই। এটা একটা ননসেন্স রাইম। চলন্ত ট্রেনের ছন্দের সঙ্গে মিল রেখে তৈরি করা। তুইও মিলটা ধরতে পারবি। একটু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ কর।’

খানিকক্ষণ চুপচাপ রইল জিমি। তারপর খুশি খুশি গলায় বলল, ‘তাই তো! ভারি মজার ব্যাপার দেখছি। কোথায় পেয়েছিস এ ছড়া, অয়ন?’

‘বাবার কাছে শুনেছি। তাঁর বাংলাদেশি ছড়ার স্টক অফুরন্ত। শুনলেই কেবল দেশে যেতে ইচ্ছে করে।’

‘একবার গেলেই পারিস!’

‘যাব, নিশ্চয়ই যাব। আপাতত এ দেশটাকে তো দেখে নিই!’

‘হুঁ, মনে হচ্ছে সামনের চারটা দিন বেশ ভালোই কাটবে।’

‘আরও ভালো হতো, যদি একটা রহস্য পেয়ে যেতাম।’ আশার সুরে বলল অয়ন।

‘আহ্! দিবাস্বপ্ন আর কাকে বলে?’ মুখ ভেংচাল জিমি। ‘রহস্য...তা–ও কিনা এই ট্রেনের ভেতরে?’

‘দিবাস্বপ্ন নয় রে গাধা, এটা হলো উইশফুল থিংকিং।’

‘উঁহু, এ হলো ফুলিশ থিংকিং—বেকুবের চিন্তা।’

‘আমাকে বেকুব বলছিস?’

‘নয়তো কাকে?’

‘তবে রে...’ অয়ন ঝাঁপিয়ে পড়ল জিমির ওপরে।

অবশ্য ঝগড়াঝাঁটি-মারামারি যা-ই করুক, অয়নের ইচ্ছেটা যে খুব শিগগির বাস্তবে পরিণত হবে, সেটা ওদের কেউই ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি।

দুই

সান ফ্রান্সিসকোতে ট্রেন থামল আধা ঘণ্টার জন্য। সেখানকার অনেক যাত্রীর সঙ্গে একজন ভদ্রমহিলা উঠলেন। জিমির মায়ের মতোই তাঁর বয়স, পরনে দামি একটা মিঙ্ক কোট। মাথার টুপি, কানের দুল—সবকিছুতেই রুচির ছাপ মেলে, ভদ্রমহিলা দেখতেও ভারি সুন্দরী বটে। লোকজন ঘাড় ফিরিয়ে বারবার দেখছিল তাঁকে।

ভদ্রমহিলার সব লাগেজ নিয়ে পোর্টার স্লিপিং কারে উঠল, তিনি কন্ডাক্টরের হাতে তাঁর টিকিটটা তুলে দিলেন।

‘৭ নম্বর কেবিন।’ বলল কন্ডাক্টর। ‘এই দিকে, ম্যাডাম। আমার সঙ্গে আসুন।’

পথ দেখিয়ে নির্দিষ্ট কেবিনে পৌঁছে দেওয়া হলো তাঁকে। পোর্টারকে বকশিশ দিয়ে বিদায় করলেন তিনি। টেবিলের ওপর হাত থেকে ছোট জুয়েলারি বক্সটা নামিয়ে রাখলেন। জিনিসটা সারাক্ষণ আগলে রেখেছেন তিনি। একটু পরেই ট্রেন ছেড়ে দিল। জানালার পাশ থেকে কোলাহলরত প্ল্যাটফর্ম অদৃশ্য হয়ে গেল।

হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলেন ভদ্রমহিলা, তাঁকে দেখে দুশ্চিন্তায় আছেন বলে মনে হচ্ছে। সিটে বসে জানালা দিয়ে উদাস নয়নে বাইরে তাকিয়ে রইলেন তিনি। একটু পরে ডিনারের সময় হয়ে গেল। জুয়েলারি বক্সটা হাতে নিয়ে ডাইনিং কারের দিকে রওনা হলেন তিনি।

খেতে বসেছিল অয়নরা। হালকা গল্প-গুজবের মধ্যে খাওয়াদাওয়া চলছে, এমন সময় সেখানে হাজির হলেন ভদ্রমহিলা। ওদের পেরিয়ে প্রায় চলেই যাচ্ছিলেন, কিন্তু জিমির মাকে দেখে থমকে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘আরে! ক্যাথারিন না?’

বিস্মিত হয়ে চোখ তুললেন মিসেস পার্কার; পরমুহূর্তে তাঁর মুখও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। উচ্ছ্বসিত গলায় বললেন, ‘ডেইজি, তুই!’

খুশিতে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরলেন দুজনে। প্রাথমিক উচ্ছ্বাসটা কেটে যেতেই সামলে উঠলেন মিসেস পার্কার। তারপর পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘গ্যারি, এ হচ্ছে আমার স্কুলজীবনের বান্ধবী ডেইজি হকিন্স।’

‘মিসেস ডেইজি হকিন্স মুনরো।’ শুধরে দিলেন ভদ্রমহিলা। ‘আমার স্বামী হেক্টর মুনরো নামকরা ব্যবসায়ী, নাম শুনে থাকবি হয়তো।’

‘তুই বিয়েও করেছিস জানতামই না!’

‘জানবি কী করে, কত দিন যোগাযোগ নেই!’ অয়ন-জিমিকে দেখালেন মিসেস মুনরো। ‘এই বাচ্চা দুটো কার, তোর?’

‘বাঁ পাশেরটা আমার জিমি।’ জানালেন মিসেস পার্কার। ‘আর এ হলো অয়ন। জিমির বন্ধু। অ্যাই বাচ্চারা, জায়গা ছাড়ো। তোমাদের আন্টিকে বসতে দাও।’

তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল অয়ন আর জিমি। খালি জায়গায় বসলেন মিসেস মুনরো, জুয়েলারি বক্সটা নামিয়ে রাখলেন টেবিলের ওপর।

‘তারপর।’ বললেন তিনি, ‘কোথায় যাচ্ছিস তোরা?’

‘ডেনভারে।’ জবাব দিলেন মিসেস পার্কার, ‘ডাক্তারদের একটা সম্মেলনে যোগ দিতে।’

‘হ্যাঁ, শুনেছি তুই বিরাট ডাক্তার হয়ে গেছিস। আছিস কোথায়?’

‘লস অ্যাঞ্জেলেসে। তোর খবর বল। একা দেখছি...তোর হাজব্যান্ড আর বাচ্চাকাচ্চা কোথায়?’

‘আমার আর কী খবর? সান ফ্রান্সিসকোতে সেটেল করেছি, ছেলেপুলে হয়নি। আর হেক্টর তো ভীষণ ব্যস্ত, সারা দেশে চরকির মতো ঘুরে বেড়ায়। এই মুহূর্তে সল্ট লেক সিটিতে আছে, আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে। সে জন্যই যাচ্ছি।’

‘সুখেই আছিস তাহলে?’

‘সুখ?’ হঠাৎ বিষণ্ন হয়ে গেলেন মিসেস মুনরো। ‘গত সপ্তাহ পর্যন্ত ছিলাম বটে। কিন্তু...’

‘কিন্তু কী?’ ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলেন মিসেস পার্কার।

‘একটা ঘটনা ঘটেছে।’ ইতস্তত করে বললেন মিসেস মুনরো। ‘ব্যাপারটা কাউকে বলতেও পারছি না, এদিকে আমার নাওয়া-খাওয়া সব মাথায় উঠেছে। তুই আমাকে সাহায্য করতে পারিস, ক্যাথি?’

‘কী হয়েছে, বলবি তো!’

এতক্ষণ হেলাফেলায় দাঁড়িয়ে ছিল অয়ন আর জিমি, এবার একই সঙ্গে পিঠ আর কান খাড়া করে ফেলল। একটা রহস্যের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।

‘বলছি।’ বললেন মিসেস মুনরো। ‘হেক্টর গত সপ্তাহে সল্ট লেক সিটিতে এসেছে। আসার আগে আমাকে বলল যে, অনেক দিন দুজনে মিলে কোথাও বেড়াতে যাই না; এবার গেলে কেমন হয়? কথাটা শুনে খুব খুশি হলাম। কারণ আসলেই অনেক দিন হয়েছে কোথাও বেড়াতে যাই না। ও যা ব্যস্ত, একদমই সময় পায় না। তাই সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম। হেক্টর বলল যে সল্ট লেকে ওর কাজ শেষ করতে সপ্তাহখানেক লাগবে, আমি যেন তারপরে যাই। আমার টিকিটের ব্যবস্থা করে ও চলে এল। আমিও অপেক্ষা করতে থাকলাম। তারপরই ঘটল ঘটনাটা।’

‘কী ঘটল?’ জানতে চাইলেন ডা. পার্কার।

‘হেক্টর চলে আসার পরদিন ওর প্রাইভেট স্টাডি গোছাচ্ছিলাম, হঠাৎ দেখলাম ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে কিছু কাগজ পড়ে আছে। বাস্কেটটা খালি করতে গিয়ে সেখানে একটা ব্লটিং পেপার পেলাম। ভালো কথা, বলতে ভুলে গেছি, হেক্টর পুরোনো আমলের কালির কলম ব্যবহার করে। জিনিসটার প্রতি ওর দুর্বলতা আছে। যা হোক, লক্ষ করলাম, ব্লটিং পেপারে কয়েকটা লাইন ফুটে আছে। সম্ভবত যে চিঠিটায় অতিরিক্ত কালি মোছার জন্য ব্যবহার করেছিল, সেটারই। কয়েক দিন আগে একটা রহস্য গল্প পড়েছিলাম, তাতে ডিটেকটিভ ব্লটিং পেপার থেকে ক্লু উদ্ধার করে। ব্যাপারটা কতটুকু সম্ভব, দেখার জন্য কাগজটা আয়নার সামনে ধরলাম। কিন্তু লাইনগুলো পড়ে আমার মাথায় যেন বাজ পড়ল।’

‘কেন? কী লেখা ছিল?’

‘পরিষ্কার পড়া যাচ্ছিল না, তবে এটুকু বোঝা যাচ্ছিল আমি যে আজ কলোরাডো এক্সপ্রেসে যাচ্ছি, এটা উল্লেখ করা হয়েছে। আর একটা লাইন বেশ ভালো পড়া যাচ্ছিল। তা হলো, “কাজটা সারার আদর্শ সময় হবে আইওয়া পৌঁছানোর ঠিক আগে!” কিছু বুঝতে পারছিস?’

‘ব্যাপারটা অস্বাভাবিক।’ স্বীকার করলেন মিসেস পার্কার। ‘হাতের লেখাটা যে তোর হাজব্যান্ডের তুই শিওর?’

‘হ্যাঁ, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এ ধরনের একটা চিঠি কেন লিখতে গেল হেক্টর? কাকেই–বা লিখেছে?’

‘ঠিকই বলেছিস, ব্যাপারটা দুশ্চিন্তারই বটে!’

‘এখন আমি কী করব, বলতে পারিস? হেক্টর কী করতে চাইছে?’

‘এ বিষয়ে এক্ষুনি কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না।’ বললেন ডা. পার্কার। ‘তা ছাড়া এই মুহূর্তে করার কিছু নেইও। পরশু আমরা আইওয়া পৌঁছাব, তখনই আসল ঘটনা বোঝা যাবে। চিন্তা করবেন না, আপনার পাশে আমরা থাকব।’

এতক্ষণ হেলাফেলায় দাঁড়িয়ে ছিল অয়ন আর জিমি, এবার একই সঙ্গে পিঠ আর কান খাড়া করে ফেলল। একটা রহস্যের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।

কথাটা শুনে মিসেস মুনরো কতটুকু সান্ত্বনা পেলেন বোঝা গেল না। তবে জিমির হাত ধরে টান দিয়ে অয়ন বলল, ‘অবজারভেশন ডেকে চল, কথা আছে।’

নীরবে ওকে অনুসরণ করল জিমি। অবজারভেশন ডেকে দুটো মুখোমুখি চেয়ার দখল করল ওরা।

অয়নের কপালে ভ্রুকুটি। তা দেখে জিমি জিজ্ঞেস করল, ‘কী ভাবছিস?’

‘সত্যিই একটা রহস্য পেয়ে গেছি আমরা, জিমি।’ বলল অয়ন। ‘কী আশ্চর্য, তাই না?’

‘তা তো বটেই।’ স্বীকার করল জিমি। ‘কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, মি. মুনরো অমন একটা চিঠি লিখতে গেলেন কেন? মতলবটা কী?’

‘ভালো প্রশ্ন। আমারও ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা হচ্ছে। আইওয়া পৌঁছানোর আগে ঠিক কী ঘটতে যাচ্ছে? কাজ সারা মানে কী ধরনের কাজ?’

‘মার্ডার-ফার্ডার নয়তো?’ শঙ্কিত গলায় বলল জিমি। ‘ভাষাটা কিন্তু খুবই সিরিয়াস। আমার কেন জানি ভয় করছে।’

‘নিশ্চিত হওয়ার কোনো উপায়ও তো দেখছি না।’ চিন্তিত কণ্ঠে বলল অয়ন। ‘কাজটা যেকোনো কিছু হতে পারে।’

‘তাহলে এখন আমরা করবটা কী?’

‘চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। আর সত্যি যদি খুনটুনের ব্যাপার হয়, একটা মোটিভ তো থাকবে! ডেইজি আন্টির সঙ্গে কথা বলে সেটা বের করতে হবে।’

‘কিন্তু আমরা ছোট মানুষ। উনি কি এসব ব্যক্তিগত বিষয়ে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন?’

‘প্রয়োজনে ক্যাথারিন আন্টিকে পটিয়ে কাজ উদ্ধার করতে হবে। পারবি না?’

‘গ্যারান্টি দিতে পারছি না, তবে চেষ্টা নিশ্চয়ই করব।’

‘গুড, আমাদের কাজ এখন থেকে শুরু হচ্ছে। মনে রাখিস, আমাদের সামান্য ভুলে একজন মানুষের জীবন চলে যেতে পারে। কাজেই সাবধান, খুব সাবধান!’

তিন

সেদিন আর কিছু ঘটল না, তার পরের দিনও না। চোখ-কান খোলা রাখল অয়ন আর জিমি, কিন্তু উল্লেখযোগ্য কোনো কিছুই দেখল না বা শুনল না। ভেতরে–ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা, অস্থিরতা অনুভব করতে লাগল দুই বন্ধু।

ট্রেন এখন রকি পর্বতমালার ভেতর দিয়ে ছুটছে। সে এক আজব কাণ্ড। এই ট্রেনলাইন বসাতে গিয়ে মানুষকে কত পরিশ্রমই না করতে হয়েছে। কখনো পাহাড় কেটেছে, কখনো জঙ্গল, কখনো বা দুরন্ত নদীর ওপর দিয়ে সেতু বানাতে হয়েছে। অবজারভেশন ডেকে বসে দুই বন্ধু মুগ্ধ বিস্ময়ে চারদিকে তাকাচ্ছিল।

ট্রেন কখনো বা টানেলে ঢুকছে, কখনো বা উঁচু উঁচু পাহাড়–পর্বতকে পাশ কাটাচ্ছে। নিচের দিকে তাকালে মাথা ঘুরে যায়। পাহাড়গুলোর সৌন্দর্যও দেখার মতো। মাথায় বরফের টোপর, শরীরে পাইনগাছের চাদর। রেললাইনের পাশে পাশেই আছে বিখ্যাত কলোরাডো নদী। কী স্বচ্ছ তার পানি! দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছে করে। মাঝে মাঝে পাহাড়ের গায়ে দু–একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। সেগুলো ছবির মতো সুন্দর। আকাশের মেঘ যেন বাড়িগুলোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। এসব দেখে দুই বন্ধু কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলল আর ভাবল, এ রকম সুন্দর জায়গায় থাকতে পারলে কী ভালোই না হতো!

তৃতীয় দিন দুপুর নাগাদ পরিস্থিতি গুমোট হয়ে উঠল। তিনটা নাগাদ আইওয়াতে পৌঁছানোর কথা কলোরাডো এক্সপ্রেসের, এখন বাজে দুইটা। সকাল থেকেই মিসেস মুনরোর কেবিনে বসে আছেন পার্কার দম্পতি, লাঞ্চও করেছেন সেখানেই। অয়ন আর জিমিও রয়েছে, তবে মাঝে মাঝে ওরা গোটা ট্রেনে চক্কর দিয়ে আসছে। বলা তো যায় না, সন্দেহজনক কিছু আবিষ্কারও করে ফেলতে পারে। তবে প্রতিবারই হতাশ হতে হয়েছে।

দুইটা বেজে যাওয়ায় মিসেস মুনরোর কেবিনে এসে থিতু হলো দুজন। সময় ঘনিয়ে আসছে, শিগগিরই কিছু একটা ঘটবে। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করতে পারছে ওরা। হতাশায় মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হচ্ছে অয়নের। এমন বিচ্ছিরি অবস্থায় আগে কখনো পড়েনি। একটা ক্রাইম ঘটার সময় হয়ে গেছে, অথচ দুদিন আগে আভাস পাওয়া সত্ত্বেও সেটার কিনারা করতে পারেনি। অবশ্য দোষটা ওর একার নয়। হাতে কোনো সূত্র ছিল না, এগোবে কী করে? মিসেস মুনরোর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল, কিন্তু তিনি আগ্রহী হননি। আর জিমি তো মায়ের কাছে প্রসঙ্গটা তুলেই এক ধমক খেয়েছে। মিসেস পার্কার ওকে পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, বড়দের নিয়ে মাথা না ঘামাতে। এখন যে কী হবে!

হঠাৎ ভাবনায় ছেদ পড়ল অয়নের। ট্রেনের আওয়াজ হঠাৎ বদলে গেছে। ব্যাপার কী? জানালা দিয়ে তাকাতেই দেখল, বিশাল একটা ব্রিজে উঠেছে ট্রেনটা, কলোরাডো নদী অতিক্রম করছে ওরা। নদীর পানিতে রোদের ঝিলিমিলি।

ঠিক তক্ষুনি করিডরে একটা চিৎকার শোনা গেল।

‘বাঁচাও, বাঁচাও, ট্রেনে আগুন লেগেছে!’

দুই লাফে করিডরে বেরিয়ে এল অয়ন আর জিমি, পিছু পিছু পার্কার দম্পতি আর মিসেস মুনরোও বেরোলেন। করিডরে মাঝবয়সী একজন মহিলাকে চেঁচাতে দেখা গেল। চোখ তুলে সবাই দেখল, সামনের কম্পার্টমেন্টের দরজা দিয়ে ভকভক করে কালো ধোঁয়া বেরোচ্ছে; এই কম্পার্টমেন্টেও ছড়িয়ে পড়েছে কিছুটা। কর্কশ শব্দে ফায়ার অ্যালার্ম বেজে চলেছে। কে যেন চেইন টানতেই ট্রেন থেমে গেল।

আশপাশের কেবিন থেকেও অনেক যাত্রী বেরিয়ে এসেছে। কয়েকজন আগুন নেভানোর জন্য ছুটে গেল, কিন্তু একটু পরই খকখক করে কাশতে কাশতে পিছিয়ে আসতে হলো তাদের। ধোঁয়া খুব বেশি।

এ সময় কোথা থেকে যেন একজন অ্যাটেনডেন্ট উদয় হলো। সে চেঁচিয়ে বলল, ‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান, কেউ উত্তেজিত হবেন না! ওটা একটা খালি কামরা, কোনো যাত্রী নেই। এক্ষুনি আগুন নিভিয়ে ফেলা হবে। আপনারা যে যার কেবিনে দয়া করে ফিরে যান।’

কিন্তু এ যেন বিনা পয়সার সার্কাস, কেউ নড়ল না। তামাশাটা অয়নও দেখছিল, কিন্তু কী যেন মনে পড়তেই ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল ও। জিমির হাত ধরে টান দিয়ে বলল, ‘কেবিনে...জলদি!’

ঠাস করে মিসেস মুনরোর কেবিনের দরজা খুলল অয়ন। দেখল, ভেতরে সেই মাঝবয়সী মহিলাটা বসে আছে, যে আগুন দেখে সবার আগে চেঁচামেচি করছিল। পাশের জানালাটা খোলা। অবাক হয়ে ঘাড় ঘোরাল মহিলা।

‘আপনি এখানে কী করছেন, ম্যাডাম?’ কড়া গলায় প্রশ্ন করল অয়ন। ‘এটা তো আপনার কেবিন না।’

‘ধোঁয়া দেখে মাথা ঘোরাচ্ছিল।’ কৈফিয়ত দেওয়ার সুরে বলল মহিলা। ‘তাই একটু টাটকা বাতাসের জন্য...’

‘ও নিয়ে চিন্তা করবেন না।’ আশ্বাস দিল অয়ন। ‘আগুনটা তেমন সিরিয়াস নয়।’

‘তাই নাকি? বাঁচা গেল!’ উঠে দাঁড়াল মহিলা। ‘যাক গে, এখন অনেকটা ভালো লাগছে। আমি তা হলে যাই।’

‘এক মিনিট।’ বাধা দিল অয়ন। ‘এভাবে তো আপনি যেতে পারবেন না।’

‘মানে!’ মহিলা অবাক।

গলায় মধু ঢেলে অয়ন বলল, ‘আপনাকে একটু অপেক্ষা করতে হবে, ম্যাডাম।’

‘বাচ্চা ছেলে, তোমার সাহস তো কম না!’ রেগে গেল মহিলা। ‘আমাকে বাধা দিচ্ছ!’

‘অতশত বুঝি না, আপনি যেতে পারবেন না।’

‘এক চড়ে সব কটা দাঁত ফেলে দেব, বেয়াদব!’

‘চড়-থাপ্পড় যা-ই দিন।’ সুর মেলাল জিমি, ‘আপনি এখানেই থাকছেন।’

রেগেমেগে আরও কী কী যেন বলতে যাচ্ছিল মহিলা, এ সময় জিমির বাবা-মা আর মিসেস মুনরো দরজায় উদয় হলেন।

‘আরে! ইনি কে?’ বিস্মিত কণ্ঠে বললেন ডা. পার্কার। ‘হচ্ছেটা কী এখানে?’

‘উনি একজন অবাঞ্ছিত অতিথি, আঙ্কেল।’ জানাল অয়ন।

‘কী!’ খেপে গেল মহিলা। ‘আমি অবাঞ্ছিত অতিথি?’

মহিলাকে পাত্তা না দিয়ে অয়ন মিসেস মুনরোকে বলল, ‘ডেইজি আন্টি, দেখুন তো আপনার জুয়েলারি বক্সটা ঠিক আছে কি না?’

টেবিল থেকে বক্সটা তুলে নিলেন মিসেস মুনরো। ঢাকনা খুলে ভেতরে উঁকি দিয়েই হাহাকার করে উঠলেন তিনি।

‘হায় হায়! সর্বনাশ হয়েছে! আমার এতসব দামি দামি অলংকার...সব গায়েব!’

অয়নকে দেখে মনে হলো না খুব একটা অবাক হয়েছে। ও বলল, ‘মনে হচ্ছে কন্ডাক্টরকে ডাকার সময় হয়েছে। জিমি, এক দৌড়ে যা। আর কন্ডাক্টরকে বলিস, আগুন নিয়ে উতলা হওয়ার কিছু নেই। ওটা সম্ভবত একটা স্মোক-বম্ব ছাড়া আর কিছু নয়। তুই যা, আমরা ততক্ষণ এই অবাঞ্ছিত অতিথির ওপর নজর রাখছি।’

‘এসব ষড়যন্ত্র!’ চেঁচিয়ে উঠল মহিলা। ‘কায়দা করে আমার ঘাড়ে দোষ চাপানো হচ্ছে। আমি কিছু করিনি, আমাকে যেতে দিন।’

‘যদি সত্যিই কিছু না করে থাকেন,’ বললেন ডা. পার্কার, ‘তা হলে ভয় কী? আসুক না কন্ডাক্টর!’

‘পস্তাবেন!’ শাসাল মহিলা। ‘এই আমি বলে দিচ্ছি।’

অয়নের কথাই ঠিক। স্মোক-বম্বটা ইতিমধ্যে খুঁজে পেয়েছে ট্রেনের লোকজন। কন্ডাক্টর তো মহাখাপ্পা। তার ধারণা, কেউ তামাশা করে ফাটিয়েছে ওটা। লোকটাকে পেলে আচ্ছাসে দুই ঘা লাগিয়ে দিত। অবশ্য জিমি বুঝতে পারছে, পুরো ব্যাপারটাই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। যা হোক, সেসব ব্যাখ্যা না করে শুধু চুরির কথা বলে কন্ডাক্টরকে ডেকে নিয়ে এল ও। একটু পরই আবার চলতে শুরু করল ট্রেনটা।

‘কী ব্যাপার?’ কেবিনে ঢুকে জানতে চাইল কন্ডাক্টর। ‘কী হয়েছে, জানতে পারি?’

সংক্ষেপে তাকে ঘটনাটা জানালেন ডা. পার্কার। সব শুনে মাথা ঝাঁকাল সে। তারপর মহিলাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার নামটা জানতে পারি, ম্যাডাম?’

‘জুলিয়া এভারেট।’ বলল মহিলা। ‘লোকে আমাকে মাদাম জুলিয়া বলে।’

‘কোথায় যাচ্ছেন আপনি?’

‘সল্ট লেক সিটি।’

‘কিছু মনে করবেন না, ম্যাডাম,’ বিনীত ভঙ্গিতে বলল কন্ডাক্টর। ‘এই পরিস্থিতিতে আপনার দেহতল্লাশি করা ছাড়া আমার আর কিছু করার নেই।’

‘যদি আমি রাজি না হই?’

‘সে ক্ষেত্রে আইওয়াতে পৌঁছে পুলিশে রিপোর্ট করতে হবে আমাকে। ততক্ষণ আপনি নজরবন্দী থাকবেন।’

‘ওরাও তো তল্লাশি করবে।’ শ্বাস ফেলল মাদাম জুলিয়া। ‘বেশ, এখনই সেটা করে ফেলুন।’

‘গুড, আমি তাহলে একজন মহিলা অ্যাটেনডেন্ট ডাকছি।’

পরবর্তী আধা ঘণ্টা যেন একটা ঘোরের মধ্যে কাটল। মিসেস পার্কার এবং মিসেস মুনরোর উপস্থিতিতে মাদাম জুলিয়ার দেহতল্লাশি করা হলো। শুধু তা–ই নয়, পুরো কেবিনের আনাচকানাচে তন্নতন্ন করে খোঁজা হলো। কিন্তু অবস্থার হেরফের হলো না তাতে। মাদাম জুলিয়া কেন, কেবিনেই পাওয়া গেল না অলংকারগুলো। মহিলাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো কন্ডাক্টর।

যাওয়ার সময় ডা. পার্কারের সামনে এসে একটা বাঁকা হাসি দিল মাদাম জুলিয়া। বলল, ‘পস্তাবেন, বলেছিলাম না?’

গটমট করে হেঁটে চলে গেল সে।

চার

ধপ করে সিটের ওপর বসে পড়ল সবাই। হতাশায় মুখ কালো হয়ে গেছে সবার।

‘হায় হায়!’ কপাল চাপড়ালেন মিসেস মুনরো। ‘আমার সব গেল। কয়েক লাখ ডলারের অলংকার ছিল বক্সে। সব শেষ।’

‘আমার এখনো ব্যাপারটা বিশ্বাস হচ্ছে না।’ মাথা নাড়ল অয়ন। ‘অলংকারগুলো গেল কোথায়?’

‘কিছুই বাঁচাতে পারিসনি?’ জিজ্ঞেস করলেন মিসেস পার্কার।

‘গলার নেকলেস আর এই আংটিটা।’ বাঁ হাত তুলে একটা হিরের আংটি দেখালেন মিসেস মুনরো। ‘সকালে কী ভেবে এই দুটো পরেছিলাম, নইলে এগুলোও যেত।’

‘এর ভেতর ঘাপলা আছে।’ চিন্তিত গলায় বলল অয়ন। ‘এতগুলো অলংকার তো আর বাতাসে মিলিয়ে যেতে পারে না।’

‘শুরু হলো খুদে শার্লক হোমসের গোয়েন্দাগিরি!’ মন্তব্য করলেন ডা. পার্কার।

‘মানে!’ মিসেস মুনরো বিস্মিত হলেন।

‘আর বলিস না, বাচ্চাদের পাগলামি!’ বললেন মিসেস পার্কার। ‘এই দুজনে কিছুদিন হলো শখের গোয়েন্দা সেজেছে। পাগলামি আর কাকে বলে!’

‘তবে কাজ কিন্তু ওরা ভালোই করে।’ ছেলেদের হয়ে ওকালতি করলেন ডা. পার্কার। ‘বেশ কয়েকটা রহস্য সমাধান করেছে। এই তো কদিন আগেই একটা হিরের নেকলেস চুরির রহস্য ভেদ করল। পুলিশ পর্যন্ত প্রশংসা করতে বাধ্য হয়েছে।’

‘আর ভুতুড়ে বাড়িতে ঢুকে যে মরতে বসেছিল, সেটা বলছ না কেন?’ মুখ ঝামটা দিলেন মিসেস পার্কার। ‘কাজ নেই বাপু গোয়েন্দাগিরির। কবে গুন্ডাপান্ডার হাতে জান খোয়াবে!’

‘আরে দূর! এসব কাজে বিপদ একটু-আধটু হয়ই। ভয় পেলে চলে?’

‘কেসটা আমাদের দিন, আন্টি।’ উৎসাহ পেয়ে বলে উঠল জিমি। ‘দেখুন না, চোরটাকে কীভাবে পাকড়াও করি।’

‘দিয়ে দিন, দিয়ে দিন।’ মিসেস মুনরোকে ইতস্তত করতে দেখে বললেন ডা. পার্কার। ‘বলা যায় না, সত্যি সত্যি ধরেও ফেলতে পারে।’

‘ঠিক আছে।’ দ্বিধা ঝেড়ে বললেন মিসেস মুনরো। ‘তোমাদের ভাড়া করলাম আমি।’

‘গ্রেট!’ খুশিতে চেঁচিয়ে উঠল জিমি।

‘কেস ফির পার্সেন্টেজ কিন্তু আমাকে দিতে হবে।’ বললেন ডা. পার্কার। ‘একটা কেস পাইয়ে দিলাম।’

‘নিশ্চয়ই!’

‘কিছু প্রশ্ন করি।’ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল অয়ন। ‘অলংকারগুলো শেষ কখন দেখেছেন আপনি, আন্টি?’

‘আজ সকালে।’ জানালেন মিসেস মুনরো। ‘আংটি আর নেকলেসটা বের করার জন্য বাক্সটা খুলেছিলাম।’

‘বাকি সব অলংকার ঠিকঠাক ছিল?’

‘খুঁজে তো দেখিনি, তবে কোনো অস্বাভাবিকতা ছিল না। অবশ্য কেউ যদি দু-একটা আংটি বা কানের দুল সরিয়ে থাকে, সেটা বোঝার কথা না।’

‘ধরে নিলাম সরায়নি। আপনার কেবিন গোছগাছ করার জন্য অ্যাটেনডেন্ট এসেছিল কখন?’

‘আমি তখন ব্রেকফাস্টের জন্য ডাইনিং কারে গিয়েছিলাম। ওই ফাঁকেই করেছে।’

‘বাক্সটা?’

‘আমার সঙ্গেই ছিল। ওটা কখনো আমি হাতছাড়া করি না।’

‘তা হলে অ্যাটেনডেন্টও বাদ। বাকি সময়টা তো আমরাই আপনার সঙ্গে ছিলাম। ভারি গোলমেলে ব্যাপার!’

‘চুরিটা তাহলে করল কে?’ প্রশ্ন করলেন মিসেস পার্কার।

‘মাদাম জুলিয়া।’ বলল অয়ন। ‘এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। কিন্তু একটা জিনিস আমার মাথায় ঢুকছে না, অলংকারগুলো গেল কোথায়? খুব বেশি সময় পায়নি সে। বড়জোর দুই–তিন মিনিট। এর ভেতরে বাক্স খুলে সেগুলো বের করে কোথায় লুকাতে পারে সে?’

‘হয়তো অন্য কারও মাধ্যমে পাচার করে দিয়েছে।’ বললেন ডা. পার্কার।

‘উঁহু,’ মাথা নাড়ল অয়ন। ‘তা–ও সম্ভব নয়। দরজার ওপর চোখ রেখেছিলাম আমি। কেবিনে আর কাউকে ঢুকতে বা বেরোতে দেখিনি।’

‘জানালা দিয়ে পাচার করেনি তো?’ হঠাৎ বলল জিমি। ‘জানালাটা খোলা ছিল।’

‘বিশ্বাসযোগ্য।’ স্বীকার করল অয়ন। ‘সমস্যা একটাই। ওই সময় আমরা একটা ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে ছিলাম। তলায় ছিল কলোরাডো নদী। কারও পক্ষে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। খোলা জানালা দিয়ে অলংকারগুলো বড়জোর পানিতে ফেলা যেতে পারে। কিন্তু লাখ লাখ ডলারের অলংকার একটা পাগলও পানিতে ফেলবে না।’

গভীর চিন্তায় ডুবে গেল অয়ন। তারপর হঠাৎ গা ঝাড়া দিয়ে উঠল। মিসেস মুনরোকে বলল, ‘আন্টি, আপনার ওই আংটিটা আমাকে একটু দেবেন?’

‘শিওর।’ অবাক হলেও আংটিটা খুলে অয়নের হাতে দিলেন মিসেস মুনরো।

জিনিসটা নেড়েচেড়ে দেখল ও। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘এটা কি খাঁটি হিরে?’

‘হ্যাঁ।’

‘দেখা যাক।’ বলে আংটির হিরেটা দিয়ে জানালার কাচে আঁচড় কাটল অয়ন। অবাক ব্যাপার, তাতে কোনো দাগ পড়ল না। অয়নের চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠল, এটা দেখে। বলল, ‘ও! ব্যাপার তাহলে এই?’

‘কী–ক...কী ব্যাপার?’ বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল জিমি।

‘মাই ডিয়ার জিমি,’ খুশি খুশি গলায় বলল অয়ন, ‘এইমাত্র রহস্যটা সমাধান করে দিয়েছিস তুই!’

‘তাই নাকি?’ জিমি বোকা বোকা কণ্ঠে বলল। ‘সত্যি?’

মাথা ঝাঁকাল অয়ন।

‘বলো কী?’ ডা. পার্কারও অবাক হয়েছেন। ‘কেস নিতে না নিতেই সলভ করে ফেললে?’

‘ঠিকই ধরেছেন, আঙ্কেল।’

‘অলংকারগুলো কোথায়, বলতে পারবে?’

‘পারব, তবে এখনই বলব না, আঙ্কেল। আগে কিছু প্রমাণ দরকার। চোরটাকেও হাতেনাতে ধরতে হবে কি না!’

‘এই যাহ্,’ অধৈর্য শোনাল ডা. পার্কারের কণ্ঠ। ‘এটা কেমন কথা?’

‘একটু ধৈর্য ধরুন, আঙ্কেল। এই ফাঁকে আমি আর জিমি একটা চক্কর দিয়ে আসি।’

‘কোথায় যাচ্ছ?’ জানতে চাইলেন মিসেস পার্কার।

‘মাদাম জুলিয়ার পেছনে।’ বলল অয়ন। ‘ডেইজি আন্টি, আংটিটা আমার কাছে থাক। কাজে লাগবে।’

‘বেশ।’ বললেন মিসেস মুনরো। ‘সাবধানে থেকো।’

‘নিশ্চয়ই!’ বলে দুই বন্ধু কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল।

পাঁচ

অবজারভেশন ডেকে মাদাম জুলিয়ার দেখা পেল ওরা। মুখোমুখি চেয়ারে বসে দাড়ি-গোঁফওয়ালা এক লোকের সঙ্গে কথা বলছে। চট করে কোনার দুটো চেয়ার দখল করল দুই বন্ধু, এমনভাবে বসল যেন জুলিয়া আর রহস্যময় লোকটা ওদের দেখতে না পায়। অয়ন বলল, ‘হুঁ, তাহলে ইনিই সেই ভদ্রলোক?’

‘তুই জানতি, মাদাম জুলিয়া এই লোকের সঙ্গে দেখা করবে?’ জিমি প্রশ্ন করল।

‘জানতাম না, তবে অনুমান করেছিলাম। দেখা যাচ্ছে ভুল করিনি।’

একটু পরই কথাবার্তা শেষ হলো। মাদাম জুলিয়া উঠে এক দিকে চলে গেল। দাড়িওয়ালা লোকটাও উঠল।

‘তাড়াতাড়ি চল, ব্যাটাকে ফলো করতে হবে।’ জিমির হাত ধরে টান দিল অয়ন।

একটু দূরত্ব রেখে অনুসরণ করল ওরা। লোকটা গিয়ে ঢুকল ডাইনিং কারে। একটা টেবিল দখল করে বসল।

‘এবার?’ ভুরু নাচাল জিমি।

লোকটার পাশের টেবিলটা খালি। কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করল অয়ন। তারপর জিমিকে বলল, ‘আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। শোন।’

পুরোটা শুনে মাথা ঝাঁকাল জিমি। তারপর দুজন কথা বলতে বলতে পাশের টেবিলটায় গিয়ে বসল।

‘কী একটা দিন গেল, তাই না?’ লোকটাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল জিমি।

‘হ্যাঁ, রীতিমতো দুর্ধর্ষ চুরি।’ বলল অয়ন, হাতের ভেতর আংটিটা এমনভাবে নাড়াচ্ছে, যেন লোকটা তাকালেই দেখতে পায়। ‘তবে ডেইজি আন্টিও কম চালাক নন। চোরটাকে কেমন বোকা বানালেন, ভেবেছিস?’

‘তা তো বটেই।’ মাথা দোলাল জিমি। ‘আসল অলংকার কার্গো হোল্ডে রেখে ইমিটেশন দিয়ে বাক্স ভরে রাখা...ব্রিলিয়ান্ট! অথচ কী অভিনয়টাই না করলেন যেন সত্যিই অলংকার চুরি হয়েছে। হি হি হি!’

‘শ্ শ্ শ্,’ ঠোঁটে আঙুল চাপা দিয়ে বলল অয়ন। ‘আস্তে। কখন কে শুনে ফেলে!’

‘তুই–ইবা আংটিটা ওভাবে নাড়াচ্ছিস কেন? ডেইজি আন্টি ওটা তোকে সামলে রাখার জন্য দিয়েছেন, খেলতে না। তা ছাড়া কেউ দেখে ফেললেই তো বুঝে ফেলবে, অলংকার আসলে চুরি যায়নি।’

ওদের কথা শুনেই চঞ্চল হয়ে উঠল লোকটা। তাড়াতাড়ি উঠে চলে গেল সে। খুশিতে দাঁত বেরিয়ে গেল দুই বন্ধুর, পরিকল্পনার প্রথম অংশ সফল হয়েছে।

সেদিন সন্ধ্যার কথা। মিসেস মুনরো যে কম্পার্টমেন্টে রয়েছেন, সেটার নিচতলায় কার্গো হোল্ডে ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে অয়ন আর জিমি। ইতিমধ্যে বেশ কয়েক ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। মালামালের স্তূপের ভেতর বসে থাকতে থাকতে হাত-পা টনটন করছে ওদের।

‘ধেত্তেরি।’ বিরক্তস্বরে একসময় বলল জিমি। ‘এভাবে আর কতক্ষণ? ব্যাটা মনে হচ্ছে আসবে না।’

‘আসবে।’ নিশ্চিত স্বরে বলল অয়ন। ‘যে টোপ দিয়েছি, আসতে সে বাধ্য।’

‘হ্যাঁ, তা তো বটেই।’ ভেংচি কাটল জিমি। ‘ততক্ষণে আমরা অচল হয়ে যাব। অলরেডি সমস্ত জয়েন্টে খিল ধরে গেছে। উফ্, কী যন্ত্রণা রে, বাবা!’

‘কী শুরু করলি?’ ধমক দিল অয়ন। ‘একটু চুপ করে বস তো!’

‘চুপ করব মানে! সারা শরীর ব্যথা হয়ে গেল...’

‘সেই কখন থেকে ভাঙা রেডিওর মতো প্যাঁ প্যাঁ করে যাচ্ছিস, একটু চুপ কর না রে, ভাই!’

‘কী! আমি ভাঙা রেডিও?’

‘আমি এখন ঝগড়া করতে পারব না। দ্যাখ জিমি, আর একটা কথা বললে কিন্তু দুই ঘা মেরে তোকে বেহুঁশ করে ফেলব। শেষ মুহূর্তে তোর জন্য আমি কোনো কিছু পণ্ড হতে দেব না।’

‘এত বড় কথা?’ রেগে গেল জিমি। ‘আজ তোর একদিন কী...’

‘শ্ শ্ শ্,’ ওকে চুপ করার জন্য ইশারা করল অয়ন। ‘কে যেন আসছে।’

খুঁট করে একটা শব্দ হলো সিঁড়ির ওপরের দরজাটা খুলে গেছে। কার্গো হোল্ডের ভেতরে গাঢ় অন্ধকার। টর্চ জ্বেলে একটা আবছা ছায়ামূর্তি নিচে নামতে শুরু করল। অন্ধকারে আরও মিশে যাওয়ার চেষ্টা করল অয়ন আর জিমি। নিচে নেমে একটু থামল মানুষটা। তারপর টর্চ নিয়ে একপাশ থেকে লাগেজের ট্যাগ দেখতে শুরু করল। আবছাভাবে তাকে দেখতে পেল ওরা। দাড়ি-গোঁফওয়ালা সেই লোকটা।

দম নিয়ে উঠে দাঁড়াল অয়ন। বলল, ‘ওখানে খুঁজে লাভ নেই, স্যার। অলংকারগুলো পাবেন না।’

চমকে উঠল লোকটা। ঝট করে ঘুরে দুই বন্ধুকে দেখতে পেল। তোতলাতে তোতলাতে বলল, ‘তো...ত্... তোমরা কারা?’

‘আমি অয়ন হোসেন। আর ও হলো জিমি পার্কার। আপনার পরিচয়টা জানতে পারি?’

জবাব না দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল লোকটা। কিছু বুঝে উঠতে পারছে না।

‘ঠিক আছে, আমিই বলে দিই।’ বলল অয়ন। ‘প্যাসেঞ্জার লিস্টে আপনার নাম হ্যারি উডস্টোন লেখা আছে। তবে আপনাকে আমি হেক্টর মুনরো বলে ডাকতেই পছন্দ করব। নাকি ভুল বললাম?’

‘কী বলছ যা-তা?’

‘আমার ধারণা, ভুল বলিনি। আপনার নকল দাড়ি–গোঁফ খুললেই তার প্রমাণ পাওয়া যাবে।’

‘হাহ্! তাই নাকি?’

‘জি। প্ল্যানটা অবশ্য আপনি ভালোই ফেঁদেছিলেন প্রায় নিখুঁতই বলা চলে। শুধু একটা ব্লটিং পেপার সব গুবলেট করে দিয়েছে।’

‘কী বলছ তুমি নিজেও জানো না, খোকা।’

‘জানি, স্যার। নকল অলংকারের কথা জানি, সেগুলো কোথায় গায়েব হলো জানি, মাদাম জুলিয়ার কথা, এমনকি আপনার লেখা চিঠির কথাও জানি।’

‘সে ক্ষেত্রে তুমি একটু বেশিই জানো, খোকা,’ ক্রূর হাসি হাসল হেক্টর মুনরো। ‘এত বেশি জানা ভালো নয়। ফলাফল খুব খারাপ হয়। জুলিয়া, বন্দী করো এই দুই বিচ্ছুকে!’

চমকে গেল অয়ন আর জিমি। কথা বলতে বলতে এতই মগ্ন ছিল, কখন যে সিঁড়ি বেয়ে মাদাম জুলিয়া নেমে এসেছে টেরই পায়নি। এই মুহূর্তে সে একটা পিস্তল ধরে রেখেছে ওদের দিকে।

‘নিজেদের খুব চালাক ভেবেছ, তাই না?’ খিক খিক করে হাসল জুলিয়া।

পরমুহূর্তেই লাফ দিয়ে আলোর সামনে থেকে সরে গেল দুই বন্ধু। মেঝে থেকে ব্যাগ-বাক্স যা পেল, ছুড়তে শুরু করল শত্রুর দিকে।

চমকে উঠল লোকটা। ঝট করে ঘুরে দুই বন্ধুকে দেখতে পেল। তোতলাতে তোতলাতে বলল, ‘তো...ত্... তোমরা কারা?’

‘অ্যাই! অ্যাই! কী করছ তোমরা?’ চেঁচাতে থাকল মুনরো। ‘থামো বলছি, থামো!’

ছেলেরা কি তাতে থামে? পরিস্থিতিটা বেকায়দা, এ থেকে বাঁচার জন্য কিছু একটা প্রয়োজন। হাতের কাছে যতগুলো ব্যাগ পেল, খুলে হাতাতে লাগল অয়ন। জিমি ততক্ষণ শত্রুদের ব্যস্ত রাখল। হঠাৎ একটা ক্যামেরা পেয়ে গেল অয়ন, ওপরে শক্তিশালী ফ্ল্যাশলাইট লাগানো—ব্যাটারিও আছে। আর কী চাই? ফ্ল্যাশের সুইচ অন করে দিল ও, তারপর ইশারায় থামতে বলল জিমিকে।

রাগে গরগর করতে করতে কাছে এগিয়ে এল মুনরো আর জুলিয়া। বলল, ‘তোমাদের কপালে ভোগান্তি আছে।’

‘তাই?’ সকৌতুকে বলল অয়ন, শত্রুদের আসতে দিল কাছে। তারপর দুজনের মুখের ওপর টিপে দিল শাটার।

তীব্র আলোয় চোখ ঝলসে গেল মুনরো আর জুলিয়ার, কিছুক্ষণের জন্য অন্ধ হয়ে গেল পুরোপুরি। মৃদু আর্তনাদ করে পিছিয়ে গেল দুজনই। ঝাঁপিয়ে পড়ে মাদাম জুলিয়ার হাত থেকে পিস্তলটা কেড়ে নিল অয়ন আর জিমি, মুনরোর হাত থেকেও টর্চটা ছিনিয়ে নেওয়া হলো।

‘খেলা খতম, স্যার।’ পিস্তল বাগিয়ে বলল অয়ন। ‘নড়াচড়া না করলেই ভালো করবেন।’

এই সময় কার্গো হোল্ডের ভেতরের বাতি জ্বলে উঠল। হুড়মুড় করে কন্ডাক্টরসহ জিমির বাবা-মা আর মিসেস মুনরো হাজির হলেন। তাঁদের আগেই সতর্ক করা হয়েছিল, গোলমাল শুনে ছুটে এসেছেন। তাঁদের দেখে মুচকি হাসল অয়ন। বলল, ‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান, পরিচিত হোন মি. হেক্টর মুনরোর সঙ্গে!’

ছয়

সল্ট লেক সিটিতে নেমে গেলেন মিসেস মুনরো তাঁর স্বামীকে নিয়ে। যাওয়ার আগে অয়ন আর জিমিকে কেস ফি বাবদ ৫০০ ডলার দিয়ে গেলেন। ভীষণ দুঃখ পেয়েছেন ভদ্রমহিলা। তাঁর স্বামী যে এমন একটা প্রতারণামূলক কাজ করবেন, এটা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি। অবশ্য মি. মুনরোর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেননি, করবেন সেই সম্ভাবনাও কম। এই সুযোগে মাদাম জুলিয়াও ছাড়া পেয়ে গেছে। তবে এসব নিয়ে অয়ন-জিমির মাথাব্যথা নেই। কেসটা যে সফলভাবে শেষ করা গেছে, এটাই সবচেয়ে বড় কথা।

যতক্ষণ মিসেস মুনরো ছিলেন, ততক্ষণ এই নাজুক বিষয়ে আলোচনা করা যায়নি। সল্ট লেক থেকে ট্রেন ছাড়ার পর অবজারভেশন ডেকে বসে মিস্টার ও মিসেস পার্কারের কাছে কেসটা ব্যাখ্যা করল দুই বন্ধু।

‘পুরো ঘটনাই নির্ভুল প্ল্যানিংয়ের মাধ্যমে ঘটেছে।’ বলল অয়ন। ‘মি. মুনরোর ব্যবসায় হঠাৎ করে ধস নামায় তাঁর জরুরি ভিত্তিতে কিছু টাকার প্রয়োজন পড়ে। এ জন্য প্রথমেই তাঁর চোখ পড়ে স্ত্রীর গয়নার ওপর। বন্ধকে হবে না, ওগুলো বিক্রিই করতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো, ডেইজি আন্টি কিছুতেই তাঁর শখের অলংকার বিক্রি করতে রাজি হবেন না। এ কারণে একটা জাল বিছালেন মি. মুনরো। আসল গয়নাগুলো সরিয়ে সেখানে ঠিক একই রকম নকল গয়না রেখে দিলেন। কিন্তু এটা তো বেশি দিন চেপে রাখা যাবে না। কাজেই নকল গয়নাগুলো চুরির প্ল্যান করা হলো। যাতে ডেইজি আন্টি চোরকে দোষারোপ করে মনকে সান্ত্বনা দিতে পারেন।’

‘কিন্তু এত ঝামেলার কী প্রয়োজন ছিল?’ বললেন ডা. পার্কার। ‘ট্রেন থেকেই কি আসল গয়নাগুলো চুরি করা যেত না?’

‘যেত, বাবা।’ বলল জিমি। ‘সে ক্ষেত্রে চোর হয়তো ধরাও পড়ে যেত। কিন্তু মি. মুনরো কোনোরকম ঝুঁকি নিতে চাননি। সে কারণেই ডেইজি আন্টির সঙ্গে নকল গয়না দেওয়া হলো, যাতে সেগুলো চিরতরে গায়েব করে দেওয়া যায়। আর চোরাই মালই যদি না থাকে, তাহলে চোর থাকবে কোত্থেকে? ধরা পড়ার প্রশ্নই ওঠে না। মাদাম জুলিয়ার সঙ্গে চিঠির মাধ্যমে ব্যবস্থাটা পাকা করলেন মি. মুনরো।’

‘কিন্তু গেল কোথায় গয়নাগুলো?’ জানতে চাইলেন মিসেস পার্কার।

‘বলছি, আন্টি।’ আবার বলতে শুরু করল অয়ন। ‘চিঠিটা...মানে ব্লটিং পেপারটাই ছিল সবচেয়ে বড় সূত্র। বুঝলাম, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। কাজেই স্মোক–বম্বটা ফাটানোয় বুঝে গেলাম, এটা একটা ডাইভারশন। কথা হচ্ছে আইওয়ায় পৌঁছানোর আগেই কেন এটা করা হলো? কাজটা তো পুরো জার্নির যেকোনো একটা সময়ে করলেই চলে। অলংকারগুলো চুরি যাওয়ায় আমি অবাক হইনি, অবাক হলাম সেগুলো পাওয়া না যাওয়ায়। এই সময় জিমি খোলা জানালার কথা উল্লেখ করায় পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। আইওয়া পৌঁছানোর আগেই ট্রেনটা সবচেয়ে বড় ব্রিজ অতিক্রম করে, এ জন্যই এর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মাদাম জুলিয়াকে তেমন কোনো কষ্ট করতে হয়নি। শুধু জানালা খুলে গয়নাগুলো পানিতে ফেলে দিয়েছে। সেগুলো যদি মাটিতে ফেলা হতো, তা হলে খুঁজে পাওয়া যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ কারণেই ব্রিজটা বেছে নেওয়া।

‘এখন কথা হচ্ছে, পানিতে কেন ফেলা হলো? লাখ লাখ ডলারের অলংকার কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ পানিতে ফেলবে না। জবাব একটাই, ওগুলো সব নকল ছিল। আসল মাল আগেই পাচার হয়ে গেছে। ব্যাপারটা পরীক্ষা করার জন্য ডেইজি আন্টির আংটি দিয়ে জানালার কাচে আঁচড় কাটলাম। দেখলাম, হিরে দিয়ে কাচ কাটা তো দূরের কথা, আঁচড়ই পড়েনি। মানে জিনিসটা নকল। আর বাক্সের একটা জিনিস নকল হলে বাকিগুলো যে আসল হবে, এমনটা ভাবার কোনো কারণই নেই।

‘এবার প্রশ্ন জাগছে, আসল গয়না কে সরিয়েছে? সেটা খুব সহজেই বোঝা গেল হেক্টর মুনরো। আসলগুলোর মতো নকল গয়না তৈরি করানো তাঁর পক্ষেই সম্ভব। শুধু তিনিই জানতে পারেন, তাঁর স্ত্রীর কয়টা অলংকার আছে, সেগুলো দেখতে কেমন। এটা একটা দুধের শিশুও বুঝতে পারবে। অতএব, ডেইজি আন্টি যদি জানতে পারেন সব গয়নাই নকল, তা হলে নির্দ্বিধায় স্বামীকেই সন্দেহ করবেন। তার হাত থেকে বাঁচার জন্যই পুরো চুরির নাটকটা সাজানো হয়েছিল। নাটের গুরু যে মি. মুনরো, চিঠিটাই তার প্রমাণ।’

‘কিন্তু মুনরো যে ট্রেনেই আছে, তা তুমি কী করে জানলে?’ জিজ্ঞেস করলেন ডা. পার্কার।

‘এটা অবশ্য জানতাম না।’ স্বীকার করল অয়ন। ‘তবে অনুমান করেছিলাম। পুরো ব্যাপারটা যেভাবে প্ল্যান করা হয়েছে, তাতে শেষটা দেখার জন্য যে কেউই কাছাকাছি থাকতে চাইবে। তা ছাড়া সল্ট লেকে মি. মুনরোর কোনো কাজ ছিল না, তাই এক সপ্তাহ আগে সেখানে গিয়ে বসে থাকারও কোনো মানে হয় না। এই সময়টা তিনি সান ফ্রান্সিসকোতেই ঘাপটি মেরে ছিলেন। যথাসময়ে চেহারা পাল্টে ট্রেনে উঠে পড়েছেন। সল্ট লেকে গিয়ে শুধু ভোল পাল্টে স্ত্রীকে রিসিভ করলেই চলে। তাই ধরে নিলাম, তিনি ট্রেনেই আছেন। মাদাম জুলিয়াকে ফলো করে তাঁকে পেয়েও গেলাম। গোটা ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছিলাম আমি, কাজেই একটা ভুয়া গল্প শুনিয়ে তাঁকে ভড়কে দিতে অসুবিধা হলো না। এমন ভাব দেখালাম, যেন নকল গয়নাগুলো চুরি হয়নি, এখনো ডেইজি আন্টির কাছে রয়ে গেছে। মরিয়া হয়ে কার্গো হোল্ডে তল্লাশি করতে গেলেন তিনি। ব্যস, ওটাই ছিল ফাঁদ।’

‘হুফ্!’ শব্দ করে শ্বাস ফেললেন ডা. পার্কার। ‘কী এক জটিল চরিত্র! ওর একটা শাস্তি হওয়া উচিত ছিল।’

‘যা হয়েছে কম কি?’ বললেন মিসেস পার্কার। ‘বউয়ের সামনে আর কোনো দিন চোখ তুলে তাকাতে পারবে? শাস্তি তো দরকার ছিল ওই জুলিয়াটার।’

‘ঠিকই বলেছ।’ একমত হলো জিমি। ‘পাক্কা হারামি মহিলা। মি. মুনরো যে ওকে কোত্থেকে জোগাড় করেছিলেন, কে জানে?’

‘শাস্তি অবশ্য তাকে একটা দিয়েছি আমি।’ মিটিমিটি হেসে অয়ন বলল।

‘কী?’ সবাই অবাক!

‘ধরা পড়ার পর জেরার সময় সে যখন ঘন ঘন পানি খাচ্ছিল, তার গ্লাসে পার্কার আঙ্কেলের ব্যাগ থেকে কটা ট্যাবলেট গুলে দিয়েছিলাম। এত নার্ভাস ছিল, কিচ্ছু টের পায়নি।’

‘তাতে লাভটা কী হলো?’ জিমি শুধাল।

‘ওতে কি আর লাভ হয়?’ মুখের হাসি বিস্তৃত হলো অয়নের। ‘আগামী কয়েক দিন ঘন ঘন বাথরুমে ছুটতে হবে তাকে, আর খেতে হবে কয়েক গ্যালন ওরস্যালাইন।’

সমস্বরে হেসে উঠল সবাই। ওদের সঙ্গে তাল দেওয়ার জন্যই যেন বেজে উঠল ট্রেনের হুইসেল।