লাইসেন্স দিয়ে বাঘ মারা

অলংকরণ: আবু হাসান

ছোট ছোট ছাত্রী বোনেরা,

বোন বলায় তোমরা আবার চটে গেলে না তো? হয়তো ভেতরে-ভেতরে বলছ, বোন কেন? বলুন নাতনিরা! আমরা তো আপনার নাতনির বয়সী! কিন্তু জানো, আমার কিন্তু তোমাদের বোন বলতেই ভালো লাগছে। ভাইবোনের সম্পর্কটা ভারি একটা প্রীতি আর মাধুর্যের সম্পর্ক; দাদা-নাতনির সম্পর্কটা অত সরাসরি নয়। দাদার কাছে হলেও নাতনির কাছে নয়। তাই বোন বলেই তোমাদের সম্বোধন করছি। আমি একটু আগে সভানেত্রীর কাছে জিগ্যেস করেছিলাম তোমরা যেভাবে এতক্ষণ খটমট করে ড্রিল করলে, তাতে তোমাদের হাসতে আবার মানাটানা নেই তো? উনি অভয় দিয়েছেন, না, হাসতে ওদের মানা নেই, ড্রিল শেষ হলেই হাসতে পারবে। কী, হাসির কথাটথা বললে তোমরা হাসবে তো, নাকি এমনি ড্রিলই করতে থাকবে?

(মেয়েরা: হাসব, হাসব)

তাহলে একটা ছোট হাসির গল্প দিয়ে শুরু করি। অবশ্য তোমরা চাইলে কান্নার গল্প দিয়েও শুরু করতে পারি। বলো কোনটা করব? হাসির না কান্নার?

(মেয়েরা: হাসির, হাসির।)

ঠিক আছে। কিন্তু মুশকিলটা হচ্ছে কি জানো? সামনের বিরাট অন্ধকার মাঠে তোমরা বসে আছো। তোমরাও আমাকে দেখছ না, আমিও তোমাদের দেখছি না। কী করে তোমাদের সঙ্গে কথা হবে? তবে সব সময় কথা বলার জন্য যে মানুষের সঙ্গে মানুষের দেখা হতেই হবে এমনও কথা নেই, অনেক সময় কথার ভেতর দিয়েও আমাদের দেখা হতে পারে। আমাদের এখন সেভাবে দেখাদেখি হোক, কেমন?

এবার গল্পটা বলি। আমরা যখন ছোট তখন আমার বাবার ছিল বিশাল একটা ভুঁড়ি। তাঁর ওই ভুঁড়ি ছেলেবেলায় ছিল আমাদের অপরিসীম মর্মবেদনার কারণ। যখনই আমাদের কোনো বন্ধু আমাদের অপমান করতে চাইত তখন সে শুধু বলে উঠত, ‘তোর বাপের ভুঁড়ি।’ ব্যস, আমাদের খেল্ খতম। এত বড় জলজ্যান্ত একটা ভুঁড়ি সামনে নিয়ে কী করে বলা যায়: কোথায় ভুঁড়ি, এ্যাঁ? কোথায় দেখলি বাবার ভুঁড়ি? অথবা আমার বাবার ওটা যদি ভুঁড়ি হয় তো তোর বাবার ওটা কী? আজকালকার ছেলেমেয়েদের মতো অত বুদ্ধি আমাদের ছিল না। তাই চুপ করে সেই অপমান সহ্য করতাম।

বাবার ভুঁড়ি নিয়ে যখন আমাদের এমনি বেহাল অবস্থা, তখন একদিন আমাদের এক বন্ধু তার মামার বাড়ি থেকে শুনে এসে ভুঁড়ি নিয়ে আমাদের একটা গল্প শোনাল। গল্পটা মজার:

দুই বন্ধুর মধ্যে প্রতিযোগিতা হচ্ছে: কার মামার ভুঁড়ি কত বড়। একজন বলল, ‘বুঝলি, ভুঁড়ি হচ্ছে আমার মামার।’

‘কত বড়?’ অন্যজন প্রশ্ন করল।

‘সুবিশাল।’

‘কত সুবিশাল?’

‘বেশি না, তবে এই যখন ঝড়-বৃষ্টি-ট্রিষ্টি ওঠে, তখন জনা পঁচিশেক লোক এর নিচে আশ্রয়-টাশ্রয় নিতে পারে আরকি।’ (মেয়েদের হাসি)

শুনে অন্যজন বলল: মাত্র পঁচিশ? শোন্ তবে আমার মামার ভুঁড়ির কথা। ভুঁড়ি কী বুঝতে হলে দেখতে হবে তাঁকে।

‘কত বড়?’

‘ভুঁড়ি সে তো নয়, যেন একটা পুরো স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা। মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন করে শরীর থেকে বেরিয়েই যেতে চায়। (হাসি) তবে যাতে তা না পারে সে জন্য আমার মামি বুদ্ধি করে ভুঁড়িটার নিচে একটা সিকসুদ্ধ বড়সড় রিকশার চাকা লাগিয়ে দিয়েছেন। ভুঁড়িটাকে সিটের ওপর রেখে মামা আজকাল সারা শহরে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এর সঙ্গে আমার মামাতো ভাই ফেঁদেছে আরেক বুদ্ধি। উনি যাতে ভুঁড়িটা নিয়ে শহরের ভিড়ভাট্টার মধ্যেও ঘুরে বেড়াতে পারেন সে জন্য সে ভুঁড়িটার একপাশে সাইকেলের একটা বেল লাগিয়ে দিয়েছে। উনি যেদিকে যান সেদিকে ক্রিং-ক্রিং, ক্রিং-ক্রিং করে বেল দিতে দিতে যান: মানে সরো, সরো, ভুঁড়ি আসছে, ভুঁড়ি আসছে, হুঁশিয়ার, সাবধান...।’ (মেয়েদের হাসি)।

কয়েক বছর পর প্রায় একই ধরনের একটা গল্প শুনেছিলাম আমার আরেক বন্ধুর কাছ থেকে। সে গল্পটাও মজার:

তিন বন্ধুর মধ্যে গল্প হচ্ছে: কার মামা কত বড় শিকারি। একজন বলল, ‘সেরা শিকারি হচ্ছে আমার মামা।’

‘কী রকম?’

‘গিয়েছেন তিনি একবার সুন্দরবনে। সুন্দরবনে কী মারতে যায় লোকে জানিস তো?’

‘জানব না কেন, রয়েল বেঙ্গল টাইগার।’

‘ঠিক। তো মামার সঙ্গে আছে চাকর। চাকরের কাছে বন্দুক-গুলি। হঠাত্ একটা বাঘ এসে লাফ দিয়ে পড়ল মামার সামনে। মামা দেরি করলেন না। হুংকারে চাকরকে বললেন, ‘বন্দুক দে’। চাকর ঝটপট বন্দুক এগিয়ে দিল। মামা এবার হাঁকলেন ‘গুলি দে’। শুনে চাকর তো ভ্যাবাচেকা। গুলি তো আনা হয়নি। ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘গুলি যে আনিনি স্যার! ভুলে গেছি।’ মামা চোখ রাঙিয়ে দিলেন এক ধমক। কিন্তু বাঘ না মারলেও যে নয়। তাই খালি বন্দুকটা দিয়েই বাঘের দিকে এমন এক প্রাণঘাতী ফায়ার করলেন যে বাঘ যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে দাঁড়িয়েই শেষ।’ (হাসি)

শুনে দ্বিতীয় বন্ধু বলল, ‘আরে তোর মামা আবার শিকারি নাকি? বন্দুক দিয়েই তো সবাই বাঘ মারে। শিকারি হচ্ছে আমার মামা। শোন্ কী দিয়ে তিনি মেরেছিলেন? গেছেন সুন্দরবনে। এক বিশাল বাঘ লাফ দিয়ে পড়েছে সামনে। মামা গর্জে উঠলেন ‘বন্দুক দে’। (এমন গর্জন যে তাতেই বাঘের দফারফা।) কিন্তু এ চাকর যে বন্দুকই আনেনি। কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলল, ‘বন্দুক যে আনিনি স্যার...।’ কিন্তু বাঘ না মারলেই যে নয়। মামা অগত্যা হুংকার দিলেন, ‘দে, তবে গুলিই দে।’ বলেই চাকরের হাত থেকে গুলিটা নিয়ে তাই দিয়েই করে দিলেন এক বেমক্কা ফায়ার। এমন ফায়ার যে বাঘ এক পা-ও নড়তে পারল না।’

তৃতীয়জন হেসে বলল, ‘আরে, তোদের মামারা আবার শিকারি হলো নাকি? বন্দুক-গুলি এসব দিয়েই তো লোকে বাঘ মারে। শোন্ কী দিয়ে মেরেছিলেন আমার মামা। গেছেন সুন্দরবনে। সামনে লাফিয়ে পড়েছে এক বেয়াদব বাঘ। বুঝতে পারেনি কার সামনে পড়েছে। মামা গর্জন করে চাকরকে বললেন, ‘বন্দুক দে’। চাকর বলল, ‘বন্দুক যে আনিনি স্যার।’ মামা বললেন, ‘তবে গুলি দে।’ চাকর বলল, ‘ওটাও যে আনতে ভুলে গেছি স্যার।’ মামা এখন করেনটা কী! বাঘ না মারলে তো চলে না! হুংকার দিয়ে বললেন, ‘দে তবে লাইসেন্সটাই দে।’ (হাসি) বলে সেই লাইসেন্স দিয়েই এমন এক ফায়ার করলেন যে বাঘ সঙ্গে সঙ্গে স্পট ডেড। (বিস্তর হাসি)।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
অলংকরণ: আবু হাসান

গল্প তো শুনলে। আমাকে এবার তোমরা একটা কথার উত্তর দাও—লাইসেন্স দিয়ে কি বাঘ মারা যায়? (মেয়েরা একসঙ্গে: না!)

যায় না যে তার প্রমাণ, কথাটা শুনে তোমরা হেসেছ। সত্যি, লাইসেন্স দিয়ে বাঘ মারা যায় না। কিন্তু একজন শিকারির কি লাইসেন্স থাকতে হয়, না হয় না? (মেয়েরা: থাকতে হয়, থাকতে হয়।) যদি লাইসেন্স না থাকে তবে তাঁর বন্দুক, অস্ত্র, গুলি সব কী হয়ে যায়? (সবাই নিশ্চুপ)। অবৈধ। হ্যাঁ, অবৈধ হয়ে যায়। কেবল তা-ই না, সঙ্গে সঙ্গে ওই মানুষটাও অবৈধ হয়ে যায়। তাঁকে জেলখানায় পুরে দেওয়া হয়। কাজেই একজন শিকারির আর যা-ই থাকুক না-থাকুক, লাইসেন্স না থাকলে কিন্তু চলবেই না। আমি আর কথা বাড়াব না। একটা কথা বলেই শেষ করব। দেখো, ১৯৭১ সালে আমাদের জাতি একটা লাইসেন্স পেয়েছিল। বলো তো লাইসেন্সটার নাম কী?

(ছাত্রীরা: স্বাধীনতা)

ঠিক বলেছ। এবার বলো তো, লাইসেন্সটা দেখতে কেমন?

(একজন ছাত্রী: কালচে সবুজের মাঝখানে লাল সূর্য।)

ঠিক। সেই লাইসেন্স পতপত করে এখন সারা পৃথিবীর বুকে ওড়ে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর যে দেশেই যাও, সেখানে কোথাও না-কোথাও আমাদের এই লাইসেন্সটিকে তোমরা দেখতে পাবে। বলো তো এ লাইসেন্স কিসের?

(সবাই: স্বাধীনতার।)

হ্যাঁ, আমরা যে একটি বৈধ স্বাধীন সার্বভৌম জাতি, এটা তার প্রমাণ। ওটা না হলে কিছুতেই আমরা বিশ্বের মর্যাদাবান নাগরিক হতে পারতাম না। সারা পৃথিবীতে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতে পারতাম না।

এবার পরের কথাটার উত্তর দাও। লাইসেন্স থাকলে একজন মানুষের অস্ত্র বৈধ হয় ঠিকই, কিন্তু লাইসেন্স থাকলেই কি একজন মানুষ সত্যিকার শিকারি হয়ে যায়? নাকি শিকারি হতে আরও কিছু যোগ্যতা লাগে?

(ছাত্রীরা: লাগে।)

কী কী লাগে বলো দেখি?

(ছাত্রীরা: অস্ত্র!)

হ্যাঁ, ঠিক, অস্ত্র। অস্ত্র, বন্দুক, গুলি—এসব তো লাগেই। না হলে বাঘ মারবে কী দিয়ে? কিন্তু কেবল অস্ত্র থাকলেই কি একজন মানুষ শিকারি হয়ে যায়? নাকি আরও কিছু লাগে?

‘লাগে।’

‘কী সেটা?’

(একজন ছাত্রী: স্বাস্থ্য।)

চমত্কার! স্বাস্থ্য। হ্যাঁ, স্বাস্থ্য লাগে—শক্তি লাগে। না হলে লড়াই করবে কী করে? আর কিছু লাগে কি? (একজন ছাত্রী: সাহস।)

ঠিক। সাহস লাগে। না হলে অমন শক্তিশালী বাঘের সামনে দাঁড়াবে কী করে?

(এক ছাত্রী: বুদ্ধি।)

হ্যাঁ, হয়তো সবচেয়ে বেশি লাগে এ জিনিসটিই। কিন্তু এটুকু হলেই কি হয়? নাকি আরও কিছু লাগে? হ্যাঁ, লাগে। চেষ্টা লাগে, সংকল্প লাগে। আর কী লাগে? একজন ছাত্রী: ‘প্রশিক্ষণ’। ঠিক বলেছ, প্রশিক্ষণ। এই যে তোমরা এত সুন্দর নাচ দেখালে, ড্রিল করলে, এটা কি এমনি এমনি হয়েছে? নাকি অনেক দিনের চেষ্টা, যত্ন, পরিশ্রম আর প্রশিক্ষণ লেগেছে। (মেয়েরা: প্রশিক্ষণ লেগেছে)। হ্যাঁ, সেই প্রশিক্ষণ লাগে। তাহলে দেখো, শিকারি হতে গেলে কত কিছুই না লাগে। স্বাস্থ্য, শক্তি, যোগ্যতা, সাহস, ক্ষিপ্রতা, প্রশিক্ষণ, মনোবল, একাগ্রতা, নিষ্ঠা, জয়ের ইচ্ছা, দুর্বার আকাঙ্ক্ষা—কত কিছুই না লাগে। তবেই না মানুষ বড় শিকারি হয়। একইভাবে আজকে আমরা যদি আমাদের জাতিকে বড় করতে চাই, তাহলে কি শুধু ওই লাইসেন্স দিয়ে, ওই পতাকাটুকু দিয়ে পারব? নাকি আরও কিছু লাগবে? কী কী লাগবে বলো তো দেখি? (ছাত্রীদের জবাব: শিক্ষা।)

হ্যাঁ, যেটা রণদাপ্রসাদ সাহা বুঝেছিলেন। বুঝেছিলেন যে শিক্ষা মানে আলো। এই আলো যার জীবনের মধ্যে প্রজ্বলিত হয়, চারপাশটাকে সে উজ্জ্বল করে রাখে। যদি দেশের সবার মধ্যে এই আলো প্রজ্বলিত হয়, তবে সারা দেশ একটা বিশাল আলোক শিখার মতো জ্বলে উঠবে। তিনি জানতেন, শিক্ষা মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি, যা দিয়ে জাতি বা দেশ শক্তিমান হয়, বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। তাই শিক্ষার জন্য তিনি তোমাদের এই অসাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি গড়ে রেখে গেছেন।

হ্যাঁ, শিক্ষা লাগবে। আর কী লাগবে? (একটি মেয়ে: সাহস)। ঠিক বলেছ। সাহস, সাধনা এসব ছাড়া কি জাতি বড় হতে পারে? কাজেই চেষ্টা, পরিশ্রম, আবেগ, বুদ্ধি, দক্ষতা, যোগ্যতা, সাধনা, শ্রম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, জ্ঞান, বিবেক, আত্মোত্সর্গ, কত কিছু লাগবে—তবে না আমাদের দেশ বড় দেশ হবে। আমরা মাথা উঁচু করে পৃথিবীর সামনে দাঁড়াব।

এসো, তোমরা-আমরা সারা দেশের সব মানুষ ওই সব বড় বড় গুণ দিয়ে নিজেদের সম্পন্ন আর যোগ্য করে তুলি। ওই সব দুর্লভ গুণে নিজেদের সমৃদ্ধ করে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ আর শক্তিশালী করি।

নিজেকে ও দেশকে বড় করতে হলে অনেক কিছুই চাই আজ আমাদের। তবে সবচেয়ে বেশি কী চাই বলো তো? আমাদের সবচেয়ে বেশি চাই ‘আলো’। বুদ্ধির আলো, শক্তির আলো, স্বাস্থ্যের আলো, চিত্তের আলো, আত্মার আলো। কেন চাই একটা গল্প বলে তোমাদের বুঝিয়ে দিই।

তোমরা সম্ভবত আরব্য উপন্যাসের ধীবর আর কলসির গল্পটা জানো। সেই যে এক জেলে সমুদ্রে জাল ফেলে মাছ ধরছিল। আর সেই জালে বাঁধল একটা খুব ভারী জিনিস। বিপুল তার ওজন। ধীবর তো খুশি। আজকে জালে না-জানি কত বড় মাছ পড়েছে। কিন্তু জাল তুলতেই তার চোখ তো চড়কগাছ। এ কী! এ যে মস্ত একটা কলসি। মুখটা বন্ধ। জেলে তাড়াতাড়ি কলসিটার মুখ খুলে ফেলল। আর অমনি ঘটল এক অবাক ঘটনা। একটা বিশাল দৈত্য বের হলো সেই কলসির ভেতর থেকে। তার পা মাটিতে, মাথা আকাশে। আকাশ-বাতাস দাপিয়ে সে বলে চলল, ‘স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালে আমার চাইতে বড় কেউ নাই আই...আই...আই...।’ টেলিভিশনে যেভাবে বলে। ‘সারা পৃথিবী আমার হাতের মুঠোয়...ওয়...ওয়...।’ তার এত শক্তি যে পৃথিবীতে সে যা চায় তা-ই করতে পারে। তার অসাধ্য কিছু নেই। এখন আমার একটা প্রশ্ন তাকে: হে দৈত্য, তোমার তো এত অন্তহীন শক্তি আর ক্ষমতা। তোমার অসাধ্য তো কিছুই নেই। তাহলে এমন বিশাল শক্তি নিয়ে হাজার বছর ধরে তুমি এই তুচ্ছ কলসির মধ্যে বন্দী হয়ে ছিলে কেন? কী ছিল না তোমার সেখানে? তোমরাই বলো না: কলসির মধ্যে শক্তিমান দৈত্যটার কী ছিল না, যার জন্য এত শক্তি নিয়েও ওই ছোট্ট কলসিটার ভেতর হাজার বছর ধরে তাকে বন্দী হয়ে থাকতে হয়েছিল। (একটা মেয়ে: জ্ঞান) হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। জ্ঞান। তার জ্ঞান ছিল না। তাই সে নিজের শক্তিকে চিনতে পারেনি। সে ছিল জড়, নির্বোধ, মূঢ়। তার বুদ্ধি ছিল না। কিন্তু জ্ঞান ছিল না কেন? স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালে যার অসাধ্য কিছু নেই, কলসির মধ্যে তার বুদ্ধি হারিয়ে গেল কেন? কী ছিল না কলসির মধ্যে, যা না থাকলে সব রকম বুদ্ধি হারিয়ে যায়? (একটা মেয়ে: আলো)। হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। আলো ছিল না ওই মুখ বন্ধ করা কলসির মধ্যে। আলো ছিল না বলে দৃষ্টি ছিল না। নিজের শক্তি বা পৃথিবীকে বোঝার-চেনার উপায় ছিল না। তাই বুদ্ধি ছিল না, জ্ঞান ছিল না। একটু আগে তোমাদের সবার হাতের প্রদীপগুলো এক এক করে জ্বলে উঠে যেভাবে পুরো স্কুলের অঙ্গনকে এক হাজার আলোর এক উজ্জ্বল জগৎ করে তুলেছিল, কলসির সংকীর্ণ বদ্ধ পৃথিবীতে সেই আলোর উজ্জ্বলতা নেই। নিজেকে, অন্যকে, বিশ্বচরাচরকে চেনার-জানার-বোঝার পথ নেই।

যে আলো দিয়ে আমরা অন্ধকারকে দূর করি, জগৎকে প্রজ্বলিত করি, নিজেকে ও জগৎকে চিনি, এসো আমরা তাতে সবাই আলোকিত হই। তোমাদের স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা জানতেন, আলো এমন একটা দীপ্তি, যা কেবল প্রদীপ থেকে প্রদীপে নয়, হৃদয় থেকে হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়ে। তোমরা সেই আলোকে জ্বালিয়ে রেখো।

[মির্জাপুর ভারতেশ্বরী হোমস-এর ছাত্রীদের উদ্দেশে বক্তৃতা: ১৯৯৯]