লড়াকু কিশোর

অলংকরণ: রিদম

তখনো অন্ধকার। কিছু বাদেই ফিকে হতে শুরু করবে চারদিক। মোরগ বাঁক দিয়ে সকাল হওয়ার সংবাদ জানাবে। বেজায় সুনসান পরিবেশ। শিশির ঝরার শব্দ শোনা যাচ্ছে টুপটাপ। এর বাইরে কোনো শব্দ নেই।

নভেম্বর মাস। আস্তে আস্তে শীতের আগমন ঘটবে প্রকৃতিতে। এ সময় শরীরে তেমন গরম কাপড় না জড়ালেও চলে। ভোরের হিম হিম বাতাস মন্দ লাগে না। কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে।

গা সওয়া অন্ধকার। সবাই গভীর নিদ্রায় অচেতন। ঘুম নেই কেবল কিশোরের চোখে। কত দিন এভাবে না ঘুমিয়েই রাত কাটে ওর। ঘুমাতে পারে না। এভাবে নির্ঘুম থাকতে থাকতে চোখজোড়া কানাকুয়ো পাখির মতো হয়ে গেছে। দেখলে ভয় লাগে। চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছে। জুতমতো কারও পেলেই যেন সেই আগুনে পুড়িয়ে ভস্ম করে দেবে।

সেই অপেক্ষায় দিন গুনছে কিশোর বহু-বহুদিন ধরে, যা করার সে একাই করবে। কারও সঙ্গী করতে চায় না ও। কেউ যেন ওর কারণে কাউকে জড়াতে না পারে, সে জন্য এই চিন্তা। তার মানে কিশোর কারোর সঙ্গেও নেই। আর এখন প্রতিশোধের মোক্ষম অস্ত্রটা ওর হাতে।

সতেরো কি আঠারো হবে কিশোরের বয়স। রক্ত ফোটার বয়স। নিজেকে সামর্থ্যবান প্রমাণ করার বয়স। সবকিছু ভেঙেচুরে মিসমার করার বয়স।

কিশোর আর নিজের ভেতর থাকতে পারে না। কেমন যেন উদ্‌ভ্রান্ত হয়ে গেছে সে। কারও কোনো কথাই আর তার কান শুনবে না। সব রকম ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে কিশোরের।

নিজের দেশ, নিজের ভিটেমাটি যখন বিদেশি শকুন কেড়ে নিতে চায়, নিজের দেশে যখন পরবাসী হয়ে থাকতে হয়—তখন কার রক্ত নাচবে না? যার ভেতরে সামান্যতম দেশের প্রতি ভালোবাসা আছে, মমত্ববোধ আছে, সে কী করে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারে? কিশোরও তাই পারছে না পাথরের মতো বসে থাকতে। মাথাটা যেন ওর গনগনে আগুনের ভাটা।

ও বদলা নিতে চায়। ভিনদেশি হায়েনার মুখ থেকে তার দুঃখী মাকে বাঁচাতে চায়। মা মানেই তো দেশ। মা মানেই তো মাটি।

নিজের মা তো সেই কবেই হারিয়ে গেছে। বুদ্ধিজ্ঞান হয়েই নিজের মাকে পায়নি কিশোর। বাবাটা নাকি তারও আগে পৃথিবী ছেড়েছে। ছিল এত দিন দাদা-দাদির কাছে। লেখাপড়া করার খুব ইচ্ছা ছিল ওর। স্কুলে ভর্তিও হয়েছিল। মাথাটা খারাপ ছিল না কিশোরের। অল্পতেই পড়া মুখস্থ করতে পারত। দাদা-দাদি যত দিন ছিল, তত দিন ওর স্কুলে যাওয়া-আসা নিয়মিত ছিল। কাছাকাছি সময়ে দাদা-দাদি দুজনেই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করল। আর কিশোরেরও পড়াশোনার পাট চুকল তখন থেকে। আর এরপর চাচারা ওকে খেতখামারের কাজে লাগিয়ে দিল। একসময় চাচাদের বাড়িতে আর টিকতে পারল না ও। একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে থানা শহরের এক বেকারিতে সামান্য বেতনে চাকরি নিল কিশোর।

যখন ও স্কুল ছেড়েছে, তার কিছুদিন পরই দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার দিনে দিনে চরমে উঠতে শুরু করল। মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেল। অন্যায়ভাবে যাকে-তাকে গুলি করে মেরে ফেলছে শয়তানের বাচ্চারা। তাই বেঘোরে মরার চেয়ে লড়াই করে মরার পণ করে বাংলার মানুষ।

ওদের নৃশংস, বর্বর কীর্তি কিশোর নিজের চোখে দেখেছে। ওর সেদিন বেকারিতে পাক্ষিক ছুটি ছিল। ছুটি হলে সবাই তাদের বাড়িঘরে যায়। মা-বাবা, ভাইবোনের সঙ্গে দেখা করে। মা ভালো ভালো কিছু রান্না করে খাওয়ায়। আদর আর মায়ের ভালোবাসা নিয়ে ফিরে আসে। ফিরে এসে তারা বাড়ির কত গল্প করে! এসব শুনে শুনে ওর খুব কষ্ট হয়। বলতে পারে না কিছু। সেই বুকভাঙা কষ্ট কেবল নিজের কাছেই জমা রেখে দিয়েছে কিশোর। কাউকে তেমন কিছু বলে না। বলতে চায় না। কিশোরেরও তো ওদের মতো করে বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কিশোর আর কোথায় যাবে? চাচাবাড়ি থেকে সেই যে বের হয়ে এসেছে, আর একবারের জন্যও যেতে ইচ্ছা করেনি ওর। তাই ছুটি হলে শহর থেকে একটু দূরে এদিক–ওদিক ঘুরে সময় কাটিয়ে ক্লান্ত শরীরে ফিরে আসে ওই বেকারিতেই।

সেদিন শহরের অদূরে বাকুলিয়া গ্রামের দিকে ঘুরতে গিয়েছিল সে। গ্রামটা কেমন যেন মরা মরা লাগে কিশোরের। নিস্তব্ধ। মনে হয় এই গ্রামে বুঝি কোনো জনমানব বাস করে না। অনেকক্ষণ হয় এই গ্রামে এসেছে সে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো মানুষের দেখা পায়নি কিশোর। ঘরবাড়ি আছে ঠিক, তবে সব যেন গভীর ঘুমে অচেতন। আসলে এখন পরিস্থিতিই এমন। অজানা ভয়ে পারতপক্ষে কেউ ঘর থেকে বাইরে বের হয় না। বাড়িঘরে পুরুষ বা ছেলেমানুষ তেমন একটা নেই বললেই চলে। যারা দু–একজন আছে, তারা ভয়ে-আতঙ্কে ঘরের ভেতর সেঁধিয়ে আছে যে যার মতো।

তখন বিকেল। কিশোর আনমনে হেঁটে চলেছে পুব দিকে। উদ্দেশ্যহীন পথচলা যাকে বলে। মোটামুটি সন্ধ্যার মধ্যে বেকারিতে ফিরলেই চলবে। কাল ভোর থেকে ওর ডিউটি শুরু। তাই ফেরার জন্য তেমন তাড়াও অনুভব করে না।

হঠাৎ সব রকম নীরবতা ভেদ করে কেমন একটা গোঁ-গোঁ আওয়াজ ভেসে আসে কানে। গাড়ির শব্দ। কিশোর শুনেছে, হানাদার বাহিনী এখন যখন–তখন গ্রামে গ্রামে ঢুকে মানুষ মারছে। একে-তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে ওদের ক্যাম্পে। তারপর কথা আদায়ের নামে নির্যাতন করে মেরে ফেলছে। এ গাড়ি ওই হানাদারদের না হয়েই যায় না।

গাড়ির শব্দ দ্রুত কাছে চলে আসছে। সামনেই একটা বাঁকমতো জায়গা। গাড়িতে চেপে যারা আসছে, রাস্তার বাঁক ঘুরলেই দেখতে পেয়ে যাবে ওকে। কিশোর তাই সতর্ক হয়ে গেল। চট করে রাস্তা থেকে নেমে নিচের খাঁড়িতে এক ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল।

আর তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দুটি জলপাই রঙের গাড়ি ধুলা উড়িয়ে কিশোরের সামনে দিয়ে ভোঁ করে চলে গেল। ও চোখ বড় বড় করে দেখল, এক গাড়িতে জনাছয়েক মিলিটারি রাইফেল নিয়ে বসা। মাথায় হেলমেট। এই প্রথম কোনো মিলিটারি এবং তাদের গাড়ি দেখল কিশোর। এর আগে কেবল ওদের নিয়ে ভয়ের গল্পই শুনে এসেছে। দেখেনি।

বয়স কম হলেও কিশোর সাহসী। ও কিছুতে ভয় পাওয়ার ছেলে নয়। সিদ্ধান্ত নিল, ওদের অনুসরণ করবে সে। কোথায় যায়, কী করে নিজের চোখে দেখবে। দেখতেই হবে। যেই ভাবা, সেই কাজ। খাঁড়ি থেকে রাস্তায় না উঠে পাড় ধরে দৌড়াতে শুরু করল কিশোর। দৌড়াতে গিয়ে কত কাঁটা আর শুকনা ডালের খোঁচা খেল, কিন্তু কোনো কিছুরই পরোয়া করল না কিশোর। যেহেতু রাস্তায় উঠলেই ওদের চোখে পড়ে যাবে সে। তাই এই ব্যবস্থা।

তুমি কে ভাই? এমন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাকে বাঁচাতে এলে কেন? আমি তো ভাবতেও পারিনি ওদের কবজা থেকে আর রেহাই পাব। আল্লাহর অশেষ রহমত, তুমি সাহস করে গাড়ি থেকে তুলে নিয়ে এলে। না হলে যে আজ...

গ্রাম্য কাঁচা রাস্তা। গাড়ি খুব একটা জোরে চলতে পারছে না। তাই কিশোরের ওই গাড়ি ফলো করতে তেমন অসুবিধাই হলো না।

বেশিক্ষণ দৌড়াতে হলো না ওর। মিনিট পনেরো পরই কিশোর দেখল, গাড়ি দুটির একটা আধা কাঁচা এক বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আর অন্যটা থামল না। সামনে চলে গেল। পেছনের গাড়িটা থামতেই ধুপধাপ করে অস্ত্র বাগিয়ে মিলিটারিরা গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। কিশোরের অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠল। আহা রে, কার জানি আজ সর্বনাশ হয়!

কিশোর পাশের কলাবাগানের আড়াল নিয়ে সামনে চোখ রাখল। একটু বাদেই বাড়ির ভেতর থেকে নারীদের কান্নাকাটির আওয়াজ। এরপর একটানা কয়েক রাউন্ড গুলির শব্দ। তারপর থেমেও গেল কান্নাকাটি। বেশি একটা সময় গেল না। বাড়ির ভেতর থেকে দুজন মিলিটারি একটা ছেলেকে হিড়হিড় করে টেনে এনে ওদের গাড়িতে তুলল চ্যাংদোলা করে। বস্তা তোলার মতো করে দুজন ধরে ছেলেটাকে গাড়ির পাটাতনে ফেলে দিল।

যে ছেলেকে আনা হলো, তার হাত-পা আর মুখ বাঁধা। বয়স বেশি হবে না। কিশোরের চেয়ে কিছু বেশি হবে হয়তো। তারপর গাড়ির চালকসহ ওরা সবাই আবার বাড়ির ভেতর চলে গেল। তার মানে আরও কিছু কাজ বাকি রয়েছে। সেটাই আবার সারতে গেল সদলবলে।

দ্রুত মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল কিশোরের। এই সুযোগ। যা থাকে কপালে। ছেলেটাকে উদ্ধার করবে সে। আগুপিছু আর না ভেবে দ্রুত কলাগাছের আড়াল থেকে বের হয়ে এল কিশোর। ছুটল গাড়িটার দিকে। বিদ্যুত্গতিতে পৌঁছে গেল হাত-পা বাঁধা ছেলেটার কাছে। বাঁধন খোলার সময় নেই এখন। শক্ত–সমর্থ শরীর ওর। তাই ছেলেটাকে পাঁজাকোলা করে ধরে কাঁধে তুলে নিল। তারপর ভোঁ-দৌড়। বেশ দূরে ঘন জঙ্গলের ভেতর তাকে নামিয়ে হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিল। মুক্তি পেয়ে ছেলেটা হাউমাউ করে বেশ শব্দ করে কেঁদে উঠল। বলল, ওরা আমার মা–বাবাকে আর বোনকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। কিশোর মুখে আঙুল ঠেকিয়ে তাকে কাঁদতে নিষেধ করল। ওর কথায় ছেলেটা শব্দ করে কান্না বন্ধ করলেও ফুঁপিয়ে কান্না থামাতে পারল না। কিশোর আর বাধা দিল না। ভাবল, কাঁদুক। কেঁদে একটু হালকা হোক। একটু পর ছেলেটা কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে কিশোরকে জড়িয়ে ধরল। বলল, তুমি কে ভাই? এমন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাকে বাঁচাতে এলে কেন? আমি তো ভাবতেও পারিনি ওদের কবজা থেকে আর রেহাই পাব। আল্লাহর অশেষ রহমত, তুমি সাহস করে গাড়ি থেকে তুলে নিয়ে এলে। না হলে যে আজ...

আরও কী যেন বলতে যাচ্ছিল ছেলেটা। কিশোর তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আমি তেমন কেউ না ভাই। আমার নাম কিশোর। মা–বাবা নেই। বাড়িঘরও নেই বলতে পারো। শহরের একটা বেকারিতে ছোট কাজ করি। আজ আমার ছুটির দিন। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই তো তাই এদিকে বেড়াতে এসেছিলাম। এখানে যা হলো, সব আমারই সামনে ঘটল। তাই সুযোগ পেয়ে তোমাকে তুলে নিয়ে এলাম। জীবন-মরণ এসব নিয়ে ভাবিনি ভাই।

কথা শেষ করল কিশোর। আর এর মধ্যেই দেখল আকাশে ধোঁয়ার কুণ্ডলী। এই দেখেই ছেলেটা আবারও কান্না শুরু করল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ওই দেখো, শয়তানগুলো আমাদের বাড়িটাও জ্বালিয়ে দিয়েছে।

কিশোর হাঁ করে দেখল সেই বাড়িটা দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুনে।

কিশোর বলল, এটা তবু মন্দের ভালো ভাই। ওরা বাড়িতে আগুন লাগাতে গিয়েছিল বলেই তোমাকে উদ্ধার করতে পেরেছি। দুঃখ কোরো না। আমার মনে হয়, এখন আসলে দুঃখ করার সময় না ভাই। প্রতিশোধ নেওয়ার সময়। আমি তো এর আগে কেবলই লোকমুখে ওদের নির্মমতার কথা শুনেছি। আজ চোখে দেখলাম। ওরা সত্যিই খুবই ভয়ংকর। ওদের আর ভয় পাওয়া চলবে না। ভয়কে জয় করে আমাদের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। শোনোনি, বঙ্গবন্ধু কী বলেছেন?

ছেলেটার নাম সোহরাব। তার চেয়েও বয়সে ছোট কিশোরের মুখে বড় মানুষের মতো কথা শুনে বিস্মিত হয়ে যায় সে। আসলে সে–ও দেশ বাঁচাতে মুক্তিবাহিনীতে নাম লিখিয়েছে। মা–বাবার কাছে বিদায় নিতে এসেছিল আজ। ব্যাপারটা কীভাবে যেন মিলিটারিরা জেনে যায়। আর তাই সোহরাবকে ধরতেই ওরা এসেছিল। মা-বাবা আর বোনটা বাধা দেওয়ার কারণে ব্রাশফায়ারে ওদের মেরে ফেলেছে তারা।

ওদিকে ওই বাড়িতে আগুন লাগিয়ে ফিরে এসে সোহরাবকে গাড়িতে না দেখে পাগল হয়ে গেছে শকুনগুলো। আর অমনি মেজাজ হারিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করে দিয়েছে শয়তানরা।

সেখানে আর থাকাটা ঠিক মনে করল না ওরা। এ ঘটনার পর জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞা নিয়ে ওরা দুজন জলা–জঙ্গল পেরিয়ে শহরে চলে এল। সোহরাব এক দিন থাকল কিশোরের কাছে। তারপর যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য ট্রেনিং নিতে ভারতে চলে গেল। কিশোরও যেতে চেয়েছিল সোহরাবের সঙ্গে। কিন্তু সোহরাব তাকে বুঝিয়েছে, আমি এখন যাচ্ছি বন্ধু। দরকার হলে আমিই তোমাকে ডেকে নেব। আর তোমার কাজ হলো, আজকের মতো করেই অসহায়-নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো। আজ যেভাবে তুমি আমায় বাঁচালে, আমি জানি, আশপাশে থেকে তুমি আরও মানুষকে এভাবে বাঁচাতে পারবে। সাহায্য করতে পারবে। তবে হ্যাঁ, অবশ্যই খুব সতর্ক হয়ে, নিজেকে নিরাপদ রেখে। এটাই তোমার লড়াই। এটাই তোমার যুদ্ধ।...

বড় অবহেলা আর বঞ্চনার মধ্য দিয়ে এই বয়স পর্যন্ত এসেছে কিশোর। তাই হারানোর কিছু নেই ওর। সে কারণে পিছুটান বলতেও তেমন কোনো বাস্তব অনুভব নেই ওর মগজের ভেতরে।

আর সময় নিতে চায় না সে। খুব সাবধানে জারের ছিপি খুলে কেমিক্যাল ঢালতে শুরু করল। সেই কেমিক্যাল দিয়ে সুন্দর একটা চক্র তৈরি করল। বাকিটুকু জানালা-দরজায় ছিটিয়ে দিল।

পাকিস্তানি বাহিনীকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য ও ছটফট করতে থাকে বেকারিতে বসেই। এর মধ্যে একদিন শহরের অদূরে অবস্থিত পাকিস্তানি বাহিনীর আস্তানাও দেখে এসেছে চুপি চুপি। ওই দিনই সে এই প্ল্যান করে ফেলেছে কীভাবে কী করবে। আস্তানা বলতে একটা স্কুলঘর। ওই স্কুলঘরটাকেই ওরা ওদের ক্যাম্প বানিয়েছে। এই ক্যাম্পে সব মিলিয়ে জনা চল্লিশেক মিলিটারি থাকে।

কিশোর খুব গোপনে খোঁজ নিয়ে দেখেছে, ওরা যেখানে যায় সাধারণত রাতের প্রথম প্রহরেই যায়। আর অপারেশন শেষ করে শেষ রাতে ক্যাম্পে এসে বেঘোরে ঘুমায়। অবশ্য পাহারায় থাকে কজন। আর এই সময়টাই কিশোর বেছে নিতে চায় ওর কাজের সুবিধার্থে।

এ জন্যই আজ রাতে শুয়ে ওর ছটফটানিটা একটু বেশিই। কদিন বেশ কুয়াশা পড়ছে। আজ আরও ঘন। এই কুয়াশায় সামান্য দূরেও তেমন কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। এ ব্যাপারটা ওর জন্য বাড়তি পাওয়া হিসেবে দেখা দিল আজ।

পা টিপে টিপে বের হয়ে এল বেকারি থেকে। হেঁটে গেলে বেশি হলেও আধা ঘণ্টা সময় লাগবে। মাথায় মাঙ্কি টুপি। কারও সঙ্গে দেখা হলেও যাতে চট করে কেউ ওকে চিনতে না পারে। হাতে পাঁচ লিটারের উচ্চমাত্রার কেমিক্যালের জার। ঘোরাপথে না গিয়ে ও সোজাপথ ধরল। তাতে আরও একটু সময় বাঁচল। ক্যাম্পের ঠিক পেছনে গিয়ে পৌঁছাল কিশোর। কুয়াশার শ্যাডো পেয়ে দারুণ খুশি সে। ক্যাম্পের পেছনের ডান দিকে একজন মিলিটারি পাহারায়। কিন্তু সে চেয়ারে বসে ঘুমাচ্ছে বুঝতে পারল কিশোর। কারণ, ও যখন পেছনে গিয়ে গাছের আড়ালে দাঁড়াল, তখন একটা ছুঁচো শব্দ করে ডাকতে ডাকতে পালাল। এরপরও বেটার কোনো নড়নচড়ন টের পেল না। সামনেটাও দেখে এল বিড়ালপায়ে। সেখানে দুজন একই কায়দায় ঘুমাচ্ছে। তিনজনের পাহারায় এত বড় একটা ক্যাম্প! কিশোর কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না। অতি আত্মবিশ্বাস হলে যা হয় আরকি।

আর সময় নিতে চায় না সে। খুব সাবধানে জারের ছিপি খুলে কেমিক্যাল ঢালতে শুরু করল। সেই কেমিক্যাল দিয়ে সুন্দর একটা চক্র তৈরি করল। বাকিটুকু জানালা-দরজায় ছিটিয়ে দিল।

ওর একটাই প্রার্থনা ছিল, কেমিক্যাল ছিটানোর সময় যেন কেউ টের না পায়। তাহলে সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে যাবে। মানে কিশোর কিছুতেই পরাজিত হতে চায় না। এদের শেষ করার পর ওকে কেউ মেরে ফেললেও ওর কোনো দুঃখ থাকবে না। আবার কেমিক্যালে কিছুটা গন্ধও ছিল। সেই গন্ধেও যদি কেউ জেগে ওঠে, তাহলেও সব মাঠে মারা যাবে। কিশোরের একান্ত চাওয়া ওদের গভীর ঘুমের এই সময়টা। জতুগৃহ বানিয়ে সব কটাকে শেষ করতে চায় সে। তবেই না ওর শান্তি।

খুব সন্তর্পণে কিশোর প্রাথমিক কাজটুকু শেষ করে ফেলল। এরপর দেশলাই বের করে যেই কাঠি ঠুকতে যাবে, এ সময় এক পাহারাদার ওকে দেখে ফেলেছে। কিশোর ওর কাছাকাছিই ছিল। আর উপায় নেই বুঝতে পারল কিশোর। এখন অবস্থা এমন যে হয় মারো, নয় মরো...মাত্র কয়েক সেকেন্ড। কিশোর লোকটির ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আর লোকটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওর হাতে থাকা বন্দুক ছিনিয়ে নিয়েছে। আর সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশন। বন্দুকের বাঁট ঘুরিয়ে ক্ষিপ্রগতিতে লোকটার মাথায় সজোরে চালান করে দিল। সে ঘোরারও সময় পেল না। একটা তীব্র আর্তনাদ করে পাক খেয়ে লুটিয়ে পড়ল সেখানেই।

এসব দেখার সময় নেই কিশোরের। আসল কাজটাই এখনো বাকি। এ বেটার আর্তনাদ শুনে নিশ্চয়ই ওরা জেগে যাবে। সুতরাং...দেশলাই জ্বালিয়ে কেমিক্যাল চক্রে ফেলে দিতেই ফস করে আগুন ধরে গেল। ওদিকে সামনে থেকে প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়ে গেছে। আর এদিকে মুহূর্তেই আগুন গোটা ক্যাম্পের চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে।

কিশোর আর পেছনে তাকাল না। এক দমবন্ধ করা দৌড়ের মাধ্যমে দূরে কুয়াশার মধ্যে মিশে গেল সে। তবে হাতের বন্দুকটা ছাড়েনি। ভাবল, আসলে সে তো বন্দুক চালাতে জানে না! তাতে কী? বন্ধু সোহরাবের কাছ থেকে শিখে নেবে। আর তার আগপর্যন্ত এটা আজকের মতো মুগুরের কাজ তো দেবে!