শব্দগুলোর অর্থ বদল

শব্দ এবং তার অর্থ চিরকাল এক সুতোয় বাঁধা থাকে না। বহু শব্দ তার মূল অর্থ পরিত্যাগ করে নতুন অর্থ গ্রহণ করে। ব্যাপারটা ভাষার নিজস্ব শব্দের বেলাতেও ঘটে। আবার ভান্ডারে আসা বিদেশি শব্দ অর্থাৎ কৃতঋণ শব্দের বেলায়ও ঘটে।

শব্দ ও অর্থের বাঁধন কখনো আলগা হয়, কখনো আবার একেবারেই কেটে যায়। এমনটা কেন হয়, তার কারণ বহু।

কখন কী কারণে ব্যাপারটা ঘটে সে বড় সহজ কথা নয়। সে কথা বলতে পারেন কেবল ভাষার পণ্ডিতগণ। তা তাঁদের গবেষণার বিষয়। আমাদের বিষয় অভিধানের গল্প। আমরা বরং গবেষণা নয়, গল্পতেই থাকি।

অলংকরণ: সালমান সাকিব

জাহাজ

জাহাজ পানিতে চলে, আকাশেও চলে। মাটিতে যে চলে না, এমনটাও নয়। উটকে তো মরুর জাহাজ বলা হয়। উট যন্ত্র নয়, জ্যান্ত। মাটিতেই চলে।

জাহাজ হয় নানা রকমের—মালবাহী জাহাজ, যাত্রীবাহী জাহাজ, যুদ্ধজাহাজ, ডুবোজাহাজ ও উড়োজাহাজ। জাহাজ নিয়ে বাগ্‌ধারাও রয়েছে বাংলায়—বিদ্যার জাহাজ। বাগ্‌ধারাটা যে খুব ইতিবাচক, এমনটা বলা যাবে না।

উড়োজাহাজের আরেক নাম বিমান। বিমান শব্দের মূল অর্থ কিন্তু আকাশ। উড়োজাহাজ আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত আমাদের কবিরা আকাশ অর্থেই বিমান শব্দটি ব্যবহার করতেন। পরে অনেক দিন পর্যন্ত চলেছে। কাজী নজরুল এবং অতুলপ্রসাদের গানেও আকাশ অর্থে বিমান শব্দের ব্যবহার দেখা যায়।

জাহাজ বাংলা ভাষায় কৃতঋণ শব্দ। আরবি শব্দ, কিন্তু ফারসি হয়ে বাংলায় আগমন। শব্দটির মূলে রয়েছে আরবি বাক্যাংশ—মারকাহ-ই-জাহাজ। অর্থ হলো মালবাহী যান। আর শুধু জাহাজ শব্দের অর্থ মালপত্র।

জাহাজ জলযান হয় ফারসি ভাষায়। ফারসিতে অবশ্য জাহাজ বলতে আরও অনেক কিছু বোঝাত। কিন্তু মুখ্য অর্থ জলযানই ছিল। বাংলা ভাষা ফারসি জাহাজের সঙ্গে আর কিছু আনেনি, মুখ্য অর্থটাই শুধু এনেছে।

অভিধান ব্যাকরণ যাই-ই বলুক, বাঙালি জাহাজকে নিজের ভাষার শব্দ বলেই মনে করে। তাই বাগ্‌ধারার পাশাপাশি জাহাজ নিয়ে প্রবাদও তৈরি হয়েছে বাংলায়—আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজের খোঁজ নিয়ে লাভ কী! এ প্রবাদে ব্যক্ত হয়েছে অক্ষমের আক্ষেপ।

অলংকরণ: সালমান সাকিব

নাস্তা

সকালের যে খাবার বাংলায় ক্ষেত্রবিশেষে কখনো তা নাস্তা, কখনো ব্রেকফাস্ট, আবার কখনো তা প্রাতরাশ। তিনটি শব্দই বিশেষ বিশেষ সামাজিক অবস্থান নির্দেশ করে। নাস্তা শব্দটি নাশতা বানানেও চলে।

বাংলার কৃষক-শ্রমিক সকালের খাবার খেয়ে এবং দুপুরেরটা সঙ্গে করে কাজে বের হন। বড়লোক বাঙালি বাড়িতে কিংবা দামি রেস্তোরাঁয় ব্রেকফাস্ট সারেন। অধিকাংশ বাঙালি নাস্তা করে। এককালে প্রাতরাশ করত গল্প-উপন্যাসের চরিত্ররা। বাস্তবের বাঙালি প্রাতরাশ করে না। বড়জোর কেউ কেউ প্রাতর্ভোজন করে।

নাস্তা ফারসি ভাষার শব্দ। উচ্চারণ মোটামুটি ঠিক থাকলেও বাংলায় এসে শব্দটার অর্থ পুরোপুরি উল্টে গেছে। ফারসিতে শব্দটির অর্থ হলো ক্ষুধার্ত, যে সকালে কিছুই খায়নি। কিন্তু বাংলায় তা হয়েছে সকালের খাবার।

অলংকরণ: সালমান সাকিব

দখল

দুর্বৃত্তরা জমিজমা, বাড়ি থেকে শুরু করে নদ–নদী, খাল–বিল সবই দখল করার চেষ্টা করে। অভাগাদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট অকারণে বেদখল হয়ে যায়। ক্ষমতাবানেরা অন্যের সম্পত্তি জবরদখল করে নেয়। সরকারি কাজে জমি অধিগ্রহণের জন্য হুকুমদখলের নোটিশ জারি করা হয়। দখল বাংলা ভাষার বহুল ব্যবহৃত ও গুরুত্ববহ একটি শব্দ। ফারসি ভাষা তার যথেষ্ট দখল—দখল নিয়ে প্রশংসাসূচক এমন বাক্যও বিরল নয় বাংলায়।

মোটকথা, দখল শব্দটি নানা অর্থে ব্যবহৃত হয় বাংলা ভাষায়। অধিকার, আয়ত্ত, কর্তৃত্ব, পটুত্ব—সবই দখল শব্দের অর্থের মধ্যে পড়ে। এখন কে কী অর্থে দখল শব্দটা ব্যবহার করবেন, সে দায়িত্বটা তাঁর।

দখল আরবি ভাষার শব্দ, কিন্তু এখন বাংলা ভাষারও দখলে। তবে বাংলা ভাষায় এসে শব্দটার আরবি ভাবসাব কিছুই নেই। উচ্চারণে খানিকটা থাকলেও অর্থের মধ্যে আরবি ভাব একেবারেই নেই। কারণ, আরবিতে দখল শব্দের অর্থ প্রবেশ করা।

অলংকরণ: সালমান সাকিব

পাপোশ

শব্দটা পাপোট বানাতেও দেখা যায়। তাতে অবশ্য অর্থের কোনো হেরফের হয় না। শব্দটি ফারসি ভাষার। বাংলায় এসে শব্দটি তার নিজের মূল অর্থ হারিয়ে ফেলেছে।

বাংলায় পাপোশ শব্দের অর্থ হলো পায়ের, জুতা-স্যান্ডেলের ধুলাবালু মোছার জন্য দরজার সামনে বিছানো আস্তরণ। এই আস্তরণ নারকেলের ছোবড়ার হতে পারে, আগে তা-ই হতো, পাটেরও হতে পারে। এখন অবশ্য ঝুট কাপড়েরও হয়, সিনথেটিক উপাদানেও হয়। মোছার কাজ অবশ্য সবটাতেই চলে।

মূল ফারসি ভাষায় শব্দটির দুটি অংশ—পা এবং পোশ। ফারসি পা আর বাংলা পা-তে বিন্দুমাত্র ফারাক নেই। একটাই অর্থ। কী করে এমনটা হলো তা পণ্ডিতগণই বলতে পারেন। বাংলা ব্যাকরণ ও অভিধানমতে, বাংলা পা—সংস্কৃত পদ থেকে তৈরি। ফারসি ভাষা থেকে আমদানি করা নয়।

ফারসি পোশ শব্দের অর্থ হলো জামা। তাই জোড়া লাগা পাপোশ শব্দের অর্থ পায়ের জামা অর্থাৎ কিনা জুতা বা স্যান্ডেল! আর শব্দটা বাংলায় এসে হয়েছে জুতার ময়লা মোছার আস্তরণ।

অলংকরণ: সালমান সাকিব

মৌজ

যেসব আরবি শব্দ বাংলা ভাষায় এসে উচ্চারণ ও অর্থ হারিয়ে পরিচয় সংকটের মধ্যে পড়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি শব্দ হলো মৌজ বা মউজ।

বাঙালি মৌজে থাকে। মৌজ করে। আনন্দ পেতে থাকা বন্ধুকে দেখে আরেক বন্ধু বলে, ‘বেশ তো মৌজে আছিস।’ বাংলা কবিতায় এককালে মৌজ শব্দটা বেশ চলত। এখন আর তেমনটা দেখা যায় না। তবে মুখের কথা থেকে শব্দটা হারিয়ে যায়নি।

বাংলায় মৌজ শব্দটার অনেক রূপ। এর মধ্যে অধঃপতিত রূপও রয়েছে। নেশাগ্রস্ত অবস্থাকেও মৌজে থাকা বলা হয়।

স্ফূর্তি, আমোদ–প্রমোদ, বিভোরতা, সমারোহ করা—সবই বাংলা মৌজ শব্দের অর্থের অন্তর্গত। কিন্তু শব্দটির আরবি অর্থ হলো ঢেউ, তরঙ্গ।

আরবিতে মৌজ ওঠে নদীতে, সাগরে। বাংলায় মৌজ ওঠে খুশিতে থাকা মানুষের প্রাণে।