প্রতি ক্লাসেই ক্লাস করার সময় মনে হয়, ইশ্, আমি যদি ক্লাসের টিচারদের মতো বোর্ডের সামনে বসে ক্লাস নিতে পারতাম! একদিন আমার এই স্বপ্নটা খুবই বিস্ময়করভাবে পূরণ হলো। তখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। কোনো একটা কারণে নানুবাড়িতে গিয়েছি। আমার ছোট আন্টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। একদিন বায়না ধরলাম আমি তোমার স্কুলে ঘুরতে যাব। বায়না ধরলাম তো ধরলাম, ছাড়ার কোনো কথা নেই। আমার নানুর চাপে আন্টি আমায় স্কুলে নিয়ে গেলেন। স্কুলে গিয়েই স্কুলের হেড স্যারের সঙ্গে আমায় পরিচয় করিয়ে দিলেন। হেড স্যারকে আন্টি বললেন, ‘আমার ভাগনে, বড় আপুর ছেলে।’ তিনি আমার নাম, কোন স্কুলে পড়ি—সব জিজ্ঞাসা করলেন। হয়তো আমার সঙ্গে কথা বলে তাঁর ভালোই লেগেছিল। ওই দিন আন্টির স্কুলে পাঁচজনের মধ্যে দুজন ছুটিতে ছিলেন। আর হেড স্যারসহ চারজনের স্কুল নিয়ন্ত্রণে প্রায় হিমশিম খাওয়ার মতো অবস্থা। এমনকি একজন দুটো শ্রেণিতে পর্যন্ত ক্লাস নিচ্ছিলেন। আর আমি পুরো স্কুল ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। আর আমায় স্কুলের তিনজন শিক্ষক খুবই সমাদর করছিলেন। তখন হঠাৎ আমি একটা শ্রেণিকক্ষের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। ক্লাসে স্যার নেই। তাই সবাই হট্টগোল করছিল।
তখন হঠাৎ হেড স্যার ওখানে এলেন। ক্লাসে গিয়ে সবাইকে চুপ করতে বললেন। ক্লাসের সামনে আমাকে পেয়ে আমাকেই বলে বসলেন, ‘বাবা, তুমি একটু এই ক্লাসে যাও তো।’ আমি তখন কিছু বুঝলাম না। যখন বুঝলাম, তখন আমি আকাশ থেকে পড়লাম। অবাক হয়ে বললাম, স্যার, আমি ক্লাস নেব? হেড স্যার বললেন, ‘ভয় কিসের, যাও না।’ একপ্রকার জোর করে আমায় ক্লাসে ঢোকালেন। আমি তো মহাখুশি। তবে প্রকাশ করলাম না। পেছন থেকে তিনি বলে গেলেন, ‘এ্যাই স্যার যাচ্ছে, সবাই দাঁড়াও।’ বলেই তিনি চলে গেলেন। আমি ক্লাসে ঢুকতেই সবাই সমস্বরে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম স্যার।’ আমার কেমন যেন লজ্জা লাগল। আমাকে স্যার বলতে নিষেধ করলাম। ভাই–ই বলতে বললাম। আমি তখন পড়লাম মহাবিপদে, এত দিন শুধু ক্লাস করেছি, আজ নিতে হবে। শ্রেণিটা ছিল প্রথম শ্রেণি। তারপরও আমার পা কাঁপা শুরু করল। আমি তখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম ক্লাস নেওয়াটা কত কঠিন। শুধু মনে হচ্ছিল এখনই যদি কেউ একটা কঠিন প্রশ্ন করে সবে! যদি উত্তর না পারি, তাহলে তো শেষ। যাহোক ওই যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে কোনোমতে আমি রেহাই পেলাম। আর ওই দিন থেকে বুঝলাম, শিক্ষক হওয়া আর ক্লাস নেওয়া কত কঠিন।