শোধ

অলংকরণ: সব্যসাচী চাকমা

শুভ্রা তাদের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছে। শুভ্রার গ্রামের বাড়িতে যাওয়া মানে শুধুই ঘোরা। যেমন আজকে! উঠে পড়ল সকাল সাড়ে ছয়টায়। মুখ ধুয়ে বেরিয়ে পড়ল গ্রামের রাস্তায় হাঁটতে। সে এখন নদীর ধারে হাঁটছে। হঠাৎ কেউ বলে উঠল, ‘সবাই আমার ওপর ময়লা–আবর্জনা ফেলে, মাঝে মাঝে মনে হয় আমি একটা ময়লার ঝুড়ি হয়ে গিয়েছি!’ এই কথা শুনে শুভ্রা সামনে-পেছনে দেখতে লাগল। আর মনে মনে বলতে লাগল, ‘কই? আগে-পিছে তো কেউ নেই। তাহলে কে এই কথা বলল?’ সে কিছুক্ষণ ভাবতে লাগল। তারপর কিছুক্ষণ বিড়বিড় করল, ‘কী জানি! কী শুনতে কী শুনেছি! এখন হাঁটা লাগাই, বাবা! না হলে বেশি দেরি হয়ে গেলে নানু আবার পুরো গ্রাম খুঁজতে শুরু করে দেবে।’

শুভ্রা হাঁটা শেষ করে বাসায় চলে এসেছে। নাশতা করে কিছুক্ষণ মামাতো-খালাতো ভাইবোনদের সঙ্গে গল্পগুজব করে আবার বেরিয়ে পড়ল হাঁটতে। হাঁটতে হাঁটতে খেয়াল করল কিছু লোক মিলে একটা গাছ কেটে ফেলছে। ঠিক তখন কেউ বলে উঠল, ‘মেরো না আমায়, মেরো না! তোমাদের দুইটা পায়ে পড়ি! মেরো না আমায়! সত্যি করে বলছি আমাকে মারলে তোমাদেরই ক্ষতি হবে! আ আ আ!’ কে জানে, ওই লোকগুলো শুনতে পেল কি না! কিন্তু শুভ্রা যে শুনতে পেয়েছে, এটা নিশ্চিত। শুভ্রা আবার ভাবতে লাগল, ‘ঘটনা কী? এগুলো কি সত্যিই কেউ বলে? নাকি আমার মনের ভুল?’

বিকেলবেলা।

পুরো পরিবার তাদের আমবাগানে ঘুরছে। সবার হাতে ছোট একটা করে চানাচুরের প্যাকেট। শুধু শুভ্রার হাতে একত্রে সুতা দিয়ে বাঁধা তিনটা প্যাকেট। একটাতে তেঁতুল, পরেরটাতে লবণ-মরিচ এবং তার পরেরটা তেঁতুলের বিচি ফেলার জন্য। শুভ্রা প্রথমে তেঁতুলগুলোকে লবণ-মরিচের প্যাকেটের ভেতর গড়াগড়ি খাওয়াচ্ছে, তারপর একটা একটা করে মুখে পুরছে। আর বিচিটা ওই খালি প্যাকেটটাতে ফেলছে। সবার খাওয়া শেষ। শুভ্রার খাওয়াও প্রায় শেষ। শুভ্রা বাদে সবাই যখন প্যাকেটগুলো মাটিতে ফেলল, এখন কেউ বলে উঠল, ‘ফেলো, ফেলো! জীবনের সাধ মিটিয়ে নাও! পরিবেশদূষণ করছ না? এই আমি বলে দিচ্ছি, প্রকৃতি একসময় এমন শোধ নেবে, যে তোমরা অনুশোচনা করবে!’ শুভ্রা এই কথা শুনে খালাতো বোন পাখি আপুকে বলল, ‘আপু, কেউ কিছু একটা বলল শুনেছ? মনে হলো মাটি কথা বলছে।’ পাখি আপু বলল, ‘পাগল হয়ে গেছ? মাটি কথা বলবে?’ শুভ্রা কিছু একটা বলতে চায়, কিন্তু পাখি আপু তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, ‘চুপ! আর একটাও কথা না। যাও হাঁটা লাগাও।’

রাতের খাওয়া শেষে ঘুমিয়ে পড়ল সবাই।

ঘুম আসছে না শুভ্রার। আজকে যা যা ঘটল তার সঙ্গে, তা নিয়ে বেশ চিন্তিত সে। ‘আচ্ছা, ওই কথাগুলো কে বলেছিল?’ ভাবল শুভ্রা। ‘নাকি আমি ভুল শুনেছি? নাহ! মানুষ একবার ভুল শুনতে পারে, দুবার ভুল শুনতে পারে, কিন্তু তিন–তিনবার কি কেউ ভুল শোনে?’ ভাবতে ভাবতে শুভ্রা ঘুমিয়ে পড়ল।

প্রায় ৯ বছর পর...২০২১ সাল...

২১ বছর বয়সী শুভ্রা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

এখন করোনা মহামারি চলছে। শুভ্রা এখনো ওই দিনগুলো ভোলেনি। এই করোনা মহামারি আসার এত দিন পর বুঝতে পারল, ওই কথাগুলোর অর্থ কী ছিল!

মানুষ একটু সচেতন হলে হয়তো এই দিনগুলো আমাদের দেখতে হতো না, সহ্য করতে হতো না। কী জানি, হয়তো প্রকৃতি আমাদের ওপর শোধ নিচ্ছে!

লেখক: পঞ্চম শ্রেণি, কোয়ালিটি লারনার্স হাইস্কুল, ঢাকা