সবজির বাহারে, শীতকাল আহা রে

অলংকরণ: সারা তৌফিকা

- রাজামশাই?

- উঁ?

- একটা বিচার ছিল।

- বিচার? এই শীতের সাতসকালে? কার বিচার? তোমার নাকি উজিরমশাইয়ের?

- আরে ছি ছি, না রাজামশাই। চোর ধরেছে পেয়াদারা। দিক না হয় মুণ্ডুটা কচাৎ করে।

- তাই তো দেবে। কিন্তু চুরিটা করেছে কী?

- জি, ওই একটু শাকসবজি।

- শাকসবজি?

- মানে রাজবাগান থেকে ওই একটু ফুলকপি, একটু বাঁধাকপি, কয়েকটা শিম আর একগোছা ধনেপাতা।

- ফেলে দাও। মুণ্ডুটা কচাৎ করে ফেলে দাও। রাজ্যে এমন এলেবেলে চোর থাকার দরকার নেই। এত কিছু থাকতে কিনা চুরি করতে গিয়েছে কয়েকটা আগাছা?

- গোস্তাখি মাফ করবেন হুজুর। মুণ্ডুটা ফেলে দেওয়ার ব্যাপারটা পরিষ্কার। কিন্তু আগাছা কোনটাকে বলছেন?

- ওই তো এই শীতের সবজিগুলোকে। হিম হিম শীতকাল মানেই গরম সব খাবার খাওয়ার ঋতু। পোলাও থাকবে, কালিয়া থাকবে, খাসির মগজ থাকবে, গরুর ভুঁড়ি থাকবে, হাঁসের দমপোখত থাকবে। ওখানে সবজির মতো ঘাসপাতা খাবার কী আছে?

- যথাযথ বলেছেন জাহাঁপনা। এসব পেট গরম খাবারই খেতে হয়। তবে কিনা শীতের সবজিও একেবারে খারাপ নয়!

- কী সব মূর্খের মতো কথা বলছ, উজির? দেব নাকি তোমার মুণ্ডুটাও উড়িয়ে? বীরের দল চিবিয়ে চিবিয়ে খাবে মাংস, চুমুক দেবে হাড্ডির মজ্জায়, ওম তাপাবে উত্তম মত্স্য কাবাবের শয্যায়। তাতে সবজির জায়গা কোথায়? এই তো আমি নাশতায় খেয়ে এলাম চিতই পিঠার সঙ্গে হাঁসের মাংসের ভুনা আর একটু খাসির মাংসের রেজালা। শীতের ঠ্যালায় সব কর্পূরের মতো উবে গেছে। তুমি খেয়েছ কী?

- গোস্তাকি মাফ করবেন জাহাঁপনা। সকালবেলা চাট্টি ভাত খেতেই আমার ভালো লাগে। লাল লাল বিরোই চালের ভাত ফুটিয়েছিলেন গিন্নি, তারই সরওয়ালা মাড় দিয়ে স্টার্টার।

- মানে ভাতের মাড়ের স্যুপ?

- ঠিক ধরেছেন হুজুর। গরম ভাতের মাড়, লালরঙা, তাতে পুরু করে পড়েছে সর। ওই মাড় হালকা একটু লবণের ছিটে দিয়ে চুমুক দিলেই শীত গায়েব!

- তারপর?

- তারপর আর কী? ওই বিরুই চালের ভাতই এল। ওপরে এক খাবলা আলুভর্তা। সকালের আলুভর্তায় আমরা শুকনো মরিচ দিই না হুজুর, কাঁচামরিচ-পেঁয়াজে আলুভর্তা। আর তাতে থাকবে কড়া সরষের তেলের ধ্বক।

- ভালোই লাগে মনে হচ্ছে।

- ভালো লাগার কেবল তো শুরু হুজুর! ভাতে দুই চামচ গাওয়া ঘি ঢেলে নিন। তারপর অর্ধসেদ্ধ একখানা ডিম। ডিমের পেটে আঙুল দিয়ে একখানা গুঁতো দিলেই হড়হড় করে বেরিয়ে আসবে লালরঙা কুসুম। সেই ঘিয়ে-ভর্তায়-কুসুমে মাখানো গরম ভাত খেলে মনে হয়...কী বলব হুজুর... মনে হয় এর জন্য চাইলে উজিরগিরিও ছাড়তে রাজি আছি!

- খামোশ! মুখ সামলে কথা বলো উজির। সামান্য শাকসবজি নিয়ে এত আহা-উহু করার কী আছে?

- মাফ করবেন হুজুর। আমার ভুল হয়েছে। তবে সাহস দিলে একটা আরজি করতে চাই।

- কী আরজি?

- আজ দুপুরে গরিবের ঘরে দুটো ডালভাত খাবেন। শাকসবজি দিয়ে আপনাকে একবার আপ্যায়ন করতে চাই।

- ঠিক আছে, আরজি মঞ্জুর। খেলাম না হয় তোমার ঘরে দুটো শাকপাতা।

- যথা আজ্ঞা জাহাঁপনা। কিন্তু ওই চোরটার বিচারের কী হবে? কত্ত বড় সাহস, রাজবাগান থেকে সবজি চুরি করে! কল্লা ফেলে দিতে বলে দিই?

- দাঁড়াও। ওকে একটু শাস্তি দিয়ে তারপর কল্লা ফেলো। ওকে বেঁধে রাখো তোমার বাড়ি নিয়ে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খালি পেটে আমাদের খাওয়া দেখবে, তারপর না হয় মরল।

- ঠিক বলেছেন হুজুর। মরলে তো মরেই গেল। খিদে পেটে আগে আমাদের খাওয়া দেখে তারপর মরুক, ওটাই হবে ব্যাটার উপযুক্ত শাস্তি।

- ছি ছি ছি উজিরমশাই, এত দিনেও তোমাদের আক্কেল হলো না, তাহলে হবেটা কবে?

- দয়া করে গর্দান নেবেন না হুজুর। কী ভুল করেছি আমি?

- রাজপুরুষদের খাবার থাল হয় স্বর্ণের, পানপাত্র রুপার। আর তুমি কিনা দিয়েছ কাঁসার থালবাটি?

- গোস্তাকি মাফ করবেন। তবে কিনা ওই স্বর্ণের থালে রাজভোগই বেশি মানায়। সাধারণ ভাত-ডাল-সবজি এই কাঁসার থালেই ভালো লাগবে।

- ঠিক আছে, আনো কী খাওয়াবে। ভালো কথা, চোরটা কোথায়?

- হুজুর, ওই যে কোণের দিকে বেঁধে রেখেছে পেয়াদারা। সকাল থেকে না খাইয়ে রেখেছি। ভুখা পেটে আমাদের খাওয়া দেখুক।

- উত্তম উত্তম।

রাজামশাই পাত পেড়ে বসলেন। উত্তুরে হিম হিম হাওয়া বইছে। গায়ের চাদরটা আরও ভালো করে জড়িয়ে নিলেন।

কাঁসার থালে প্রথমেই বাড়া হলো ধোঁয়া ওঠা ভাত। সঙ্গে গরম–গরম ফুলকপি ভাজা।

রাজপুরুষদের খাবার থাল হয় স্বর্ণের, পানপাত্র রুপার। আর তুমি কিনা দিয়েছ কাঁসার থালবাটি?

রাজা ফুঁ দিয়ে ফুঁ দিয়ে ফুলকপি ভাজায় একটা কামড় দিলেন। তারপর আরেকটা। মুখের গরম কাটাতে হু-হা করলেন। তারপর বললেন, আরে! অদ্ভুত ব্যাপার! বাইরে কামড় দিতেই একেবারে মচমচ করে উঠল, আর ভেতরে কী সুন্দর নরম!

উজির বিগলিত হেসে বললেন, ফুলকপির বড়া হুজুর। ফুলুরিও বলে অনেকে।

- খালি খালিই তো খেতে ভালো লাগছে।

- খালি পেটে খেতে মজা, খাবার শুরু করার জন্য উত্তম অনুষঙ্গ। আবার গরম ভাত, ঘন ডালের সঙ্গে কামড়ে কামড়ে খেতেও মজা।

- অতি উত্তম। আনো তোমার পরের পদ।

পরের পদ অতি সাধারণ। শিমের ভর্তা। রাজা একটুখানি তুলে ভাতের সঙ্গে মাখালেন। মুখে দিতেই গরম ভাতের সঙ্গে ঠান্ডা ভর্তার আমেজ পেলেন। দাঁতের নিচে টের পেলেন নরম শিমের বিচি, কচকচ করা পেঁয়াজ কুচি, হালকা মরিচের ঘ্রাণ। প্রসন্নচিত্তে রাজা বললেন, ভালোই তো!

বলতে বলতেই রাজার চোখ বড় বড় হয়ে উঠল, নাসারন্ধ্র ফুলে ফুলে উঠল। উজির হাসিমুখে বললেন, সর্ষের তেলের ঝাঁজ হুজুর।

রাজা ততক্ষণে ধাতস্থ হয়েছেন। চাদরটা সরিয়ে বললেন, সর্ষের ঝাঁজে তো শীত চলে গেল উজিরমশাই!

উজির হেসে বললেন, ভালো লেগেছে কি না, বলুন হুজুর।

- আলবত। পেঁয়াজ, ধনেপাতা, কাঁচা মরিচের ঘ্রাণটাই পাগল করে দিল! কেমন একটা ঝাঁজালো সোয়াদ!

- আরে বাহ বাহ, হুজুর কি ঝাঁজ পছন্দ করেন? তাহলে সর্ষে বাটার সঙ্গে শিমের ওই ছেঁচকিটা খেয়ে দেখুন। ওই যে উজির সাহেবের ডান পাশের বাটিটা।

- কে? কে কথা বলে?

- হুজুর আমি কেউ না, ওই যে সবজিচোর।

- তোমার এত বড় আস্পর্ধা? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের খাওয়া না দেখে খাদ্য বিশেষজ্ঞের মতো উপদেশ দিচ্ছ!

- না না মহারাজ! আপনাকে উপদেশ দেব, এত সাহস কোথায়?

- তো চুরি করার সাহসটা কীভাবে হয়েছিল তাহলে?

- ওই সাহস অভাবে পড়লে হয়, হুজুর। ছেলেটা জ্বরের মুখে শিম দিয়ে দুটো ছেঁচকি খেতে চেয়েছিল। শিম কিনতে তো টাকা লাগে, আমার টাকা কোথায়? ভাত আর নুন কিনতেই সব শেষ! সবার বাগানের সবজিই বিক্রি হয়ে যায়, কেবল আপনার বাগানেই দেখি সবজি হয়, আবার ঝরে যায়। ওই দেখে দুটো তুলে নিতে গিয়েছিলাম। বাগানের মধ্যেও যে পেয়াদা লুকিয়ে আছে, কীভাবে জানব মহারাজ? তাই ধরা খেয়েছি।

- আহা...থাক, তোমার আর মুণ্ডু কেটে লাভ নেই। সবজি আসলে খুব একটা খারাপ জিনিস নয়। ইয়ে, উজিরমশাই, ও ব্যাটাকেও দুটো খাইয়ে দেওয়া যায়—কী বলো?

- যা আপনি বলেন মহারাজ! তবে গত কুড়ি বছরে অন্তত হাজার কুড়িবার আপনি কল্লা ফেলে দেওয়ার রায় দিয়েছেন, আবার হাজার কুড়িবার সেই রায় উঠিয়েও নিয়েছেন। প্রজারা তো এরপর শীতের তোড়েই কাঁপবে কেবল, রাজার ভয়ে আর কাঁপবে না হুজুর!

- আহা, থাক সে হিসাব। কল্লা কি কম আছে নাকি রাজ্যে? তুমিও তো দশাসই একখান নিয়ে ঘোরো। সুযোগমতো যেকোনো একটা ফেলে দেওয়া যাবে। এখন দেখি, ওই ব্যাটার হাতের বাঁধন খুলে দিতে বলো। আমাদের সঙ্গেই চাট্টে খাক।

তারপর? তারপর আর কী? রাজামশাইরা টেংরা মাছ দিয়ে পেঁয়াজকলি খেলেন, পালং শাকের ঘণ্ট চাখলেন, শালগমের বাটি চচ্চড়ি শুঁকলেন, কচি মুলোর ঘণ্ট মাখালেন, নতুন আলুর দম গিললেন, শোল মাছের সঙ্গে লাউয়ের ঝোল সাঁটালেন।

আস্ত কাতল মাছের মুড়োটা রাজার পাতে তুলে দেওয়া হলো। রাজা কিছুটা ভেঙে তুলে দিলেন উজিরের পাতে, কিছুটা চোরের পাতে। সঙ্গে সঙ্গেই শূন্যস্থান পূরণ করে দেওয়া হলো আলু, ফুলকপি, টমেটো আর মটরশুঁটির মাখা মাখা ঝোলে।

তৃপ্তি করে গরাস মেখে খেয়েদেয়ে রাজামশাই ঢেঁকুর তুললেন। উজির কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, হুজুর একটা পদ তো এখনো বাকি আছে।

- বলো কী হে, আবার কী বাকি?

- সামান্য একটু খাসির ব্যঞ্জন। বাঁধাকপি দিয়ে।

- কী মুশকিল! তোমাকে নিয়ে আর পারা গেল না। ভালো কথা, এই যে চোর ভাইয়া, যাওয়ার আগে তোমার থেকে জব্দ করা ওই শিমটিম যা আছে, নিয়ে যেয়ো তো। আর সবজি যখন যা দরকার পড়ে, আমার বাগান থেকে নিয়ে নিয়ো। আমার আবার এসব অভাব-টভাব দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়। কই হে উজির, নিয়ে এসো তোমার খাসি-বাঁধাকপির ব্যঞ্জন।

রাজামশাই রাজ কোমরবন্ধনী আলগা করে আবার লেগে পড়লেন, উজিরমশাই লেগে পড়লেন, চোর বেচারাও লেগে পড়ল।

রাজামশাইয়ের গল্প ফুরাল

নটেগাছটি মুড়াল।