সমুদ্রপারে পাঁচ বছর

সুন্দর কিছু যখন নেশা হয়ে যায়, তখন মানুষ কী-ই না করে। দারুণ কিছু মুহূর্ত ক্যামেরায় বন্দী করতে বহুদিন ধরেই নানা জায়গা ভ্রমণ করেছেন কুইন্টন লেক নামের এই ফটোগ্রাফার। নিজে পড়াশোনা করেছেন আর্কিটেকচার নিয়ে। কিন্তু আগ্রহের জায়গা থেকে হয়েছেন পেশাদার ফটোগ্রাফার। নানা দেশ, নানা বৈচিত্র্য, নানা মুহূর্তের ছবি তুলেছেন ২০ বছর ধরে। ঘুরেছেন ৭০টি দেশ! কিন্তু একটা সময় গিয়ে কুইন্টনের মনে হলো, আরে, নিজের দেশেরই তো খুব বেশি ছবি তোলা হয়নি। এবার নাহয় নিজের দেশের ছবিই তোলা যাক।

কুইন্টন লেক

কুইন্টনের বাড়ি ইউরোপের দেশ ইংল্যান্ডে। সুন্দর এই দেশে ছবি তোলার জায়গাও অনেক। বাড়িঘর, সমুদ্র, নয়নাভিরাম প্রকৃতি, গাছপালা, রাজপ্রাসাদ, আরও কত কী। কিন্তু বাকি সব রেখে শুধু সমুদ্র উপকূলেই ছবি তুলবেন বলে মনস্থির করলেন কুইন্টন। কিন্তু সমুদ্র উপকূলই কেন? প্রশ্ন করলে কুইন্টন বলেন, ‘একবার টেমস নদীর (ইংল্যান্ডের দীর্ঘতম নদী) পাশ দিয়ে আমি ছবি তুলতে বেরিয়েছিলাম। নদীটা একসময় সমুদ্রে মিশে যায়। জায়গাটা সত্যিই অসম্ভব সুন্দর। তখনই আমার মাথায় আইডিয়াটা এল। আরে, আমি তো সমুদ্রের তীর ঘেঁষে ছবি তুলতে পারি।’

ছবি: কুইন্টন লেক

যারা মানচিত্র জানো তারা বুঝবে, যুক্তরাজ্য হচ্ছে ইউরোপের একদম পশ্চিমের একটা দেশ। এর চারদিকে অন্য কোনো দেশ নেই। শুধুই সমুদ্র আর সমুদ্র। দেশটা খুব বড় না হলেও স্বভাবতই এর সমুদ্র উপকূলের দৈর্ঘ্য অনেক—১০ হাজার কিলোমিটারের বেশি। এত বড় জায়গার কোথায় ছবি তুলবেন কুইন্টন লেক?

এখানেই সবচেয়ে বড় পাগলামিটা করে বসলেন তিনি। সিদ্ধান্ত নিলেন, যুক্তরাজ্যের উপকূলজুড়ে হেঁটে হেঁটে ছবি তুলবেন। ১০ হাজার কিলোমিটার! চিন্তা তো কত কিছুই করা যায়, কিন্তু ১০ হাজার কিলোমিটারের চিন্তা বাস্তবে কি আদৌ সম্ভব? ৪০ বছর বয়সী কুইন্টন কিন্তু মনের চিন্তা শুধু মনে না রেখে ক্যামেরা, খাবার আর প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ঠিক বেরিয়ে পড়লেন।

শুরুতে খুব রোমাঞ্চকর মনে হলেও যাত্রাটা কিন্তু মোটেও বাধাহীন থাকল না। যাত্রার কিছুদিনের মাথায় কুইন্টন টের পেলেন, সমুদ্রপারে ছবি তোলা সহজ ব্যাপার নয়। সমুদ্রপারের একেক জায়গা একেক রকম। কোথাও অসমতল পাথুরে জমি, কোথাও নরম কাদা, কোথাওবা উঁচু পাহাড়। অনেক জায়গা তো একেবারে জনশূন্য, আরও অজানা বিপদের আশঙ্কা তো থাকেই। ‘একদিন ছবি তুলতে তুলতে হাঁটছিলাম। হঠাৎ টের পেলাম, কিছু একটায় আমার দুই পা আটকে গেছে। কোনোমতেই পা তুলতে পারছি না। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে, কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। অন্যদিক থেকে সমুদ্রে জোয়ারের পানি আস্তে আস্তে বাড়ছে। আমি সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। পরে দেখলাম, আস্তে আস্তে চেষ্টা করলে পা ওঠানো সম্ভব। তখন একটু করে পা ওঠাতে থাকলাম। শেষমেশ যখন নিরাপদ জায়গায় পৌঁছেছি, জোয়ারের পানি আমার পেট ছাড়িয়েছে!’ স্মৃতি ঘেঁটে নিয়ে বললেন কুইন্টন।

সমুদ্রে সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, রাতের সমুদ্র কিংবা সমুদ্রপারের মানুষগুলোর জীবন, কী ধরা পড়েনি কুইন্টনের ক্যামেরায়।
ছবি: কুইন্টন লেক

যাত্রার শুরুটা যে উদ্দেশ্য নিয়ে, সেই ছবি তোলা কিন্তু ভালোই চলছিল। অসীম সুন্দর পৃথিবীর অনন্যসুন্দর কিছু মুহূর্ত ইংল্যান্ডের সমুদ্রতীর ঘেঁষে ক্যামেরাবন্দী করে চলেছিলেন ২০ বছরের অভিজ্ঞ এই ফটোগ্রাফার। সমুদ্রে সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, রাতের সমুদ্র কিংবা সমুদ্রপারের মানুষগুলোর জীবন, কী ধরা পড়েনি কুইন্টনের ক্যামেরায়! আরও কত অপ্রত্যাশিত সুন্দর মুহূর্তও তো হাজির হয়েছে ক্যামেরার লেন্সের সামনে। হাজার কিলোমিটার হেঁটে হেঁটে এ রকম কিছু ছবি তোলার নেশায়ই তো এসেছিলেন তিনি। এ বিষয়ে একটা প্রশ্ন না করে আর পারলাম না, ‘আপনার পুরো ভ্রমণে সবচেয়ে সেরা মুহূর্ত কোনটা ছিল?’ কুইন্টন বললেন, ‘লিন্ডিসফার্ন দ্বীপ। ওখানে যাওয়ার জন্য একটা রাস্তা আছে। অদ্ভুত রাস্তা। জোয়ারের সময় পানির নিচে চলে যায় আবার ভাটার সময় ভেসে ওঠে। একদিন ভাটার সময়। রাতে আমি সেখানে পৌঁছালাম। সেদিন ছিল জ্যোৎস্না। চাঁদের আলোই আমাকে সেই রাস্তা দিয়ে নিয়ে চলছিল। আমার চারপাশে অবারিত সমুদ্র, প্রচুর বাতাস আর পায়ের নিচে ভেজা মাটিতে চাঁদের প্রতিফলন। আমার মনে হচ্ছিল, আমি যেন পানির ওপর দিয়ে হাঁটছি। শিউরে ওঠার মতো সুন্দর অনুভূতি।’

১১ হাজার কিলোমিটার হেঁটে, নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, ছবি তুলতে তুলতে একদিন কুইন্টন লেক পৌঁছান ঠিক সেই জায়গায়, যেখান থেকে তিনি যাত্রা শুরু করেছিলেন। তার মানে সত্যি সত্যিই তিনি হেঁটে এসেছেন পুরো যুক্তরাজ্য! এই অসাধ্য সাধন করে যখন তিনি বাড়ি ফিরছেন, তখন তাঁর বয়স ৪৫ বছর। শিরোনাম থেকেই ধরতে পেরেছ, পুরো যাত্রায় পেরিয়ে গেছে পাঁচটি বছর। ১৭ এপ্রিল ২০১৫ শুরু হওয়া এ অভিযানের শেষ নেমেছে এ বছর ১৫ সেপ্টেম্বরে। এত ধৈর্য, সাহস আর আগ্রহ এত দিন ধরে রাখা অবশ্যই অনেক কঠিন কাজ।

ইতিমধ্যে তাঁকে নিয়ে হইচই পড়ে যায়। বিবিসিসহ ইংল্যান্ডের বড় সংবাদমাধ্যমগুলো তাঁর এ যাত্রা নিয়ে খবর প্রকাশ করে। অভিজ্ঞতাপূর্ণ এই ফটোগ্রাফারকে বললাম বাংলাদেশের কিশোর-তরুণদের উদ্দেশে ভ্রমণ ও ফটোগ্রাফি নিয়ে কিছু বলতে। ভদ্রলোক বললেন, ‘তোমরা স্কুলের বইয়ে যা পড়ো, আসলে ভ্রমণ সেটার বাস্তব অভিজ্ঞতা দেয় না। তাই ভ্রমণ অবশ্য অবশ্যই করা উচিত। তবে ভ্রমণের সবচেয়ে কঠিন অংশ হচ্ছে ঘর থেকে বের হওয়া। নানা সংশয়, ভয় কাজ করে শুরুতে। একবার ভ্রমণে অভ্যস্ত হয়ে গেলে আর কঠিন লাগে না। আর ফটোগ্রাফি? তুমি যখন একবার ফটোগ্রাফি ভালোবাসতে শুরু করবে, তখন দেখবে এটা তোমাকে প্রচুর আনন্দ দেবে। আর নিজের তোলা ছবিগুলো অন্যদের দেখাতেও ভালো লাগবে।’

ছবি: কুইন্টন লেক

পাঁচ বছর আর ১১ হাজার কিলোমিটারের যাত্রা শেষ। দারুণ দারুণ ছবি, দারুণ সব স্মৃতি আছে তাঁর ঝুলিতে। শেষ প্রশ্নটা করলাম। ‘এরপর কী করবেন?’ কুইন্টনের জবাব, ‘এবার আমি কিছুদিন বিশ্রাম নেব। আমার দুই সন্তানের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাব। কিছু আর্ট গ্যালারিতে ঘুরতে যাব। তারপর হয়তো আবার নতুন কোনো অভিযানে বেরিয়ে পড়ব। হা হা হা।’