সময় এখন লেভানডফস্কির

পোল্যান্ডের ওয়ারশ শহরের একটা ছোট যুব ক্লাবে কোচ হিসেবে কাজ করতেন মারেক শিয়েকি। ভারসোভিয়া নামের সেই ক্লাবের আর্থিক অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে খেলোয়াড়দের গোসলেরও জায়গা ছিল না। শুধু একটা কলের নিচে পা ধুয়েই কাজ সারতে হতো সবাইকে। সব বয়সের দলের জন্য ছিল একটাই মাঠ এবং এর অবস্থাও এতটাই খারাপ যে খেলোয়াড়েরা টিটকারি করে সেই মাঠকে আলুর মাঠ বলে ডাকতেন।

শিয়েকি যখন নিজের কোচিং ক্যারিয়ার কিংবা ক্লাবের আর্থিক সীমাবদ্ধতা–জাতীয় জটিল সমস্যা নিয়ে তটস্থ, তখনো তিনি জানতেন না, তাঁর ক্লাবের এই আলুর মাঠেই বোনা হবে পুরো একটি প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ এক স্ট্রাইকারের বীজ। একদিন হঠাৎ দেখলেন, বয়সের তুলনায় প্রচণ্ড শীর্ণ ও বেঁটে একটা ছেলেকে দলে ট্রায়াল দেওয়াতে নিয়ে এসেছেন তাঁর বাবা। ছেলেটার পা দুটো এতটাই শীর্ণ ছিল যে প্রথম দেখাতেই শিয়েকির মনে হয়েছিল যে এই ছেলেকে দিয়ে আর যা-ই হোক, ফুটবল হবে না।

কিন্তু তা–ও কী যেন ভেবে বলটা এগিয়ে দিলেন শিয়েকি। বলা বাহুল্য, এরপর তিনি এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তাঁর কিশোর দলের অন্যদের তুলনায় বয়সে প্রায় দুই বছরের ছোট হলেও দলে নিয়ে নিলেন ছেলেটাকে। এরপর শিয়েকিকে আর তাঁর কিশোর ও যুব দল নিয়ে ভাবতে হয়নি। প্রায় সাত বছর রবার্ট লেভানডফস্কি নামের সেই ছেলেই তাঁকে নিশ্চিন্তে রেখেছিলেন।

রবার্ট লেভানডফস্কির ফুটবলপ্রেমের শুরুটা তাঁর নিজের শহর লেজনোর রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে। পোল্যান্ডের এই নীরব ছোট শহরের প্রায় প্রত্যেক সন্তানই ফুটবল খেলে বড় হয়। তবে লেভানডফস্কির নাওয়া-খাওয়া ভুলে ফুটবলের পিছে লেগে থাকা দেখে তাঁর বাবা প্রায় বাধ্য হয়েই তাঁকে শিয়েকির কাছে নিয়ে আসেন। তবে শিয়েকির ক্লাব ভারসোভিয়া লেভানডফস্কির বাবার প্রথম পছন্দ ছিল না। ভারসোভিয়ার যা অবস্থা ছিল, এই ক্লাব কারও প্রথম পছন্দ হওয়ার কোনো কারণও ছিল না।

কিন্তু এরপরও যে ছেলেকে নিয়ে এই ক্লাবেই এসেছিলেন, তার কারণ ছোট্ট লেভানডফস্কির শারীরিক গড়ন। ভারসোভিয়াতে ছেলেকে নিয়ে আসার আগে নিয়ে গিয়েছিলেন দুই পোলিশ জায়ান্ট ক্লাব লেগিয়া আর পোলোনিয়ার কিশোর দলের ট্রায়ালে। কিন্তু বেঁটে, শীর্ণ লেভানডফস্কিকে দেখে ট্রায়ালের আগেই বাদ দিয়ে দিয়েছিল তারা। এই সুযোগই কাজে লেগে গেল শিয়েকির। পোল্যান্ডের কোথাকার কোন ছোট ক্লাবের কোচকে অন্য কোনো কারণে ইতিহাস হয়তো মনে রাখবে না। কিন্তু রেখেছে এবং সম্ভবত রাখবেও; কারণ, তিনি রবার্ট লেভানডফস্কির প্রথম কোচ।

লেভানডফস্কি একটু আলাদা ছিল। যখন কোচ কিছু বলত, সে তখন ড্রেসিংরুমের এক কোনায় বসে চুপচাপ তা শুনে যেত। নিজের কাজটা সে আগের থেকেই ভালো পারত, কিন্তু আরও ভালো কীভাবে করা যায়, সেই চেষ্টাও চালিয়ে যেত সব সময়।
জিবিগনিউ কোওলস্কি (লেভানডফস্কির ছোটবেলার সতীর্থ)

পোল্যান্ডের বিভিন্ন ক্লাবে লেভানডফস্কির বেড়ে ওঠার গল্পটা অম্লমধুর। ভারসোভিয়াতে সাত বছর থাকার সময় এই ক্লাবকে প্রায় পরিবার বানিয়ে ফেলেছিলেন। তবে ওই সময় যে খুবই অসাধারণ কিছু করেছেন, এমনও নয়। তিনি যে ভালো, সেটা সবাই জানতেন, কিন্তু এই ছেলেই যে একদিন পোল্যান্ডের সর্বোচ্চ গোলদাতা হবেন, সেটা বোধ হয় কেউ-ই কল্পনা করতে পারেননি। লেভানডফস্কি নিজেও কি জানতেন?

লেভানডফস্কির জীবনের মোড়টা ঘুরতে শুরু করল ২০০৫ সালে তাঁর বাবা মারা যাওয়ার পর। বাবা মারা যাওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ভারসোভিয়া ছেড়ে ওয়ারশ শহরেরই আরেকটু বড় ক্লাব ডেলটায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। সেখানে কিছুদিন খেলার পর সুযোগ পেলেন বড় ক্লাব লেগিয়ার রিজার্ভ দলে।

বড় দলে শুরুতেই ট্রায়ালের সুযোগ পাননি শুধু শারীরিক গড়নের কারণে। সেই একই কারণে আবারও লেগিয়াতে লেভানডফস্কির ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নটা বড় ধাক্কা খায়। সেখানে মাত্র এক মৌসুম খেলার পরই লেগিয়া ছেড়ে দেয় চোটগ্রস্ত লেভানডফস্কিকে। বলা হয়, শারীরিক গড়নের কারণে কখনোই পরিপূর্ণ ফুটবলার হওয়ার সম্ভাবনা নেই তাঁর। ছেড়ে দেওয়ার আগে তাঁকে জানানোও হয়নি, দল হারাচ্ছেন তিনি। অফিস সেক্রেটারির ঘোষণাপত্র থেকে জানতে পারেন ব্যাপারটা। ক্লাবের অন্য সবাইকে বলে দেওয়া হয় যাতে কেউ তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ না করেন। বলা যেতে পারে, দল থেকে যেন প্রায় ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয় তাঁকে।

লেভানডফস্কি ভেঙে পড়েছিলেন, নাকি এটাই তাঁকে নতুন করে তাতিয়ে দিয়েছিল, সেটা নিয়ে একেকজনের মুখে একেক ভাষ্য শোনা যায়। তবে বিপদের দিনে এগিয়ে আসেন তাঁর প্রথম ক্লাবের পূর্বপরিচিত কোচরাই। তাঁদের সাহায্যে তৃতীয় বিভাগের একটি দল জিনিজ প্রুসকোতে নতুন জীবনের সন্ধান পান লেভানডফস্কি। এরপর আর কখনোই পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি এই পোলিশ স্ট্রাইকারকে।

নতুন ক্লাবে যাওয়ার পর প্রথম মৌসুমে ১৫টি গোল করে তাঁর দলকে দ্বিতীয় বিভাগে ওঠানোর পেছনে সবচেয়ে বড় অবদানটা রাখেন লেভানডফস্কি। জিতে নেন গোল্ডেন বুটও। সেটাই শুরু। এরপর প্রতি মৌসুমে আগের মৌসুমের থেকে শুধু ভালোই করে গেছেন। প্রুসকোর হয়ে দ্বিতীয় মৌসুমেও করেন ২১টি গোল, জিতে নেন আরেকটি গোল্ডেন বুট। ২০০৮ সালে রেকর্ড ট্রান্সফার ফিতে তাঁকে কিনে নেয় আরেক পোলিশ ক্লাব লেচ পজনান। একই বছর ডাক পান পোল্যান্ড জাতীয় দলে।

ফিফা বর্ষসেরার ট্রফি হাতে লেভানডফস্কি

লেভানডফস্কির আলোচনায় আসাটা এই প্রজন্মের অন্য ফুটবল তারকাদের তুলনায় বেশ দেরিতেই হয়েছে। ২০ বছর বয়স পর্যন্ত পরিচিত কোনো ক্লাবে সুযোগ পাননি। ২২ বছর বয়সে বরুসিয়া ডর্টমুন্ড তাঁকে মাত্র ৪.৫ মিলিয়ন পাউন্ডে কিনে নেয়। তারপরও বহুদিন পর্যন্ত মিডিয়া তাঁকে পাত্তা দেয়নি। মেসি-রোনালদোর ছায়ায় তো এই প্রজন্মের প্রায় সব ফুটবলারই ঢাকা পড়েছেন, কিন্তু এই প্রজন্মের সেরা সেন্টার ফরোয়ার্ড কে বা কারা, সেই তালিকায়ও লেভানডফস্কির নাম এসেছে বহু মানুষের পরে। সুয়ারেজ, ইব্রাহিমোভিচ, আগুয়েরো কিংবা করিম বেনজেমারও পরে উচ্চারণ করা হয়েছে তাঁর নাম।

মানুষ তাঁকে সেরা স্ট্রাইকারদের তালিকায় জায়গা দিক বা না দিক, লেভানডফস্কি নিজের কাজটা করে গেছেন ভালোমতোই। ডর্টমুন্ডকে পরপর দুবার লিগ জেতানোর পর করেছেন চ্যাম্পিয়নস লিগ রানার্সআপ। বায়ার্নে আসার পর বুলেট ট্রেনের মতো করে গেছেন একের পর এক গোল। টানা পাঁচ বছর জিতেছেন লিগ, গত বছর জিতেছেন চ্যাম্পিয়নস লিগও। টানা পাঁচ বছর বুন্দেসলিগায় মৌসুমে সবচেয়ে বেশি গোল করেছেন। ১০ বছরে লিগে ২৫৩ গোল করেছেন, যা বুন্দেসলিগার ইতিহাসেই তৃতীয় সর্বোচ্চ। পোল্যান্ডের হয়ে ১১৬ ম্যাচে ৬৩ গোল করে এখন তিনি পোল্যান্ডের ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা। সোজা কথায় বলতে গেলে, এক জীবনে একজন ফুটবলারের যা কিছু জেতা সম্ভব, শুধু বিশ্বকাপটা ছাড়া এর প্রায় সবকিছুই জিতেছেন তিনি।

লেভানডফস্কি কী, তা আসলে সবচেয়ে দারুণভাবে বোঝাতে পেরেছেন তাঁর ছোটবেলার সতীর্থ জিবিগনিউ কোওলস্কি। কোওলস্কির মতে, লেভানডফস্কি যে সব সময়ই এতটা ক্যারিশম্যাটিক ছিলেন, এমন নয়। তবে ওই বয়সেই অন্য খেলোয়াড়দের সঙ্গে তাঁর একটা মৌলিক পার্থক্য ছিল।

কোওলস্কি বলেন, ‘ওই বয়সে প্রায় সব খেলোয়াড়ের মধ্যেই একটা অহমিকা থাকে। তারা কোচ কিংবা ম্যানেজমেন্টকে পাত্তা দিতে চায় না, যেন তারাই সবার থেকে সবকিছু বেশি বোঝে। আমাদের সবার মধ্যেই তা ছিল। কিন্তু লেভানডফস্কি একটু আলাদা ছিল। যখন কোচ কিছু বলত, সে তখন ড্রেসিংরুমের এক কোনায় বসে চুপচাপ তা শুনে যেত। নিজের কাজটা সে আগের থেকেই ভালো পারত, কিন্তু আরও ভালো কীভাবে করা যায়, সেই চেষ্টাও চালিয়ে যেত সব সময়।’

কিন্তু এত কিছু করার পরও লেভানডফস্কি মূলত পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছেন ২০১৫ সালের পর, যখন এক ম্যাচে পাঁচ গোল করে একাই ছারখার করে দেন প্রতিপক্ষ উলফসবুর্গকে। কিংবা একই বছরে ব্যালন ডি’অরে চতুর্থ স্থান অর্জনের পর, টানা দু-তিন বছর বুন্দেসলিগায় সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার পর।

এই একটা জিনিস লেভানডফস্কির ক্যারিয়ারের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রায় সব জায়গায় দেখা গেছে। নিজের যোগ্যতা ও কীর্তির তুলনায় মর্যাদা পেতে দরকারের চেয়ে বেশিই খাটতে হয়েছে তাঁকে। একজন এমবাপ্পে কিংবা নেইমারের মতো সহজেই তারকাখ্যাতি এসে ধরা দেয়নি তাঁর হাতে।

এতে অবশ্য লেভানডফস্কির তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। নামের পাশে গ্রেট শব্দটি বসাতে তাঁর কীর্তিই যথেষ্ট। মেসি, রোনালদোকে ছাপিয়ে এ বছর জিতেছেন ফিফার বর্ষসেরা পুরস্কার। বলাই বাহুল্য, করোনার কারণে ব্যালন ডি’অর এবার বন্ধ না থাকলে হয়তো সেটাও জিততেন।

লেভানডফস্কি যে আরও অনেক কিছু জিতবেন, তা এখনই বলে দেওয়া যায়। তিনি যে নিজের কাজটা ঠিকমতোই করতে জানেন!