সাইকেলে চেপে সারা দুনিয়া

জার্মান ভূপর্যটক হাইঞ্জ স্টুক। বিশ্বের ১৯৬টি স্বাধীন দেশসহ ৭৮টি ভূখণ্ড ঘুরে বেড়িয়েছেন স্রেফ দুই চাকার সাইকেলে চেপে। রোমাঞ্চপ্রিয় এই সাইক্লিস্টের বিশ্বভ্রমণের কথাই জানাচ্ছেন সজীব মিয়া।

কৈশোরে ভালো টেনিস আর ফুটবল খেলতেন হাইঞ্জ স্টুক। স্বপ্ন ছিল একদিন পেশাদার ফুটবলার হবেন। কিন্তু দিনে দিনে বুঝতে পারলেন, পেশাদার ফুটবলার হওয়ার মতো খেলোয়াড়ি যোগ্যতা তাঁর নেই। এতে কিছুটা মন খারাপ হলো বটে, কিন্তু বসে থাকলেন না। বিকল্প ভালো লাগা খুঁজে বের করলেন। স্টুকের সেই ভালো লাগাটা তৈরি হয়েছিল বাইসাইকেলের সঙ্গে।

হাইঞ্জ স্টুকের জন্ম ১৯৪০ সালে, জার্মানির হোভলফ শহরে। বেড়ে ওঠাও ওই শহরেই। কৈশোরের সেই সময় হরহামেশা বাইসাইকেলে চেপে ঘুরতে বেরোতেন, যেতেন পাহাড়ি দুর্গম পথে কিংবা পার্শ্ববর্তী কোনো শহরে। স্বল্প খরচে ভ্রমণের সুযোগ আর ইচ্ছেমতো চালানোর স্বাধীনতা—দিনে দিনে সাইকেলই হয়ে উঠল তাঁর প্রিয় বন্ধু। পায়ে ফুটবল নিয়ে যেমন রোমাঞ্চ অনুভব করতেন, স্টুকের কাছে মনে হতে লাগল, সাইকেলও ঠিক যেন তা-ই!

স্টুকের এই গল্পগুলো ১৯৫৮ সালের। অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে সেই যে প্রথম অন্য কোনো শহর ভ্রমণে বেরোন। তাঁর সুসজ্জিত সাইকেল আর বাক্সপেটরা দেখে কৌতূহলী মানুষ নানা প্রশ্ন করতেন। সেই প্রথম তিনি বুঝতে পারলেন সাইকেলে যেভাবে মানুষের কাছাকাছি যাওয়া যায়, অন্য কোনো বাহনে নয়।

রোমাঞ্চকর ছোট্ট যাত্রাটা শেষে স্টুক ফেরেন নিজ শহরে। ফেরার কয়েক মাস পর শিক্ষানবিশ হিসেবে একটি কারখানায় চাকরি নেন। কিন্তু তাঁর মন পড়ে থাকে সাইকেলের প্যাডেলে। ঘুরবেন, অজানাকে জানবেন। পরিকল্পনা করে ফেলেন, শিক্ষানবিশকালের শেষ দিকে কিংবা পূর্ণকালীন চাকরি শুরুর আগে আগে এক বছরের একটি ট্রিপ দেওয়ার।

একদিন প্রিয় সাইকেলটি নিয়ে ঠিক বেরিয়ে গেলেন। তবে সেই যাত্রা ছিল প্রত্যাশার চেয়ে ছয় মাস বেশি। দেড় বছর পর জার্মানিতে ফিরে ভাবলেন, কাজে যোগ দেবেন। ভাবলেন বিয়েথা সেরে সংসারী হবেন। কিন্তু এক বছরের মাথায় তিনি বুঝতে পারলেন, আর দশজন যেভাবে ভাবছেন, তিনি যেন তার ব্যতিক্রম। এই জীবনসংসার স্টুকের জন্য নয়। তিনি যা চান, তা এই জীবন নয়।

হাইঞ্জ স্টুক। ১৯৬০ সালের ছবি

রোমাঞ্চ থেকে বিশ্বযাত্রা

১৯৬২ সাল। হাইঞ্জ স্টুকের বয়স তখন ২২ বছর। জীবন নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলেছেন তত দিনে। বিশ্বভ্রমণে বেরোবেন। এক জার্মান কোম্পানির কাছে উপহার পেয়েছেন দুই হাতলের সাইকেলটি। ক্যালেন্ডারের পাতায় দিন, ৪ নভেম্বর। বেরিয়ে পড়লেন অজানাকে জানতে।

সাইকেলে ছুটে চলছেন এ শহর থেকে ও শহর, এক দেশ থেকে অন্য দেশে। বাহন হিসেবে সাইকেল তখনই জনপ্রিয় হয়েছে বটে, তবু একজন সাইকেলে চেপে দেশান্তরি হয়েছেন, এটা জেনেই অনেকের যেন চক্ষু চড়কগাছ। তা ছাড়া আস্ত বাড়িঘরসমেত এক লোক পথে পথে ঘুরছে (বাড়িঘর নয়তো কী, সাইকেলের সামনে–পেছনে তিনটি ব্যাগে প্রায় ৫০ কেজি ওজনের জিনিসপত্র থাকত)। সে–ও তো এক বিস্ময়!

একদিন প্রিয় সাইকেলটি নিয়ে ঠিক বেরিয়ে গেলেন। তবে সেই যাত্রা ছিল প্রত্যাশার চেয়ে ছয় মাস বেশি। দেড় বছর পর জার্মানিতে ফিরে ভাবলেন, কাজে যোগ দেবেন। ভাবলেন বিয়েথা সেরে সংসারী হবেন। কিন্তু এক বছরের মাথায় তিনি বুঝতে পারলেন, আর দশজন যেভাবে ভাবছেন, তিনি যেন তার ব্যতিক্রম।

১৯৬২ সালেই পৌঁছে গেলেন আফ্রিকা মহাদেশে। আফ্রিকার দেশগুলো ঘুরতে থাকলেন। ১৯৬৪ সালে তাঁর দেখা মিলল দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন শহরে। তত দিনে জাপানের টোকিওতে অলিম্পিক আসর শুরু হয়েছে। স্টুকের ইচ্ছা ছিল অলিম্পিক দেখতে জাপানে আসবেন। কিন্তু তিনি মুখোমুখি আর্থিক সংকটের। বেশি দেশ ভ্রমণ করতে মোটা অঙ্কের টাকা দরকার। কেপটাউনে বসেই এত দিনে তোলা ছবিগুলো নিয়ে প্রকাশ করলেন পুস্তিকা। সেই পুস্তিকা ফেরি করে বিক্রি করতে থাকলেন। কয়েক দিন বেশ কিছু আয়ও হলো। সেই আয়ের টাকায় সাইকেল নিয়ে ছুটলেন দক্ষিণ আমেরিকায়।

সাইকেলই স্টুকের জীবন

এরপর অর্থ জোগানোর জন্য প্রতিটি দেশেই হাজারখানেক পুস্তিকা বিক্রি করেছেন। প্রথম ১০ বছর মাত্র এক হাজার ডলারের মধ্যে অতিসাধারণ জীবন চালিয়ে নিতেন স্টুক। দিনে দিনে সাইকেলই হয়ে উঠল তাঁর পাসপোর্ট, বিজনেস কার্ড। দেশে দেশে তোলা ছবিগুলো প্রকাশ হতে থাকল খ্যাতনামা পত্রিকায়, লিখতে শুরু করলেন ভ্রমণকাহিনিও। ছবি আর লেখার সম্মানীও যোগ হলো আয়ের উৎস হিসেবে। অনেক সময় পেতেন অনুদান। যাযাবর জীবনের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে উঠলেন হাইঞ্জ। 

পথে পথে কত ঘটনাই না ঘটতে থাকল তাঁর জীবনে। চিলির আতাকামা মরুভূমিতে আহত হলেন ট্রাকের আঘাতে, মিসরে পিটিয়ে সংজ্ঞাহীন করল দেশটির সেনারা, রাষ্ট্রবিরোধী কাজের মিথ্যা অভিযোগে ক্যামেরুনের সেনাবাহিনীর হাতে আটক হলেন, কানাডায় গাড়ির ধাক্কায় এক বরফ জমাট নদীতে পড়ে গিয়ে হাসপাতালে থাকতে হলো, যুক্তরাষ্ট্রে এক মোটরগাড়ির চালক পথে নামিয়ে দেওয়ার কথা বলে সবকিছু ছিনিয়ে নিলেন, জিম্বাবুয়েতে বিদ্রোহীদের দ্বারা গুলিবিদ্ধ হলেন, মোজাম্বিকে নদীতে গোসল করার সময় একঝাঁক মৌমাছি এসে আক্রমণ করল।

২০১০ সাল পর্যন্ত টানা ৪৮ বছর ধরে তিনি বিশ্বের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত চষে বেড়িয়েছেন। সাইকেলে মাড়িয়েছেন প্রায় সাড়ে ছয় লাখ কিলোমিটার পথ। এই পথে তাঁর সাইকেলের চাকা ঘুরেছে ১৯৬টি স্বাধীন দেশে। এ ছাড়া ঘুরে বেড়িয়েছেন ৭৮টি ভূখণ্ড। এই দীর্ঘ যাত্রায় ছয়বার সাইকেল হারিয়েছেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, প্রতিবারই তিনি সাইকেলটি ফেরত পেয়েছেন।

হাইঞ্জ স্টুকের বাস এখন জার্মানিতেই। বয়স ৮০ ছুঁইছুঁই। বয়স বেড়েছে বটে, কিন্তু সাইকেলপ্রীতি একটুকু কমেনি। এখনো হুটহাট সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন শহরের পথে। এই সাইকেলই যে তাঁর জীবন! 

তথ্যসূত্র: হাইঞ্জ স্টুক ডটকম, দ্য টেলিগ্রাফ, ট্রাভেলিং টু ও উইকিপিডিয়া।