সাতের সাতসতেরো

সাতের সাতসতেরো
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

দেখতে দেখতে কিশোর আলো সাত বছরে পড়ল। কিআ ডাকনামের এই পত্রিকার সঙ্গে আমার সম্পর্ক প্রথম বছর থেকেই—‘অভিধানের গল্প’ লেখার সুবাদে। কিআ যে সাতে পা দিল, সে খবর আমার মাথায় ছিল না, জানলাম আদনান মুকিতের ফোনে।

পশ্চিমা দুনিয়ায় সাত তো বড়ই শুভ সংখ্যা—লাকি সেভেন। বাঙালি সমাজে এখন কথাটা বেশ চালু। ভাবছি, আদনান মুকিতের মাধ্যমে কিশোর আলোকে ‘লাকি সেভেন’-এর শুভেচ্ছা জানাব, নাকি বাঙালি কায়দায় বলব ‘কিআর কৈশোরক প্রাণচাঞ্চল্য অটুট থাক’—তার মধ্যেই মুকিতের অনুযোগ ও অনুরোধ একসঙ্গে শোনা গেল। অনুযোগ—‘অভিধানের গল্প’ অনেক দিন লিখছি না বলে আর, অনুরোধ—কিশোর আলোর সাতে পা উপলক্ষে সাত নিয়ে অভিধানের গল্প পুনরায় শুরু করার জন্য।

সাতপাঁচ না ভেবেই রাজি হয়ে গেলাম। বললাম, পাঁচ–সাত দিনের মধ্যে লেখা পাঠিয়ে দেব। লিখতে বসে দেখি, অনুরোধে ঢেঁকি গেলা হয়ে গেছে। আমি পড়ে গেলাম সাত হাত পানির নিচে।

সাত মাস ধরে চারদিকে শুধু করোনা—করোনা শব্দ আর টেলিভিশনের পর্দায় তার বিচিত্র ভয়ংকর চিত্র এবং সেই সঙ্গে এই ভাইরাসের রাশ টেনে ধরতে না পারায় আতঙ্কের কথা শুনতে শুনতে মাথার মধ্যে এলোমেলো অবস্থা। এর মধ্যে অভিধানের গল্প তো দূরের কথা, কোনো গল্পই বের হয় না।

আমি অবশ্য গল্পলেখক নই। গল্প লিখতেও জানি না। আমার কাজ হলো বিভিন্ন অভিধান ঘেঁটে শব্দ সম্পর্কে তথ্য নিয়ে সেগুলোকে গল্পের মতো তুলে ধরার চেষ্টা করা। যা–ই হোক, সাত নিয়ে সাত–আটটা অভিধান খুঁজলাম, দেখলাম অন্য অনেক কিছু বলার থাকলেও গল্প বলার মতো কিছু নেই। তাই ‘অভিধানের গল্প’ যেভাবে লিখি, সেই ছক পাল্টে অন্য পথ ধরতে বাধ্য হলাম। সেই জন্য গোড়াতেই বলেছি, অনুরোধে ঢেঁকি গিলেছি। কিছু তো লিখতে হবে, তাই অনেক কিছু নিয়ে সাতের এই সাতসতেরো।

সাত নিয়ে গল্পকাহিনি রয়েছে পশ্চিমা জগতে। সাত নিয়ে রয়েছে নানা লৌকিক-অলৌকিক বিশ্বাস। সংখ্যা হিসেবেও সাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিতশাস্ত্রে তাই সাত একটি গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা। প্রাচীন মিসরেও সাত ছিল অলৌকিক একটি সংখ্যা। পশ্চিমাদের জীবন ও সংস্কৃতিতে সাতের প্রভাব যথেষ্ট। লাকি সেভেন—স্রেফ কথার কথা নয়। ভিনদেশি সাত নিয়ে আর সাতকাহন নয়, ফিরে আসি বাংলায়।

বাঙালি জীবনের ওপর সংখ্যার কোনো প্রভাব নেই, কিন্তু অনেক সংখ্যাশব্দের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বাংলা ভাষায়। সংখ্যাশব্দ দিয়ে তৈরি হয়েছে অপূর্ব সব বাগ্‌ধারা ও প্রবচন। তবে কেন যেন আমাদের মুখের ভাষা এবং লেখার ভাষায় সাম্প্রতিক সময়ে বাগ্‌ধারা ও প্রবাদ–প্রবচনের ব্যবহার বেশ হ্রাসমান। কী এর কারণ, তা নিয়ে কথা বলা আমার মানায় না। আমি গবেষক নই, লেখকও নই। মাঝেমধ্যে লেখালেখি করি মাত্র।

যা–ই হোক, ফিরে আসি আজকের প্রসঙ্গে। তবে সাতে যাওয়ার আগে একটা কথা বলে নেওয়া ভালো। বাংলায় সংখ্যাশব্দ ব্যবহার করে সবচেয়ে বেশি বাগ্‌ধারা ও প্রবচন হয়েছে তিন, পাঁচ ও সাত নিয়ে। কিছু সংখ্যার ব্যবহার একবারের বেশি চোখে পড়ে না। যেমন নয় ও ছয় নিয়ে নয়ছয় করা; বাহান্ন ও তিপ্পান্ন নিয়ে যাহা বাহান্ন, তাহাই তিপ্পান্ন; নিরানব্বই নিয়ে নিরানব্বইয়ের ধাক্কা; বাহাত্তর নিয়ে বাহাত্তুরে ধরা ইত্যাদি।

কথা তো সাত নিয়ে, তাই সাতের কথা শুরু করি। সাত নিয়ে কিছু কথা এখনো অবশ্য মুখে মুখে চলে। যখন চাকরি করতাম, তখন সাততাড়াতাড়ি অফিসে যাওয়ার জন্য সাতসকালে ঘুম থেকে উঠতে হতো। চাকরি করতে এসে ‘দলাদলি’ শব্দ ও বিষয়টার সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে। আমাদের সময় ব্যাপারটা তেমন দৃশ্যমান হতো না। ভেতরে–ভেতরে থাকত। এখন শুনি ব্যাপারটা উল্টো হয়ে গেছে। সব পক্ষ সর্বদাই নাকি যুযুধান। মাঝেমধ্যে যুদ্ধের ঘটনাও ঘটে যায়।

সাতেও নেই, পাঁচেও নেই—এমন জীবনদর্শন নিয়ে একালে অফিস করা নাকি দুরূহ ব্যাপার। সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হলো সাতেও হুঁ পাঁচেও হুঁ করে চলা। আর না হয়, অফিসের কর্তাব্যক্তির সঙ্গে থাকা—তাহলে সাতখুন মাফ। তাতে আরও কিছু সুবিধা আছে। অফিসে যারা সাত ঘাটে ঘটি ডোবায়, অর্থাৎ সব ব্যাপারে নাক গলায়, তাদের ব্যাপারে কর্তাব্যক্তিকে সাতকান করে লাগাতে পারলে তিনি তাদের সাত ঘাটের জল খাইয়ে ছাড়বেন, অর্থাৎ তাদের বারোটা বাজিয়ে ছাড়বেন।

স্কুলজীবনের একটা কথা মনে পড়লে এখনো হাসি পায়। আমাদের বাংলার শিক্ষক ছিলেন হারেজ স্যার। একটা কবিতা বা গল্প তিনি পাঁচ–সাত দিন ধরে পড়াতেন। তারপর চলত প্রশ্ন-উত্তরের পালা। কেউ ভুল উত্তর দিলে তিনি তার দুই গালে গুনে গুনে সাতটা চড় মারতেন আর বলতেন, সাতকাণ্ড রামায়ণ পড়ে সীতা কার বাপ!

বাগ্‌ধারা ও প্রবচন ব্যবহারের ব্যাপারে সম্ভবত আঞ্চলিক কোনো প্রভাব রয়েছে। পণ্ডিতগণ বলতে পারবেন। আমি কুষ্টিয়ার মানুষ। পাশেই মেহেরপুর। আমি স্কুলে থাকতেই শিক্ষকদের মুখে শুনেছি—সাত নকলে আসল খাস্তা, অর্থাৎ একই লেখা বা অন্য কিছু বারবার ব্যবহার করতে গেলে তা বিকৃত হয়ে পড়ে। সাত চড়ে রা করে না—অর্থাৎ সব অত্যাচার যে মুখ বুজে সহ্য করে—মায়ের মুখেই প্রথম শুনি। সাত জন্মে না শোনা, অর্থাৎ জীবনে কখনো না শোনা; সাত রাজার ধন মানিক, অর্থাৎ বহু মূল্যবান জিনিস; সাতপুরুষের ভিটে ইত্যাদি প্রবচন তো চাচি–খালাদের মুখে প্রায়ই শুনতাম।

প্রবাদ–প্রবচনের আঞ্চলিকতার কথা বলছিলাম। নাট্যকার-অধ্যাপক মমতাজউদদীনের একটি বিখ্যাত নাটকের নাম—‘সাত ঘাটের কানাকড়ি’। মঞ্চসফল নাটক। অনেককেই বলতে শুনেছি—অদ্ভুত নাম, অর্থহীন। সাত ঘাটের কানাকড়ির অর্থ জানা অবশ্য এখন বেশ কঠিন। এখনকার শিক্ষিত অনেক লোক কড়ি শব্দটাই বোঝেন না, কানাকড়ি তো আরও রহস্যময় শব্দ। ঘাট যে খেয়াঘাট—তা–ও অনেকের অজানা। দেশে এখন তো সবই ফেরিঘাট, খেয়াঘাট কি এখনো আছে? যাহোক, সাত ঘাটের কানাকড়ির অর্থ—যে অনেক ঘুরেছে, অনেক কিছু জেনেছে, শিখেছে, অর্থাৎ অভিজ্ঞ ব্যক্তি।

আমি নিজেই সমস্যায় পড়েছিলাম বাংলা একাডেমিতে চাকরির সময়ে সেলিম আল দীনের ‘হাত হদাই’ নাটক ছাপতে গিয়ে। ঢাকার বিখ্যাত মঞ্চসফল নাটক এটি। তাঁর কাছ থেকেই জ্ঞান লাভ করি—যে বাগ্‌ধারাটি আমাদের অঞ্চলে সাত সদাই মানে সাত রকমের সওদা, অর্থাৎ বহু রকমের জিনিস কেনা বা সংগ্রহ করা—সেই প্রবচনই নোয়াখালী অঞ্চলে—হাত হদাই।

সাত নিয়ে শেষ করতে হলো সাতসতেরো। কারণ, অনেক কিছুই বাদ থেকে গেল। তোমাদের ভালো না লাগলে সম্পাদকের কানে যেন সাতকান করে কিছু বোলো না, বুড়ো বয়সে লজ্জা পাব।