সাতের সেরা সাত

ফুটবলে ৭ নম্বর জার্সির মাহাত্ম্যই আলাদা। বর্তমানে ৭ নম্বর জার্সিটার প্রতিচ্ছবি হয়ে গেছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। ‘সিআর সেভেন’ হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি আইকন। যদিও ফুটবল দুনিয়ায় এই ৭ নম্বরকে নিজেদের অর্জনের মধ্য দিয়ে মহান করে তুলেছেন কিংবদন্তি খেলোয়াড়েরা। ঐতিহাসিকভাবেই ৭ নম্বর জার্সিটা উইঙ্গারদের মধ্যে বেশি জনপ্রিয়। তবে এ তালিকায় কিছু স্ট্রাইকারও আছেন। তাঁদের সবাইকে মিলিয়েই ৭ নম্বর জার্সি গায়ে তোলা সাতজন ফুটবলারকে নিয়ে আমাদের এবারের আয়োজন।

গারিঞ্চা

পেলের ব্রাজিলের রাইট উইঙ্গার গারিঞ্চা। পেলের ছায়ায় কিছুটা ঢাকা পড়ে গেলেও গারিঞ্চাকে সর্বকালের সেরা ড্রিবলার মনে করেন অনেকে। সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ড্রিবলার জন্মই নিয়েছিলেন স্থায়ী শারীরিক অক্ষমতা নিয়ে। তার বাঁ পা ডান পায়ের থেকে ছয় ইঞ্চি বড় ছিল। যাঁর ঠিকমতো হাঁটতে পারারই কথা নয়, তিনি কীভাবে তিনবার বিশ্বকাপজয়ী ফুটবলারে পরিণত হলেন, সেটা এখনো একটা বিস্ময়।

পেলে-গারিঞ্চা মানিকজোড় ব্রাজিলের হয়ে যত ম্যাচে একসঙ্গে খেলেছেন, কোনোটিতেই হারেনি ব্রাজিল। পেলে দলে থাকার পরও ১৯৬২ সালে গারিঞ্চা অনেকটা একাই বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন ব্রাজিলকে।

যত দিন বেঁচে ছিলেন, গারিঞ্চা ছড়িয়ে গেছেন নির্মল আনন্দ। ব্রাজিলে তাঁকে অ্যালেগ্রিয়া দো পোভো নামে ডাকা হয়, সহজ বাংলায় যার মানে দাঁড়ায়—‘মানুষের জয়’।

জর্জ বেস্ট

সর্বকালের সেরা ৭ নম্বরদের একজন আইরিশ উইঙ্গার জর্জ বেস্ট। তাঁর এ উপাধি দিয়েছেন স্বয়ং পেলে। প্রায় ৬০ বছর আগে ক্যারিয়ার শুরু করা জর্জ বেস্ট মাঠ ও মাঠের বাইরে স্টাইল ও ফ্যাশনের মতো দুটি বিমূর্ত ধারণার মূর্তিমান প্রকাশ ছিলেন। ফুটবলে গ্ল্যামারের শুরুটাও বলা যায় বেস্টের হাত ধরে। তাঁর ড্রিবলিং, বলের ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং ফিনিশিংয়ের সঙ্গে ওই বড় চুল মিলিয়ে যা দাঁড়াত, মনে হতো গ্রিক দেবতা অ্যাকিলিস যেন আকাশ থেকে ফুটবল খেলতে মাঠে নেমে এসেছেন। অনায়াসে ঠান্ডা মাথায় ছারখার করতেন প্রতিপক্ষের ডিফেন্স। বড় চুলের কারণে ভক্তরা তাঁকে আদর করে পঞ্চম বিটলস সদস্যও ডাকতেন। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে ১১ বছরে ৪৬৬ ম্যাচে ১৭৪ গোল করেছেন বেস্ট। তাঁর কারণেই গ্ল্যামারের ছোঁয়া প্রথম লাগে ৭ নম্বর জার্সির গায়ে।

সে সময়ের তুলনায় এই অভিনব গ্ল্যামারই অবশ্য শেষ পর্যন্ত কাল হয়ে দাঁড়ায় বেস্টের। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কিংবদন্তির ক্যারিয়ার শেষ হওয়ার কারণ তাঁর অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন। জীবনের ওপর এই নিয়ন্ত্রণহীনতা তাঁর মৃত্যুর কারণও হয়ে দাঁড়ায়।

লুই ফিগো

আরেক বিখ্যাত ‘৭ নম্বর’ পর্তুগালের লুই ফিগো। নিঃসন্দেহে তাঁর প্রজন্মের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবলারদের একজন তিনি। বার্সেলোনা থেকে কাউকে না জানিয়ে তাঁর রিয়াল মাদ্রিদে চলে আসার গল্প তো ফুটবল বিশ্বে রীতিমতো উপকথায় পরিণত। যাঁরা ফিগোর বিপক্ষে খেলেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই তাঁকে সর্বকালের সেরার কাতারেই রাখেন। ফিগোর খেলায় একটা অন্য রকম আনন্দ ছিল। একটা অন্য রকম আত্মবিশ্বাস ছিল। ম্যাচে তাঁকে কখনোই থামতে দেখা যেত না। যখন বার্সেলোনায় খেলেছেন, রিয়াল মাদ্রিদের ডিফেন্ডারদের সঙ্গে রীতিমতো সাপে–নেউলে সম্পর্ক হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁর। ১৮ বছর বয়সে প্রথম বার্নাব্যুতে এসে ছারখার করে দিয়েছিলেন মাদ্রিদের বাঘা বাঘা ডিফেন্ডার দিয়ে সাজানো ডিফেন্স লাইনকে। কদিন আগ পর্যন্তও পর্তুগালের সর্বকালের সেরা ফুটবলারের স্বীকৃতিটা তাঁর ছিল, এখন যা রোনালদোর প্রবল প্রতাপের সামনে ম্লান। পর্তুগালের হয়ে ‌১২৭ ম্যাচে জয় এনে দিয়েছেন, যা পরে শুধু রোনালদোই ভাঙতে পেরেছিলেন।

ডেভিড বেকহাম

জর্জ অবসর নেওয়ার প্রায় ২০ বছর পর তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি খুঁজে পায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড—ডেভিড বেকহাম। পুরো বিশ্বেই স্টাইলের আইকন হয়ে ওঠেন তিনি। নতুন নতুন চুলের স্টাইল নিয়ে হাজির হতেন বেকহাম আর পুরো বিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে যেত সেটা। ৭ নম্বর জার্সি, গ্ল্যামার আর স্টাইলিশ খেলার ধরন, সব মিলিয়ে বেকহাম নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন অন্য উচ্চতায়। ২০ বছরের ক্যারিয়ারে ১৯টি গুরুত্বপূর্ণ ট্রফি। নামের পাশে আছে ১৪০টি গোল এবং ২০২টি অ্যাসিস্ট। বেকহাম অবসর নিয়েছেন ২০১৩ সালে, কিন্তু এখনো জনপ্রিয়তা আর আলোচনার কেন্দ্রেই থাকেন তিনি।

রাউল গঞ্জালেস

ফিগো কিন্তু রিয়াল মাদ্রিদে ৭ নম্বর জার্সি গায়ে জড়াননি, পরেছেন ১০ নম্বর জার্সি। রোনালদোও মাদ্রিদে প্রথম দুই বছর পরেছেন ৯ নম্বর জার্সি। দুটো ক্ষেত্রেই কারণটা রাউল গঞ্জালেস। স্পেনের এই কিংবদন্তি স্ট্রাইকার যত দিন মাদ্রিদে খেলেছেন, তাঁর থেকে ৭ নম্বরটি ছিনিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা কারও ছিল না। ১৬ বছরে মাদ্রিদের হয়ে তিনি ৩২৩টি গোল করেছেন, যা রোনালদোর ৪৫০ গোলের রেকর্ডের পরই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।

মাদ্রিদের হয়ে সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলা ফুটবলারও তিনি। ৭৪১ ম্যাচে নেমেছেন মাদ্রিদের জার্সি গায়ে। জিতেছেন ১৬টি গুরুত্বপূর্ণ ট্রফি, যার মধ্যে ৩টি চ্যাম্পিয়নস লিগও আছে।

তিনি অবসর নেওয়ার ঠিক আগে একটি ম্যাচ খেলতে ফেরত নিয়ে আসে মাদ্রিদ। ২০১৩ সালে আল সাদের বিরুদ্ধে ওই প্রীতি ম্যাচে রাউল খেলেন তাঁর আগের প্রাণপ্রিয় ৭ নম্বর জার্সি পরে। আবার মাদ্রিদের অধিনায়ক হিসেবে দেখা যায় তাঁকে। যে ৪৫ মিনিট খেলেছেন, তাতে একটা গোলও করলেন। মাঠ থেকে উঠে যাওয়ার আগে ৭ নম্বর জার্সিটা খুলে পরিয়ে দিলেন রোনালদোকে। অধিনায়কের ব্যান্ডটা পরিয়ে দিলেন ইকার ক্যাসিয়াসকে। যেন প্রিয় ক্লাবের ভার উত্তরসূরিদের হাতে দিয়ে যাচ্ছেন কিংবদন্তি।

আন্দ্রে শেভচেঙ্কো

ইউক্রেনের সবচেয়ে প্রভাবশালী স্ট্রাইকার আন্দ্রে শেভচেঙ্কো। ৭ নম্বর জার্সি পরেই দাপিয়ে বেড়িয়েছেন এসি মিলানের হয়ে। প্রতিপক্ষের কাছে ছিলেন আতঙ্কের নাম। ক্যারিয়ারের মধ্যগগনে যে এসি মিলানে খেলেছেন, সেই মিলান ছেড়েই চেলসিতে যাওয়ার সময় মিলান ভক্তদের হৃদয় এতটাই ভঙ্গুর অবস্থায় ছিল যে দাবি উঠেছিল, আমৃত্যু শেভচেঙ্কোর ৭ নম্বর জার্সিটি তুলে রাখা হোক। কারও কারও চোখে আবার তিনি বিশ্বাসঘাতকেও পরিণত হয়েছিলেন। এখনো তাঁকে ইউক্রেনের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার মনে করা হয়। প্রায় ২০ বছরের ক্যারিয়ারে ক্লাব ও জাতীয় দলের হয়ে ৩৬৯টি গোল করে অবসর নেন ভক্তদের প্রিয় শেভা।

ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো

তাঁকে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। ৩৫ বছর বয়সে এসেও এখনো নিজেকে প্রতিদিনই নিয়ে যাচ্ছেন নতুন উচ্চতায়। তাঁকে প্রথম ৭ নম্বর জার্সির সঙ্গে পরিচিত করান স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন। এরপর তো রীতিমতো নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন সাত সংখ্যাটিকে। এখন ৭ নম্বর জার্সি মানেই ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো।

তবে এই সাতজন ছাড়া আরও অনেক দুর্দান্ত ফুটবলার ৭ নম্বর জার্সি পরে পুরো ক্যারিয়ারই কাটিয়েছেন। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কিংবদন্তি এরিক ক্যান্টোনা তাঁদের মধ্যে একজন। জার্সির এই সংখ্যাকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার পেছনে ভূমিকা আছে জার্মান লেজেন্ড বাস্তিয়ান সোয়াইনস্টাইগারেরও।

ক্রিকেটেও ৭ নম্বর জার্সিকে স্মরণীয় করে রেখেছেন অনেক খেলোয়াড়। কদিন আগেই ধোনি অবসর নেওয়ার পরই দাবি উঠল, তাঁর কীর্তির স্মরণে ভারতের ৭ নম্বর জার্সি আমৃত্যু তুলে রাখার। ৭ নম্বর জার্সি নিয়ে আমাদের দেশের ক্রিকেট ভক্তদেরও খুবই আবেগময় স্মৃতি আছে। বাংলাদেশের অন্যতম সফল অধিনায়ক হাবিবুল বাশার পরতেন ৭ নম্বর জার্সি।