সাদা পৃষ্ঠা

আমি যখন জাফর ইকবাল স্যারের ব্ল্যাকহোলের বাচ্চা বইটা পড়ছিলাম, তখন এক আশ্চর্য ব্যাপার খেয়াল করলাম। আমাদের স্কুলটাও ঠিক সেই হাজী মহব্বতজান স্কুলের মতো! বইটা যারা পড়েছ, তারা তো বুঝেই গেছ, আর যারা এখনো পড়োনি তাদের সতর্কবাণী শুনিয়ে দিলাম, বইটা পড়তে গিয়ে কিন্তু তোমার অট্টহাসি শুনে বাসার সবাই ভয় পেয়ে যাবে!

আমাদের ক্লাসের বেঞ্চে কেউ একবার বসে পড়লে বের হওয়ার জন্য তাকে পর্বত ডিঙানোর সমান কসরত করতে হয়। মোদ্দাকথা ক্লাসে জনসংখ্যা এত বেশি যে দেখলে মনে হয় একজন আরেকজনের কোলে বসে আছে। তো একদিন ক্লাসে স্যার আমাদের সৃজনশীল লিখতে দিলেন। এমন সময় খেয়াল হলো, আমাদের বেঞ্চে আমার আর তটিনীর কলম হাওয়া! হয়তো ছোট বেঞ্চিতে বড় বেশি চাপাচাপির কারণে নিচে পড়ে গেছে। এ অবস্থায় নিচে ঝুঁকে কলম আনতে যাওয়া মানে বেঞ্চের অন্য প্রান্তে বসা আরও দুজনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া! স্যারের ক্লাসে তা করা মানে রক্তারক্তি কাণ্ড! বলে রাখি, ক্লাসে কেউ টুঁ শব্দটি করলে তাকে আপাদমস্তক ঠাস ঠাস বাড়ি খেতে হতো! কী আর করা!

সবাই চুপচাপ লিখছে। আমি আর তটিনী সাদা পৃষ্ঠায় খালি হাতে উবু হয়ে লেখার ভান করছি কেবল। স্যার ক্লাসে হাঁটতে হাঁটতে সবার লেখা দেখছিলেন। ভাগ্য প্রসন্ন, আমরা কোনায় বসেছিলাম বলে স্যারের চোখে পড়িনি। ধীরে ধীরে আমাদের ক্লাসের টপার রাশেদ এমনকি ক্লাসের লাস্ট বয়ও লেখা দেখিয়ে ফেলল। আমি আর তটিনী মনে মনে জোর প্রার্থনা করতে লাগলাম যেন এক্ষুনি ক্লাস শেষ হয়ে যায়। কিন্তু বিধি বাম! স্যার ডাকলেন, ‘সামিয়া, খাতা দেখাও।’ তটিনী তা শুনে মাথা আরও নিচু করে লেখার অভিনয় করত লাগল। সেদিন মনে হয়েছিল, ক্লাস ক্যাপ্টেনদের মতো দুঃখী মানুষ বোধ হয় সারা পৃথিবীতে নেই। আমি দাঁড়ালাম। স্যার আমার দিকে আসছেন। এমন সময় হঠাৎ করে মাসুদ স্যারের আগমন ঘটল। যেন জান ফিরে পেলাম! মাসুদ স্যার আমাদের ইংরেজি পড়ান। এমনকি যদি কখনো কিআতে আমার লেখা ছাপা হয়, সেটা মাসুদ স্যার আগে পড়েন। স্যাররা কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে কথা বললেন, তারপর টিচার্স রুমে চলে গেলেন। এত ভালো লাগল আমার! ইচ্ছা করছিল পুরো ক্লাসকে মিষ্টি খাওয়াই। তটিনী মহা খুশি হয়ে সবাইকে আমাদের বীরত্বের কথা বলতে লাগল।

ঘণ্টা পড়ার পর স্যার আবারও আসলেন। কিন্তু তখন আর কী হবে! ঘণ্টা তো পড়েই গেছে! হুট করে রাশেদ দাঁড়িয়ে বলল, ‘স্যার, সামিয়ার খাতা তো দেখা বাকি আছে।’ রক্ত হিম হয়ে গেল আমার। এরা বন্ধু না শত্রু, বুঝলাম না। ক্লাসের টপারগুলো পড়ালেখার ব্যাপারে বড্ড বাড়াবাড়ি করে! স্যার বললেন, ‘ছুটির পর তোমার খাতা নিয়ে টিচার্স রুমে এসো।’ স্যার চলে যাওয়ার পর রাশেদের সঙ্গে আমার একটা ছোটখাটো কুস্তি হয়ে গেল। ছুটির পর আমতা–আমতা করে স্যারকে খাতা দেখালাম। স্যার দেখলেন সাদা পৃষ্ঠা। এরপর যা হলো তা বোধ করি আর না বললেও চলবে!

লেখক: নবম শ্রেণি, বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি উচ্চবিদ্যালয়, চট্টগ্রাম