স্টেশনের নাম প্রজাপতি

যেন একটা ঝড় বয়ে গেল।

যাত্রীরা ছুটছে। ছুটন্ত যাত্রীদের মতো রূপমেরও ছুটতে ইচ্ছা করছে। হঠাৎ দেখে দাদুভাই পাশে নেই। ওর গা-টা একটু ছমছম করে উঠল একমুহূর্তের জন্য।

যাত্রীদের ছোটার ঢেউটা আস্তে করে যেন ছোট হয়ে গেল। হঠাৎ একটা হাতের স্পর্শে পেছনে তাকাল রূপম।

দাদুভাই জলদি চলো। আজ ঠিক সময় ট্রেন ছাড়বে।

স্টেশনের কোলাহল, কুলিদের হাঁকডাক, দূরের শহর থেকে আসা ট্রেনের হুইসেল—কোনো কিছুই রূপমের কানে পৌঁছাচ্ছে না। ও শুধু ৫ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে এক্ষুনি যে ট্রেন ছাড়বে, সেই ট্রেনের দুলুনির শব্দ শুনছে। একমুহূর্তের জন্য মনে হলো নীল সাগরে ভেসে ওঠা একটা সাদা তিমির পিঠে চড়ে চড়ে দুলে দুলে দূরে আরও দূরে চলে যাচ্ছে বীরপুরুষের মতো।

দাদুভাই বললেন, রূপম আমরা ‘ঙ’ কামরায় উঠব।

রূপমের অস্পষ্ট অথচ মজার ভাবনাটা দাদুভাইয়ের আদুরে কথা শুনে কেটে গেল।

কেন যেন আজ ‘ঙ’ বর্ণটাকে ভালো লাগল রূপমের। ভালো লাগার একটা কারণ থাকতে পারে। কারণ, আজ রূপম যে কামরায় চড়বে, সেই কামরার নম্বর ‘ঙ’। অথচ ছোটবেলায় ‘ঙ’ বর্ণটাকে উচ্চারণ করতে পারত না। আর যখন পেরেছে, তখন বিরক্তিতে মুখেই আনত না। কেমন প্যাঁচানো একটা বর্ণ ‘ঙ’। উচ্চারণটাও কেমন কেমন যেন!

‘ঙ’-তে ওঠার জন্য দাদুভাইয়ের সঙ্গে হাঁটছে সে। একটু দ্রুত। একটু অস্থির। ‘ঙ’ খুঁজতে খুঁজতে একমুহূর্তের জন্য থামল রূপম। বাংলাদেশ রেলওয়ের সাদা ইউনিফর্ম পরা গোঁফওয়ালা গম্ভীর একজন স্টাফ সবুজ পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। ঠোঁটে ঝুলছে বাঁশি। হয়তো এক্ষুনি বাজাবেন। আজ এই স্টেশনে সবকিছু দেখতে এত ভালো লাগছে কেন, কে জানে!

দাদুভাই তাড়া দিলেন, রূপম ওঠো জলদি। শুনছ না, ট্রেনের হুইসেল বাজছে। এক্ষুনি ছাড়বে।

রূপম এবার লাফিয়ে ট্রেনের ‘ঙ’-তে উঠে পড়ল। এরপর সিট খোঁজার পালা। কামরাটায় বেশ ভিড়। শুধু ভিড় নয়, লোকে গিজগিজ করছে। ঠেলাঠেলি করে এগোতে হচ্ছে। সবাই ইতিউতি করে যার যার সিট খুঁজছে। ওরা খুঁজছে ২১-২২। একজন তো সিট ছাড়তেই চাইছে না। কার না কার সিটে বসে ঝগড়া বাধিয়ে দিয়েছে। আরেকজন ব্যাগ নিয়ে বসে পড়েছে নিচে। তার জন্য হাঁটাই যাচ্ছে না। ওই বয়স্ক যাত্রীকে ডিঙাতে গিয়ে বাধোবাধো লাগছে রূপমের।

রূপম বলল, আঙ্কেল একটু সরবেন, আমরা এগোব।

জানালা দিয়ে আওয়াজ ভেসে এল, এই চিপস, চকলেট, চিপস।

দাদুভাই বললেন, রূপম, এই যে এই পাশে।

বাহ্! ২১-২২ একদম ফাঁকা। যেন রূপমদের ডাকছে। রূপম আর দাদুভাই সিটে বসলেন। একটু হাঁপ ছাড়লেন দাদুভাই। এরপর লাগেজ, খাবারের ছোট ব্যাগ রাখলেন বাংকারে। দাদুভাইকে সাহায্য করতে রূপমও হাত লাগাল।

ট্রেনের জানালা দিয়ে স্টেশনের এদিক-সেদিক তাকায় রূপম। সুপ্রভাত কমলাপুর স্টেশন।

জবাবে স্টেশন থেকে ভেসে ওঠে কণ্ঠস্বর, সুপ্রভাত।

কার কণ্ঠস্বর? প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষারত যাত্রীদের কেউ কি বলল সুপ্রভাত? নাকি বাতাসে ভেসে এল কমলাপুর স্টেশনের মনের কথা? ইট-দালানের কমলাপুর স্টেশন তো আর কথা বলতে পারে না। যদি পারত তাহলে নিশ্চয়ই সুপ্রভাতের জবাবে স্টেশনটাও বলত সুপ্রভাত।

রূপম খেয়াল করল, পেছনের বগি থেকে সবুজ পতাকা নাড়তে থাকেন ট্রেনের গার্ড। ট্রেন ছেড়ে দেয়। গার্ডের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে রূপমের। সবুজ মানে কি ট্রেন চলার অনুমতি দেওয়া? গার্ডকে যদি প্রশ্নটা করা যেত নিশ্চয়ই তিনি জবাব দিতেন, হ্যাঁ, ট্রেনের গার্ড যখন সবুজ পতাকা নাড়তে থাকেন, তখন অনুমতি দেওয়া হয় ট্রেন ছাড়ার। সময় হয়েছে ট্রেন ছাড়ার, তাই আমি অনুমতি দিলাম।

বেজে উঠল একটা লম্বা হুইসেল। ট্রেন এবার সত্যি সত্যি ছেড়ে দিল। রূপমের শরীরটা হঠাৎ দুলে উঠল। এই প্রথম রূপম অনুভব করল, ট্রেন চললে যাত্রীর শরীর দুলে ওঠে।

কমলাপুর স্টেশনের দুই পাশে রেললাইন ঘেঁষে কত কত বাতিল ট্রেন দাঁড়ানো। কারা যেন ঘাসের ওপর কাপড় শুকাতে দিয়েছে। জীর্ণশীর্ণ ময়লাগোছের কাপড় পরে রাঁধছে কোনো এক মা। চুলার পাশে বসে আছে দুটো শিশু। ঝকরঝকর করে কমলাপুর ছেড়ে যাচ্ছে ট্রেন। রেললাইনের পাশে সবুজ সবজির বাহার। ট্রেন চলছে। দেয়ালের ও পাশে খিলগাঁও ফ্লাইওভার। ট্রেনে বসে বাস দেখতে ওর খুব মজা লাগল। খিলগাঁও রেলক্রসিং পার হয়ে চলে যাচ্ছে সকালের তিস্তা এক্সপ্রেস।

দাদুভাই বললেন, ছোটবেলায় রেললাইনের ওপর পয়সা রেখে দিতাম। ওপর দিয়ে ট্রেন চলে যাওয়ার পর পয়সা তুলে দিতাম। গোলাকার পয়সাটা কেমন চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যেত। হাতে নিয়ে কী যে খুশি হতাম! তারপর রেললাইনে কান পেতে শুনতাম ট্রেনের শব্দ।

রূপমেরও খুব ইচ্ছা করছে রেললাইনের ওপর পয়সা রেখে দিতে। কিন্তু পারছে না। একটা কষ্ট অনুভব করল বুকের ভেতরে। দাদুভাইয়ের ছোটবেলা, বাবার ছোটবেলা কত আনন্দে কেটেছে, কত হইহুল্লোড় করে কেটেছে। সেই ছোটবেলা কি এখন আছে? বাবা একদিন গল্প করছিল—দাদুভাইয়ের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ছোটবেলায় হলুদ শর্ষেখেতে কীভাবে দৌড়াদৌড়ি করত। মুহূর্তের মধ্যে রূপম বাবার ছোটবেলা দেখতে পেল। নিজেকে বাবার জায়গায় আবিষ্কার করল।

বাবার মতো শর্ষেখেতে দৌড়াচ্ছে, দৌড়াচ্ছে। মনে হলো, মাঠের ওপর কে যেন হলুদ চাদর বিছিয়ে রেখেছে।

মাকে বলল, আমি ওই হলুদ চাদরে শুয়ে আকাশ দেখব। আকাশের রং নীল। নীল রং আমার ভালো লাগে।

মা বলল, ওটা চাদর নয়, শর্ষে ফুল। শর্ষে ফুলের রং হলুদ। তুমি ফুলের ওপর শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখলে ফুলগুলো নষ্ট হবে। ফুল নষ্ট হলে শর্ষে হবে না। শর্ষে থেকে তেল হয়। তুমি নীল আকাশ দেখতে পারো শর্ষেখেতের পাশে দাঁড়িয়ে।

মায়ের কথা শুনে হাঁটতে লাগল শর্ষেখেতের দিকে।

কিছুদূর যেতেই একটা পিঁপড়া দেখতে পেল।

পিঁপড়াকে বলল, হলুদ ফুলের পাশে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখব। আকাশের রং নীল। নীল রং আমার ভালো লাগে।

পিঁপড়া বলল, আমার গায়ের রং লাল। লাল রং তোমার ভালো লাগে না?

লাল রংও আমার ভালো লাগে।

পিঁপড়া বলল, ঘাসফড়িং আর মৌমাছির মতো আমি উড়তে পারি না। তাতে কী, আমরা সবাই বন্ধু। ফুল দেখি, মধু খাই আর আকাশ দেখি। আকাশও আমাদের বন্ধু

পিঁপড়া বলল, আমি তো রোজ মাঠেই ঘুরি। মাঠে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখি।

তুমি কি আমার সঙ্গে নীল আকাশ দেখবে?

পিঁপড়া বলল, দেখতে পারি। তুমি যদি ওই শর্ষেখেতের পাশে দাঁড়াও, তাহলে আমার আরও অনেক বন্ধুকেও দেখতে পাবে।

বেশ। তাহলে আমাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে চলো। তোমার বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে।

পিঁপড়ার সঙ্গে কিছুদূর যেতেই দেখল কী যেন ডানা মেলে উড়ছে, দুই পাখা ছড়িয়ে। পিঁপড়া বলল, ওর নাম ঘাসফড়িং। আমার বন্ধু। সে-ও উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ায়। উড়তে উড়তে রোজ আকাশ দেখে।

আজ আমি শর্ষেখেতের পাশে দাঁড়িয়ে তোমাদের সঙ্গে আকাশ দেখব। যাবে আমার সঙ্গে?

ঘাসফড়িং হাসে। বলল, পিঁপড়া ছাড়াও আমার আরেকটা বন্ধু আছে। ওখানে গেলে তুমি ওকেও দেখতে পাবে।

তাহলে আমার সঙ্গে চলো। তোমাদের বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে।

পিঁপড়া আর ঘাসফড়িংয়ের সঙ্গে কিছুদূর যেতেই দেখা মিলল মৌমাছির সঙ্গে। ভনভন করে উড়ছে। পিঁপড়া পরিচয় করিয়ে দেয়, ওর নাম মৌমাছি। আমাদের বন্ধু।

ঘাসফড়িং জানাল, মৌমাছিও উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ায়। উড়তে উড়তে রোজ আকাশ দেখে।

মৌমাছি বলল, জানো আমি, পিঁপড়া ও ঘাসফড়িং—আমরা সবাই সবার বন্ধু। তোমারও নিশ্চয়ই বন্ধু আছে।

বন্ধু তো আছেই। কিন্তু ওরা তো শহরে থাকে। ওরা শর্ষেখেত দেখেনি। ওরা শর্ষেখেতের পাশে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখেনি। নীল আকাশ দেখেনি। ওরা পিঁপড়ার কথা শুনতে পারে না। ওরা ঘাসফড়িংয়ের কথা জানতে পারে না। ওরা মৌমাছি চেনে না। তোমরা আমাকে আকাশ দেখাও। তোমাদের কথা আমার বন্ধুদেরও বলব। পিঁপড়া বলল, এবার তুমি আকাশ দেখতে ওপরের দিকে তাকাও।

ওপরের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল কী অদ্ভুত আকাশ! নীল আকাশ! তুলো তুলো সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশের বুক দিয়ে। তখন বিকেল। একটু পরে পশ্চিমে সূর্য ডুববে। হলুদ ফুলের বিশাল খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে কখনোই এভাবে আকাশ দেখেনি। আজ যেভাবে দেখছে।

পিঁপড়া বলল, কেমন লাগছে তোমার?

অনেক ভালো লাগছে। খোলা আকাশের নিচে কত কী ঘুরে বেড়ায়, উড়ে বেড়ায়, নেচে বেড়ায়। তোমাদের না দেখলে বুঝতেই পারতাম না।

ক্লাসের বন্ধুদের কথা মনে পড়ল তার। ওদের সঙ্গে খেলা করতে দারুণ লাগে। কত না আনন্দ, কত না হইচই। তার মানে সবারই বন্ধু থাকে। যেমন বন্ধু আছে পিঁপড়া, ঘাসফড়িং, মৌমাছির।

পিঁপড়া বলল, ঘাসফড়িং আর মৌমাছির মতো আমি উড়তে পারি না। তাতে কি, আমরা সবাই বন্ধু। ফুল দেখি, মধু খাই আর আকাশ দেখি। আকাশও আমাদের বন্ধু।

এই বলে পিঁপড়া শর্ষে ফুল বেয়ে বেয়ে ফুলের পাপড়িতে এসে বসল। বলল, দেখো তো আমাকে কেমন লাগছে?

সঙ্গে সঙ্গে মৌমাছি উড়ে গিয়ে আরেকটি ফুলে গিয়ে বসল। বলল, দেখো তো আমাকে কেমন লাগছে?

ফুলের ওপর মৌমাছি আর পিঁপড়াকে বসতে দেখে ফড়িংটাও পাখা ছড়িয়ে উড়তে লাগল। উড়তে উড়তে বলল, দেখো তো আমাকে কেমন লাগছে?

কে যেন বলে উঠল, সবাইকে খুব সুন্দর লাগছে।

কে বলল কথাটা?

পেছনে তাকিয়ে দেখল, মা।

হঠাৎ উল্টো দিক দিয়ে আসা ট্রেনের ঝাঁ ঝাঁ শব্দে রূপমের ভাবনার সুতা ছিঁড়ে যায়।

রূপম তাকিয়ে দেখল, চোখের পলকে অন্য একটা ট্রেন চলে গেল কমলাপুরের দিকে। এ যেন জায়গা বদল হলো। একটা ট্রেন স্টেশন ছেড়ে যায়। আরেকটা ট্রেন এসে স্টেশনের জায়গা পূরণ করে। ওদিকে বুক পেতে থাকে রেললাইন।

ট্রেন চলছে। রূপম ভাবছে, দুই পাশে রিকশা, সিএনজি, বাস, মানুষজন—সবাই থেমে গিয়ে যেন ওদের গার্ড অব অনার দিচ্ছে। গার্ড অব অনার কথাটি ভাবতেই ওর মনে হলো স্মৃতিসৌধের কথা। স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে আসা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। টিভিতে কত দেখেছে এই ছবি। রূপমও স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়েছিল। স্মৃতিসৌধের চূড়া দেখে বিস্মিত হয়েছিল রূপম। মিতালি মিস বলেছিলেন, ‘এই চূড়া হচ্ছে স্বাধীনতার স্বপ্নচূড়া। বাংলার স্বাধীন আকাশ পেতে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর সাহসীরা জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন। তাঁরা শহীদ। তাঁদের স্বপ্নের কথাগুলো স্মৃতিসৌধের চূড়া ছুঁয়ে আছে। সেদিন থেকে এ দেশের মেঘলা আকাশ, কখনোবা রোদেলা কখনোবা ঝিমধরা রোদহীন-মেঘহীন আকাশ রূপমের ভালো লাগে। রূপম বসেছে জানালার পাশে। ও মাথা গলিয়ে একটু আকাশ দেখতে চাইল।

দাদুভাই মানা করলেন, জানালা দিয়ে মাথা বের কোরো না। শুনেছি, কেউ কেউ ঢিল ছোড়ে ট্রেনে। ডেঞ্জারাস!

রূপম আবার ঠিকঠাকমতো বসল।

একমুহূর্তের জন্য ওর মনটা খারাপ হয়ে যায়। মালিবাগ রেলক্রসিং পার হতেই ওর মনটা চনমনিয়ে উঠল। ঢাকা শহরের চেনা জায়গাগুলো ভেসে ভেসে যেন ট্রেনের উল্টো দিকে চলে যাচ্ছে।

ট্রেন ছুটছে ঝম ঝম করে। ট্রেনলাইনে যেন হাজার আকাশ ঝরে বৃষ্টি ঝরছে। ঝম ঝম ঝম ঝম। এত ছন্দ কেন ট্রেনের বুকে! কে শেখাল ওকে? কে বানাল ওকে? যা-ই বলি, তা-ই যেন ছন্দ হয়ে যায়। রূপম আপনমনে বলতে থাকে—ঝিক্কির ঝিক্কির ময়মনসিং, ঢাকা যেতে কত দিন...।

মানুষের জন্য মানুষ পথ সৃষ্টি করে। এই পথে চলতে চলতে কত কিছু দেখা যায়। কত কিছু চেনা যায়। আমরা পথ চলি কীভাবে? হেঁটে হেঁটে। আবার এই পথে আছে নানা ধরনের যানবাহন। কোনোটা চলে রাস্তায়, কোনোটা চলে নদীতে, কোনোটা আকাশে

দাদুভাই বললেন, ট্রেন কে বানিয়েছে জানো?

রূপমের চোখের সামনে বইয়ের পাতাগুলো ভেসে ওঠে। কোন বইয়ে পড়েছে ট্রেন বানানোর কথা? ভাবতে থাকে রূপম। বিজ্ঞান? বাংলা? নাকি অন্য কোনো গল্পে? নাকি কোনো পত্রিকার পাতায়।

দাদুভাই বললেন, জর্জ স্টিফেনসন।

লাফিয়ে উঠল রূপম। হ্যাঁ হ্যাঁ, জর্জ স্টিফেনসন ট্রেন বানিয়েছে।

সেদিনের সেই ট্রেনের চাকা ঘুরতে ঘুরতে কত কত বছর পেরিয়ে গেল। দাদুভাই বললেন, বাংলাদেশে প্রথম ট্রেন চালু হয় ১৮৬২ সালে। তখন ব্রিটিশদের রাজত্ব।

রূপমের খুব জানতে ইচ্ছা করল, কোথা থেকে বাংলাদেশে ট্রেন চলাচল শুরু হলো?

দাদুভাই বললেন, দর্শনা থেকে কুষ্টিয়া।

দাদুভাইয়ের কথা শোনার পর থেকে রূপম একটা ঘোরলাগা আবেগের জালে আটকা পড়ে। মামার কথা মনে পড়ল। মামাই ওকে জানিয়েছে ট্রেনের কথা। মাথায় কিলবিল করতে থাকে কত কত ভাবনা। রূপম ভাবছে, আমাদের আছে কত কত পথ। এই পথে চলতে চলতে কত কথা, কত স্বপ্ন দেখা, কত স্মৃতি—এর যেন শেষ নেই। আসলে পথের কি কোনো শেষ আছে? নেই। মানুষের জন্য মানুষ পথ সৃষ্টি করে। এই পথে চলতে চলতে কত কিছু দেখা যায়। কত কিছু চেনা যায়। আমরা পথ চলি কীভাবে? হেঁটে হেঁটে। আবার এই পথে আছে নানা ধরনের যানবাহন। কোনোটা চলে রাস্তায়, কোনোটা চলে নদীতে, কোনোটা আকাশে।

ট্রেনের ঝাঁকুনিতে দুলতে দুলতে রূপম ভাবতে লাগল পথ চেনার সেই গল্পের কথা। গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় আসার পথে মামার কাছ থেকে কত কিছু জানা হয়েছিল। পথের কথা। যানবাহনের কথা। সে সময় মামাতো ভাই মিঠু ছিল সঙ্গে। ছবির মতো ভেসে উঠল সেসব কথা। সেদিন সকালে বাড়ি থেকে ওরা বের হওয়ামাত্রই একটা কাক আকাশে উড়ছে কা কা করে। মিঠু জানতে চাইল মামার কাছে, ওই যে কাকটা কা কা করে উড়ে উড়ে পথ চলছে, কিন্তু মানুষ তো উড়তে পারে না। তাহলে মানুষ পথ চলে কীভাবে?

উত্তরটা মামা চমত্কারভাবে বুঝিয়ে দিলেন, কেন? আমাদের জন্য যানবাহন আছে না?

মিঠুর প্রশ্নটা শোনার পর মনে হয়েছে, একি বোকাটে প্রশ্ন! এই যে আমরা হাঁটছি, এভাবেও তো পথচলা। যখন এখনকার মতো বাস, ট্রেন, প্লেন—এসব ছিল না, তখন মানুষ তো হেঁটে হেঁটে পথ পাড়ি দিত। বুঝেছ?

আগেকার দিনের মানুষেরা কত কষ্ট করেছে।

এ সময় একটা গরুর গাড়ির ক্যাঁচর-ক্যাঁচর শব্দ কানে এল।

গরুর গাড়ি দেখে মামা বললেন, জানো, এককালে গ্রামদেশে গরুর গাড়ি ছিল একমাত্র বাহন। এখন অবশ্য গ্রামে রিকশা, মোটরসাইকেল, বাস—সবই চলে।

গরুর গাড়িটা বানাল কীভাবে মামা?

মামা জানালেন, গরুর গাড়িতে কাঠের তৈরি দুটো চাকা থাকে। চাকায় বেড় দিয়ে থাকে লোহার একটা বলয়। চাকা দুটোর কেন্দ্র লোহার একটি দণ্ড দিয়ে জোড়া থাকে। তার ওপরে বাঁশ ও কাঠের পাটাতন থাকে। গাড়ির সামনের দিকে জোয়ালে দুটো গরু বাঁধা থাকে। গাড়োয়ান বসে গরুকে তাড়া দেয়। গরুর গাড়ি চলতে শুরু করে।

মামার কথা শুনে গরুর গাড়ি নিয়ে আমার একটা গানের কথা মনে হলো। ওই যে ওই গানটা—

‘ও কি গাড়িয়াল ভাই
কত রব আমি পন্থের দিকে চাইয়া রে...’

এমন সময় দেখি পালকি নিয়ে চারজন লোক ছুটছে। হুহুমনা-হুহুমনা-হুহুমনা। দেখি কী, নতুন বউ বসে আছে পালকিতে।

মিঠু তো ছড়া বলতে শুরু করল—

‘বাকবাকুম পায়রা
মাথায় দিয়ে টায়রা
বউ সাজবে কালকি
চড়বে সোনার পালকি’

মামা বললেন, অনেক দিন পর গ্রামের পথে পালকি দেখলাম। আজকের দিনে বিয়ে উপলক্ষে যেমন গাড়ি ভাড়া করা হয়, তেমনি একটা সময় ছিল পালকি ভাড়া করা হতো। জানো, ওই যে চারটা লোক কাঁধে করে পালকিটা টানছে, তাদের বলে বেহারা।

আমরা হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম নদীর ঘাটে। মাঝিরা ডাকাডাকি করছে—আসেন, আসেন, ঘাট পার কইরা দিই, আসেন, আসেন।

মামা আমাদের বোঝালেন। আমাদের চলাচলের জন্য অনেক পথ আছে। এই যে আমরা হেঁটে এলাম, এটা হলো স্থলপথ। এবার নৌকা করে যাচ্ছি, এটা হলো জলপথ। নৌকা কীভাবে বানিয়েছে জানো?

আমরা দুজনই বললাম, নাহ্।

একসময় নৌকার আগে মানুষ চালিয়েছিল কলাগাছের ভেলা। তিন-চারটা কলাগাছ কেটে বাঁশের কাঠি দিয়ে আটকে দিয়ে বানাত ভেলা। তারপর ধীরে ধীরে মানুষ গাছের গুঁড়ি কেটে নৌকা বানানো শিখল। পানি কেটে এগোনোর জন্য তাতে দাঁড় লাগাল। গতি ঠিক রাখার জন্য জুড়ে দিল হাল। বাতাসের সাহায্যে গতি বাড়ানোর জন্য নৌকায় পাল লাগানো হলো। অনেক নামে নৌকা আছে। যেমন বালাম, শালতি, ময়ূরপঙ্খি, বজরা ইত্যাদি। এসব নৌকা দেখতে কোনোটা ছোট, কোনোটা বড়।

মাঝির নৌকা চালানো দেখে বলেছিলাম, মাঝিরা হচ্ছে নৌকার ড্রাইভার।

আমার কথা শুনে মামা হো হো করে হেসে দিলেন। বললেন, একটা মজার বিষয় কি জানো? এই যে এত গাড়ি, ঘোড়া, মোটর, লঞ্চ, স্টিমার, প্লেন—এসব যাঁরা চালান, তাঁদের একেকজনের একেক নাম। গরুর গাড়ি যিনি চালান তাঁকে বলে গাড়োয়ান, নৌকা চালান মাঝি, প্লেন চালান পাইলট। যিনি লঞ্চ চালান তিনি সারেং। আবার বড় বড় স্টিমার যিনি চালান, তাঁকে বলে ক্যাপ্টেন। আর বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার, রেলগাড়ি—এগুলো যিনি চালান, তাঁকে বলে ড্রাইভার।

মিঠু বলল, আচ্ছা, জাহাজে তো বইঠা নেই, তাহলে পানি কেটে কেটে চলে কীভাবে?

মামা বললেন, কেন, চাকার সাহায্যে।

শুনে তো আমরা অবাক। ওমা। জাহাজেরও চাকা থাকে!

মামা বললেন, হ্যাঁ, জাহাজ বানিয়েছেন রবার্ট ফুলটন।

এ সময় কানে এল প্লেনের আওয়াজ। প্লেনটাকে দেখে মনে হলো, এ যেন যন্ত্রের পাখি।

মামা বললেন, হ্যাঁ, ওটাকেই বলে আকাশপথ। ওই আকাশপথে উড়োজাহাজ চলে, যাকে আমরা বলি প্লেন।

মামা যখন উড়োজাহাজ সম্পর্কে বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তখন আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন উড়োজাহাজের সঙ্গে কথা বলছি। উড়োজাহাজ আমাকে বলছে, আমারও ডানা আছে। পাখির মতো ডানা। পাখি আকাশে ওড়ে। তাই দেখে একদিন মানুষেরও ইচ্ছা হলো আকাশে ওড়ার। ডানা তৈরি করে ওড়ার চেষ্টা করল সে। শেষে তৈরি হলো বেলুন। তারপর বেলুন থেকে উড়োজাহাজ।

সত্যি, এই নদীপথে কত কী দেখা যায়। নৌকা, লঞ্চ, স্টিমার। আকাশ। আকাশে ওড়া প্লেন।

মামা বললেন, পথের কি শেষ আছে? স্থলপথ, নৌপথ, এবার যাব রেলপথে।

আমরা রিকশায় চড়ে রেলস্টেশনে এলাম। টিকিট কাটলাম। ট্রেনে চড়লাম। ট্রেন চলতে শুরু করল। রেললাইনের ওপর দিয়ে ট্রেনটা দারুণ বেগে ছুটে চলেছে। ট্রেন চলার একটা ছন্দ আছে।

মামা বললেন, ট্রেন যখন ছুটে চলে, সে সময় ছন্দ দিয়ে যে কথাই বলি না কেন, মনে হবে ট্রেনটা আমার সঙ্গে একই ছন্দে কথা বলছে। ছড়া কাটছে। আমার সঙ্গে সঙ্গে বলো—

‘ঝিক্কির ঝিক্কির ময়মনসিং
ঢাকা যাইতে কত দিন’

মিঠু আর আমি বলতে শুরু করলাম। কী আশ্চর্য! ট্রেনের সঙ্গে ছন্দটা মিলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ট্রেনও ছড়া কাটছে—

‘ঝিক্কির ঝিক্কির ময়মনসিং
ঢাকা যাইতে কত দিন
ঝিক্কির ঝিক্কির ময়মনসিং
ঢাকা যাইতে কত দিন’

মামা বললেন, এই তো আর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে আমরা ঢাকায় পৌঁছাব।

আমি বললাম, কিন্তু রেলগাড়ি কীভাবে বানানো হলো তা তো বললেন না মামা?

মামা বললেন, ১৮৩০ সালে রেল চলাচল শুরু হয়। কে বানিয়েছেন জানো? তাঁর নাম জর্জ স্টিফেনসন।

ট্রেন শব্দটি প্রাচীন ফরাসি শব্দ ট্রাহিনার থেকে এসেছে, যা লাতিন ট্রাহিয়ার থেকে উদ্ভূত। লাতিন ট্রাহিয়ারের অর্থ হলো টানা অথবা টানিয়া আনা।

চা, কফি, কাটলেট—কথাগুলো শুনতেই স্মৃতিকথাগুলো হারিয়ে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে রূপম দেখল, সাদা ইউনিফর্ম পরা তিস্তা এক্সপ্রেসের স্টাফ যাত্রীদের কাছে খাবার বিক্রি করতে চাইছেন। খাবারের ঘ্রাণে রূপম খিদে অনুভব করল।

দাদুভাই বললেন, কিছু খাবে?

একটু লজ্জাই পেল রূপম। ট্রেনে এত লোকের সামনে কী করে খাবে! কিন্তু ওর খেতে ইচ্ছা করছে। ‘খাব’ কথাটি বলতেই পারল না দাদুভাইয়ের কাছে। রূপম চুপ হয়ে থাকল।

রূপম দেখো দেখো, ওই যে তোমার স্কুল।

রূপম দেখল, বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুল।

স্কুলটা দেখে এত খুশি লাগল ওর, যেন একটা কিছু আবিষ্কার করল। সেই যে গল্পে পড়া কলম্বাসের মতো। যিনি কিনা আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলেন। বাইনোকুলারে দেখতে দেখতে এক দ্বীপরাজ্য আবিষ্কার করলেন কলম্বাস। সেই রাজ্যই আজকের আমেরিকা।

ট্রেনের জানালা দিয়ে স্কুলটা দেখার পর কিছু একটা আবিষ্কারের আনন্দে রূপম চেঁচিয়ে উঠল ইউরেকা ইউরেকা বলে।

এই প্রথম ট্রেন থেকে স্কুল দেখার এক অন্য রকম আনন্দ অনুভব করল রূপম। স্কুল ছুটি শেষে যখন আবার ক্লাস শুরু হবে, তখন বন্ধুদের কাছে এই গল্পই সে করবে। স্কুলের হলুদ দেয়াল, প্লাস্টার ঝরে পড়া ভবন, বন্ধ জানালা ধা করে মিলিয়ে গেল। কারওয়ান বাজার পার হয়ে ট্রেন চলছে। ছুটে চলায় এত আনন্দ!

দাদুভাই বাংকার থেকে খাবার রাখা ব্যাগটি নামিয়ে সবুজ ঢাকনার ছোট্ট গোলাপি বক্স বের করলেন। গরম নুডলস। টিস্যু পেপার দিয়ে মোড়ানো চামচ। দাদুভাই আর রূপম নুডলস খাচ্ছে।

ঝনঝনাৎ আওয়াজ তুলে ট্রেনটাও ছুটছে। তেজগাঁও, বনানী, ক্যান্টনমেন্ট পেরিয়ে বিমানবন্দর স্টেশন। গতি কমে এল ট্রেনের। ট্রেনটা থেমে পড়ল। হুড়মুড়িয়ে যাত্রীরা উঠছে। কিছু কিছু যাত্রী নামল। সামান্য যাত্রাবিরতি। আবার হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন চলতে শুরু করল।

জেএসসি পরীক্ষা শেষ। পড়ার চাপ নেই। হইহুল্লোড় করার দিন। কিন্তু হইহুল্লোড় করবে কোথায়? মাকে বলতেই মা রাজি হয়ে গেল। বলল, দাদুর বাড়ি থেকে ঘুরে আসো

ভোর ভেঙে কখন যে সকাল হয়ে গেল! একসময় সকাল থেকে আবার দুপুর হয়ে গেল। জানলা দিয়ে তাকিয়ে রূপম দেখল, বাইরে রোদ বেশ প্রখর। ততক্ষণে ঝাঁ ঝাঁ করে ট্রেন আরও গতি বাড়িয়ে চলতে শুরু করেছে। মাঝেমধ্যে হুইসেলের আওয়াজ প-অ-ম...

‘ঙ’ কামরায় উঠে পড়েছে এক অন্ধজন। তার হাতে একটা পুরোনো বেহালা। বেহালায় সুর বাজছে। লোকটি বেশ করুণ সুরে বাজাচ্ছে। অন্ধ লোকটির হাত ধরে একটা ছোট্ট মেয়ে গুটি গুটি পায়ে যাত্রীদের ভিড় ঠেলে এগিয়ে চলেছে। মেয়েটির হাতে একটা বাটি। মেয়েটি ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে আছে। মুখে কোনো হাসি নেই। চোখে কোনো কান্না নেই। ছোট্ট একটা মেয়ে। ময়লা ফ্রক পরা। কেবল বাটি ধরে আছে। ওদের পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার সময় রূপম পকেট থেকে পাঁচ টাকার কয়েন মেয়েটির বাটিতে দিল।

ঝনাৎ করে শব্দ হলো।

বেহালার সুরের সঙ্গে কয়েন ফেলার আওয়াজটা সুন্দর একটা ধ্বনি তৈরি করল। রূপমের মনে পড়ল গল্পে পড়া হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালার কথা। বাঁশি বাজিয়ে হ্যামিলিনের ছোট্ট খোকা-খুকুদের নিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল লোকটা!

আচ্ছা দাদুভাই, হ্যামিলিনের মেয়র ওই বাঁশিওয়ালাকে স্বর্ণমুদ্রা না দিয়ে রৌপ্যমুদ্রা দিয়েছিল কেন?

দাদুভাই বললেন, মেয়র ভবিষ্যৎ দেখতে পায়নি।

কথাটা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না রূপম। কিন্তু বেশ মনে ধরল কথাটা। দাদুভাই দারুণ মানুষ! খুব কম কথা বলেন। যখন বলেন, এতটা মিষ্টি করে বলেন যে খুব ভালো লাগে। রূপম দাদুভাইকে খুব ভালোবাসে।

হঠাৎ হইচইয়ের শব্দে রূপম সচকিত হয়ে উঠল।

কার নাকি মোবাইল পড়ে গেছে জানালা দিয়ে। কেউ বলছে, নিচ থেকে কেউ টেনে নিয়েছে। কেউ বলছে, না না, ওসব এই লাইনে নেই। শুনেছি মৌলভীবাজার, লাউয়াছড়া জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যখন ট্রেন যায়, এ রকম ঘটনা ঘটে। অবশ্যই এখন এগুলো বন্ধ হয়েছে। পেছন থেকে কেউ একজন বলল, ঠিক বলেছেন, পুলিশ ওদের অ্যারেস্ট করেছে। যে লোকের মোবাইল হারিয়েছে, তাকে দেখার জন্য রূপম ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের দিকে তাকাল। লোকটিকে কেউ কেউ বলছে, মোবাইলটা কি অ্যান্ড্রয়েড ছিল?

আরেকজন বলছে, গ্যালাক্সি টেন? আহা রে, কত দামি মোবাইল!

আরেকজন বলছে, আপনি কি ছবি তুলছিলেন?

রূপম লক্ষ করল, লোকটি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিলেন। কেমন মলিন মলিন চেহারা। আজকাল মোবাইল হারিয়ে যাওয়া বড়দের অনেক কষ্টের। একবার বাবারও হারিয়েছিল। হারায়নি ঠিক, মোবাইলটি জাফলংয়ের পানিতে পড়ে গিয়েছিল। সে সময় আমি ছিলাম। মা ছিল, বাবা ছিল। পাহাড়ি ঝরনা দেখেছি। নৌকায় চড়ে বেড়িয়েছি, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বসেছি। জাফলংয়ের নীল পানিতে মিশে থাকা পাথর কুড়িয়েছি। এভাবেই তিন দিন কেটেছে। চতুর্থ দিন জাফলংয়ের খাসিয়া জৈন্তা রাজার বাড়ি দেখার জন্য নৌকায় উঠছিলাম, হঠাৎ করে বাবার মোবাইলটি পানিতে পড়ে যায়। ইশ্‌! বাবার যে কী কষ্ট! বাবার সেই কষ্ট কষ্ট চেহারাটা ভাসছে এখন। বাবা সুইডেনে থাকে। প্রায় দিনই আমার সঙ্গে, মায়ের সঙ্গে ইমোতে, মেসেঞ্জারে কথা হয়। বাবা সুইডেন থেকে ভিডিও কল করে। আমি যখন ক্লাস সেভেনে উঠলাম, পাতা উল্টে উল্টে আমার নতুন বই বাবাকে দেখিয়েছি।

বই দেখে বাবা বলল, নতুন বইয়ের গন্ধ আমারও ভালো লাগে।

সেদিন জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ ছিল। রূপমদের স্কুলে ছিল বই উত্সব। সেই দিনের সেই কথাগুলো ট্রেনের দুলুনিতে রূপমের মনেও যেন ঢেউ খেলে যাচ্ছে। আপনমনে দাদুভাই পত্রিকা পড়ছেন। ‘ঙ’ কামরাজুড়ে মোবাইল নিয়ে যে গুঞ্জন উঠেছে, তা দাদুভাইকে একটুও স্পর্শ করেনি।

ট্রেন চলছে। পেরিয়ে যাচ্ছে কত কত স্টেশন। কত কত জায়গা। কত কত জনপদ। ট্রেন চলছে।

শ্রীপুর। স্টেশনটা পার হতেই রূপমের মনে হয় হঠাৎ আস্ত ঢাকা শহরটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। দালানকোঠা, অট্টালিকা, বাস-ট্রাক-রিকশা, মানুষের ছুটে চলা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। চোখের সামনে দুই পাশে সবুজ প্রান্তর। গাছগাছালি। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট নদী। দূরে ঘাস খাচ্ছে গরু। কৃষিখেতে লোকেরা কাজ করছে।

প্রখর রোদ। অদ্ভুত সুন্দর এই প্রান্ত দেখে রূপমের বিশ্বাসই হচ্ছে না ও এটা নিজের চোখে দেখছে। সময় এত দ্রুত গড়িয়ে গেল। কমলাপুর থেকে যেন উঠল এইমাত্র। কেমন যেন একটা ঘোরলাগা মুগ্ধতার মধ্যে রূপম ঢুকে পড়ছে।

জেএসসি পরীক্ষা শেষ। পড়ার চাপ নেই। হইহুল্লোড় করার দিন। কিন্তু হইহুল্লোড় করবে কোথায়? মাকে বলতেই মা রাজি হয়ে গেল। বলল, দাদুর বাড়ি থেকে ঘুরে আসো।

এর কদিন পরই দাদুভাই এলেন ঢাকায় ডাক্তার দেখাতে। ডাক্তার অনেক পরীক্ষা করালেন। দাদুভাইকে নিয়ে মায়েরও বেশ ব্যস্ত দিন কাটল গত সাত দিন। ডাক্তার দেখানোর পর থেকে দাদুভাই সুস্থ বোধ করছেন। দাদুভাই একজন শান্ত মানুষ। কথা বলেন ধীরে ধীরে। খুব আদরমাখা কথা। যখন কথা বলেন, খুব গুছিয়ে বলেন। এ জন্যই দাদুভাইকে ভীষণ ভালো লাগে রূপমের। দাদুভাইকে একনজর দেখে রূপম দৃষ্টি দেয় ‘ঙ’ কামরায় বসা যাত্রীদের দিকে। কেউ পেপার পড়ছে। কেউ পাশের জনের সঙ্গে কথা বলছে। কেউ মোবাইলে ব্যস্ত।

টিকিট চেকার এসে বললেন, টিকিট।

দাদুভাই টিকিট দেখালেন।

টিকিটের গায়ে টিকিট চেকার খ্যাঁচ করে কলমে একটা দাগ দিয়ে দাদুভাইয়ের হাতে ফেরত দিলেন।

টিকিট চেকারকে দেখার পর রূপমের মনে খামোখা ধুকপুকানি উঠেছিল, দাদুভাইয়ের হাতে টিকিট ফেরত দেওয়ার পর, তা মিলিয়ে গেল।

টিকিট চেকার ট্রেনের ঝাঁকুনিতে দুলতে দুলতে টিকিট দেখার জন্য অন্য যাত্রীর দিকে হাত বাড়ালেন।

কিছুক্ষণ পর ট্রেনটা থামল।

দাদুভাই বললেন, বিমানবন্দর স্টেশন।

হুড়মুড় করে যাত্রীদের কেউ কেউ উঠে পড়ল ‘ঙ’ কামরায়। অন্যরা ছোটাছুটি করছে নির্দিষ্ট কামরাটি খুঁজে পেতে। নারী-পুরুষ-শিশু-কিশোর—কত বয়সী যাত্রী। ট্রেনে ওঠার জন্য না জানি কী অধীর অপেক্ষায় বসেছিল ওরা। ‘ঙ’ কামরায় ওঠা যাত্রীদের প্রতি রূপমের খুব মায়া হলো। অপেক্ষা করার জন্য মায়া। হুইসেল বাজিয়ে ট্রেনটা যখন প্ল্যাটফর্ম স্পর্শ করছিল, তখন এসব যাত্রীর মনে কত না খুশির হাওয়া বয়েছিল। এ খুশি বড় এবং ছোট সব বয়সীর কাছে একইভাবে ধরা দিয়েছিল।

এতক্ষণ ‘ঙ’ কামরায় যে খালি খালি ভাবটা ছিল, তা আর রইল না। প্রতিটি আসন এখন পূর্ণ।

আবার হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন ছেড়ে দিল। ট্রেন চলার আনন্দে রূপমের হৃদয়ে সৌরভ ছড়িয়ে পড়ল। যেন রঙিন ফুলের বাহারি পাপড়িগুলো ওর গায়ে ছিটিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আজ ওর অনেক আনন্দ। যেন চারপাশে ফুলের গন্ধ ছড়ানো।

ফুল রূপমের খুব প্রিয়। ফুলের বাগান করার খুব ইচ্ছা। মা বলেছে, যখন নিজের বাড়ি হবে, তখন বাড়ির সামনে একটা বাগান হবে। বনশিউলি, কাঠমল্লিকা, ডালিয়া, গন্ধরাজ, গাঁদা, গোলাপ, বেলি, রঙ্গন, ক্যাকটাস। কত ফুল ফুটবে সেই বাগানে।

মায়ের কথা শুনে বাবা বলেছিল, মনটাকে সুন্দর করে দেওয়ার কারখানা হলো ফুলের বাগান। এ কারখানায় ধোঁয়া ওঠে না, শুধু সুবাস ছড়ায়।

খাবার টেবিলে বসে যেদিন এ গল্প হচ্ছিল, সেদিন ছোট মামা ছিল বাসায়। বাবার কথা শুনে মামা বলল, ঢাকা শহরে এক ইঞ্চি জায়গার অনেক দাম। অহেতুক বাগানটাগান করে জায়গা নষ্ট করবেন না। তার চেয়ে পাঁচ-ছয়টা দোকান বানাতে পারলে লাভ হবে।

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

ছোট মামার কথাকে মা-বাবা পাত্তা দেয়নি।

মামার কথা শুনে রূপমের খুব কষ্ট হয়েছিল। অথচ রূপমের শখ বাগান করা। মাটি, টব, গোবর, সার—এসব নিয়ে নাড়াচাড়া করতে ওর খুব ভালো লাগে। ওর এক বন্ধু আছে, নাম আরাফাত। আরাফাতদের বাসায় বাগান আছে। সেই বাগানে কত ফুল ফোটে। স্কুলে প্রায় দিনই ও বাগানের গল্প শোনায়। রূপমেরও ইচ্ছা করে প্রতিদিন সকালে তাজা ফুলের গন্ধ নিয়ে ক্লাসে ঢুকতে। একদিন বাগান নিয়ে গল্প করতে করতে বন্ধু অনীক আরাফাতকে বলল, আচ্ছা, মানুষের মতো ফুল গাছের খিদে লাগে?

আরাফাত বিজ্ঞের মতো উত্তর দিল, ওমা! লাগবে না কেন? চন্দ্রমল্লিকা তো সবচেয়ে বেশি ক্ষুধার্ত থাকে। ভীষণ পেটুক ধরনের।

এ কথা শোনার পর সবাই হেসে উঠল। বন্ধুরা ফুলবাগানের ব্যাপারে খুঁটিনাটি জিজ্ঞেস করতে লাগল আরাফাতকে।

আরাফাতও খুব খুশি হয় বাগানের প্রতি বন্ধুদের কৌতূহল দেখে। বলল, ফুলবাগান তো আর আমার পর নয়। ওদের সব খবরই জানি। তোদের বলি জেনে রাখ, শীতকাল হচ্ছে ফুলবাগানের সৌরভ ছড়ানোর দিন। সে সময় বাগানজুড়ে পুষ্পমেলা বসে। আবার কিছু ফুল আছে, বর্ষাকে স্বাগত জানায়। যেমন কদম, জিনিয়া। আমাদের বাগানে কদমগাছ নেই।

শুনেছি, ফুলবাগানে পরি ঘুরে বেড়ায়। তুই কি পরি দেখেছিস? আরাফাতের কাছে জানতে চেয়েছিল রূপম।

কই, না তো! কোনো দিন পরি দেখিনি। পরিদের খোঁজখবর শুধু গল্পে গল্পে পেলাম। আমাদের বাগানে গোলাপ আছে, ডালিয়া আছে। ওরাও কিন্তু অনেক খায়। গোবর, সার, খইল পেলে লকলকিয়ে বড় হয় ওরা। ওদের অনেক যত্ন নিতে হয়। বাগান করা অনেক কষ্টের, জানিস?

রূপম জানতে চায়। এত এত গাছ কীভাবে যত্ন নিস?

আমাদের মালি আছে, মালির সঙ্গে আমরাও হাত লাগাই।

তবে গাছে পানি দেওয়ার কাজটা মা আর আমি দুজনই করি। ফুল গাছকে যত্ন না করলে অভিমান করে ওরা। ওরা খুব অভিমানী। একবার অভিমান করলে ওরা আর পাপড়ি মেলে ফুটতে চায় না।

রূপমের মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। ভাড়া বাসায় থেকে বাগান করা যায় না। বারান্দায় গ্রিলের সঙ্গে ছোট ছোট টবে মা অনেক ফুল গাছ লাগিয়েছে। আপাতত এটাই রূপমের সুখ। ঢাকা শহরটা যদি ফুলের বাগানে ঢেকে থাকত, নগরবাসী অনেক আনন্দ পেত। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বাগান, বাসায় বাসায় বাগান। অফিসে বাগান, শপিং মল সেন্টারে বাগান। আর সেসব বাগানে যদি নানা রঙের ফুল ফুটত। ফুলের ভিড়ে মানুষের মন নির্মল আর নরম থাকত। মানুষে মানুষে ঝগড়া-বিবাদ থাকত না।

আরাফাতের কথা যেন আর থামে না। বলল, একদিন স্কুল থেকে বাসায় ফিরেছি। পাশের বাসা থেকে আমারই বয়সী এক ছেলে এসে মাকে বলল, আন্টি, আপনাদের বাগানে গাঁদা ফুল আছে?

মা বললেন, কেন?

ছেলেটির মুখ বিষণ্ন।

হঠাৎ মা খেয়াল করল, ছেলেটি ওর ডান হাতের একটা আঙুল চেপে ধরে আছে। আঙুলের ফাঁক গলে রক্ত পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা। বলল, মা পাঠিয়েছে আপনার কাছে। আমার এই আঙুলে গাঁদা ফুলের পাতার রস লাগাব। আঙুলটা কেটে গেছে তো!

আমি তখন দৌড়ে গিয়ে বাগান থেকে গাঁদা ফুলের পাতা ছিঁড়ে আনি। মা পাতা থেকে রস বের করে ছেলেটির আঙুলে লাগিয়ে দেয়। ছেলেটি ধন্যবাদ বলে ওর বাসায় চলে গেল।

আরাফাতের সেদিনের সেই কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বাগানের মুগ্ধতায় কল্পনার রঙে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে রূপম।

হঠাৎ দাদুভাইয়ের কণ্ঠ শুনতে পেল, এই রূপম, কী, কেমন লাগছে তোমার?

অনেক ভালো লাগছে। এখন কোথায় আছি আমরা?

শ্রীপুর স্টেশন পার হলো মাত্র।

ঢাকা শহরটার জন্য অদ্ভুত মায়া জাগল। মাকে কল করতে ইচ্ছা করে। মা এখন কী করছে? নিশ্চয় আমার কথা ভাবছে। দাদুভাইয়ের কাছ থেকে ফোন নিয়ে কল করল রূপম।

মা, অনেক দূরে চলে যাচ্ছি। যেন একটা মেঘের ট্রেন আমাকে ভাসিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দূরে, অনেক দূরে।

ফোনের ও পাশে মা চুপচাপ শুনতে থাকে রূপমের কথা। কতটা দিন পর রূপম নিজের বাসা ছেড়ে, চেনা শহর ছেড়ে অন্য শহরে যাচ্ছে।

মা জিজ্ঞেস করে, বাবা খেয়েছ? তোমার ভালো লাগছে? ট্রেনের জানালা দিয়ে দূরে শুধু তাকিয়ে থেকো না, উদাস হয়ে যাও। প্রকৃতি দেখো। আকাশ দেখো। গাছপালা দেখো। আর দাদুর সঙ্গে গল্প করো।

আমার গল্প করতে ভালো লাগছে না। গল্প হয়ে যেতে ইচ্ছা করছে। ডালিমকুমারের মতো গল্প। ঠাকুরমার ঝুলির গল্প। টগবগ করে ঘোড়া দৌড়ানোর গল্প।

মা হাসে। বলে, ফোন রেখে দাও বাবা। পরে কথা হবে।

দাদুভাইয়ের হাতে ফোনটা দিয়ে রূপম বাইরে তাকায়।

রূপমের মনে হলো, ও আজ হঠাৎ মুক্ত। কাঁধে ঝোলানো স্কুলব্যাগ থেকে মুক্ত। একগাদা রচনা লেখা থেকে মুক্ত। পড়ো পড়ো, লেখো লেখো, টিফিন খাও—এমন সব আদেশ থেকে মুক্ত। টিভি দেখো না, কার্টুন দেখো না—এসব থেকেও মুক্ত। রূপম আজ একা। নিজেকে বড় ভাবতে ভালো লাগছে। এমনই ভাবনার ঘোরে আটকে পড়ে রূপমের সেই দিনের কথা খুব মনে পড়ল, যেদিন স্কুল ছিল বন্ধ।

সকালের পড়া শেষে টেবিল ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। দশতলার ছোট্ট ফ্ল্যাটটির বারান্দায় দাঁড়িয়ে রূপম আকাশ দেখে, ঢাকা শহর দেখে, মানুষ দেখে। দেখতে দেখতে ভাবে, শুধু আকাশটাই বড়, আর সবকিছু ছোট ছোট।

আকাশ দেখার জন্য আরও গভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। বড় বড় বিল্ডিং, অ্যাপার্টমেন্ট আর রঙিন বিলবোর্ডের জন্য এই শহরের আকাশটাও ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছে না। সত্যি, ঢাকা শহরটা কেমন যেন। মুক্ত নীল আকাশকে ঠিকমতো দেখাও যায় না। ওর খুব রাগ হয়। চলে আসে নিজের রুমে। চোখ পড়ে ব্যাট-বলের দিকে। হাতে তুলে নেবে, এ সময় বুয়ার গলা, ‘খাইছে রে, আবারও না জানি জানালার কাচ ভাইঙ্গা ফালায়।’

রূপম বুয়ার কথাটি শুনেও না শোনার ভান করে চলে আসে বারান্দায়। রেলিং-ঘেরা বারান্দা। ফ্ল্যাটের শিশুদের জন্য এই তো খেলার মাঠ। মোজাইক করা ঝকঝকে মেঝেটাকে মনে হয় যেন সবুজ ঘাস।

বুয়াকে শুনিয়ে শুনিয়ে রূপম বলে ওঠে, ‘বুয়া, আমি স্টেডিয়ামে খেলা করছি।’

এই ছোট্ট বারান্দা রূপমের কাছে বিশাল স্টেডিয়াম। পশ্চিম কোনার পাশের দেয়ালটাকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে টেনিস বলের ওপর ধুমধাম ব্যাট চালাতে লাগল। বলটি টপাস করে একবার দেয়ালে যায়, আবার টপাস করে ফিরে আসে রূপমের ব্যাটে। এভাবে চলতে চলতে হঠাৎ গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে পড়ে ওর সবুজ রঙের টেনিস বল।

হায় হায়, এখন! রূপম লিফটের অপেক্ষা না করেই সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতে থাকে।

দৌড়ে গেট পেরিয়ে অ্যাপার্টমেন্টের বাঁ পাশ দিয়ে বল পড়ে যাওয়ার জায়গাটির দিকে এগিয়ে যায়। দেখল, ময়লা জামা পরা একটা টোকাই খালি পায়ে ওর বলটা নিয়ে দৌড়াচ্ছে।

রূপম ডাকতে থাকে, ‘এই ছেলে, এই ছেলে।’

কিন্তু রাস্তায় গাড়ির হর্ন আর মানুষের কোলাহলে সে ডাক টোকাইয়ের কানে পৌঁছায় না। রূপম ওর পিছু পিছু দৌড়াতে থাকে।

অনেক আঁকাবাঁকা প্রশস্ত পথ, রিকশা, মোটরসাইকেল, বাস, মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার, সিএনজি গাড়ি, গর্ত খোঁড়া রাস্তা ডিঙিয়ে পাগলের মতো দৌড়াতে থাকে। হঠাৎ রূপমের গেঞ্জিতে পেছন থেকে একটা টান পড়তেই সে দাঁড়িয়ে গেল। মুখ ঘুরিয়ে দেখল, একজন মহিলা।

দূরে দেখল একটা বিশাল ঘিয়ে রঙের বিল্ডিং। লেখা—হোটেল শেরাটন। রাস্তার মাঝখানে একটা বড় টুপির মতো সাদা ছাতা ছড়ানো। ছাতার নিচে ট্রাফিক পুলিশ হাতের ইশারায় থামিয়ে দিল রাস্তার গাড়িগুলোকে। মানুষভর্তি একটি দোতলা ভলভো বাস রূপমের সামনে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল।

এই সময় মহিলাটি বলল, ‘তুমি রাস্তা পার হবে? এসো।’

রূপম গোলাপি রঙের শাড়ি পরা মহিলাটির হাত ধরে রাস্তা পার হয়। রাস্তা পার হয়ে রূপম অচেনা ওই মহিলার দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল, থ্যাঙ্ক ইউ।

জবাবে মহিলাটি হাসল। এভাবে রাস্তায় কখনো দৌড়াবে না, অ্যাকসিডেন্ট হবে।

মহিলাটি ফুটপাতে হাঁটতে থাকা অনেক মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যায়।

রূপম রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে একা। কই! বল নিয়ে পালানো সেই ছেলেটা কই? সে-ও হারিয়ে গেছে। তার সবুজ রঙের বলটাও।

রূপম কী করবে বুঝতে পারছে না। এদিক-ওদিকে তাকাল। কত মানুষ। কত গাড়ি। দু-একটা চায়ের দোকানও নজরে পড়ল। সেখানেও ভিড়। হঠাৎ তাকিয়ে দেখে আকাশে কালো মেঘ জমেছে। বৃষ্টি হবে নাকি? কিছুটা ভয় পেল সে। ভাবল, এরই মধ্যে বুয়া নিশ্চয়ই তাকে খুঁজছে। নিশ্চয় মা-বাবাকে ফোনে জানিয়ে দিয়েছে।

মা-বাবা তাকে খুঁজছে। না, দেরি করা যাবে না, বাসায় ফিরতে হবে। কিন্তু এভাবে কখনো সে একা পথ চলেনি। এমনকি স্কুলেও যায়নি। স্কুলভ্যান এসে তাকে নিয়ে যায়। তাহলে আজ বাসায় ফিরবে কীভাবে? বুদ্ধি করে রূপম একটা খালি রিকশা ডাকে। বাসার রাস্তাটা তার চেনা আছে। বেইলি রোডের শৈলী অ্যাপার্টমেন্ট। রিকশায় উঠে বসে রূপম।

ততক্ষণে ঝুমবৃষ্টি নামে। রিকশাওয়ালা রূপমের হাতে পর্দা দেয়। রূপম পর্দা দিয়ে নিজেকে ঢেকেঢুকে বসে থাকে রিকশায়। রিকশা ওকে নিয়ে যায় বেইলি রোডের বাসায়।

দারুণ এক অনুভূতি হয়েছিল সেদিন। মুহূর্তের জন্য যেন একাকী হয়ে যাওয়া। মাকে না বলে বাসা থেকে বের হওয়াটা ভালো নয়। রূপম জানে এটা। তারপরও একটা টেনিস বলের জন্য ছুটতে ছুটতে সেদিন রূপম যেন সাহসী বালকের রূপ ধরেছিল। কী করবে! মনটা তার মানে না। সব সময় বাইরে যাওয়ার জন্য, খোলা মাঠে দৌড়ানোর জন্য মনটা ছটফট করে উঠত।

এই যে একটু আগে ওর মনে হলো ও এখন মুক্ত, ঠিক এ রকমই মুক্তমনে আকাশ দেখার জন্য রূপমের মনটা কী যে ছটফট করত! পাহাড় থেকে ঝরনাধারা দেখতে ইচ্ছা করত। টিয়ের ঝুঁটি হাতানোর জন্য ইচ্ছা করত। মেঘে মেঘে ঘর্ষণে যে বজ্র হয়, সেটা দেখতে ইচ্ছা করত। দাদুভাইয়ের কাছ থেকে গল্পে শোনা ওই অন্ধ লোকটা, যে কিনা বেহালা বাজাতে বাজাতে হেঁটে বেড়াত, সেই অন্ধ লোকটার সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছা করত।

সব ইচ্ছা রূপম মনের মধ্যে পুষে রাখত। আর কে যেন এসে পিষে ফেলত। কে পিষে ফেলত? স্কুল? হোমওয়ার্ক? কোচিং ক্লাস? একগাদা বই? জিপিএ–ফাইভ? উত্তর জানা নেই। কিন্তু স্কুল ওর ভালো লাগে সত্যি। বন্ধুদের ভালো লাগে। বাংলা ক্লাসে ছন্দ দিয়ে মালতী মিস যখন বলতেন—পাখি সব করে রব, রাতি পোহাইল। শুনতে রূপমের ভীষণ ভালো লাগত। ভালো লাগত অঙ্ক ক্লাস। ড্রয়িং ক্লাস। এত কিছু ভালো লাগার পরও মনটা মাঝেমধ্যে কেমন জানি করত। মনে হতো ও যেন ডুবে যাচ্ছে। আবার ভেসে উঠছে। দাদুভাইয়ের সঙ্গে ট্রেনে চড়ে আজ সব খারাপ লাগাকে পিষে ফেলে রূপম এখন মুগ্ধতার আবেশে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছে। একেই বলে সুখের আবেশ।

ট্রেন মানেই কি হাজার ভাবনার দোল খাওয়ার বাহন? ট্রেন মানে কি যা খুশি তাই ভাবার বাহন? ট্রেন মানে কি কল্পনার পাখায় ভর করে এদিক-সেদিক ছোটার বাহন? রূপমের আজ তা–ই মনে হচ্ছে

ট্রেন চলছে। আজ বাড়ি ছেড়েছে রূপম। আজ ট্রেনে বসেছে সে।

ট্রেন মানেই কি হাজার ভাবনার দোল খাওয়ার বাহন? ট্রেন মানে কি যা খুশি তাই ভাবার বাহন? ট্রেন মানে কি কল্পনার পাখায় ভর করে এদিক-সেদিক ছোটার বাহন? রূপমের আজ তা-ই মনে হচ্ছে। হাজারো ভাবনা এসে ভিড় করেছে ওর মাথায়। এলোমেলো সব ভাবনা। কখনো বাস্তবের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। কখনো কল্পনার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। কল্পনায় ভাবনাগুলোর কথা দাদুভাই যদি টের পেত তাহলে নিশ্চয়ই বলত, কী সব আকাশকুসুম ভাবছ রূপম।

কিন্তু রূপমের এসব ভাবনার কথা এখন কেউ জানে না। মানুষ তো একা একাই ভাবে। একা একাই কল্পনা করে। জ্বর হলে থার্মোমিটার দিয়ে মাপা যায়। কিন্তু ভাবনাগুলো মাপার কোনো যন্ত্র নেই। রূপমের হাসি পায়। দুনিয়ায় এত সব যন্ত্র আবিষ্কার হচ্ছে, কিন্তু ভাবনা মাপার যন্ত্র আবিষ্কার হচ্ছে না কেন? না হোক তা-ই ভালো। আমার মাথায় কী খেলা করছে অন্যেরা কেন জানবে? কারণ, ভাবনাগুলো একান্ত নিজের। এই যে ট্রেনে এত যাত্রী কেউ কথা বলছে, কেউ পেপার পড়ছে, কেউ হাঁটাচলা করছে, কেউ খাচ্ছে, কেউ ঝিমোচ্ছে, কেউবা জানালা দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে উদাস হয়ে ভাবছে। ঠিক রূপমের মতো।

দাদুভাইকে একনজর দেখে নেয় রূপম। কিছুক্ষণ আগে পেপার পড়ছিলেন দাদুভাই। কখন যে ঘুমিয়ে পড়লেন! ডাকতে ইচ্ছা করল। মন বলল, না থাক। যদি ঘুমিয়ে থাকে ঘুমাক। গত রাতে দাদুভাইয়ের ঘুম হয়নি। সকাল সকাল ট্রেন ধরতে হবে। এই চিন্তায় আর কি ঘুম হয়? ঘুম রূপমেরও হয়নি। ওর ভেতরেও অজানা আনন্দ এসে ভিড় করেছিল গত রাত থেকে। ট্রেনে চড়বে। বেড়াতে যাবে। একি কম আনন্দ? ট্রেনে বসে ওর মনে হলো শুধু দুশ্চিন্তা থাকলেই রাতে ঘুম হয় না, ব্যাপারটা তা নয়। আনন্দে থাকলেও ঘুম হয় না। গত রাতে রূপমের যে কম ঘুম হয়েছে, এ জন্য একটুও ক্লান্তি নেই; বরং ট্রেনে বসে বেশ ফুরফুরে লাগছে। আজ ওর মন ভালো হয়ে গেছে। কত কী দেখছে। কত কী ভাবছে। এ ভাবনার কোনো শেষ নেই। ভাবনাগুলো কখনো কখনো গল্প হয়ে মাথায় ভর করছে। কখনো কবিতা হয়ে মাথায় ভর করছে। কখনো ছবি হয়ে ভর করছে। কখনো রূপকথার আজগুবি গল্পকথার মতো অনেক কথা এসে ভর করছে। রূপম আপনমনে এসব ভাবনার সঙ্গে একা একাই গল্প করছে। ট্রেন ছুটছে।

ট্রেনের জানালায় বসে রূপমের আজ বাতাসের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে। পাখিদের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে। পাখি শব্দটা অদ্ভুত লাগে। পাখি মানেই ছোট্ট একটা কিছু। পালক আছে। কিচিরমিচির করে। আকাশে ওড়ে। এ ডালে বসে, ও ডালে বসে। ঢাকায় ঠিকমতো পাখি দেখা যায় না। ঢাকার পাখি ঢেকে আছে ইট-দালানের আড়ালে।

স্কুলে যেতে যেতে রূপমের কোনো কোনো দিন মনে হতো পাখি হবে। উড়াল দেবে দূর আকাশে। আকাশ থেকে আবার নেমে আসবে শহরে। শহরটার নাম দিয়ে দিত পাখিদের শহর। এ রকম ভাবতে ভাবতে রূপম একদিন কল্পনায় চলে গিয়েছিল পাখিদের শহরে। তারপর কে যেন সেই শহরের গল্প শোনাল রূপমকে।

আচ্ছা, তোমার শহরের নাম কী? ঢাকা? চট্টগ্রাম? সিলেট? নাকি ময়মনসিংহ? যাক, কোথাও তো হবে। রাজশাহীও হতে পারে। হতে পারে খুলনা-রংপুরও। কিংবা দেশের চৌষট্টি জেলার যেকোনো একটি শহর তোমার হতেই পারে।

আবার এমনও হতে পারে, তুমি জেলা শহরেই থাকো না। থাকো হয়তো কোনো এক গ্রামে। শান্ত-শীতল কোনো এক গ্রাম। কিংবা উপজেলা, সেখানেও থাকতে পারো।

তবে তুমি যেখানেই থাকো না কেন, আমি যে শহরের কথা বলছি, সে শহর তুমি আগে দেখোনি। এ এক অদ্ভুত শহর, পাখিদের শহর। এখানে সবাই পাখি! মানুষও পাখি হয়ে ওড়ে। আমাকে এই শহর চিনিয়ে দিয়েছিল এক হরবোলা। জানো তো, হরবোলা বিভিন্ন পশুপাখির ডাক নকল করতে পারে।

স্কুলে যেতে যেতে রূপমের কোনো কোনো দিন মনে হতো পাখি হবে। উড়াল দেবে দূর আকাশে। আকাশ থেকে আবার নেমে আসবে শহরে। শহরটার নাম দিয়ে দিত পাখিদের শহর

একদিন বাবা টিয়ে পাখি কিনে আনলেন। খাঁচায় ভরা টিয়ে পাখি। টিয়ে পাখিকে আমি আমার নাম ধরে ডাকতে শেখালাম।

বাব্বা। কী মিষ্টি গলা! কী স্পষ্ট তার স্বর। টিয়ের ডাক শুনে আমি রোজ ঘুম থেকে উঠি। একদিন ঘুম ভাঙার পর মনে হলো, টিয়েটা আমায় ডাকেনি। তাহলে টিয়েটারই কি ঘুম ভাঙেনি আজ?

বিছানা ছেড়ে গেলাম বারান্দায়। যেতে যেতে ভাবছি, আজ আমি ডাকব, টিয়ে ওঠো, টিয়ে ওঠো।

বেডরুম ছেড়ে ড্রয়িংরুম পেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম, দেখি শূন্য খাঁচা। বুকটা ধড়াস করে উঠল। ‘মা’ বলে একটা চিত্কার দিলাম।

রান্নাঘরে মা তখন সকালের নাশতা বানাতে ব্যস্ত। আমার চিত্কার শুনে বেরিয়ে আসেন বারান্দায়। ছলছল করে ওঠে চোখ দুটো। বললাম, কে আমাকে মিষ্টি স্বরে এখন জাগাবে মা?

মা বললেন, বড় হয়েছ। একা একা নিজের মতো করে ঘুম থেকে উঠতে শেখো। বলতে বলতে আড়ালে চোখ মুছলেন শাড়ির আঁচল দিয়ে।

কিন্তু টিয়েটা তো আমাকে একটা অভ্যাসে আটকে ফেলেছিল। ওর ডাক না শুনে আমি ঘুম থেকে উঠতেই পারি না। মাকে এই অনুভূতির কথাটাই জানালাম। আমি জানি, টিয়েটা খাঁচা ছেড়ে পালানোর কারণে মায়ের মনটাও বিষণ্ন হয়ে পড়েছে। আবেগের জলে তিনিও কান্না ঝরিয়েছেন। মা কেঁদেছেন। কিন্তু আমি কাঁদিনি।

সেই মুহূর্তে আমার মনে হলো, এবার টিয়ের খোঁজে হাঁটা যাক।

হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দেখা হলো এক হরবোলার সঙ্গে। তাকে সব বললাম। হরবোলা বলল, চলো পাখিদের শহরে যাই। সেখানে গেলে তোমার টিয়েকে পেলে পেতেও পারো।

কোনো দ্বিমত না করে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম। হরবোলার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দেখি, একটা কাক ট্রাফিক হয়ে গাড়ি সামলাচ্ছে। অবাক কাণ্ড! গাড়ি চালাচ্ছে সারস, ময়না, টুনটুনি। সাইকেল চালাচ্ছে চড়ুই। দালানকোঠার ভিড়ে সবুজ গাছের সমারোহ। গাছে গাছে ঝুলছে বাবুই পাখির বাসা। কিন্তু সুন্দর শহর!

শহরের দুই ধারে পাহাড়। চূড়া বেয়ে রোদের আলো ছড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ের গায়ে। সেই আলোর সবুজ আভা শহরটাকে সবুজ করে তুলছে। দেখে মনে হলো, এমন একটি সবুজ শহরের জন্য ছোট-বড় সবার প্রত্যাশা। প্রাণভরে নিশ্বাস নিলাম।

শহরের রূপ দেখে আমি তো রীতিমতো অবাক! হরবোলার কাছে জানতে চাইলাম শহরের সৌন্দর্যভরা রূপের কথা।

হরবোলা বলল, পাখির আবাসভূমি হচ্ছে বনভূমি। বন যদি উজাড় করে ফেলো, তাহলে ওদের বাঁচাতে হলে শহর ছাড়া কী আছে বলো? শহরে থাকার জন্য নিজেদের উপযোগী করে তুলছে পাখিরা। এমন সময় হরবোলা আমার পিঠে খোঁচা দিয়ে বলল, দেখো দেখো। ওপরে দেখো। দেখলাম, দু-তিনজন মানুষ পাখির মতো উড়ছে। পিঠে লাগিয়ে নিয়েছে নকল ডানা। বাতাসের বুক চিরে চিরে মানুষগুলো নির্বিঘ্নে উড়ছে।

আমার কৌতূহলী জিজ্ঞাসা আবারও হরবোলার কাছে। উত্তরে সে বলল, উড়বে না কেন, আজকাল শহরে যে হারে ট্রাফিক জ্যাম-যানজট শুরু হয়েছে, তাতে মানুষের ওড়া ছাড়া উপায় নেই। এক জায়গায় আটকে থেকে জ্যামে বসে থাকার চেয়ে ওড়ার পদ্ধতি ফলপ্রসূ হবে। তাই প্র্যাকটিস চলছে। যানজট থেকে বাঁচতে, নির্বিঘ্নে চলাচল করতে মানুষ ওড়া শিখছে।

হরবোলার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে শুনলাম কোকিলের গান। দেখলাম মাছরাঙার সাঁতার। বুকের ভেতরে কবিতার ছন্দ দোল খেতে লাগল—

‘এইমাত্র দেখতে পেলাম ডুবডুবি আর ভুবনচিল

ডাহুক, ময়ূর, পানকৌড়ি—ওরাও এল কী যে মিল।

তিলাই ঘুঘু, টিয়া, তোতা, চড়ুই, বাবুই, ময়না

দোয়েল, কোকিল, হুতুমপ্যাঁচা গলায় রুপার গয়না।’

আমার কবিতা শুনে হরবোলা বলল, তোমাকে পাখি দেখাতেই পাখিদের শহরে নিয়ে এসেছি। এসব পাখি বাংলাদেশের। ওই যে দেখো—লালমুনিয়া, নীলকণ্ঠ, কালাকুকা, পাঙ্গা, সোনালি পিঠ কাঠঠোকরা, ভাতশালিকে রাঙা।

আমার হৃদয়টা কেমন জানি নেচে উঠল। সত্যি এই শহরে না এলে এত পাখি দেখতে পেতাম না। পাখিদের সৌন্দর্য মন ভরে দেখতে লাগলাম।

‘ওই যে দেখি জলমুরগি, হাট্টিটি আর কত্ত পাখি
ধনেশ নাচে লেজ দুলিয়ে বউ কথা কও ডাকাডাকি।
হাঁস-কবুতর, পাতা বুলবুল আর যে আছে বুলবুলি
মদনটেক আর খোঁড়ল প্যাঁচা, টুনটুনিদের কেমনে ভুলি।’
হরবোলাও আমার সঙ্গে সঙ্গে কবিতার সুরে বলল,
‘রংবাহারি পালক পাখির তাকিয়ে শুধু থাকি
চিনে রাখো এরা আমার বাংলাদেশের পাখি।’

পাখিদের শহরে এত এত পাখি দেখতে দেখতে হঠাৎ আমার টিয়েটার জন্য মনটা হু হু করে উঠল। হরবোলাকে বললাম, কই, আমার টিয়েটাকে তো দেখছি না।

হরবোলা বলল, টিয়ে পাখি খুঁজতে এসে আজ তুমি কত কত পাখি দেখলে। নিশ্চয় ভালো লাগছে।

অবশ্যই ভালো লাগছে। কিন্তু যে পাখিকে দরদ দিয়ে আমার নাম শেখালাম, আমাকে ঘুম থেকে জাগানোর কৌশল শেখালাম, তাকে না দেখতে পেরে এখন আমার আর ভালো লাগছে না। আমার টিয়ে পাখিকে এনে দাও।

এমন সময় হট্টগোল শুনে পেছন ঘুরে তাকালাম। দেখি, এক পাখিশিকারিকে ঠোকরাচ্ছে একদল বাজপাখি। আমরা দূর থেকে দেখতে থাকলাম এই কাণ্ড।

হরবোলা বলল, এই শহরে কোনো পাখিশিকারি ঢুকতে পারে না।

দূর থেকে দেখলাম, বাজপাখিদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে সেই পাখিশিকারি শহর ছেড়ে দৌড়াতে দৌড়াতে দৌড়াতে পালিয়ে যায় শহরের পাশে পাহাড়ের কাছে এক জঙ্গলে।

এমন সময় শুনতে পেলাম আমার টিয়ে পাখি আমায় ডাকছে, ওঠো ওঠো, ঘুম থেকে ওঠো।

কে শোনাল এ গল্প? কোথা থেকে ভেসে এল এ গল্প? এ গল্প কি আমি আগে কারও কাছ থেকে শুনেছি? নাকি নিজে নিজে বানালাম। নাকি খোকন ভাই গল্পটা বলেছিল। মনে মনে রূপম তাহলে কার সঙ্গে কথা বলল, খোকন ভাই?

ট্রেনে বসে খোকন ভাইয়ের কথা খুব মনে পড়ছে। খোকন ভাই ওদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকে। প্রায়ই গল্প শোনায়। পাখিদের গল্প। ভূতের গল্প। মুক্তিযুদ্ধের গল্প। বিজয়ের গল্প। খোকন ভাই মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। কিন্তু বই পড়ে পড়ে অনেক কিছু জানে। এ জন্য খোকন ভাইকে রূপমের খুব ভালো লাগে। একবার রূপমের সঙ্গে অমলের গল্প বলেছিল।

জানিস, এই শহরে তোরা অমল হয়ে গেছিস।

রূপম জিজ্ঞেস করে, অমল কে?

অমল হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর নাটকের একটি চরিত্র। সারা দিন জানালার পাশে বসে থাকে। বাইরে বেরোনোর জন্য অনেক আকুতি তার। কিন্তু বের হতে পারে না। জানালায় বসে দইওয়ালার সঙ্গে গল্প জমায়। কল্পনায় ভাসতে ভাসতে অমল দেখে পাঁচমুড়া পাহাড় ঘেঁষে যাওয়া শ্যামলা নদীর ধারে দইওয়ালার গ্রাম। যেখানে গরু চরে, মেয়েরা নদী থেকে জল তুলে মাথায় কলসি করে নিয়ে যায়—তাদের লাল শাড়ি পরা। অমলের কথা শুনে দইওয়ালা খুব খুশি হয়। মনের কথা খুলে বলে দইওয়ালাকে। বলে কিনা, আমি পণ্ডিত হব না। আমি তোমাদের রাঙা রাস্তার ধারে তোমাদের বুড়ো বটের তলায় গোয়ালপাড়া থেকে দই নিয়ে এসে দূরে দূরে গ্রামে গ্রামে বেচে বেচে বেড়াব। কী রকম করে তুমি বলো, দই, দই, দই—ভালো দই। আমাকে সুরটা শিখিয়ে দাও। দইওয়ালা বলেছিল, এ সুরও কি শেখানোর সুর! জবাবে অমল বলেছিল, আমার শুনতে ভালো লাগে। আকাশের খুব শেষ থেকে পাখির ডাক শুনলে যেমন মন উদাস হয়ে যায়, তেমনি ওই রাস্তার মোড় থেকে ওই গাছের সারির মধ্য দিয়ে যখন তোমার ডাক আসছিল, আমার মনে হচ্ছিল—কী জানি কী মনে হচ্ছিল!

অমলের গল্প বলতে বলতে খোকন ভাই এমনভাবে খোঁচা দিত রূপমকে, মনে হতো সত্যি তো! রূপমও যেন একজন অমল। যে মাঠে বের হয় না। পাখি চেনে না। নদীর ঢেউ দেখেনি। অমলের মতোই যেন বন্দিজীবন। তাই তো খোকন ভাই দেখা হলেই বলে, এই শহরের সব অমলকে নিয়ে মুক্তির পাঠশালা বানাব। তোমরা তো চেনো গ্রিল-বারান্দা, ফাস্ট ফুডের দোকান, শপিং মল। তোমরা ঘুড়ি ওড়াও না। পুকুরে সাঁতার কাটো না। গাছে উঠে আম পাড়ো না। প্রজাপতি চেনো না। তোমাদের জন্য কষ্ট হয়। তোমরা চিঠি লিখতে জানো না। অমল রাজার কাছ থেকে চিঠি পাওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকত। তোমরা তো তা-ও করো না। সারাক্ষণ ফেসবুক, মোবাইল নিয়ে ডুবে থাকো। যত খেলা মোবাইল ফোনে।

রূপম বলেছিল, তাহলে কী করব? কীই–বা করার আছে?

খোকন ভাই জবাব দেয়, এ জন্যই তো বলি, এই শহরের সব অমলকে মুক্ত করে মুক্তির পাঠশালা বানাব। তোরা গান করবি। নাচ করবি। ছবি আঁকবি। পাখি হবি।

আজ খোকন ভাইকে বলতে ইচ্ছা করছে, অমলের ছুটি হয়েছে। রূপম নামের ছেলেটা অমলকে বের করে এনেছে। আজ অমল ও রূপম খেলবে। জুটি বেঁধে খেলবে। খোলা পথের ডাক শুনে হয়তো অমল স্বর্গে গিয়েছিল। আর আমি খোলা পথের ডাক শুনে ট্রেনে চড়েছি, খোকন ভাই।

খোকন ভাই! কে সে?

হঠাৎ দাদুভাইয়ের কথাটা শুনে রূপম একটু লজ্জা পেল। তাহলে ও কি বিড়বিড় করে খোকন ভাইকে ডাকছিল?

কী রূপম? খোকন কে?

আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। জানো দাদুভাই, খোকন ভাই অনেক বই পড়ে। আমারও অনেক বই পড়তে ইচ্ছা করে।

পড়তে ইচ্ছা করছে পড়বে।

অত বই পড়ার সময় কই? ক্লাসের বই পড়া শেষ হয় না।

সময় বের করে নিতে হয়। সারাক্ষণ ক্লাসের বই না পড়ে গল্পের বই পড়বে, কবিতা পড়বে। ছবি আঁকবে। তাহলে দেখবে মাথাটা খুলবে। বুদ্ধি হবে।

আমি অনেক বুদ্ধিমান হতে চাই দাদুভাই।

বুদ্ধিমান হতে হলে জগৎ চিনতে হয়।

রূপম আজ জগৎ চেনার জন্য মুক্তমনে খোলা হাওয়ায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে। ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখছে কী অদ্ভুত সব সুন্দর দৃশ্য। চোখ জুড়িয়ে যায়। ট্রেনে না বসলে এ আনন্দ কখনোই পেত না রূপম। মায়ের কথামতো উদাস হয়ে রূপম সবকিছু উপভোগ করতে লাগল। ট্রেন চলছে। ভাবনাগুলো দোল খাচ্ছে। হঠাৎ কবি শামসুর রাহমানের কবিতার কথা মনে পড়ল। স্কুলের বইয়ে আছে কবিতাটি। ট্রেনের কবিতা। জানালা দিয়ে তাকিয়ে থেকে রূপম আপনমনে কবিতাটি আবৃত্তি করতে লাগল—

ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে
রাত দুপুরে অই।
ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে
ট্রেনের বাড়ি কই?
একটু জিরোয়, ফের ছুটে যায়
মাঠ পেরুলেই বন।
পুলের ওপর বাজনা বাজে
ঝন ঝনা ঝন ঝন।
দেশ-বিদেশে বেড়ায় ঘুরে
নেইকো ঘোরার শেষ।
ইচ্ছে হলেই বাজায় বাঁশি,
দিন কেটে যায় বেশ।
থামবে হঠাৎ মজার গাড়ি
একটু কেশে খক।
আমায় নিয়ে ছুটবে আবার
ঝক ঝকা ঝক ঝক।

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

খুব জানতে ইচ্ছা করে, ট্রেনের বাড়ি কই? স্টেশনগুলো কি ট্রেনের বাড়ি? ট্রেন ছুটছে ছুটছে, আবার স্টেশনে এসে থামছে। একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। ট্রেনের সত্যিকারের রূপ যেন ধরা পড়ল রূপমের কাছে। কবি কি ট্রেনে বসে ট্রেনের কবিতা লিখেছিলেন? আজ হঠাৎ রূপমের কবি হয়ে যেতে ইচ্ছা করছে। কবিতা লিখতে ইচ্ছা করছে। গল্প বানাতে ইচ্ছা করছে। খাতা-কলম যদি সঙ্গে থাকত তাহলে একটা গল্প লিখতে পারত। কিন্তু লেখা হচ্ছে না, ভাবনাটা এগোচ্ছে। রূপমের মনের ভেতরে এক গল্প এসে ভর করে। মালা গাঁথার মতো একটু একটু করে ভাবনাগুলো দিয়ে গল্প বানাতে লাগল। ইলিশের গল্প। গল্পের শেষটা এখনো খুঁজে পায়নি। কিন্তু গল্প এগোচ্ছে। রূপম ভাবছে।

একদিন এক ইলিশের কাছে খবর এল, ঢাকার এক বিড়ালের গলায় মাছের কাঁটা বিঁধেছে। শুনে ইলিশের মনটা খারাপ হয়ে গেল। না জানি বিড়ালটার কত কষ্ট হচ্ছে। ওকে হাসপাতালে নিতে হবে। চিকিত্সা করাতে হবে।

ইলিশ ওর মাকে বলল, ঢাকার এক বিড়ালের গলায় কাঁটা বিঁধেছে। আমি ঢাকা গিয়ে বিড়ালটাকে খুঁজে বের করব। তারপর হাসপাতালে নিয়ে যাব, চিকিত্সা করাব।

কী বলছ তুমি? মা খুব রেগে গেল। কোনো মানুষ যদি তোমাকে দেখে ফেলে, আস্ত আর রাখবে না। ভাজি করে খেয়ে নেবে। অথবা কচু দিয়ে ঝোল রান্না করে খাবে। তুমি জানো না, ইলিশ মাছ ওদের কত প্রিয়?

জানি।

তারপরও যেতে চাইছ।

হ্যাঁ, কারণ, বিড়ালের গলায় মাছের কাঁটা বিঁধেছে। মাছ হয়ে মাছের কাঁটা কীভাবে বের করতে হয়, আমি জানি।

মা বলল, বেশ। যাও। তবে অন্যের খাবার হয়ো না, সাবধান।

মায়ের অনুমতি পেয়ে ইলিশ বেরিয়ে পড়ল ঢাকার উদ্দেশে, বিড়ালকে সাহায্য করতে।

হঠাৎ এক চানাচুরওয়ালার ‘অই চানাচুর’ ডাক শুনে রূপমের গল্পভাবনার সুতা ছিঁড়ে যায়। আচ্ছা, ইলিশ মাছের সঙ্গে ওই বিড়ালের কি দেখা হবে? ইলিশ মাছ কি ডাক্তার? ও কি অপারেশন করতে জানে? ইলিশের কি এক্স-রে মেশিন আছে? বিড়ালের যদি ডায়াবেটিস হয়ে থাকে, তাহলে তো অপারেশন করা যাবে না। বিড়ালের জন্য খুব মায়া হয়। দাদুভাইকে নিয়ে মায়ের সঙ্গে ক্লিনিকের ডাক্তারের কাছে যেতে যেতে অনেক রোগী দেখেছে। রোগীদের যে কী কষ্ট! বিড়ালটারও এমন কষ্ট হচ্ছে। হঠাৎ মনে হলো, রূপমের এ রকম একটা গল্প কেন মাথায় এল? ট্রেনে চড়লে কি এ রকম গল্প মাথায় চলে আসে?

রূপম কি তাহলে ট্রেনের জানালা দিয়ে শুধু দৃশ্যই দেখেনি, কল্পনার পাখায় ভর করে গল্পও বুনেছে! কিন্তু গল্পটা ওই চানাচুরওয়ালা শেষ করতে দিল না।

খুব ইচ্ছা করে চানাচুর খেতে। ততক্ষণে দাদুভাই ক্লান্তিমাখা চোখ নিয়ে পেপার পড়ছিলেন। কখন যে দাদুভাইয়ের ঘুম ভেঙেছে রূপম খেয়ালই করেনি।

দাদুভাই, চানাচুর খাব।

দাদুভাই চানাচুরওয়ালাকে বলল, একটা বানাও তো।

ছোট্ট একটি কৌটার মধ্যে চানাচুর ঢেলে তার ওপরে লেবুর রস চিপে দিল চানাচুরওয়ালা।

রূপম বলে, ঝাল দেবেন না।

ঝমঝমানো একটা ছন্দ তুলে চানাচুরওয়ালা কৌটাটা ঝাঁকাতে লাগল। কী অদ্ভুত ছন্দ। হঠাৎ রবীন্দ্রনাথের অমলের কথা মনে পড়ল। সেই যে খোকন ভাই একদিন বলেছিল, অমল বন্ধুত্ব করেছিল দইওয়ালার সঙ্গে। আজ চানাচুরওয়ালাকে বন্ধু বানাতে ইচ্ছা করছে। অমল মুক্ত হওয়ার ইচ্ছা নিয়ে দইওয়ালার সঙ্গে কত কথা বলেছে। কিন্তু এই চানাচুরওয়ালা কোনো কথাই বলছে না। মুখে হাসি নেই। চোখে স্বপ্ন নেই। ওর কি অনেক দুঃখ? অনেক কষ্ট? ইচ্ছা করছে চানাচুরওয়ালাকে বলতে, তুমি কি দইওয়ালাকে চেনো? ওই পাঁচমুড়া পাহাড়ঘেঁষা শ্যামলা নদী চেনো? তোমাদের গ্রামে কি গরু চরে? মেয়েরা নদী থেকে জল তুলে কলসি করে নিয়ে যায়। ওরা কি লাল শাড়ি পরে?

কিন্তু পারে না। রূপমের হাতে চানাচুর দিয়ে টাকার জন্য দাদুভাইকে তাড়া দিল। দ্যান, টাকা দ্যান। সময় নাই। তাড়াতাড়ি।

চানাচুরওয়ালার এত তাড়া কেন? দইওয়ালার তো তাড়া ছিল না। ও তো অমলকে বিনে পয়সায় দই খাইয়েছে। কিন্তু চানাচুরওয়ালা বিনে পয়সায় দিল না। পয়সা না নিয়েও অমলকে বলেছিল, তার কোনো লোকসান হয়নি। বরং অমলের কাছে দই বেচতে পেরে অনেক সুখ পেয়েছে। কিন্তু চানাচুরওয়ালা? আজব! আমার কাছে চানাচুর বিক্রি করে সুখ পায়নি সে? একবার জিজ্ঞেসও করল না তোমার নাম কী? ওর কি কোনো বন্ধু নেই? দইওয়ালার তো বন্ধু ছিল অমল। আমি রূপম, আমিও তো ওর বন্ধু হতে পারতাম। আমিও তো ওর কাছ থেকে অনেক কিছু জানতে পারতাম। ভালো বন্ধুর কাছ থেকেই তো অনেক কিছু জানা যায়। আজ যদি চানাচুরওয়ালা বন্ধু হতো, তাহলে ওর কাছ থেকে কত কী জানা যেত। ওর বাড়ির কথা। ছেলেমেয়ের কথা। ট্রেনের কথা। মানুষের কথা। কত কী।

দাদুভাই ১০ টাকার নোট চানাচুরওয়ালার হাতে দেওয়ামাত্রই লোকটা চলে গেল ‘চানাচুর চানাচুর’ বলতে বলতে।

চানাচুর খেতে ভালোই লাগছে।

ট্রেন ট্রেনের মতো ছুটতে থাকে। ভাবনা ভাবনার মতো বিক্ষিপ্ত। সুতাছেঁড়া ঘুড়ির মতো। এঁকেবেঁকে কোথায় যাচ্ছে বাতাসে বাতাসে।

১০

কোথা থেকে যেন একটা হলুদ পাখি উড়ে আসতে দেখছে। পাখিটা শিস বাজাল। ডানা ছড়িয়ে দিল। ওমা, পাখিটা ওর হাতে বসে পড়ল। চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে পাখি ওর হাতে এসে বসল! রূপম অবাক।

হাফপ্যান্ট পরা অনেক ছেলেমেয়ে লাল-নীল-সাদা ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। নদীতে আশ্চর্য একটা সাদা নৌকা, নীল পালতোলা। পালের ওপরে বসেছে একটা সবুজ টিয়ে। হলুদ পাখিটি উড়ে গিয়ে তাহলে কি সবুজ টিয়ে পাখি হয়ে গেল! ট্রেন চলছে। পাল্লা দিয়ে টিয়েটাও যেন ট্রেনের সঙ্গে সঙ্গে চলছে।

টিয়েটা ডেকে উঠল, ‘রূপম, তুমিও কি যাচ্ছ আমাদের সঙ্গে?’

টিয়েটা যেন জানালায় এসে বসল। আরও কয়েকটা পাখি। সঙ্গে নিয়ে এল।

হঠাৎ মনে হলো, এই ট্রেনে আর কেউ নেই। রূপম একা। রূপমের ভালো লাগছে।

ট্রেন চলছে। পাখিরা ট্রেনের ভেতরে ডানা ঝাপটাচ্ছে।

রূপম দাঁড়িয়ে গেল। এই ট্রেনে বসার মতো কোনো সিট নেই। বেঞ্চ নেই। চেয়ার নেই। বাংকার নেই। বাংকারে রাখা বাক্সপেটরা নেই। সবটা ফাঁকা। কিন্তু আশ্চর্য সুন্দর।

ওর নিজেকেও কেমন যেন পাখি পাখি মনে হচ্ছে। ও-ও যেন পাখির ভাষায় কথা বলতে শুরু করল। ওর মনে হলো, সেই টিয়ের মতো ওর কোনো রঙিন পালক নেই। টিয়েটাকে ও বলল, আমাকে তোমার একটা পালক দেবে! আশ্চর্য! টিয়েটা ওর কথা বুঝল। রূপমের সত্যি সত্যি মনে হলো, ও নিজে এখন একটা টিয়ে পাখি হয়ে গেছে।

হাজার টিয়েতে ট্রেনের ‘ঙ’ কামরা ভরে উঠল। রূপমের কাছে ট্রেনটাকে আর ট্রেন মনে হয় না। মনে হয় রূপকথার এক পাখিবাড়ি। নানান রঙের পাখিরা ডানা ঝাপটাচ্ছে।

সোনার কাঠি রুপার কাঠি, তোকে দিলাম নীল পাখি। পাখপাখালি আমরা সবাই সঙ্গী-সাথি। একটা দারুণ উল্লাসে রূপম ফেটে পড়ল। চেঁচিয়ে উঠল। বুকের ভেতরে কবিতার ছন্দ দোল খেতে লাগল।

‘রং ছড়ানো ডানা নিয়ে ডুবডুবি আর ভুবনচিল

ডাহুক, ময়ূর, পানকৌড়ি ওরাও এল কী যে মিল।

তিলাই ঘুঘু, টিয়া, তোতা, চড়ুই, বাবুই, ময়না

দোয়েল, কোকিল, হুতুমপ্যাঁচা গলায় রুপার গয়না।’

এমন সময় হাজার পাখির ভিড়ে সবুজ পালক দুই পাশে ছড়িয়ে দিয়ে ধপাস করে সামনে এসে দাঁড়াল টিয়েটা। বলল, এই তো আমি এখানে।

আশ্চর্য! টিয়েটা এমন কেন? রূপমের মনের কথা সব বুঝতে পারছে। কী করে সম্ভব?

লাল মরিচের মতো রাঙা ঠোঁট কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে টিয়েটা বলল, আমরা এক দারুণ স্টেশনে এসেছি। প্রতি এক শ বছরে শুধু একজন যাত্রী এই স্টেশনে আসতে পারে।

রূপম অস্ফুট কণ্ঠে বলল, তাই!

হ্যাঁ তাই। টিয়ে বলল, আমরা তো তোমারই অপেক্ষায় ছিলাম। স্কুলের ছুটি শেষে বই-খাতা, কলম-পেনসিল রেখে যে আমাদের পালকে আমাদের ছোট্ট ছোট্ট চোখে চোখ রেখে শহর পেরিয়ে বেরিয়ে পড়ে, সে-ই তো আমাদের বন্ধু।

আমরা আজ তোমাকে নিয়ে যাব অন্যখানে অন্য কোথাও। একটু পরই। আগে ট্রেন থেকে নামতে হবে। তাকাও তাকাও, জানালা দিয়ে তাকাও। এই তো এসে গেছি সেই স্টেশনে।

রূপম জানালা দিয়ে স্টেশনটা খুঁজতে থাকে। ওই স্টেশনে কী আছে?

টিয়েটা সঙ্গে সঙ্গে শিস বাজিয়ে বলে উঠল, হাজার রঙের প্রজাপতি আছে। এই স্টেশনের নাম প্রজাপতি।

এমন সময় কোথা থেকে যেন একটা প্রজাপতি উড়ে এসে রূপমের গালে বসে পড়ল। রূপম খুব মজা পেল। মুহূর্তের মধ্যেই একটা প্রজাপতি থেকে যেন অনেক প্রজাপতি হয়ে গেল। ওর চুলের ডগায় একটি-দুটি, অগণিত প্রজাপতি। উজ্জ্বল বর্ণের সব প্রজাপতি। চিত্রবিচিত্র নকশা আঁকা সব প্রজাপতি। রূপম বইয়ে পড়েছে, প্রজাপতিরা নিজেকে বাঁচাতে খুব তাড়াতাড়ি নতুন নতুন রং ধারণ করতে পারে। ওরা নাকি ছদ্মবেশও ধরে। তাহলে ছদ্মবেশে আজ কি এই প্রজাপতির দল রূপমকে ঘায়েল করতে এসেছে? রূপমকে ভোলাতে এসেছে? রূপম উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে।

আচ্ছা দাদুভাই, তুমি প্রজাপতি ধরেছ?

কত ধরেছি। একেকটি প্রজাপতি নানা রঙে রঙিন। প্রজাপতি হচ্ছে সৌন্দর্যের প্রতীক।

প্রজাপতি খায় কী? রূপম জানতে চায়।

প্রজাপতির খাবার হচ্ছে ফুলের মধু। দাদুভাই বলতে থাকেন, মানুষের শরীর থেকে যে ঘাম বের হয়, সে ঘামের লবণ খাওয়ার জন্যই মানুষের শরীরে এসে বসে। প্রজাপতি শুনতে পায় না, তবে ওরা কম্পন অনুভব করতে পারে। এরা সুরের সাহায্যে গন্ধ পায়। প্রজাপতি তার রঙিন ডানা দেখিয়ে অন্যের মন ভুলিয়ে দেয়।

বাব্বাহ্। প্রজাপতি নিশ্চয়ই তার ডানা দেখিয়ে কাজী নজরুল ইসলামকে ভুলিয়েছিলেন। এ জন্যই তো তিনি লিখেছেন—‘প্রজাপতি! প্রজাপতি! কোথায় পেলে ভাই এমন রঙিন পাখা?’

ট্রেনের জানালা দিয়ে আসা ফুরফুরে হাওয়ায় রূপম গুনগুন করে গান গেয়ে ওঠে। ‘প্রজাপতি! প্রজাপতি! কোথায় পেলে ভাই এমন রঙিন পাখা...’।

১১

আমাদের জীবনে কত গান আছে। কত গল্প আছে। আছে কল্পনা। মানুষের ইচ্ছেপূরণের হাজারো গল্প আছে। কত বিজয়ের গল্প আছে। কত সাহসের গল্প আছে। এর মধ্যে আছে কত কত মানুষের জীবনের কথা। যে জীবন আলোকসামান্য মানুষের, যে জীবন সূর্যের মতো উজ্জ্বল, অরণ্যের মতো রহস্য, নদীর মতো প্রবহমান, ঝরনার মতো স্বচ্ছ, প্রজাপতির ডানার মতো রঙিন। এসব ভাবনার ঘোর পেয়ে বসে রূপমকে।

হঠাৎ রূপমের ইচ্ছা করে প্রজাপতিদের পেছন পেছন ছুটতে। পারে না। কারণ, পা চলে না। হঠাৎ করে যেন চারদিকে অন্ধকার নেমে আসছে। তবে এই অন্ধকার দেখে ভয় করছে না রূপমের। প্রজাপতিদের পেছনে ছুটতে ছুটতে শুনতে পেল ঝিঁঝি পোকার দল ডাকছে। একটা জোনাক পোকা রূপমের কানে কানে বলল, তোমার জন্য আমরা আলো জ্বালিয়ে দিচ্ছি।

রূপম এ মুহূর্তে একটু চঞ্চল হয়ে উঠল। ভেতরের শান্ত মনটা ঠিক এখন যেন ছটফট করছে। তবে কি মা ডাকছে তাকে? মায়ের জন্য রূপমের অনেক মায়া হলো। মায়ের মুখ মনে পড়ল। হঠাৎ রূপমের চোখে পানি এসে গেল। রূপম ধু ধু দুপুরে, বাসা থেকে বেশ দূরে, ট্রেনে বসে হঠাৎ টের পেল তার কান্না পাচ্ছে। দাদুভাইকে আড়াল করে রূপমের কাঁদতে ইচ্ছা করল। এ কান্না মায়ের জন্য কান্না। মাকে একলা রেখে রূপম কখনো বাসা থেকে বের হয়নি। কিন্তু আজ হয়েছে। মাকে ছাড়া এভাবে বেড়াতে যাওয়া কি ঠিক হলো? উত্তর পায় না। বুকটা ভার হয়ে ওঠে। নিজেই নিজেকে সামাল দিল। ধুর! কাঁদব কেন? আমি কি এখন ছোট?

রূপম নিজেকে যত বড়ই ভাবুক, ও তো ছোটই। এখনো স্কুলের গণ্ডি পার হয়নি। এক অদ্ভুত শূন্য আর ঝাঁঝালো রোদের আলোয় রূপম অনুভব করল, ওর চোখে জল জমেছে। কিন্তু কাঁদছে না। কান্নার জলটুকু চোখে আটকে থাকে। ট্রেনের ঝমঝমানো ছন্দে চেষ্টা করল মাকে বাসায় রেখে আসার কষ্টের কথা ভুলতে। কিন্তু মায়ের মুখটা চোখ থেকে যেন সরছেই না। জল টলমল চোখে রূপম তাকাল চলন্ত ট্রেন থেকে দেখা মাঠের দিকে, একটু দূরে নদীর দিকে। কান্নার জল চোখে আটকে গিয়ে কেমন যেন কুয়াশার মতো একটা আবহ তৈরি করেছে। জলভরা চোখে বাংলার গ্রাম, নদী, গাছগাছালি আর জনপদের দৃশ্য দেখতে দেখতে চমকে গেল রূপম। স্বাভাবিক চোখে এমন দৃশ্য দেখা যায় না। অথচ চলন্ত ট্রেনের জানালায় বসে কান্নার পানি ধরা চোখ দিয়ে এসব দৃশ্য কেমন ঝাপসা আর সুন্দর দেখা যাচ্ছে। এই হঠাৎ আবিষ্কার মুহূর্তের মধ্যে রূপমকে আনন্দের শিহরণ দিল। এই মুহূর্তগুলো একটু অন্য রকম লাগছে। এই ভালো লাগার আবেশের ভেতরেই রূপম টের পেল, চোখে আর জলের শিশির নেই। কাঁদতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু কাঁদছে না। দূরে একটা সাদা বক উড়ে যেতে দেখল।

এখন কি বকের পেছন পেছন উড়ে যাবে? নাকি জোনাকিদের দেওয়া আলোয় নিজের ঘোরে আটকে থাকবে।

ও আসলে জাদুকরও নয়, চিত্রকরও নয়। ও একটা কল্পনা। ও একটা ভাবনা। ওর ভেতরে অনেক রং ছিল। তুমি যদি কল্পনাই না করতে পারো, তাহলে রংও তুমি দেখতে পাবে না।

আনমনে রূপম ভাবতে থাকে। জোনাকিদের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। একঝাঁক জোনাকি পোকা। রূপমের মনে খুব বিস্ময়! এই জোনাকিরা কেরোসিন পায় কোথায়? সলতে পায় কোথায়? ওরা বিদ্যুৎ পায় কোথায়? কীভাবে জ্বলে ওঠে? তাহলে কি জোনাকিরা শরীরে বিদ্যুৎ বহন করে। ভেবে ভেবে রূপম খুব অবাক হয়ে যায়। আলোর পোকাদের দেখে দেখে খুশিতে আনন্দে বিস্ময়ে হাতে তালি দিতে থাকে। হাজারো জোনাকি পোকার আলোয় মুহূর্তের মধ্যেই যেন সব ফকফকা হয়ে উঠল। রূপম যেন ভুলে গেছে কোথায় তার বাসা, কোথায় তার স্কুল। কোথায় সেই ট্রেন, কমলাপুর স্টেশন, টিকিট চেকার, চানাচুরওয়ালা—সবার কথা সে ভুলে যায়। শুধু মা আর বাবার মুখটা মনে রেখে রূপম জোনাকিদের সঙ্গে খেলায় মেতে উঠল। জোনাকিগুলো তার বন্ধু হয়ে গেল। একটা জোনাকি বুঝি ওকে খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছে। বারবার তার গাল ছুঁয়ে উড়ে যাচ্ছে। অনেকটা সময় যদি জোনাকিটা বসে থাকত ওর গালে! ভাবতে থাকে। হঠাৎ একটা জোনাকি হাতের মুঠোয় ভরে ফেলল। তারপর আবার ছেড়ে দিল। উফ্‌ কী মজা! যেন একটা উড়ন্ত আলোর বিন্দু ওর হাত ফসকে বেরিয়ে যায়। আবার সেই হাতের মুঠোয় ধরা দেয় আরেকটা জোনাকি। আবার ছেড়ে দেয়। নিজের হাতটি এসব আলোর আলোকপোকার উত্স মনে হওয়ায় কেমন যেন এক গর্বের অনুভূতি রূপমের মনটাকে পূর্ণ করে দিল।

একটা দুষ্টু ছোট্ট জোনাকি পোকা, কী যেন নাম তার, ও এসে বলল, চাঁদমামা চরকাকাটা বুড়ি নিয়ে প্রজাপতি স্টেশনে এখনই নামবে। আশ্চর্য, সত্যি! রূপম হঠাৎ লক্ষ করল, চাঁদ উঠেছে মাথার ওপর। চাঁদের দেশ থেকে চরকাকাটা সুতা পড়তে লাগল। যত দূর চোখ যায় চাঁদের জ্যোত্স্নায়, তত দূর রূপম দেখতে পেল সাদা সুতা আলোর মতো ফুটে আছে।

এক কাঠঠোকরা এল, রূপমের কাঁধে এসে বসল। রূপম একটু ব্যথা পেল। ও বলল, তোমার জন্য খেজুরের রস এনেছি। এটা খাও।

রূপম হাত দিয়ে ধরতে যাবে খেজুরের রসের বাটি, কিন্তু ধরতে পারে না। লক্ষ করল, ওর হাত হাতের মতো নেই। সুন্দর দুটো ডানা, লম্বা ঠোঁট, সবুজ পাতায় ধরা লাল খেজুরের রস। যেন পাখির ঠোঁটে রূপম খেজুরের রস খাচ্ছে।

হঠাৎ শাঁ করে বিশাল ডানাওয়ালা পাখি নেমে পড়ল। পাখিগুলো ভয়ে ফিসফিসিয়ে রূপমকে বলল, এদিকে এসো, এদিকে। আমাদের এখন লুকোতে হবে। আমাদের বুড়ো দাদিমা এসেছে। ওরা ছুটে গিয়ে একটি গুহার অন্ধকারে বসে পড়ল।

জায়গাটা আরও সুন্দর। ছোট্ট ঝরনা বইছে। সোনালি মাছ সেই ঝরনার জলে ভাসছে। হাজারো খানাখন্দে ডুবে থাকা ঝরনার বুকে ছোট্ট সোনালি মাছগুলো দুষ্টুমি করছে। পাশেই একটা মানুষ ছবি আঁকছে। মানুষটাকে দেখে রূপমের মনে হলো, বাবা বুঝি। কিন্তু বাবা তো ছবি আঁকে না। তাহলে এই লোকটি কে? রূপম সাহস করে জিজ্ঞাসা করে। তুমি এখানে কী করো? তুমি তো পাখি নও। তোমার ডানা নেই। এই পাখিদের দেশে তোমার কী কাজ?

লোকটা পেছনে মাথা ঘুরিয়ে বলল, আমার সব ডানা পাখিদের ডানায় আছে। আমার সব পালক পাখিদের পালকে আছে। আমার সব স্বপ্ন তোমার কাছে আছে।

অবাক হয়ে যায় রূপম। তখন অন্য সব পাখি কিচিরমিচির করতে লাগল। চেনা প্রজাপতিগুলো অচেনা হয়ে উঠল। ছদ্মবেশ ধারণ করল প্রজাপতিরা। রূপম কাঁপতে থাকে। মনে হচ্ছে, এখানে এই গুহায় অন্য কিছু হতে চলেছে। রূপম একটু এগিয়ে লোকটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। লোকটা অদ্ভুত হাসি হাসল।

রূপম বলল, তুমি কি জাদু জানো? ম্যাজিশিয়ান? তোমার ঘর কোথায়? তুমি কোথায় থাকো? তুমি এখানে কেন? তুমি হাসছ কেন?

লোকটি হাসতেই থাকে।

রূপম এবার ভয় পেতে থাকে।

লোকটি ছবি আঁকার একটা বড় খাতা বের করে রূপমের হাতে দিল।

রূপম খাতার প্রথম পৃষ্ঠা ওল্টাতেই দেখল, একটা ছোট্ট ছেলে বয়স্ক লোকের হাত ধরা।

দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় একটা ট্রেন। ট্রেনের কামরায় লেখা ‘ঙ’।

তৃতীয় পৃষ্ঠায় প্রথম পৃষ্ঠায় আঁকা সেই ছেলেটির ছবি। ছেলেটি বুড়ো লোকটির সঙ্গে নুডলস খাচ্ছে।

রূপম হতভম্ব। চিত্কার করতে থাকে। কিন্তু গলার স্বর কেমন যেন আটকে আটকে আসে। কে তুমি, তুমি কে?

লোকটি কথা বলে না। ফ্যালফ্যাল করে রূপমের দিকে তাকিয়ে থাকে।

রূপম ছবি আঁকা খাতাটির পৃষ্ঠা ওল্টাতে লাগল আবার।

চতুর্থ পৃষ্ঠা। কিছুই আঁকা হয়নি, সাদা।

এরপর আরেকটা পৃষ্ঠা ওল্টাল। এটাতেও কিছু আঁকা হয়নি, সাদা।

এরপর আরেকটি পৃষ্ঠা ওল্টাল। সেই বুড়ো লোকটির ছবি। তার সঙ্গে ট্রেনের কামরায় বসে আছে ছোট্ট একটা ছেলে।

কাঠবিড়ালির কথা শুনে রূপম ফিরে তাকায়। খুব আদুরে কণ্ঠে কাঠবিড়ালি বলল, আমাদের ঘরে এসো।

রূপম ঘাবড়ে গেল। ছবি আঁকা খাতাটির দিকে চোখ রাখল। আশ্চর্য! যে ছবিটা দেখছিল, সেই ছবিটা নেই। যে লোকটি ছবি আঁকছিল, তাকেও দেখা যাচ্ছে না।

এমন সময় সেই টিয়ে, যে ওকে পালক দিয়েছিল, কোথা থেকে যেন উড়ে এসে বলল, তুমি জানো, প্রজাপতি স্টেশনে যারা আসে তাদের থাকার কোনো ঘর নেই। বাতাসের ঘ্রাণ, আকাশের নীল মেঘ, ঝরনার ঝিরিঝিরি বয়ে চলা আর রঙিন ডানার আঁকাবাঁকা রেখাগুলো দেখতে দেখতে জীবনটা কাটিয়ে দিতে চায় ওরা।

রূপম এদিক-ওদিক তাকিয়ে লোকটিকে খুঁজতে লাগল।

কী খুঁজছ তুমি?

ওই লোকটাকে।

কে সে?

জানি না। আমাকে ছবি আঁকার এই খাতা দিয়েছে। এখানে অনেক ছবি আছে। দাদুভাইয়ের ছবি, আমার ছবি, ট্রেনের ছবি, ‘ঙ’ কামরার ছবি, নুডলস খাওয়ার ছবি।

দেখি দেখি।

রূপম খাতাটি টিয়েটার সামনে মেলে ধরে। একটা একটা করে পাতা ওল্টায়। অদ্ভুত কাণ্ড। কোনো ছবি নেই। সাদা। পৃষ্ঠাজুড়ে শুধু সাদা আর সাদা।

টিয়ে বলল, কোথায়, ছবি কোথায়?

রূপম বলল, ছিল তো, এখানেই ছিল। এই পাতায় ছিল। এখানে একটা বুড়ো লোকের ছবি ছিল। যার চেহারাটা আমার দাদুভাইয়ের মতোন।

আর যে ছোট্ট ছেলে বুড়ো লোকটির হাত ধরে ছিল, সেই ছেলেটার ছবি তোমার মতো?

রূপম চিত্কার দিয়ে উঠল, হ্যাঁ হ্যাঁ, সেটা আমারই মতোন। সেটা আমিই।

মিথ্যা কথা।

না, মিথ্যা কথা না। তুমি ছবিটি দেখোনি। আমি দেখেছি।

তুমি এখানে কোনো ছবিই দেখতে পারো না। এখানে শুধু প্রজাপতি দেখতে পাবে। পাখি দেখতে পাবে। ঝরনা দেখতে পাবে। আমাকে দেখতে পাবে।

কিন্তু আমি যে আরও কিছু দেখেছি। ছবি দেখেছি। ছবির রং দেখেছি। একজন আঁকিয়ে লোককে দেখেছি। সে জাদুকর কি না, জানি না।

ও আসলে জাদুকরও নয়, চিত্রকরও নয়। ও একটা কল্পনা। ও একটা ভাবনা। ওর ভেতরে অনেক রং ছিল। তুমি যদি কল্পনাই না করতে পারো, তাহলে রংও তুমি দেখতে পাবে না।

কিন্তু আমি তো রং দেখেছি।

সেটা তোমার কল্পনার রং। কল্পনার রং মাখিয়ে তুমি চেনা শহর থেকে অজানা প্রান্তর ছাড়িয়ে দূর তেপান্তরে চলে যেতে পারো। শুধু দরকার একটু ভাবনা। একটু কল্পনা। প্রজাপতি স্টেশনে এলে সেই কল্পনাগুলো পাখনা মেলে। কোনোটা পাখি হয়ে ওড়ে। কোনোটা প্রজাপতি হয়ে ওড়ে।

হ্যাঁ, আমি পাখিও দেখেছি, প্রজাপতিও দেখেছি।

প্রজাপতি স্টেশন দেখোনি?

দেখেছি। সেখানে ট্রেন থামে।

ট্রেন থামে বটে, কিন্তু এক শ বছর পরপর থামে এবং একজন যাত্রী নামে। তুমি সেই ভাগ্যবান যাত্রী।

রূপমের মুখটা ঝলমল করে উঠল। চারপাশটায় তাকিয়ে দেখল, ওরা সবাই এসেছে। সেই পাখির দল, প্রজাপতি, ঝিঁঝি পোকা, কাঠবিড়ালি, সোনালি মাছ। ওরা হাসছে। রূপমকে পেয়ে আনন্দ করছে।

টিয়ে বলল, জোনাকিদের মেলে ধরা আলোয় এই প্রজাপতির রঙের মেলায় তোমাকে স্বাগত।

হঠাৎ একটা তীব্র হুইসেল। দড়াম করে লাফিয়ে উঠল রূপম।

দাদুভাই বললেন, এই কী হয়েছে? তুমি এত ঘামছ কেন? এসো নেমে এসো, দেখো ময়মনসিংহ স্টেশন এসে গেছে। দেখো কারা দাঁড়িয়ে আছে। ওরা তোমাকে নিতে এসেছে।

রূপম হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। বলল, দাদুভাই, প্রজাপতি স্টেশনটা কোথায়?