হারানো দিনের স্মৃতি

শোঁ শোঁ করে বয়ে যাওয়া বসন্তের বাতাস উড়িয়ে আনল কয়েকটি শিমুলগাছের পাতা। সঙ্গে যোগ দিল গোলাপ, বেলি, শিউলি, বকুল আরও কত ফুলের সুবাস! পাখির কলরব, বসন্তের কোকিলের গান মাড়িয়ে দেয় সব দুঃখ-কষ্টের স্মৃতি। ফল-ফুল, পাখি, প্রজাপতির উপস্থিতিতে বাগানটাকে মনে হচ্ছে ছোটখাটো একটা বনাঞ্চল।

আমি মধ্যবয়সী ঘরছাড়া এক গরিব ভৃত্য, দাঁড়িয়ে দেখছি প্রকৃতির অপরূপ এই লীলা। হঠাৎ চোখে পড়ল আমার বয়সী একটি বরইগাছ। বাগানটা যতবার দেখছি, প্রতিবারই নজর কেড়ে নিচ্ছে বরইগাছটি। দুই দশক আগে ২৫ কাঠা জমির ওপর ছিল আমার বসতভিটা। আজ সেই দুই আনার চাষির একমাত্র জীবিকাসম্বল রূপ নিয়েছে বিলাসিতায়। কিন্তু পুরোনো বন্ধুর দেখা পেয়ে যেন সেই দুই আনারও দাম মিলেছে।

একে একে চোখের ওপর ভেসে উঠল এই গাছকে ঘিরে ছোটবেলার স্মৃতিগুলো। শীতের এক ঠান্ডা সকাল। ছোট্ট আমি শীতের পরোয়া না করে খালি গায়ে শুয়ে বরই খাচ্ছি। তখন হঠাৎ কী মনে করে বরইয়ের বিচি না ফেলে উঠে বসে মাটি খুঁড়ে বিচিটি পুঁতে দিলাম। এই দৃশ্য মনে পড়তেই ঠোঁটে একচিলতে হাসি ফুটল। আমার সেই পুরোনো বন্ধুর ইতিহাস!

এরপর দৃশ্যপট বদলে এল এক গ্রীষ্মকালের কড়া রোদেলা দিন। দৌড়ে ছুটে চলেছি খুশি মনে। মনে পড়ে, এ তো সেই দিনগুলোর একদিন! ছুটে ক্লান্ত হয়ে ভিড়লাম সেই বরইগাছের তলায়। কত বড় হয়ে গেছে! নিশ্চয় পাঠশালা থেকে পলায়নের মধুর স্মৃতিগুলোকেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে সেই গাছ!

একে একে মনে পড়তে শুরু করল এই গাছকে ঘিরে সব স্মৃতি। গাছটির ছায়ায় বসে কতই না গল্প! ছোটবেলা থেকে এই গাছই আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। যেদিন এই মাতৃভূমি ছেড়ে যাওয়ার কথা, সেদিন কতই না কেঁদেছি এই বন্ধুকে ছেড়ে যেতে হবে দেখে!

এই বরইগাছ ছাড়া আজ আমি নিঃস্ব। গ্রামের কোনো কিছুই সেই দুই দশক আগের মতো মনোমুগ্ধকর নয়। সবই যেন বদলে গেছে, শুধু পার্থক্য, আজও অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই বরইগাছ!

গাছটির ছায়ায় বসে সোনালি সেই দিনগুলোতে হারিয়ে গেছি। এমন সময় ঝোড়ো বাতাসে দুটি বরই এসে পড়ল আমার কোলে। এ যেন নরকে বসন্তের খোঁজ পাওয়া। দুই চোখ আমার জলে ভরে যায়, মাতৃভূমির এই পুরোনো বন্ধুর উপহার সযত্নে গ্রহণ করলাম। কিন্তু ভাগ্য আমার এত সহায় নয়।

হঠাৎ কোত্থেকে উদয় হলো বাগানটির মালি। আমার হাতে বরই দেখে আর কোনো কিছুই শুনল না সে। আমার নাম চোর রেখে দিল। ঠেলে বের করল বাগানের সীমানা থেকে। আমার প্রাণপ্রিয় বরই দুটিও রইল তার কাছে। দুঃখী হাসি হেসে ভাবছি, এত দিন আমার সবচেয়ে মধুর স্মৃতিগুলো চুরি করে রেখেছিল সেই বরইগাছ। আর আজ আমার প্রাপ্য ফল দুটিও ছিনিয়ে নিল। তুমি চোরগাছই বটে!

লেখক: অষ্টম শ্রেণি, বাংলাদেশ মহিলা সমিতি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ, চট্টগ্রাম